Breaking
18 Apr 2025, Fri

মা সঙ্গীতেও সেরা কুমার শানু, এইকাল এর বিশেষ প্রতিবেদন লিখছেন তারকনাথ দত্ত

লেখক তারকনাথ দত্ত

কিছুদিন আগে এইকালের সম্পাদক তথা আমার বড় দাদা সাংবাদিক শোভনলাল রাহার সঙ্গে শানুদা’র গাওয়া মা বিষয়ক একটি গানটি নিয়ে কথা হচ্ছিল। কথার মাঝে শোভনদা হঠাৎ বলে বসল—”আচ্ছা, এই ‘মা’ নিয়ে কুমার শানু তো প্রচুর গান গেয়েছেন তাই না?”
আমি বললাম,”একদমই তাই! অনেক গান গেয়েছেন।”
আমি ভাবছিলাম অন্য কথা, এতদিন ধরে শানুদা’র গান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি, অথচ এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা কখনও আমার মাথায় আসেনি। উৎফুল্ল হচ্ছিলাম, সেই সাথে অবাকও হচ্ছিলাম। ঝানু সাংবাদিকের চোখে খুব গুরুত্বপূর্ণ অথবা কম গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছুই দেখছি নজর এড়ায় না। আমি যখন এইসব কথা ভাবছি, ফোনের অপর প্রান্তে শোভনদা তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে প্রায় লাফিয়ে উঠে বলল,”এই বিষয়টা নিয়ে কিন্তু একটা চমৎকার লেখা হতে পারে, তাই না?”
আমি মাথা নেড়ে তার কথায় সহমত পোষণ করলাম। যদিও সেই মাথা নাড়ানো শোভনদা দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এরপরে শোভনদা কী বলতে পারে তা বোধহয় খানিকটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। আন্দাজ করতে পারছিলাম বলেই হয়ত আমি খানিকটা অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছিলাম।
আমার আশংকাকে সত্যি করে শোভনদা বলল,”তুমি এই বিষয়টা নিয়ে একটা লেখা দাও। এবং আজ থেকেই তুমি এটা নিয়ে কাজ শুরু করে দাও।”
আমি নির্বাক শ্রোতা। কিছুই আমার বলার নেই। কেননা আমি খুব ভালো করেই জানি এই লোক এখানেই থেমে থাকার পাত্র না। এর মাথায় একবার যেটা ঢুকবে সেটা যতক্ষণ না ফলপ্রসূ হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত নিস্তার নেই। শোভনদা ইদানিং একটা ভয়ংকর কারবার শুরু করেছে। সেই ভয়ংকর কারবারটি হলো গাধা পিটিয়ে মানুষ বানানোর কারবার। এখন প্রশ্ন হলো, গাধা পিটিয়ে আদৌ কি মানুষ বানানো সম্ভব? গাধা আর ঘোড়ার অবাধ মিশেলে ‘খচ্চর’ বলে একটি গোবেচারা প্রাণীর কথা শুনেছি। যার মধ্যে গাধা আর ঘোড়ার বেশ কিছু গুণাবলী চোখে পড়ে। এদের জীবনের সবথেকে বড় ট্রাজেডি এরা প্রজননে অক্ষম। বংশ বিস্তারের কোন সুযোগ এদের দেওয়া হয়নি।
এই লেখাটি আগাগোড়া আদতে শোভনদার দুরন্ত ভাবনার ফসল। আমি কেবল আমার কলম চালিয়ে তার ভাবনাটাকে মোটামুটি ভাবে একটা ভদ্রস্থ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র।

Advertisement

‘মা দিয়ে শুরু যার মাটি তার নাম
মাটি আর মাকে তাই জানাই প্রণাম…’

মা! শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের মনের ক্যানভাসে একজন নরম-শান্ত-স্নিগ্ধ স্নেহময়ী নারীর অবয়ব ফুটে ওঠে।
মা! ছোট্ট একটি শব্দ। আসলে একটি পৃথিবী। শুধু পৃথিবী বলাটা বোধহয় ঠিক হবে না, ত্রিভূবন । ত্রিভূবনের সবচেয়ে মধুরতম শব্দ হলো মা। বহু ব্যবহারেও যে শব্দের গরীমা এতটুকু ম্লান হয় না।
বিজ্ঞানীরা মাথা খাটিয়ে অনেক কিছু আবিস্কার করেছেন। তার মধ্যে এমন কিছু অত্যাশ্চর্য যন্ত্র তারা আবিস্কার করেছেন যাতে করে প্রকৃতির অনেক অজানা রহস্যই আমরা উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু ভালোবাসা মাপার মত কোন যন্ত্র তারা এখনও পর্যন্ত আবিস্কার করে উঠতে পারেননি। যদি পারতেন তো ভালোবাসার মাপকাঠিতে অবধারিতভাবে প্রথম স্থানে থাকতেন মা নামের নিঃস্বার্থ মহিলাটি।

জগতের প্রায় প্রতিটি সম্পর্কের পিছনে কিছু না কিছু স্বার্থ থাকে। ব্যতিক্রম মা। নিঃস্বার্থভাবে সন্তানকে ভালোবাসতে পারাটা একমাত্র একজন মায়ের পক্ষেই সম্ভব। মা’তো মা-ই। সন্তানের জন্য তাঁদের এই স্নেহ-মায়া-মমতা, চিরন্তন। সন্তান আঘাত পেলে মায়ের বুকটাই আগে ফাটে। তাঁদের সেই বুক ফাটার আওয়াজ পচা কানে শুনতে পাওয়া যায় না এই যা। শুনতে পেলে শেষ বয়সে সন্তানের লাথি-গুঁতো খেয়ে, নিজের হাতে গড়া সংসারের এক কোণে সন্তানের কাছে দয়া ভিক্ষা করে অকিঞ্চিৎকরের মত বাকি জীবনটা তাঁদের কাটাতে হতো না। এবং দেশে এত বৃদ্ধাশ্রমেরও বাড়বাড়ন্ত হতো না।

