শোভনলাল রাহা, এইকাল নিউজ:
প্রয়াত হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ, লেখক, বঙ্কিম-বিশেষজ্ঞ অভয়চরণ দে। শুক্রবার সকালে ৯১ বছর বয়সে নৈহাটির নিজ বাসভবনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। রেখে গেলেন সহধর্মিণী পুতুল দে, দুই পুত্র অমিত বিকাশ ও অনিন্দ্য কান্তিকে। এবং সেই সঙ্গে তাঁর হাতে গড়া অসংখ্য ছাত্র,শিক্ষক থেকে রুচিশীল পাঠককে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন সমাজ সংসারে কঠিন সঙ্ঘাতের মধ্যে থেকেও লড়া যায়।
আমৃত্যু তিনি ছিলেন সাহিত্য পরিষদের কার্য নির্বাহক সমিতির সদস্য ,বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ নৈহাটি শাখার সম্পাদক এবং বঙ্কিম-ভবন গবেষণা কেন্দ্রের প্রকাশনা উপসমিতি ও ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য।
শিক্ষক অভয় চরণ দে-র জন্ম ১৯২৯ সালের ১ জানুয়ারি।
বাবা বিপিনবিহারী দে ও মা সুমিতা দে। ছয় ভাইবোনের সর্বকনিষ্ঠ ছিলেন অভয়বাবু।
নৈহাটির জনসেবায়, শিক্ষার প্রসারে এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে উদ্দীপিত পারিবারিক পরিবেশে তাঁর শৈশব লালিত হয়েছে।
একেবারে শুরু থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা লক্ষ্মীকান্ত পাঠশালায়। এরপর নবম শ্রেণিতে ভর্তি হন নৈহাটি মহেন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে সেখান থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করে ভর্তি হলেন হুগলি মহসীন কলেজে। ১৯৪৮-এ এখান থেকে আইএ পাশ করার পর ১৯৫৩-তে সহকারি শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন নৈহাটি মহেন্দ্র স্কুলে। সেখানে চাকরি করতে করতেই হুগলি কলেজ থেকে বিএ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ এবং কল্যাণী বিটি কলেজ থেকে বিটি পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে, ওই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক হিসাবে, দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৯৩ এর ডিসেম্বরে অবসর নেন।
তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ নৈহাটি শাখার দ্বিতীয় সম্পাদক।
একসময় তাঁর ছোড়দা অতুল্যচরণ দে পুরাণরত্নের হাত ধরে বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষদের যে নৈহাটি শাখার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, অতুল্যবাবুর মৃত্যুর পর অভয়বাবু তাঁকে সবটুকু দিয়ে ধরে রেখেছিলেন। প্রতিবছর নিয়ম করে সাড়ম্বরে পালন করে গেছেন সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ও মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর জন্মদিন।
দীর্ঘ জীবনে বহু দৈনিক কাগজে ছোটো গল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন অভয়বাবু। শুধু তাই নয়, দৈনিক বসুমতী পত্রিকায়, ১৯৭৩ সাল থেকে দীর্ঘকাল সাংবাদিকতাও করেছিলেন তিনি। তিনি সমরেশ বসু এবং ঈশ্বর গুপ্ত স্মারক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর উল্লেযোগ্য গ্রন্থগুলি হল ‘বঙ্কিচন্দ্র মনীষী ও মানুষ’ ‘মনীষীদের বিচিত্র কথা’, ‘হরপ্রসাদ প্রসঙ্গ’, ‘বঙ্কিম উপন্যাসে মৃত্যু’, ‘নৈহাটিতে বঙ্কিম চর্চা’, ‘কথায় কথায় (গল্প গ্রন্থ)’, ‘বঙ্কিমী গপ্প’। এছাড়া ড. রতনকুমার নন্দীর সঙ্গে যৌথ সম্পাদনায় ‘হরপ্রসাদ প্রসঙ্গ’ তাঁর উল্লখযোগ্য একটি গ্রন্থ। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের পৈতৃক বসতবাড়িতে বঙ্কিম চন্দ্রের নামে, ঋষি বঙ্কিম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং রবীন্দ্রভারতীতে বঙ্কিমের নামে অধ্যাপক পদ সৃষ্টি করার জন্য তিনি শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড.
রতনকুমার নন্দীকে সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছেন। দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বিধায়ককেও। একসময় রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্কিমের নামে অধ্যাপক পদ সৃষ্টির প্রস্তাবটির সুপারিশও করেছিলেন কিন্তু কোনও এক অজ্ঞাত কারণে শেষ পযর্ন্ত তা হয়নি।
সাপ্তাহিক সংবাদপত্র এইকাল-এ দীর্ঘদিন ধরেই, বহু প্রবন্ধ ও গল্প লিখেছেন অভয়বাবু। ২০১৯ সালে তিনি এইকাল স্মারক সম্মানেও ভূষিত হয়ছেন । শুধু তাই নয়, www.eikal.in অর্থাৎ এইকাল নিউজ পোর্টাল-এর জন্মলগ্ন থেকে তিনি এই সংস্থার সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে ছিলেন। সম্প্রতি মূলত তাঁর ও অধ্যাপক ড. রতনকুমার নন্দীর যৌথ উদ্যোগে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের নৈহাটি শাখার ৭৫ বছর পূর্তির একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যা এই সংস্থার সার্বিক ইতিহাসকে মেলে ধরে।
বহু প্রবন্ধ -গ্রন্থের প্রণেতা ও গল্প লেখক অভয়বাবু বাংলার সারস্বত সমাজে সুপরিচিত নাম। তিনি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলেও সাহিত্য সংস্কৃতির জগতে চিরজীবী হয়ে থাকবেন। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিধায়ক পার্থ ভৌমিক, নৈহাটি পুরসভার মুখ্য পুরপ্রশাসক অশোক চট্টোপাধ্যায়, বঙ্কিম ভবন গবেষণা কেন্দ্রের অধ্যক্ষ তথা বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্পাদক অধ্যাপক ড. রতনকুমার নন্দী, বিশিষ্ট সমাজসেবী সেঞ্চুরিয়ান ব্লাড ডোনার পরেশ সরকার, প্রমুখ বহু বিশিষ্ট জন। তাঁর প্রয়ানে বাংলা সাহিত্য জগতে গভীর শোকের ছায়া নেমেছে।