এইকাল নিউজ:গান তো আমরা প্রায় সকলেই কমবেশি শুনে থাকি। কিন্তু এত এত গান তৈরীর নেপথ্যে কত যে গল্পগাছা থাকে, তার হদিশ ক’জনই বা রাখেন। কেউ কেউ অবশ্য এসব নিয়ে বিস্তর ঘাঁটাঘাঁটি করেন। তাঁদের কথা অবশ্যই আলাদা। স্বনামধন্য বাঙালি গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়কে চেনেন না এমন লোক এ-বাংলায় খুঁজলে হয়তো হাতে গোনা কিছু মানুষ পেলেও পাওয়া যেতে পারে। হয় তাঁরা গানবাজনা শোনার মতো যথেষ্ট সময় সুযোগ পান না। নচেৎ তাঁরা একেবারেই গানবাজনা বিমুখ। তো সেই পুলকবাবু বেশ কয়েকবছর হল আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি কেমন গীতিকার ছিলেন, তা নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করার সাধ বা সাধ্য কোনওটাই আমার নেই। যাইহোক, ভদ্রলোক যে শুধুই একজন অসামান্য গীতিকার ছিলেন, তাই নয়, সেইসাথে একজন নিপাট ভদ্রলোক। ভারতীয় সংগীত জগতের আর এক দিকপাল গায়ক কুমার শানু। আজ প্রায় গোটা পৃথিবী যাকে একডাকে চেনে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় সেই পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আর কুমার শানুকে নিয়েই আজকের এই প্রতিবেদন।
আশির দশকের গোড়ায় বসুশ্রী সিনেমা হলে জলসা বসেছে। সেই জলসায় বিখ্যাত অখ্যাত অনেক শিল্পীই এসেছেন তাদের প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটাতে। ঘটনাচক্রে জলসায় পুলক বাবুও এসে উপস্থিত হয়েছেন। সচরাচর এই জাতীয় জলসায় ওনাকে বড় একটা দেখা যায় না। এদিন এসেছেন। সবাই নিবিষ্ট মনে গান শুনছেন। ভিড়ের মধ্যে এক কোণায় একটা চেয়ারে একজন যুবক চুপচাপ বসে আছে। যদিও গান শোনার ব্যাপারে তার খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হচ্ছে না। গান শুনতে নয়, সে চায় গান শোনাতে। যে কোনও মূল্যে যদি একটা সুযোগ পাওয়া যায় তাহলেই সে বর্তে যাবে, এমনই একটা ভাবনাচিন্তা তার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। একটা সুযোগ। সেই সাথে এটাও মনে হচ্ছে, এতসব গুণী শিল্পীদের ভিড়ে সে কি আদৌ সেই রকম কোনও সুযোগ পাবে? ছেলেটিকে দেখিয়ে কেউ একজন পুলক বাবুকে বললেন, “ওই যে ছেলেটিকে দেখছেন বসে আছে, ওর নাম শানু ভট্টাচার্য। গান গাইবে বলে আছে।”
পুলক বাবু ভ্রু কোঁচকালেন—”শানু ভট্টাচার্য? সে আবার কে? আগে কখনও এর নাম শুনেছি বলে তো মনে পড়ছে না!”
—”আরে আমাদের পশুপতিবাবুর ছেলে। পশুপতি ভট্টাচার্যকে চেনেন তো?”
পুলক বাবু বললেন,”হ্যাঁ চিনি। ওঁর বড় ছেলে তপন ভট্টাচার্য গান-টান করে শুনেছি। কিন্তু আরেক ছেলেও যে গান করে জানতাম না তো!”
পাশ থেকে আরেকজন বললেন, “ওকে আমি চিনি। কিন্তু ও তো ভালো তবলা বাজায় জানি। ও আবার গান শিখল কবে?”
অন্যজন তার উত্তরে বললেন,”না শেখার কী আছে? গান তো ওর রক্তে!”