শুরু থেকে এই পর্যন্ত মাকে নিয়ে অনেকগুলো কথা খরচ করলাম। কেন করলাম? উদ্দেশ্য তো একটা কিছু আছেই। মানুষ উদ্দেশ্য ছাড়া কিছু করে না। ভণিতা ছেড়ে এবার সেই উদ্দেশ্যটা একটু খোলসা করে নেওয়া যাক। আজ আমরা এমন একজন মানুষের এমন একটি দিক দিয়ে আলোচনা করতে চলেছি, যে দিক নিয়ে সম্ভবত এর আগে খুব একটা লেখালেখি হয়নি। যদিও যে মানুষটার কথা এখানে বলতে চাচ্ছি তাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আমি তথাকথিত সংগীত বোদ্ধাদের কথা বলছি না। তাদের লেভেল আকাশছোঁয়া। সেখানে আমার বিদ্যাবুদ্ধি অতি নিম্ন পর্যায়ের। আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা আমার নেই। জ্ঞানি গুণী মানুষেরা অনেক আগেই পইপই করে বলে গেছেন, যদ্দুর হাত যায় তদ্দুর চুলকানোর চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের। বাড়াবাড়ি রকমের কিছু করার চেষ্টা করলে এর ফল মারাত্মক হতে পারে।
যাই হোক, এবার কাজের কথায় আসা যাক।
যারা একটু আধটু হলেও গান শোনেন বা গান নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাদের মধ্যে কুমার শানুর নাম শোনেননি, বা জীবনে একবারও তাঁর গান শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
নম্বইয়ের দশকে যারা ওনার গান শুনে বড় হয়েছেন, তাদের কথা অবশ্য আলাদা। কেননা তাদের বেড়ে ওঠা একটা অতি সুন্দর সুরেলা সময়ের মধ্যে দিয়ে।
কুমার শানু ভারতীয় সংগীত আকাশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। ওনার কথা আলোচনা করতে গিয়ে যে-কথাটা আমার বারবার মনে হয়, তিনি শুধু ৯০ দশকের একজন জনপ্রিয় গায়কই নন, বর্তমান এবং আগামী গাযক়কুলেরও পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আছেন। তাই তাঁর যে কোনো গান যে কোনো পরিস্থিতিতে নির্বাচন করাই যায়। যে সমস্ত গানে তাঁর শক্তি ও দুর্বলতার পরিচয় একসাথে ফুটে উঠবে; অথচ গায়ক হিসেবে তাঁর মূল্য ও তাৎপর্য কিছু মাত্র ম্লান হবে না। সংগীতের এমন কোন ধারা নেই যেখানে ওনার অবাধ বিচরণ আমরা দেখতে পাই না। সব থেকে মজার বিষয় হলো কোন ক্ষেত্রেই তিনি একেবারে অসফল এমনটা বলা যাচ্ছে না। যাতে হাত দিয়েছেন তাতেই সাফল্য এসেছে।
আজ আমরা ওনার গাওয়া তেমনি কিছু ভিন্ন স্বাদের গান নিয়ে আলোচনা করব। লেখার শুরুটা করেছি ‘মা’ দিয়ে। এখন অনেকের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, লেখাটা যখন কুমার শানু বা তাঁর গান নিয়ে, তখন হঠাৎ করে এত মা! মা! করে চিৎকার করার আদৌ কি কোন প্রয়োজন ছিল? উত্তরটা হলো ছিল।
এবং অবশ্য করেই ছিল। উপরের ভূমিকাতেই স্পষ্ট আজ আমরা কোন বিষয়ের উপর আলোচনা করতে চলেছি। তাও আর একবার বলি,
আজ আমাদের আলোচনার বিষয় হলো, কুমার শানু তাঁর গোটা কেরিয়ারে মাকে নিয়ে করা বেশ কিছু ভালো গান আমাদের উপহার দিয়েছেন। সেখানে তিনি যে শুধু গর্ভধারিণী মাকে উদ্দেশ্য করেই গানগুলি গেয়েছেন তা নয়। আমরা যে শুধু নিজের গর্ভধারিণী মাকেই ‘মা’ বলে ডাকি তা তো নয়। এর বাইরেও আমরা ‘মা’ শব্দটা ব্যবহার করে থাকি। সেটা প্রকৃতি মা হতে পারে, আবার আমাদের আরাধ্য দেবীগণকেও আমরা ‘মা’ বলে সম্মোধন করে থাকি। সেইসব মা পর্যায়ের গানগুলি নিয়ে আজ আমরা আমাদের আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করব।
অন্য আর পাঁচটা সন্তানের মত কুমার শানুও তার মায়ের আদরের দুলাল। মাকে নিয়ে তাঁর মনের মধ্যে উথালপাথাল আবেগ থাকাটাই স্বাভাবিক। ওনার জীবনে ওনার মায়ের ভূমিকাটা নিঃশব্দ অথচ ভীষণ কার্যকরী।

