Breaking
11 Apr 2025, Fri

সাড়ে তিন দশক পরে শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল বদল, বিতর্ক

এইকাল নিউজ: প্রায় সাড়ে তিন দশক পরে ফের আমূল বদল ঘটল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়। এক কথায়, খোল নলচে বদলে ফেলা হল।

Advertisement

সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন, এক দেশ এক রেশন কার্ডের পর এবার জাতীয় শিক্ষা নীতিতেও এক দেশ এক সিলেবাসের আভাস দিল মোদি সরকার।

গত বুধবার নতুন শিক্ষানীতিতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা সিলমোহর দেওয়ার পর দেশের শিক্ষাক্ষেত্রকে পুরোপুরি কুক্ষিগত করার অভিযোগ উঠছে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে। ইউজিসির মতো স্বশাসিত সংস্থার বিলোপ, আঠারো পর্যন্ত শিক্ষার অধিকার আইন, মাধ্যমিক পরীক্ষার গুরুত্ব হ্রাসের পাশাপাশি স্কুল ও উচ্চ শিক্ষার বহু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের কথা ঘোষণা করা হয়েছে এদিন। এমনকী, স্কুল-কলেজের মার্কশিট কেমন হবে, তার ও দিক নির্দেশ করা হয়েছে। যদিও সমালোচকদের ব্যাখ্যা, শিক্ষা যে কেন্দ্র ও রাজ্যের যৌথ বিষয়, সে বিষয়টা ভুলে গিয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়েছে মোদির মন্ত্রিসভা।

অন্য দিকে, ‘মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক’-এর নাম বদলে করা হয়েছে ‘শিক্ষা মন্ত্রক’। মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল জানিয়েছেন, ‘এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। গত ৩৪ বছরের শিক্ষানীতিতে কোনও পরিবর্তন হয়নি।’ স্কুল শিক্ষায় শিক্ষাদানের পদ্ধতিতে বদল, উচ্চশিক্ষায় মাল্টিপল এন্ট্রি- এক্সিট ব্যবস্থা, উচ্চশিক্ষাকে একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার আওতায় আনা, ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন গঠন- এটাই নয়া জাতীয় শিক্ষা নীতির নির্যাস। বহুবারই এই নতুন জাতীয় শিক্ষানীতিতে সিলমোহর দিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা। ফলে ৩৪ বছর পর ব্যপক রদবদল হল দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায়।
আগে শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো ছিলো১০+২ ভিত্তিতে। কিন্তু সেই কাঠামো পুরোপুরি ভেঙ্গে নতুন শিক্ষানীতিতে করা হয়েছে ৫+৩+৩+৪।

উল্লেখ্য, টার্গেট রাখা হয়েছে 2025 সালের মধ্যে সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। তিন বছর বয়স থেকে শিক্ষা শুরু। প্রথম তিন বছর প্লে গ্রূপ ও কিন্ডারগার্টেন, তারপর ক্লাস ওয়ান ও টু (প্রথম পাঁচ)। এরপর তিন বছর প্রাথমিক স্কুল।
ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মধ্য শিক্ষা। এই পর্বের শুরুতেই পড়ুয়ারা ঠিক করবে তাদের পছন্দের বিষয়। নবম থেকে দ্বাদশ, এই চার বছরে মোট আটটি সেমিস্টারে পরীক্ষা হবে। দশম ও দ্বাদশের আলাদা করে পরীক্ষা রীতি থাকবে না।

নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় যে কোনও বিষয় উচ্চ শিক্ষার জন্য বাছাই করতে পারবেন পড়ুয়ারা। সায়েন্স, আর্টস, কমার্স স্ট্রিম থাকবে না।

নতুন শিক্ষা ব্যবস্থায় তিন বছর নয়, ব্যাচেলর ডিগ্রি হল চার বছরের। নতুন এই ডিগ্রি কোর্সকে বলা হচ্ছে মাল্টিডিসিপ্লিনারি ব্যাচেলরস প্রোগ্রাম। তবে সার্টিফিকেট বা ডিপ্লোমা নিয়ে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষেও বেরিয়ে আসা যাবে। একে বলা হচ্ছে মাল্টিপল এন্ট্রি অ্যান্ড এক্সিট সিস্টেম। এর জন্য একটি ক্রেডিট ব্যাংক গড়া হবে। পড়ুয়ার প্রত্যেক বর্ষের প্রাপ্ত নম্বর সেখানে জমা থাকবে। উচ্চশিক্ষায় উঠে যাচ্ছে এমফিল।
এবার বিশদে দেখা যাক নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান দিকগুলি।

মাতৃভাষার শিক্ষার জোর: পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত মাতৃভাষা তথা আঞ্চলিক ভাষায় পঠন-পাঠন বাধ্যতামূলক। স্কুল চাইলে তা অষ্টম শ্রেণি বা তার পরেও চালাতে পারে। প্রতিটি স্তরেই সংস্কৃত পড়ানো হবে। সেকেন্ডারি স্তরে বিদেশি ভাষাও বাধ্যতা মূলক। যদিও শিক্ষানীতিতে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, পড়ুয়াদের ওপর কোনও ভাষা চাপিয়ে দেওয়া হবে না।