সেদিনই প্রথম শানু ভট্টাচার্যকে সামনে থেকে দেখেন পুলকবাবু। যদিও আলাপ পরিচয় প্রায় কিছুই হয়নি। এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। একদিন সংগীত পরিচালক দিলীপ রায় পুলকবাবুকে ফোন করলেন। এই দিলীপ রায় ছাড়াও আরও কয়েকজন দিলীপ রায়কে পুলকবাবু চিনতেন। কাজেই ফোনের অন্য প্রান্তে কোন দিলীপ রায় কথা বলছেন তিনি প্রথমে বুঝতে পারলেন না। দিলীপবাবু নিজের পরিচয় দেওয়ার পর চিনতে পারলেন। ফোনে এটা সেটা কথার পর দিলীপ বাবু বললেন,”আপনি বলেছিলেন প্রয়োজনে নতুন শিল্পীদের জন্য আপনি গান লিখতে রাজি আছেন। তা শানু ভট্টাচার্যের জন্য গান কি আপনি লিখবেন? ওকে তো আপনি চেনেন।”
পুলকবাবু মনে হলো আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন,”শানু ভট্টাচার্য? কে বলুন তো?”
দিলীপবাবু বললেন,”ওই যে বসুশ্রী সিনেমায় দেখা হল। পশুপতি ভট্টাচার্যের ছেলে।”
পুলকবাবুর মনে পড়ে গেল। বসুশ্রী সিনেমার সেই জলসায় ছেলেটিকে তিনি দেখেছিলেন বটে। কিন্তু তারপরে নানান ব্যস্ততায় ছেলেটির কথা তিনি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন।
দিলীপবাবু বললেন, “ও বেশ কিছুদিন মুম্বইতে একটা হোটেলে গান করছিল। ওখানে কীসব ঝামেলা-টামেলা হওয়ায় কলকাতায় চলে এসেছে। এখন দারুণ স্ট্রাগলিংয়ের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে। এখন একটা ক্যাসেট বের করতে চায়। ওর বন্ধুরাই টাকা-পয়সা জোগাড় করেছে। কাজেই পারিশ্রমিক বাবদ খুব বেশি দিতে পারবে না।”
কী মনে করে পুলকবাবু গান লিখতে রাজি হয়ে গেলেন। ক্যাসেটের নাম রাখা হলো ‘তরঙ্গ’। গোটা ক্যাসেটে সর্বমোট দশখানা গান। সবক’টাই পুলকবাবুর লেখা। দিলীপ রায় সুরকার।
‘তরঙ্গ’ ক্যাসেটে মোট দশখানা গান। গান তো তৈরি হল। এখন দরকার একটা ক্যাসেট কোম্পানি, যারা কিনা গানগুলি প্রকাশ করবে। শানু’র গান পুলক বাবুর এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে, তিনি নিজেই উদ্যোগী হয়ে কলকাতার এক নামী ক্যাসেট কোম্পানিকে অনুরোধ করলেন নতুন শিল্পীর গানগুলি যাতে তারা প্রকাশ করে। দুঃখের বিষয়, তারা পুলকবাবুর সেই অনুরোধ রাখেনি। তারা ওনার মুখের উপর সাফ জানিয়ে দিয়েছিল—”কিশোর কুমারের এমন নকল কণ্ঠ কলকাতার অলিতে গলিতে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।আপনি এর মধ্যে কী এমন দেখলেন তা আপনিই জানেন।”
পুলকবাবুর জবাব ছিল, “ছেলেটির কণ্ঠে একটি সতেজ রস আছে। যা কিনা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এটা আসলে উপলব্ধির বিষয়।”