শুরু থেকে এই পর্যন্ত শানুদার নানাসময়ের আন্তরিক আলাপচারিতায় নিজের মায়ের প্রতি অকৃত্রিম ও অগাধ ভালোবাসার কথা অবধারিতভাবে প্রকাশ পেয়েছে। যার ছোঁয়া তার গানকেও প্রভাবিত করেছে। কুমার শানু তার গোটা কেরিয়ারে যত সংখ্যক ‘মা’ নিয়ে গান গেয়েছেন, বোধকরি দ্বিতীয় কোন গায়ক এই কাজটি করতে সমর্থ হননি।
শানুদার নিজের মুখ থেকেই শোনা, তিনি তখন বম্বেতে। ওনার তখন বেশ নামডাক হয়েছে। দেশের প্রথম সারির গায়কদের সাথে তাঁর নাম উচ্চারিত হচ্ছে। সেই সময়টাতে তিনি
বহুবার মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু মাকে কোনভাবেই রাজী করাতে পারেননি। যতবারই আসার জন্য পীড়াপীড়ি করেছেন, মায়ের সেই এক কথা—”না রে, আমার যাওয়া হবে না রে। সংসার ফেলে কোথায় যাবো? তুই একদম মন খারাপ করবি না। জানবি, যেখানেই থাকিস মা তোর সঙ্গে সঙ্গেই আছে।”
মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে না পারার আক্ষেপ শানুদাকে ভীষণ কষ্ট দিত। সেই কষ্টের প্রতিফল তাঁর গানের মধ্যে দিয়েও বারে বারে প্রতিফলিত হয়েছে। সেইরকমই একটা গানের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে। সেবার পুজোর মুখে টি-সিরিজ থেকে কুমার শানু ও অনুরাধা পড়োয়ালের যৌথভাবে একটা সংকলন বাজারে এসেছিল। সংকলনটির নাম ছিল— আমার প্রাণের খাতায়। গানের কথা লিখেছিলেন স্বর্গীয় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। সুরকার অরূপ-প্রণয়। এই সংকলনে কুমার শানুর কণ্ঠে মাকে উদ্দেশ্য করে চমৎকার একখানি গান ছিল। গানটি হলো—’এসো মা গৌরী মা/ বসে আছি পথ চেয়ে মা আশার আলো জ্বেলে/আনন্দেতে উঠবো ভোরে মা গো, তুমি এলে…’
শানুদার নিজের কথায় এই গানখানি তিনি তাঁর নিজের মাকেই উৎসর্গ করে গেয়েছিলেন। অসম্ভব ভালো একটি গান। কুমার শানুর স্বকীয় গায়ন শৈলীতে মায়ের থেকে সন্তানের বিচ্ছিন্ন থাকার যে যন্ত্রণা তার করুণ ভাবাবেগ গানের প্রতিটি শব্দের মধ্যে দিয়ে উচ্চকিত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। মায়ের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা না থাকলে এই জাতীয় গান গাওয়া সম্ভব না। এই গানটি যারা শুনেছেন তারা আশাকরি আমার সহমত হবেন।

‘যার কোলেতে জন্ম নিলি আঁধার ভেঙে বাইরে এলি/সেই মাকে কি দুঃখ দিতে আছে…’
কলকাতার এককালের অনামী অখ্যাত শানু ভট্টাচার্য নামের ছেলেটির কুমার শানু হয়ে ওঠার ইতিহাস সম্পর্কে আজ আমরা প্রত্যেকেই অবগত। এই পর্যায়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে মানুষটির অবদান সবথেকে বেশি ছিল, তিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। পুলক বাবু আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। একবুক অভিমান নিয়ে তিনি আজ অনেকদিন হয়ে গেল না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি নেই, কিন্তু ওনার অসাধারণ সৃষ্টিগুলো আজও আমাদের মধ্যে তাঁর স্মৃতিকে চির জাগরুক করে রেখেছে। কুমার শানু তাঁর গোটা কেরিয়ারে যত সংখ্যক সুপার হিট বাংলা গান আপামর সংগীত পীপাষু মানুষকে উপহার দিয়েছেন, তার অধিকাংশ গানই পুলক বাবুর লেখা। তাঁর লেখা সেইরকমই একটি জনপ্রিয় গান
কুমার শানুর ‘কিশোর কুমার’ সংকলনের এই গানটি। গানটির সুরকার ছিলেন বাবুল বোস। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়-কুমার শানু-বাবুল বোস এই ত্রয়ী বেশ কিছু ভালো মানের বাংলা ছায়াছবি ও আধুনিক গান আমাদের উপহার দিয়েছেন। এই গানটি তার মধ্যে একটি। যদিও জনপ্রিয়তার নিরিখে এই ত্রয়ীর আরেকটি কালজয়ী সংকলন ‘অমর শিল্পী’র তুলনায় অনেকটাই পিছিয়ে। তারপরেও কুমার শানুর গাওয়া বাংলা গান নিয়ে আলোচনায় এই সংকলনটির প্রাসঙ্গিকতা একেবারে হেলাফেলা করা যাবে না।’যখন রাত্রি নিঝুম নেই চোখে ঘুম/ একলা শূন্য ঘরে তোমায় মনে পড়ে মা গো, তোমায় মনে পড়ে…’
কুমার শানুর মা-পর্যায়ের গান নিয়ে কথা হবে আর এই গানটির কথা উল্লেখ হবে না, তাই কখনও হয়!
‘ভরবো জীবন গানে গানে/ এই তো আশা আমার প্রাণে/মা গো, তোমার আশীষ সকল কাজে পড়ছে মাথায় ঝরে…’
অঞ্জন (বিশিষ্ট পরিচালক অঞ্জন চৌধুরী) পত্নী লীলা চৌধুরীর কথায় মৃণাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে কুমার শানুর সেই বিখ্যাত গান। একটা সময় শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরেছে। এত বছর বাদে এসেও সেই গানের জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। চোখ বন্ধ করে গানটি শুনতে শুনতে রসকষহীন কাঠখোট্টা বলে পরিচিত মানুষের চোখেও অটোমেটিক জল চলে আসাটাই স্বাভাবিক।’এই মাটি যে সোনার মাটি/ এ যে আমার মায়ের মত/কখনও যা ভালোবাসা/ কোনদিনও হয় না মরণ…’
১৯৯৪ সালের ছবি ‘ফিরিয়ে দাও’। চিরঞ্জিৎ পরিচালিত এ ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন বাপ্পী লাহিড়ী। গানের কথা লিখেছিলেন শ্রদ্ধেয় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলে ভালোবাসা/এলোমেলো বাতাসেতে কথা বলে ভালোবাসা/যেদিকে তাকাই দেখে দেখে যাই/আমার মায়ের স্নেহের নয়ণ…’
প্রকৃতি মায়ের রূপ বর্ণনার মধ্যে দিয়ে নিজের গর্ভধারিনী মাকে কল্পনা করার এক ফলবতী প্রচেষ্টা এই গানের মধ্যে দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। কুমার শানু গেয়েছেনও ভারি চমৎকার। আমার মনে হয় এই গানটিতে কুমার শানু যেমন দক্ষতার সাথে তার চূড়ান্ত ভাবাবেগ আর নিখুঁত গায়ন শৈলীর মিশেল ঘটিয়েছেন, বোধকরি দ্বিতীয় কোন গায়কের পক্ষে এমনটা করে দেখানো সম্ভব নয়।