শিক্ষার অধিকার: ২০২৫-এর মধ্যে দেশে তিন থেকে ছয় বছরের প্রত্যেকের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ২০৩৫ সালের মধ্যে স্কুল থেকে উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি বাড়িয়ে ৫০ শতাংশ করা হবে।

বোর্ড পরীক্ষার ব্যবস্থা বদল: নতুন কাঠামো হবে ৫+৩+৩+৪ বিন্যাসে। শুধু তৃতীয়, পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পরীক্ষা হবে অন্য শ্রেণিতে পরীক্ষা হবে পারদর্শিতা নির্ভর। ফলে মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক এর মতো বোর্ড পরীক্ষার গুরুত্ব কমেছে। সব কোর্স দুটি ভাষায় করার সুবিধা থাকবে। ব্যবহারিক জ্ঞানের প্রয়োগে গুরুত্ব দেওয়া হবে। বোর্ড পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয় আলাদা আলাদা করে সংক্ষিপ্ত এবং বর্ণনা মূলক প্রশ্নে পরীক্ষা হবে। বোর্ড পরীক্ষা বছরে একবারের বদলে দু’বার নেওয়া হতে পারে।

মূল্যায়নের পদ্ধতি বদল: দক্ষতা বৃদ্ধিতে জোর দেওয়া হবে। সেই অনুযায়ী পরীক্ষা হবে। রেজাল্টের সময় পড়ুয়া নিজে, সহপাঠী এবং শিক্ষকরা মূল্যায়ণ করবেন। জোর দেওয়া হবে কৃত্রিম মেধা (এ আই) ভিত্তিতে মূল্যায়নে। শিক্ষা ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারে জোর দেওয়া হবে। মাপকাঠি নির্ধারণের জন্য গড়া হবে ন্যাশনাল অ্যাসেসমেন্ট সেন্টার।

ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে কোডিং: ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শুরু হবে ভোকেশনাল বিষয়ে শিক্ষা। ২০২৫ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ পড়ুয়াকে ভোকেশনাল বিষয়ের সঙ্গে পরিচয় করানো হবে। একুশ শতাংশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসাবে কোডিং শেখানো শুরু হবে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই। অত্যন্ত দু’বছর কঠোর কাজ, মৃৎশিল্পী, বাগান করা বৈদ্যুতিন সামগ্রী মেরামতি, অঙ্কন ইত্যাদি ক্ষেত্রে দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে অত্যন্ত দশ দিন ব্যাগহীন পিরিয়ডে এই ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের ইন্টার্নশিপ দেওয়া হবে। এই ইন্টার্নশিপ করা যাবে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত।

বিজ্ঞান, বানণজ্য ও কলা বিভাগের অবসান: একাদশ, দ্বাদশে বড় বদল আসছে। পদার্থ বিদ্যার সঙ্গে ফ্যাশন টেকনোলজি পড়া যাবে, বা অঙ্কের সঙ্গে গান।

এমফিল-এর অবসান: স্নাতক স্তরে গবেষণা করতে চাইলে চার বছরের ডিগ্রি কোর্সের পর সরাসরি পিএইচডি করা যাবে। এমফিল বলে কিছু থাকবে না।

একটি প্রবেশিকা: উচ্চশিক্ষায় কলেজে ভর্তির জন্য থাকবে একটি প্রবেশিকা পরীক্ষা ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি তা নেবে। তবে পরীক্ষাটি হবে ঐচ্ছিক।

কলেজগুলিকে স্বশাসন, এক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: কলেজগুলিকে দেওয়া হবে স্বশাসন । কলেজের পারফরম্যান্সের ভিত্তিতে তা মিলবে। এ প্লাস, এ, বি-এই তিন ক্যাটাগরিতে হবে। এ ছাড়া ইউজিসি, এআইসিটি-র মতো একাধিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে এক ছাতার তলায় এনে তৈরি হবে একটি নতুন কমিশন বা পর্ষদ। বাদ রাখা হবে, ডাক্তারি ও আইনকে।

ন্যাশনাল রিসার্চ ফাউন্ডেশন: গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় অনুদানের জন্য হচ্ছে এই ফাউন্ডেশন। শুধু বিজ্ঞান নয়, সমাজ বিজ্ঞানও এর আওতায় থাকবে। ১০০টি বিদেশি বিশ্ব বিদ্যালয় ভারতে তাদের ক্যাম্পাস খুলবে।

প্রসঙ্গত, 1986 সালে শেষবার শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। তবে নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে বিতর্ক ইতিমধ্যেই দানা বাঁধছে। এই নয়া শিক্ষানীতির বিরোধিতায় সরব হয়েছে বিরোধী দলগুলি। হাউসে আলোচনা না করে এভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কড়া সমালোচনা করেছেন তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্র। অন্যদিকে, নতুন শিক্ষানীতির বিরোধিতা করে শুক্রবার থেকে লাগাতার আন্দোলনে নামছে বাম ছাত্র সংগঠন এসএফআই। বৃহস্পতিবার এসএফআইয়ের তরফে ধারাবাহিক এই কর্মসূচির কথা ঘোষণা করা হয়। তবে নতুন শিক্ষানীতিকে স্বাগত জানিয়েছে এবিভিপি।

Developed by