ওরা তখন বেয়ারাকে ডেকে পুলকবাবুকে এক কাপ কফি দিতে বলল। এটা আসলে একধরনের অভদ্রতা। যেটা পুলকবাবুর মোটেও পছন্দ হল না। তিনি কফি না খেয়েই সেখান থেকে বেরিয়ে এলেন। আসার সময় বলে এলেন, “আপনারা কে.এল সায়গল, শচীন দেব বর্মণকেও প্রথমে গ্রহণ করেননি। আজ আবার একজনকে প্রত্যাখ্যান করলেন। ভুল করলেন।”
একবুক উষ্মা নিয়ে পুলকবাবু সেখান থেকে বেরিয়ে আসতেই পথে ওনার সঙ্গে সাহা ইলেকট্রনিক্সের কর্ণধার বিএম সাহার দেখা হয়ে গেল। বিএম সাহা পুলকবাবুর পূর্ব পরিচিত। উনি তখন কলকাতায় গুলশন কুমারের ডানহাত। পুলকবাবু গোটা ঘটনাটা ওনাকে খুলে বললেন। সব শুনে উনি দিল্লিতে গুলশন কুমারের সাথে যোগাযোগ করলেন। বলাই বাহুল্য তাঁর উদ্যোগে কাজ হল। সুপার ক্যাসেট থেকে শানু ভট্টাচার্যের ‘তরঙ্গ’ ক্যাসেটটি প্রকাশিত হল। গুলশন কুমারের জহুরির চোখ। শানু ভট্টাচার্যকে চিনতে তাঁর বিন্দুমাত্র ভুল হয়নি। শানু’র গান শুনেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন ছেলেটির সম্ভাবনা অপরিসীম। তিনিই শানুকে নিয়ে এলেন সর্বভারতীয় গানের আসরে। শুধু তাই নয়, দিলেন ওনার অফিসের কাছেই একটা সিঙ্গল রুম ফ্ল্যাট। রয়ালটির টাকায় পরিশোধযোগ্য একটি মারুতি ৮০০। যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে তখন দিল্লিতেও টেলিফোন এতটা সহজলভ্য ছিল না। গুলশন কুমার তাঁর অফিসের একটা টেলিফোন শানুকে যথেচ্ছ ব্যবহারেরও অনুমতি দিলেন। সুদূর নিউ বম্বে এবং মুম্বইয়ের অনেক অগম্য স্থানে স্বল্প ভাড়ায় থাকা রেস্তোরাঁর মাতালদের সামনে তথাকথিত ফিল্মি গান গাওয়া শানু ভট্টাচার্যকে নিয়ে এলেন সঠিক রাস্তায়।
‘তরঙ্গ’ ক্যাসেটের গানগুলো সত্যিই ভারি চমৎকার হয়েছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় গানগুলো পাবলিক সেভাবে নিল না। কোথাকার কোন নতুন গায়ক শানু ভট্টাচার্য গোটাকতক গান করেছে, গ্যাঁটের কড়ি খরচা করে সেই গান শোনার জন্য পাবলিকের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ দেখা গেল না। ক্যাসেট না চললেও পুলকবাবুর অভিজ্ঞ চোখ শানু ভট্টাচার্যকে চিনে নিতে এতটুকু ভুল করেনি। তিনি দিলীপবাবুকে বললেন,”ছেলেটি চমৎকার গেয়েছে কিন্তু। হোক সে কিশোর কুমারের স্টাইল। কিশোর কুমার নিজেও একটা সময় কেএল সায়গলের স্টাইলে গাইতেন। আমাদের হেমন্তবাবুকেই (হেমন্ত মুখোপাধ্যায়) দেখুন না, ওনার সংগীত জীবনের শুরুটাই তো পঙ্কজকুমার মল্লিককে অনুকরণ করে। তারপর দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়, সুবীর সেন এনারা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময় হেমন্তবাবুকে ফলো করে পরে যে যাঁর নিজের রাস্তায় হেঁটে আজ এক একজন সফল গায়ক। ঠিকঠাক সুযোগ পেলে এই ছেলেটিও অনেক দূর যাবে।”
