উত্তর সম্পাদকীয়
*************
বাংলার মাটি আবেগের মাটি। বঙ্গীয় রাজনীতিতেও সৌজন্যের অভূতপূর্ব বহু উদাহরণ ইতিহাসের ছত্রে ছত্রে পাওয়া যায়। তা সেই মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে বিরোধী বামপন্থী নেতা জ্যোতি বসুর বহু চর্চিত সম্পর্কই হোক , কিংবা মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর বারবার সুব্রত মুখার্জির প্রতি থাকা স্নেহের প্রশ্রয়ই হোক অথবা, সাম্প্রতিক কালে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী বিজেপির বাবুল সুপ্রিয়র বিখ্যাত ঝালমুড়ি এপিসোডই হোক।
মতবাদ আলাদা হলেও ব্যক্তিগত সৌজন্য যে সুস্থ রাজনৈতিক বাতাবরনেরই বার্তা বহন করে ইতিহাস তার স্বাক্ষী হয়ে থেকেছে বারবার।
সম্প্রতি এইরকমই রাজনৈতিক সৌজন্যের আর এক নজির গড়লেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজনীতির ময়দানে তাঁরা যুযুধান। কিন্তু মুখোমুখি হতেই দেখাগেল সৌজন্যবোধের ঘাটতি তো কোনোপক্ষেই নেই, উল্টে দুতরফেই রয়েছে সম্ভ্রম আর স্নেহের যুগলবন্দী, যা আজকের জেনারেশনের ক্যাডার থেকে নেতা সবার কাছে অবশ্যই শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয়।
ইতিপূর্বে ২০১৪-র জুন মাসে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে নবান্নের দ্বারস্থ হয়েছিল বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসুর নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল। সাধারণত, নবান্নে দিদিমনির সঙ্গে বৈঠক করেছেন আর অন্তত এক কাপ চা আর দিদির প্রিয় ফিস ফ্রাই খাননি এমন খুব একটা ঘটেনা। এক্ষেত্রেও সেদিন চা ও ফিসফ্রাই যোগে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কিন্তু ফিসফ্রাইয়ে কামড় বসানোয় বেশ সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছিল কমিউনিস্ট বিমান বসুকে। কিন্তু সেই বৈঠক রাজ্য-রাজনীতিতে নতুন মাত্রা এনে দেয় তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই বৈঠক ফিসফ্রাই বৈঠক নামে পরিচিতি পায়।
মঙ্গলবার আরও এক বার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর মুখোমুখি হলেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান। তবে, এবার কোনও ফিসফ্রাই বৈঠক নয়, করোনা জর্জরিত রাজ্যকে বাঁচাতে একগুচ্ছ পরামর্শ দিতে ৭ এপ্রিল নবান্নে এসেছেন বিমান বসু।
ক’দিন আগে ফোন করে ছিলেন নিজে থেকেই। রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তিনি কথা বলতে চান। মমতাও সময়ের কার্পন্য করেননি। মঙ্গলবার বিকেলে নবান্নে আসার কথা বলেন তিনি। সূত্রের খবর, সদর্থক আলোচনা হয়েছে বিমান-মমতার মধ্যে। বামেদের দাবি ছিল, পরিযায়ী শ্রমিকদের যথাযথ চিকিৎসা, রেশন নিয়ে কালোবাজারি রোখা, প্রাথমিক চিকিৎসা, কেন্দ্রে ফিভার ক্লিনিকের ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি, উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে সর্বদলীয় বৈঠকেরও দাবি জানান বিমান বসু।
সবই তো হলো, কিন্তু কৌতূহল ছিল এবার বৈঠকেও কি জলযোগে ফিসফ্রাই দেওয়া হয়েছে। না, শুধুমাত্র কাগজের কাপে লাল চা-ই খেয়েছেন বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দল। তবে, এবারও বৈঠকে যা নতুন মাত্রা পেয়েছে, তা হলো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৌজন্যতা।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে আসা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক তথা চিকিৎসক সূর্যকান্ত মিশ্র সহ সব নেতাই মাস্ক পরেছিলেন। ব্যতিক্রম ছিলেন আশি ছুঁই ছুঁই বিমানবাবু। উপরন্তু তাঁর পরনের পাঞ্জাবির সামনে ডান দিকে খানিকটা অংশ ছিল ফেঁসে যাওয়া । মুখ্যমন্ত্রী বিমানবাবুকে কার্যত অভিভাবকের সুরে বলেন, “এ কী বিমান দা, আপনি ছেড়া পাঞ্জাবি পরে কেন বেরিয়েছেন! তার উপরে মাস্কও নেই!” বিমানবাবু বলার চেষ্টা করছিলেন, এই বয়সে তাঁর পাঞ্জাবি আর কে দেখবে! আর এখন মাস্ক পরেই বা কী হবে? কিন্তু এর পরেই পাল্টা আবেগঘন গলায় মমতা বলেন, “ছেড়া পাঞ্জাবি পরে বাইরে বেরোনো উচিত হয়নি।আর মাস্ক পরেন না কেন? বয়স হয়েছে আপনার। খুব সাবধানে থাকতে হবে আপনাকে।”
মমতার এ কথা শুনে এক গাল হাসি দেন বিমান বসু। মমতা তাতেও সন্তুষ্ট নন। বলেন, “আপনি খুব সাবধানে থাকুন। কোনও অসুবিধা হলে আমাকে জানাবেন।” রাজনীতিতে কনিষ্ঠ মমতাকে একটু আবেগঘন গলায় বিমানের উত্তর, ‘তুমিও অনেক ছোটাছুটি করছো। তোমাকেও সাবধানে থাকতে হবে।’
নিমেষে বদলে যায় ঘরের পরিবেশ। হ্যা, এটাই বাংলা, এটাই আমাদের সংস্কৃতি। লোকসভা পরবর্তীকালে এই সৌজন্য আর রাজনৈতিক সুস্থ বাতাবরনটাই যেন রাতারাতি উবে গিয়েছিল। যা এদিন একচিলতে সময়ে টাটকা বিশুদ্ধ বাতাসের মতোই ফিরিয়ে দিলেন বিমান-মমতা।
কালের নিয়মে একদিন হয়তো থাকবেন না বিমান বসু কিংবা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেউই। তবে করোনা সংকটের প্রেক্ষিতে হওয়া নবান্নের এই বৈঠক কিন্তু ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নিল আবেগ আর সৌজন্যবোধের এক নির্ভেজাল উদাহরণ হিসাবেই।