‘চোখের জ্বলে ধোঁয়াবো আজ তারা মায়ের চরণ দু’টি/রাঙা ফুলে সাজাবো মা যতন করে পরিপাটি…
১৯৯৬ এর ছবি ‘তারিণী তারা মা’। ছবির নাম শুনেই বুঝতে অসুবিধা হয় না এটি একটি ভক্তিমূলক ছবি। বাংলা ছবির ইতিহাসে এই ধরনের ছবির সংখ্যা নেহাত কম না। ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলে অকারণে লেখাটিকে দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছি না। কাজেই সময় নষ্ট না করে সরাসরি ছবির গানের কথায় চলে আসি। ভূপেন রায়ের কথায়, শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে কুমার শানুর চমৎকার গানটির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। যারা মনে করেন কুমার শানু ক্লাসিক্যালটা একেবারেই গাইতে পারেন না, বা ওনার ক্লাসিক্যাল বেস বড্ড নড়বড়ে, আমি তাদেরকে বলব তারা সম্ভব হলে সময় করে একটিবার গানটা শুনে দেখতে পারেন। হতে পারে তাদের এতদিনকার বস্তাপচা ধারণা বদলালেও বদলাতে পারেন।
‘তুই মা তারা শ্মশান বাসী/ ঘর ছেড়ে মা পরবাসী/ আমি কেন বদ্ধ ঘরে মা, জীবনটাকে করি মাটি/আমার সকল জ্বালা মিটিয়ে দিয়ে মা…মা…মা গো…’
ভক্তের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে উঠে আসা ‘মা’ ডাক কুমার শানুর দরদী কণ্ঠে যেন আরো বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।’মধুর আমার মায়ের হাসি/ চাঁদের মুখে ঝরে/ মাকে মনে পড়ে আমার/ মাকে মনে পড়ে…’
এই গানটি আদতে অতীতের খ্যাতনামা শিল্পী সুধীরলাল চক্রবর্তীর বিখ্যাত একখানি কালজয়ী গান। যে গান কুমার শানু পুনরায় নতুন করে রেকর্ড করেছিলেন। যেটি তার ‘আমার প্রিয় গান’ সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। কুমার শানুর মায়াবী কণ্ঠে এ গানখানি শুনতে শুনতে একটা কথাই মনে হয়, কুমার শানু শুধু যে তার সমকালীন গানগুলোতেই নিজের আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন তাই না, স্বর্ণ যুগের গানের ক্ষেত্রেও তাঁর অনায়াস দক্ষতা রীতিমত প্রশংসার দাবি রাখে। কুমার শানুর সব থেকে বড় গুণ যে কোন ধরনের গানেই তাঁর আধিপত্য বরাবর লক্ষ্য করা যায়। এই গানটার কথাই ধরা যাক। আগ্রহ নিয়ে গানটি শুনতে শুনতে একবারের জন্যও মনে হয় না এটি একটি পুরনো গান, যার মূল গায়ক অন্য কেউ। মনে হয় যেন এই গানটির আসল মালিক কুমার শানু নিজেই। তার কথা মাথায় রেখেই গানটি তৈরী করা হয়েছিল।’টুকরা ম্যায় তেরে দিলকা/অ্যায় মা তু আকে মিল জা…’
ছবির নাম মাহীর (১৯৯৬)। বাপ্পী লাহিড়ীর সুরে কুমার শানুর এই গানটি তার অন্য জনপ্রিয় গানগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম সমাদৃত। অবশ্য গানটি কুমার শানুর শ্রেষ্ঠ গানগুলির একটি একথা বলা যাবে না মোটেও। তথাপি তার গায়কীর যে বৈশিষ্ট্য তা এই গানটিতেও প্রবল ভাবে উপস্থিত।

‘ফুল য্যায়সি মুশকান তেরি…’
সমীর আনজানের কথায় আনন্দ মিলিন্দের সুরে ‘তকদিরবালা (১৯৯৫)’ ছবির এই গানটিতে মা ও ছেলের চিরন্তন ভাবের আদান-প্রদানকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। কুমার শানু ও সাধনা সরগরম সেই কাজে নিশ্চিত করেই সদর্থক ভূমিকা পালনে সক্ষম হয়েছেন সে কথা বলাই বাহুল্য।’ওই যে আকাশ, এই যে মাটি / ছোট্ট বেলায় হারিয়ে যাওয়া এই তো আমার মা, জন্মভূমি মা…’
ছবির নাম বিদ্রোহ (১৯৯৭)।
খুব সুন্দর সুর করেছিলেন সুরকার দেবজ্যোতি মিশ্র। এই ধরনের গান শানুদা খুব বেশি গাননি। এ গানের সুরে একটা মায়াকাড়া ব্যাপার আছে। শ্রদ্ধেয় মান্না দের একটা গান আছে— ‘ওই মহা সিন্ধুর ওপার থেকে কী সংগীত ভেসে আসে…’ এই গানের মধ্যেও একটা ভেসে আসা ব্যাপার আছে। সেটা হয়ত মহা সিন্ধুর ওপার থেকে আসা কোন মহা সংগীত নয়, কিন্তু কী ভাবে, কী বিস্তারে এই গানের সুর মনকে দীর্ঘক্ষণ মোহাবিষ্ট করে রাখে। কে যেন বলেছিল, দ্রুত লয়ের গান গাওয়া যতটা সহজ, ঠিক ততটাই কঠিন একটা ধীর লয়ের গানকে সঠিক ভাবে উৎরে দেওয়া। কুমার শানু সেই গুরুতর কাজটাই সাবলীল ভাবে এই গানটিতে করে দেখিয়েছেন। গানটার প্রথম অন্তরায়—’যেদিকেতে চাই আমি মাকেই খুঁজে পাই/আয় আয় মা ডাকে ফিরে আয়….’ থেমে থেমে আসা সুর হঠাৎ করেই চড়ায় পৌঁছে যায়। কিন্তু সে ক্ষণিকের জন্য। অদ্ভুত দক্ষতায় সেই সুর পুনরায় খাদে নেমে আসে—’মায়ের স্মৃতি ছাড়া কিছু মনে পড়ে না…’
গান আবার সেই আগের গতিতেই চলতে থাকে। অথচ সুরের এই সুক্ষ্ণ ও জটিল তারতম্যের কারণে গায়ককে আমরা একবারের জন্যও বিভ্রান্ত হতে দেখি না। এটাই গায়কী। গলা ছেড়ে ষাঁড়ের মত চিৎকার করলেই তাকে গান বলা যায় না। গান অতি সাধনার জিনিস। কেবল মাত্র প্রতিভা থাকলেই কখনও এই পর্যায়ে পৌঁছনো যায় না। তার জন্য দরকার চূড়ান্ত অধ্যাবসায় আর অতি উচ্চ পর্যায়ের সাধনা। জগতে ভেকধারী সাধুর অভাব নেই। সেখানে খুঁজলে পরে প্রকৃত সাধুর সংখ্যা হাতে গোনা। কুমার শানু হয়ত সেই সাধুদের দলে পড়েন না, কিন্তু তাঁর সংগীত সাধনা অতি উচ্চ মার্গের। যার নিট ফল এই জাতীয় গানগুলো। শুনতে শুনতে মনে হবে যেন গায়ক নিজেই বহুকাল ধরে মায়ের এই আদরমাখা ডাকটি শোনার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছেন।

‘মাগো তুমি একবার খোকা বলে ডাকো…’
ছবির নাম ‘মা(১৯৯৮)’। সুরকার ওপার বাংলার সত্য সাহা। সত্য সাহার সুরে কুমার শানুর গাওয়া একাধিক বাংলা গান এপার-ওপার দুই বাংলার গান পাগল শ্রোতাদেরকে আগাগোড়া মুগ্ধ করে গেছে। এই গানটির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মায়ের মুখ থেকে একটিবার ‘খোকা’ ডাক শোনার জন্য সন্তানের যে আকুতি এই গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে, মনে হয় যেন অন্য কারো নয় এই আকুতি আদতে গায়কের নিজের। তৎকালীন গানের যে ধারা তার অভ্রান্ত প্রতিফলন এই গানটির মধ্যে পাওয়া যায়।’নিঝুম পুরের রাজকন্যের ঘুম এলো চোখে/ সোনার কাঠির পরশ তখন ছোঁয়ালো কে/পক্ষীরাজের সওয়ার তখন কে সে এলো/গল্প বলো মা গো আমায় গল্প বলো…’
‘শিল্পী আমি’ কুমার শানুর জীবনে এই সংকলনটির গুরুত্ব অপরিসীম। নিজের গোটা কেরিয়ারে তিনি অসংখ্য কালজয়ী গান আমাদের উপহার দিয়েছেন। সেইসব গানের সঙ্গে তাঁর নানা স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কিন্তু অন্য সংকলন গুলির তুলনায় ‘শিল্পী আমি’ নিয়ে তাঁর আবেগটা একটু বেশিই। কেননা এই সংকলনটির সুরকার তাঁর পিতৃদেব পশুপতি ভট্টাচার্য। গানের কথা লিখেছেন কৃষ্ণমোহন ভট্টাচার্য।
বাবা-ছেলের যুগলবন্দীতে এই ধরনের কাজ এর আগে কখনও হয়েছে বলে মনে হয় না। তারপর কুমার শানু তখন তাঁর গায়ক জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভবত সেই কারণেই এই সংকলনটি যখন বাজারে আসে বাবা-ছেলের যুগলবন্দী নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে বাড়তি আগ্রহ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।’মায়ের হাতের মুড়ির মোয়া/ পিঠে পায়েস মালপোয়া…’
স্বর্গীয় ঋতুপর্ণ ঘোষের কথায়, অঞ্জন চ্যাটার্জ্জীর সুরে ‘ফেলে আসা পথে’ সংকলনের এই গানটি আপাত দৃষ্টিতে মজার ছলে গাওয়া গান মনে হলেও গানটির মধ্যে একটি করুণ বিষাদের ছায়া আছে।’পুছো না হ্যায় ক্যায়সি মেরি মা/ এক সচ্চে দোস্ত জ্যায়সি মা…’
ছবির নাম ‘মেরে দো আনমল রতন (২০০০)’।
ছবির সুরকার কুমার শানুর বহু হিট গানের সুর স্রষ্টা রাজেশ রোশন। এই গানটিতে কুমার শানুর সহ শিল্পী সনু নিগম।’সো গয়ি ইয়ে জমীন, সো গয়া আসমান/ নিন্দ মে খো গয়া দেখ সারা জাহান/ পলকো পে সপনে সাজায়ে, ধীরে ধীরে বাহোঁ মে ঝুলায়ে/ মা গা গা কে সুলায়ে আ রি আ, নিন্দিয়া তু আ… আ আভি যা…’
২০০২ সালের ছবি কর্জ টু বার্ডেন অফ ট্রুথ। সমীরের কথায় এই ছবির বেশিরভাগ গানই সুরকার সঞ্জীব-দর্শন কুমার শানুকে দিয়ে গাইয়েছেন। উপরের গানটি এই ছবিরই একখানি অসাধারণ গান। এই গানটিও তারই গাওয়া।
গানটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, গানটি ভিডিও সহযোগে দেখলে মানে, শ্রবণ আর দর্শন দুটো একযোগে হলে গানটির আসল আবেগটা সঠিক বুঝতে পারা যাবে। কুমার শানু কেমন গেয়েছেন? তা বোঝার জন্য গানটি অবশ্য করে শোনা প্রয়োজন। কিছু কিছু অনুভূতি থাকে যাকে ভাষায় প্রকাশ করাটা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। একই কথা এই গানটির ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে প্রযোজ্য। কাজেই অক্ষম বিশ্লেষণে না গিয়ে গানটি যারা শোনেননি তাদের একটিবার সময় করে শোনার অনুরোধ করছি। আশাকরি তারা আমার সাথে একমত হবেন।’যেদিন মায়ের গর্ভে এলাম/ একই খাওয়া, একই হাওয়া, এক শরীরে বড় হওয়া/কেমন করে ভুলবো মাকে এত কিছু পেলাম…’
একটা সময় ছিল যখন পুজোয় কার কী নতুন গান আসছে তা নিয়ে বাঙালি শ্রোতাদের মধ্যে আগ্রহের সীমা থাকত না। পুজোর কেনাকাটার সাথে সাথে গানের ক্যাসেট কেনার ক্ষেত্রেও রীতিমত হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। ছোটবেলায় বাবা-কাকাদের কাছ থেকে তাদের সময়কার সব তাবড় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, কিশোর কুমার এদের পুজোর গান নিয়ে তাদের নস্টালজিয়ার কথা শুনে অবাক হতাম, আবার মনে মনে রাগও হতো। ভাবতাম পুজোর গান নিয়ে এত আদিখ্যেতা করার কী আছে? কিন্তু মজার বিষয় হলো বাবা-কাকাদের মত সেই একই কাজ আজ আমরা করছি। কেননা তাদের মত করে না হলেও আমরাও পুজোর গান নিয়ে মাতামাতি করার সুযোগটা অন্তত পেয়েছি। আমাদের সময়ে পুজোর সময় যার গান নিয়ে সবথেকে বেশি হইচই হতো তিনি কুমার শানু। তার সময়কার তিনিই একমাত্র গায়ক যিনি পুজোর গান নিয়ে বাঙালির এই চিরকালীন আবেগটাকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত জিইয়ে রাখতে পেরেছিলেন। সেই সমস্ত গান নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। আজ এতদিন বাদে এসেও সেই সমস্ত গানের জনপ্রিয়তায় এতটুকুও ভাটা পড়েনি। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো কুমার শানু যখন তাঁর সংগীত জীবনের সব থেকে ব্যস্ততম সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, দিনে দশটা-পাঁচটা হিন্দি ছবির গান রেকর্ড করছেন, তখনও প্রতিবছর নিয়ম করে পুজোর গান করেছেন। এতদিন বাদেও সেই ধারা অব্যাহত। ২০১০ সাল নাগাদ পুজোর সময় রিলিজ করেছিল সৈয়দ আহমেদের সুর করা আটখানি চমৎকার গান সম্বলিত তাঁর ‘রামধনু’ সংকলনটি। উপরিউক্ত গানটি সেই রামধনু সংকলনেরই মাকে নিয়ে গাওয়া কুমার শানুর একটি অনবদ্য গান। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার অনেক আগে থেকেই মায়ের জঠরে আগামীর আলো দেখার উৎসাহে নিজের শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে থাকে। তারপর একদিন আঁধার ভেঙে বাইরে আসে। স্বাভাবিক ভাবে গোটা প্রক্রিয়াটায় সময় লাগে দশ মাস দশ দিন। এই দশ মাস দশ দিনের এই জার্নিটা একজন মায়ের জন্য কতখানি পীড়াদায়ক তা একজন মা-ই ভালো উপলব্ধি করতে পারবেন। সেই উপলব্ধিটাকেই গানের মধ্যে দিয়ে খুব সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে। কুমার শানুর অনবদ্য গায়কী গানটিকে একটি যথার্থ মাতৃবন্দনার রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে।লেখার শুরুতেই যে গানটির কথা উল্লেখ করেছি সেটি আদতে ১৯৯৫ সালে বিঠোভেন ক্যাসেট থেকে প্রকাশিত কুমার শানুর ‘জননী জন্মভূমি’‌ সংকলনের জনপ্রিয় একটি গান। আটখানি গান সম্বলিত এই সংকলনের সবক’টা গানই এক কথায় অনবদ্য। সুমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে গানে কথা বসিয়েছেন বিশিষ্ট গীতিকার লক্ষ্মীকান্ত রায়। পৌরাণিক কাল থেকেই পৃথিবীকে ধরিত্রী মাতা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কুমার শানুর গাওয়া এই সংকলনের গানগুলি আমাদের এতটাই মোহাবিষ্ট করে রাখে যে, জন্মদাত্রী মা আর পৃথিবী মায়ের মধ্যে তফাৎ করাটা কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়ে। মস্তিষ্কের ভোঁতা সেলগুলোতে হঠাৎ করেই একধরনের সক্রিয় ভাব চলে আসে।
গর্ভধারিণী মা আর প্রকৃতি মা আসলে এক ও অভিন্ন। জাগতিক এই গূঢ় তত্ত্ব বোঝার জন্য খুব বেশি শিক্ষিত হবার প্রয়োজন নেই।
‘জননী জন্মভূমি’ সংকলনের সবক’টি গানের তালিকা নীচে দেওয়া হলো—
১.পৃথিবীতে তুমি শুধু তোমার উপমা…
২.ফুল যখনই গন্ধ ছড়ায়…
৩.আবার আসি যেন ফিরে..
৪.ভোরের অরুণ ললাটে তোমার…
৫.গঙ্গা মা গঙ্গা মা…
৬.তোমাদের প্রাণভরা ভালোবাসা…
৭.জন্মেছি যে এই মাটিতে…
৮.মা দিয়ে শুরু যার মাটি তার নাম…আমাদের দেবদেবীদের নিয়ে আমাদের সঙ্গীতের একটা বিরাট অংশ যথেষ্ট পরিমাণে সমৃদ্ধ। সঙ্গীতের ইতিহাস ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যায়, সঙ্গীতের জন্মই হয়েছিল দেবদেবীদের বন্দনার তাগিদে। দেবতাকে তুষ্ট রাখতে তাঁর স্তুতিকে আকর্ষণীয় করে তুলতেই মানুষ সঙ্গীতের আশ্রয় নিয়েছিল। যাকে আমরা ডিভোশনাল-সং বা ভক্তিগীতি বলে থাকি। আমার অতি ক্ষুদ্র জ্ঞানে যেটুকু বুঝি, সব ধর্মের মানুষের ক্ষেত্রেই এই ভক্তিসংগীতের বিরাট প্রভাব অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। আমাদের হিন্দু দেবদেবীদের নিয়েও চমৎকার সব গান তৈরি হয়েছে, যা শুনলে মন বেশ পবিত্র হয়ে ওঠে। যুক্তিতর্কের উর্দ্ধে গিয়ে আমরা এমন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়ি, তার রেশ থেকে যায় দীর্ঘসময় ধরে। যেমন আমাদের শাক্ত মতের আরাধ্য দেবী হলেন, শ্রীশ্রী মা-কালীকা। তাঁর প্রভাব সমাজের একেবারে নীচুতলা থেকে উঁচুতলা সর্বত্রই প্রায় সমান। যুগ যুগ ধরে তাঁকে বন্দনা করে বহু গান রচনা হয়েছে, এবং এখনও হচ্ছে। এর কোনো গানকেই অবহেলা করার উপায় নেই। সমস্ত গানগুলোই যেমন শ্রুতিমধুর, তেমনি ভাবে, ভাষায় সবদিক দিয়েই যথেষ্ট উৎকৃষ্ট মানের। আমি বলতে চাইছি, শ্যামা সংগীতের কথা। আগেই বলেছি সংগীতের এমন কোন ধারা নেই যেখানে কুমার শানুর অবাধ গতিবিধি আমরা দেখতে পাই না। একটা সময় ছিল যখন শ্যামা সংগীতের প্রসঙ্গ এলে অবধারিতভাবে যে দুটো নাম আমাদের সামনে চলে আসত তাঁরা হলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। অদ্ভুত বিষয় হলো, এতকাল পরেও তাঁরা ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক। এঁনারা ছাড়াও আরো অনেক শিল্পীই এই কাজে হাত পাকানোর চেষ্টা করেছেন। এবং তারা বহুলাংশে সফলও। কুমার শানুও তার গোটা কেরিয়ারে বেশ কিছু শ্যামা সংগীত গেয়েছেন। এবং সেই সমস্ত গান শ্রোতাদের দরাজ প্রশংসাও কুড়িয়েছে।’সকলি তোমারই ইচ্ছা/ ইচ্ছাময়ী তারা তুমি/ তোমার কর্ম তুমি করো মা/ লোকে বলে করি আমি…’
১৯৯৪ সালে এইচ.এম.ভি থেকে
কুমার শানুর গাওয়া শ্যামা সংগীতের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। সংকলনটির নাম ছিল—সকলি তোমারই ইচ্ছা। সংকলনটিতে সর্বমোট গান ছিল আটখানি। যার প্রতিটি গানই ছিল শ্যামা সংগীতের পুরনো গানের রিমেক ভার্সন। তা সত্ত্বেও কুমার শানুর মায়াবী কণ্ঠে বহু শ্রুত গানগুলিও ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। ‘শ্যামা মা কি আমার কালো…’ কিংবা ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন…’ অথবা ‘বসন পরো মা…’ এমন অভ্রান্ত সুরে কুমার শানু গেয়েছেন শুনতে শুনতে মনের ভেতর এক ধরনের নিষ্কাম প্রশান্তি চলে আসে।
‘সকলি তোমারই ইচ্ছা’ সংকলনের গানগুলির দিকে একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক—
১.সকলি তোমারই ইচ্ছা…
২.মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন…
৩.তুই নাকি মা দয়াময়ী…
৪.শ্যামা মা কি আমার কালো…
৫.বসন পড়ো মা…
৬.মা তোর কত রঙ্গ দেখবো বল…
৭. আমার সাধ না মিটিলো…
৮.সদানন্দময়ী কালী…’আমার কাছে থাক মা কিছুক্ষণ/ তোকে শুধু চাই মা তারা, চাই না মাণিক ধন…’
কুমার শানুর মা পর্যায়ের আরো একটি অনবদ্য গান।
‘সিদ্ধিদায়িনী মা তারা’ সংকলনের প্রতিটি গানই এককথায় অসাধারণ। সবগুলো গানই নতুন করে লেখা এবং সুর করা। আধুনিক যন্ত্রাণুসঙ্গ সহযোগে গানগুলি শুনতে মন্দ লাগে না। বিশেষ করে ‘এলি যখন আমার ঘরে, আমায় ছেড়ে যাস না তারা মা…’
কিংবা ‘আমার কাছে থাক মা কিছুক্ষণ…’
কুমার শানুর পরিণত কণ্ঠের অব্যর্থ পরিবেশনা গানগুলিকে শ্রোতাদের কাছে আরো বেশি করে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছে।
‘সিদ্ধিদায়িণী মা তারা’ সংকলনের সবক’টি গানের তালিকা নীচে দিয়ে দেওয়া হলো। শুনে দেখতে পারেন।
১.ও মা তারা তোকে ছাড়া মন বসে না আমার…
২.এলি যখন আমার ঘরে, আমায় ছেড়ে যাস না তারা মা..
৩. আমার কাছে থাক মা কিছুক্ষণ..
৪.তারা তারা ডেকে…
৫. জয় মা তারা জয় জয় তারা…
৬.বল জয় তারা জয় তারা বল জয় মা জয় তারা…
৭.জয় জয় তারা নাম তারা নাম…
৮.মহামায়ার খেলা চলছে…এই পর্যায়ে শানুদা শুধু যে প্রচুর বাংলা গান গেয়েছেন তা না। হিন্দি ভাষাতেও তার বেশ কিছু উচ্চমানের ভক্তিগীতির সংকলন আছে।
যেমন ১৯৯৬ সালে প্রখ্যাত সুরকার রাজেশ রোশনের সুরে অলকা ইয়াগনিকের সঙ্গে জুটি বেঁধে করা সর্বমোট আটখানা গানের বহুল আলোচিত অ্যালবাম—’মাতা রাণী কা ধ্যায়ান ধরিয়ে’।
হিন্দি নন ফিল্মি ডিভোশনাল সংকলন গুলির যদি তালিকা প্রকাশ করা হয়, আমার মনে হয় এই সংকলনটি অনেক উপরের দিকে থাকবে। এই সংকলনের ‘ন্যায়ন্ তেরে কিরনো ভরে লায়েগা সবেরা মিটেগা অন্ধেরা…গানটি কুমার শানুর ক্লাস গান গুলোর একটা। ক্লাসিক্যাল বেসড এই গানটিতে কুমার শানুর গায়কীর এক অজানা দিক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রথাগত ক্লাসিক্যাল শিক্ষা না থাকলেও, যে পরিমাণ আত্মবিশ্বাস আর তুখোড় মুন্সিয়ানার সাথে তিনি গানটি পরিবেশন করেছেন তাতে করে তাঁর সমালোচকদের হাতে শুধু মাত্র পেন্সিল ছাড়া কিছু থাকবে বলে মনে হয় না। তারপরেও আমরা ‘কুমার শানু ক্লাসিক্যালটা ঠিক গাইতে পারেন না’ এই জাতীয় অন্তহীন আলোচনায় নিজেদেরকে ব্যস্ত রাখবো।
‘মাতা রানী কা ধ্যায়ান ধরিয়ে’ সংকলনের সব কটি গানের তালিকা নীচে দেওয়া হলো—
১. জাউন্ জাহাঁ জাহাঁ পাউন্ বাহাঁ বাহাঁ…
২. মা জয় অম্বে মা, রকসা করো…
৩. মাতা রানী কা ধ্যায়ান ধরিয়ে…
৪.ন্যায়ণ তেরে কিরণো ভরে…
৫.ও শক্তিশালীয়ে দয়া দৃষ্টি হামপে ডালিয়ে…
৬. পেহনাও কোই লাল রঙ…
৭.স্বীকার করো জগদম্বে মা মেরি আরতি…
৮. তেরে দরশন সে মিলতি হ্যায় দিল কো সাহারে মা…
এর মধ্যে ৭ নম্বর গানটি অলকা ইয়াগনিকের একক কণ্ঠে গাওয়া। যদিও কুমার শানুর গাওয়া গান নিয়েই এই প্রতিবেদনটি লেখা, তথাপি এই গানটিকে তালিকায় না রাখলে সমগ্র সংকলনটি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। যার কারণে গানটিকে রেখে দেওয়া হলো।’পাগল করে দে মা তারা/ ভাবের পাগল করে দে না/ ভবের পাগল করিস নে মা/ভাবের পাগল করে দে না…’
২০১৬ সালের একেবারে গোড়ার দিকে রেকর্ড হওয়া আমার নিজের পছন্দের এই গানটি দিয়ে প্রতিবেদনটি শেষ করব। সাধক কল্যাণ বাবার কথায় ও শঙ্কর গোস্বামীর সুরে এই গানটিতে শানুদাকে আমরা পূর্বের সেই চেনা মেজাজে ফিরে পাই। একটা নিরীহ ডিভোশনাল গানকেও যে এই পর্যায়ে তুলে আনা যায় গানটি না শুনলে ঠিক লিখে বোঝানো যাবে না। সঙ্গত কারণেই গানের মধ্যে ‘পাগল করে দে মা তারা’ এই লাইনটা ঘুরেফিরে এসেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো এই লাইনটাই শানুদা ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে গেয়েছেন। যে কারণে গানটির উৎকর্ষতা একধাক্কায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা পর্যায়ে পাগল করে দে মা তারা…এই ‘পাগল’ শব্দটা তিনি উচ্চারণ করছেন ভেঙে ভেঙে। ‘পা-গ-ল করে দে মা তারা…’ মনে হচ্ছে তিনিও খানিকটা ভাবাবেগের মধ্যে আছেন। ছোট্ট একটা টাচ অথচ কী গভীর আর অর্থবহ।

পুনশ্চ : উপরে এতক্ষণ ধরে যে গানগুলি নিয়ে আলোচনা করলাম, এগুলো ছাড়াও কুমার শানুর বেশ কিছু হিন্দি/বাংলা ভক্তি গীতির সংকলন আছে। স্বল্প পরিসরে সবগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব নয়। তবে সেইসব সংকলনের নাম ও গানের তালিকা নীচে দিয়ে দিচ্ছি। যাতে করে এই পর্যায়ের গানে তাঁর ব্যপ্তি খানিকটা স্পষ্ট করা যায়।

-:তারানাম মহানাম :-
১. তারিণী তোমায় ভালোবাসি তাই…
২. ভয়টা কীসের ভয় কেন তোর…
৩. মন্ত্র পড়ে তোর পূজা হয়…
৪. জ্বলছে চিতা উঠছে ধোঁয়া…-: তারা মায়ের মিষ্টি হাসি:-
১. ভক্তি স্রোতে ভাসরে মন মায়ের দেখা পাবি/ না হয় বৃথাই মন্দিরে তুই মাকে খুঁজে যাবি…

-: দে মা পাগল করে:-
১. স্তোত্র পাঠ
২.দোষ কারো নয় গো মা…
৩.চাই না মা গো রাজা হতে…
৪.আমায় মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন…
৫. আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী…
৬.জেনেছি জেনেছি তারা…
৭. আমায় দে মা পাগল করে…
৯. আমায় একটু জায়গা দাও…

-: রাঙা চরণ:-
১.মা তোর রাঙা চরণ বুকে করে থাকবো আজীবন…

-:দয়াময়ী তারা মা:-
১.তুমি ঈশ্বরী পরমেশ্বরী…
২.তুই যে মা আমার দয়াময়ী তারা মা…

-:যদি কখনো:-
১. যদি কখনও ফিরে আসি…
২.আমার বাবা-মা তোমায় ডাকে মা…

-: সবার দূর্গা মা:-
১.সবার দূর্গা মা…

-:মাইয়া কা দরবার:-
১.সাঁচো রে মাইয়া কা নাম রে…
২.তেরি ভক্তি মে ডুবা মাইয়া…
৩.এক ঝলক কো তরসে নজরিয়া/মাইয়া দে দো দরশিয়া…
৪.সব মিল গাও সগুন মানাও…

-:মা কে চরণো মে:-
১.প্রভাত সে ভক্তো কি আজ…
২.হামকো মিলা ক্যায়া দ্বয়ার তুমহারা…
৩.মা সে ম্যায় দূর হুঁ…
৪.হ্যায় শস্ত্র হাথো মে…
৫.সোনা চান্দি না মাঙ্গু…

-:ভজন সরিতা:-
১.মাতা বৈষ্ণদেবী কা দরবার…

কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শোভনলাল রাহা, মঙ্গল সাধুখাঁ ও অর্ণব মুখার্জি।

Developed by