‘তরঙ্গ’ অ্যালবামটা সেভাবে সাফল্য না পেলেও লাভের লাভ শানু ভট্টাচার্য গুলশন কুমারের নজরে পড়ে গেল। তিনি তখন অতীতের নামকরা শিল্পীদের বিখ্যাত সব গান নতুন শিল্পীদের দিয়ে রেকর্ড করিয়ে বাজারে ছাড়ছেন। অন্যদের কণ্ঠী পাওয়া গেলেও কিশোর কুমারের গান গাইবার মত ওনার কাছাকাছি কোনও কণ্ঠ তিনি তখনও পর্যন্ত সন্ধান করে উঠতে পারেননি। শানু ভট্টাচার্যের কণ্ঠ শুনে তিনি চমকে উঠলেন। অবিকল কিশোর কুমারের মতো কণ্ঠ! তিনি ব্যবসায়ী মানুষ। দিল্লির রাস্তায় সামান্য ফলের জুস বিক্রেতা থেকে আজ এতবড় ইন্ড্রাস্ট্রির মালিক। প্রখর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন না হলে কখনওই এমনটা সম্ভব না। তিনি শানুকে দিয়ে ঝটপট বেশ কিছু কিশোর কুমারের গান গাইয়ে বাজারে ছেড়ে দিলেন। ক্যাসেট কভারে বড় করে কিশোর কুমারের ছবি। নীচে এক কোণায় ছোট্ট মূল গায়কের ছবি—শানু ভট্টাচার্য। ক্যাসেটের নাম দিলেন ‘কিশোর কি ইয়াদেঁ’। ক্যাসেট বাজারে আসতেই হুহ করে বিকোতে লাগল। যে কারণে তড়িঘড়ি করে ‘কিশোর কি ইয়াদেঁ’র দ্বিতীয় খণ্ডটাও গুলশন কুমার প্রকাশ করে ফেললেন। এখানেই থেমে না থেকে একের পর একের এক ‘কিশোর কি ইয়াদেঁ’র ভল্যুম নম্বর বাজারে আনতে থাকলেন। প্রতিটা অ্যালবামেরই মারকাটারি বিক্রি। গুলশন কুমারের অদ্ভুত বানিজ্যিক দূরদর্শিতার প্রশংসা করতেই হবে। ‘কিশোর কি ইয়াদেঁ’র হাত ধরে শানুর জীবনে বানিজ্যিক সাফল্য এলেও তখনও কিন্তু কেউই এই জাত শিল্পীকে চিনে উঠতে পারেনি। ক্যাসেট কভারে কিশোর কুমারের ছবি দেওয়া ‘ইয়াদেঁ’র গানগুলি শুনে সবাই মোটামুটিভাবে ধরেই নিয়েছিল গানগুলি স্বয়ং কিশোর কুমারেরই গাওয়া। এটা যে আসলে দ্বিতীয় কণ্ঠ সেটা প্রায় কারোরই বোধগম্য হয়নি।
শানু তখন সংগীত পরিচালক, প্রযোজকদের দরজায় দরজায় প্লে-ব্যাকের আর্জি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এদিকে কিশোর কুমারের অকাল প্রয়াণে মুম্বইয়ের সংগীত জগতের শঙ্কিত, বিপর্যস্ত অবস্থা। সেবার পুজোর মুখে পুলকবাবু নিজেরই একটা কাজে মুম্বইতে রয়েছেন। থাকছেন একটা হোটেলে। খবর পেয়ে সুপার ক্যাসেটের বিভাগীয় অধিকর্তা রাজ বিনোট এবং সংগীত পরিচালক বাবুল বোস সটান হোটেলে গিয়ে উপস্থিত। রাজ বিনোট সরাসরি প্রসঙ্গে চলে গেলেন। বললেন, “আমরা আটখানা বাংলা ক্যাসেট করছি। ক্যাসেট প্রতি যদি আটখানা করে গান ধরা হয় মোট আটষট্টি গান আপনাকে লিখে দিতে হবে।”
রাজ বিনোটের কথা শুনে পুলকবাবু রীতিমত আঁৎকে উঠলেন। বললেন,”অসম্ভব! আপনার কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে?”
শেষমেষ রাজ বিনোট অলকা ইয়াগনিক, অনুরাধা পড়োয়াল ও দেবাশীষ দাশগুপ্তকে নিয়ে মোটমাট চব্বিশখানা গান লেখার জন্য পুলকবাবুকে রাজি করালেন। কী মনে হতেই রাজ বিনোট হঠাৎ বলে উঠলেন,”আপনার আর্টিস্ট কুমার শানু’র গানও কিন্তু আপনাকেই লিখতে হবে।”
রাজ বিনোটের কথা শুনে পুলকবাবু মনে হলো আকাশ থেকে পড়লেন—”কুমার শানু? সেটি আবার কে?”
বাবুল বোস এতক্ষণ একটি কথাও বলেননি। চুপ করে দু’জনার আলোচনা শুনছিলেন। এবারে উত্তরটা তিনিই দিলেন—”সেই ‘তরঙ্গ’ ক্যাসেটের কথা আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে?”
পুলকবাবু মাথা নাড়লেন। অর্থাৎ মনে আছে। বাবুল বোস বললেন,”সেই শানু ভট্টাচার্যই তো এখন ‘কুমার শানু’।”
বিষয়টা পুলকবাবুর জানা ছিল না। যেই মুহুর্তে জানলেন বেশ অবাক হলেন। হঠাৎ করে তাঁকে কেমন যেন অন্যমনষ্ক বলে মনে হলো। পরে পুলক বাবুর নিজের মুখ থেকেই শোনা— ওনার নিজের লেখা একটা বিখ্যাত গান যেটা উনি অনেক আগে লিখেছিলেন। পরে সেই গান ‘তুমি কত সুন্দর’ ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল। গানটি ছিল—”তোমার বাড়ির সামনে দিয়ে আমার মরণ যাত্রা যেদিন যাবে…” গানটি গেয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় কিশোর কুমার। বিখ্যাত সেই গান গাওয়ার কিছুদিন বাদে কিশোর কুমার মারা গেলেন। যে কারণে পুলকবাবুর মনে একটা চাপা বেদনা ছিল। কেন জানি ওনার মনে হয়েছিল, এই গানটি না গাইলে হয়তো কিশোরদা এত তাড়াতাড়ি চলে যেতেন না। গোটা বিষয়টা হয়ত কাকতালীয়। কিন্তু পুলকবাবু নিজের মনকে কিছুতেই সান্ত্বনা দিয়ে উঠতে পারছিলেন না।
তিনি তখন ভাবছেন— কিশোর কুমার আর কুমার শানু অদ্ভুত এক সুরেলা তরঙ্গ! এই শানুকে দিয়ে একটা শ্রদ্ধার্ঘ্য গাওয়ালে কেমন হয়?
দীর্ঘ সময় ধরে কিশোর কুমারকে নিয়ে ওনার মনের মধ্যে যে অস্বস্তির কাঁটাটা বিঁধে ছিল, সেটা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার এর থেকে ভালো সুযোগ আর হতে পারে না। গভীর প্রত্যয়ে তিনি তৎক্ষণাৎ রাজ বিনোট আর বাবুল বোসকে জানিয়ে দিলেন— “শানু’র জন্য গান আমিই লিখব। আমার দৃঢ় ধারণা ক্যাসেট সুপার হিট হবে।”
যথা সময়ে ক্যাসেট বেরোলো। ক্যাসেট কভারে কিশোর কুমারের বড় একটা ছবি। নীচে ছোট্ট করে কুমার শানু’র ছবি সহ নাম লেখা।
পুলক বাবুর লেখা গান—” অমর শিল্পী তুমি কিশোর কুমার…” রাতারাতি একজন অখ্যাত, অজ্ঞাত শিল্পীকে তুলে দিল জনপ্রিয়তার উচ্চতম শিখরে। এই পর্যন্ত গোটা ঘটনাপ্রবাহ পর্যালোচনা করলে এমনটা ধরে নেওয়াই যায় যে, হিন্দি গানে নয়, গায়ক হিসেবে কুমার শানু’র প্রথম প্রতিষ্ঠা এই ‘অমর শিল্পী’ বাংলা গানের ক্যাসেটটির হাত ধরেই।
‘অমর শিল্পী’ গোটা দেশের সংগীত মহলে রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করল। সবাই জেনে গেল এসে গেছে কুমার শানু। ‘অমর শিল্পী’র অনেক পরে এল ‘আশিকী’। এতদিনে আমরা সবাই মোটামুটিভাবে জেনে গেছি যে, আশিকী প্রথমে অ্যালবাম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে বলে ঠিক ছিল। কিন্তু সব হিসেব ওলটপালট করে দিলেন মহেশ ভাট নামের এক ভদ্রলোক। মহেশ ভাট ভদ্রলোকটির পরিচয় নতুন করে দেওয়ার দরকার আছে বলে আমার মনে হয় না। দিচ্ছিও না। বলাই বাহুল্য এই ‘আশিকী’ই কুমার শানুকে এনে দিল সর্বভারতীয় স্বীকৃতি। এই সত্যিটা শানুদা নিজেও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। ওনার মনের অ্যাপার্টমেন্ট জুড়ে বিরাট আবেগের জায়গা জুড়ে আছে ‘আশিকী’। খুব সম্ভবত সেই আবেগের জায়গা থেকেই তিনি তাঁর নতুন বাড়ির নাম রেখেছিলেন— আশিকী। কী অদ্ভুত না? নিউ মুম্বইয়ে স্ট্রাগল করা কলকাতার সেই শানু ভট্টাচার্য হয়ে গেলেন নর্থ মুম্বইয়ের পশ এলাকার বাসিন্দা। মানুষের সময় বদলানোর সাথে সাথে ভারি অদ্ভুতভাবে তাঁর দীর্ঘদিনের চেনা পৃথিবীটাও বদলে যেতে শুরু করে। কলকাতার সেই নামী ক্যাসেট কোম্পানি একদিন যারা কুমার শানুকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সাফল্য পেতেই সেই তারাই নির্লজ্জের মতো পুলকবাবুকে রীতিমত অনুরোধ করে বলল, কুমার শানুকে তাদের কাছে এনে দিতে হবে। কোম্পানির সেদিনের সেই অবমাননা পুলকবাবু ভুলতে পারেননি। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন,”গুলশন কুমার শানুকে একটা ছোট্ট ফ্ল্যাট আর একটা মারুতি গাড়ি দিয়েছে। আপনারা একটা বাংলো আর একটা মার্সিডিজের ব্যবস্থা করুন, আমি শানুকে আপনাদের কাছে এনে দেব।”
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় কুমার শানুর জন্য অজস্র গান লিখে গেছেন। এর মধ্যে সুরের রজনী গন্ধা, প্রিয়তমা মনে রেখো, সোনার মেয়ে, আমার ভালোবাসা’র মত বেশ কিছু কালজয়ী বাংলা গান তাঁর কলম থেকে বেরিয়েছে। এছাড়াও ওনার লেখা বহু বাংলা ছবির গান শানুদা’র সাথে সাথে বাংলা গানের রত্নখচিত সম্ভারকেও সমৃদ্ধ করেছে। পুলকবাবুর লেখা বাপী লাহিড়ীর সুর করা ‘বলিদান’ ছবির শানুদা’র গাওয়া সেই বিখ্যাত গান—”মানুষ যে আজ আর নেইকো মানুষ/ দুনিয়াটা শুধু স্বার্থের…” পুলক বাবুর খুবই পছন্দের একটা গান। যে গানের আবেদন আজও একইরকমের অমলিন।
তিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর সেই অকপট স্বীকারোক্তি—”শানু নিজেই তো আজ একটা ইন্ড্রাস্ট্রি। সারা দেশের নতুন প্রজন্ম আজ ওকে কপি করছে।”
শানু স্নেহে তিনি কতটা অন্ধ ছিলেন সেটা তাঁর এই উক্তিটির মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট ধরা পড়ে।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় আজ আর আমাদের মধ্যে নেই।
তাঁর লেখা গানগুলো আজও প্রতিটা সংগীত পিপাসু মানুষের মণিকোঠায় চিরসবুজ হয়ে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে।