এইকাল নিউজ: করোনা আক্রান্ত হলেন বীজপুর ও নৈহাটির কোভিড যুদ্ধের তিন ফ্রন্টলাইনার। প্রথমজন নৈহাটি পুরসভার হেল্থ নডাল অফিসার সমীর সরকার ওরফে নন্দু । দ্বিতীয়জন হালিশহরের বিশিষ্ট সমাজসেবী তথা তৃণমূল নেতা শুভঙ্কর ঘোষ ওরফে সোনাই। আর তৃতীয়জন কাঁচরাপাড়ার বিশিষ্ট সমাসেবী তথা বরিষ্ঠ সিপিএম নেতা শম্ভু চট্টোপধ্যায়।
তিনজনের ব্যাক্তি পরিচয় ও রাজনৈতিক পরিচয় ভিন্ন হলেও একটি ক্ষেত্রে তাঁদের বিশেষ মিল। করোনা মোকাবিলায় তিনজনই সামনের সারির যোদ্ধা। যার কাছে আজ ফিকে হয়েছে তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়।
এই প্রতিবেদনের প্রথম সুপারস্টার সমীর সরকার। নৈহাটিতে নন্দু নামেই বেশি পরিচিত। সিপিএমের দীর্ঘদিনের পার্টি মেম্বার তিনি। পটু নেতৃত্বেও। নৈহাটি পুরসভার প্রাক্তন কর্মী। স্যানিটারি সিনিয়র ইন্সপেক্টর হিসাবে 2018 সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু পুরবোর্ড তৃণমূলের হলেও অত্যন্ত কর্মদক্ষ বামপন্থী মনস্ক এই অফিসারকে জনস্বার্থে হারাতে চাননি পুরপ্রধান অশোক চট্টোপাধ্যায়। ফলে নৈহাটি পুরসভার স্বাস্থ্য বিভাগের নোডাল অফিসার হিসাবে কর্মজীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেন নন্দুবাবু। করোনা পরিস্থিতিতে সকলের প্রিয় ‘নন্দুদা’ হয়ে ওঠেন পুর-প্রশাসনের অন্যতম ভরসা। করোনাকালে তিনি খুব ভালো কাজ করেছেন, মানছেন নৈহাটির বর্তমান পুর-প্রশাসক অশোক চট্টোপাধ্যায়ও। আর এভাবেই সামনের সারিতে কাজ করতে করতে তিনি নিজেই আজ করোনা আক্রান্ত। তবে কোভিড টেস্টের রিপোর্ট পজিটিভ এলেও এলাকার অন্যতম এই করোনা যোদ্ধা কাজের চাপের কথা ভেবে প্রথম অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি না হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং বাড়িতে আইসোলেশনে থেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ল্যাপটপে নৈহাটি পুর-এলাকার করোনা রোগীদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দেখভালের কাজ করতে থাকেন। কিন্তু অবস্থার অবনতির কারণে তাঁকে বাধ্য হয়েই পরে রাজারহাট কোভিড হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। হাসপাতালে ভর্তির আগে পর্যন্ত, করোনা আক্রান্ত অবস্থাতেই বেনজির ভাবে তিনি অনলাইন স্বাস্থ্য পরিসেবা দিয়ে গেছেন। অথচ এই ঘটনা জানে ক’জন! প্রচারবিমুখ সমীরবাবুর করোনা যুদ্ধে এহেন কর্মকাণ্ড তাই থেকে গেছে প্রচারের আড়ালেই।
দ্বিতীয় সুপারস্টার সিপিএমের কাঁচরাপাড়া এরিয়া কমিটির সদস্য শম্ভু চট্টোপাধ্যায়। এক সময় লোকাল কমিটির সম্পাদক ছিলেন। গোষ্ঠী কোন্দলের জন্য আরও উঁচু পোস্ট পাওয়ার দাবিদার হলেও পাননি।
কিন্তু বিশিষ্ট সমাজসেবী শম্ভুবাবু সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে এলাকা এবং এলাকার বাইরে সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন করোনা আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত। তিনি করোনা আবহে পিছিয়ে পড়া শ্রমিক ও অসংগঠিত মজুরদের সর্বদা সহযোগিতা করে গিয়েছেন। সহকর্মীদের নিয়ে নিয়মিত ত্রাণ বণ্টন করেছেন। আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত সীমান্তবর্তী বাগদা, হেলেঞ্চা অঞ্চলেও তিনি ত্রাণ বন্টন করে এসেছেন। শম্ভুবাবু বরাবরই সংষ্কৃতি মনস্ক মানুষ। যাঁরা গানবাজনা করে সংসার চালান, অথচ করোনা পরিস্থিতিতে সংসার চালাতে পারছেন না, এমন বহু শিল্পীকে তিনি সাহায্য করেছেন প্রচারের আড়ালে থেকেই। করোনা আক্রান্ত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে সমাজসেবা চালিয়ে গেছেন।
তৃতীয় সুপারস্টার শুভঙ্কর ঘোষ ওরফে সোনাই হালিশহর পুর এলাকায় একটি পরিচিত নাম। ছাত্র রাজনীতি থেকে তিনি উঠে এসেছেন। হঠাৎ গজিয়ে ওঠা নেতা নয়, দল রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই বুক চিতিয়ে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ করেছেন দাপটের সঙ্গে। তৃণমূল ছাত্রনেতা হিসাবে সুপরিচিত হলেও পরে বৃহত্তর রাজনীতিতে প্রবেশ। বিশেষ করে হালিশহরের সদ্য প্রাক্তন পুরপ্রধান অংশুমান রায়ের ছায়া সঙ্গী। এলাকায় জবরদস্ত সংগঠন আছে তাঁর । কিন্তু এসবের বাইরেও তাঁর পরিচয়, তিনি করোনা যুদ্ধের প্রথম সারির সৈনিক। করোনা পরিস্থিতিতে নিজস্ব ক্লাবের উদ্যোগে তিনি আরও কয়েকজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে খাদ্য বণ্টন, দুঃস্থদের সাহায্য ইত্যাদি করে চলেছিলেন। শুধু তাই নয়, আমফানের পর তিন দিন তিন রাত জেগে তিনি প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবিলায় পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সহযোগিতা করেছেন বলে জানিয়েছেন বীজপুরের আইসি কৃষ্ণেন্দু ঘোষ। ফ্রন্টলাইনার হিসাবে কাজ করায় তিনি নিজে থেকেই কোভিড টেস্ট করিয়েছিলেন। রিপোর্ট পজিটিভ আসায় আপাতত তিনি নৈহাটির সেফ হোম-এ চিকিৎসাধীন। ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি মানুষের কাছে এই বার্তাই দিতে চাই যে, করোনা হলে ভেঙে পড়বেন না এবং এলাকায় কারও করোনা হয়েছে শুনলে সেই পরিবারকে একঘরে করে দেবেন না। বেশিরভাগ মানুষই করোনা হলে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন । আমিও আশাবাদী, খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আবারও নিজেকে সমাজ সেবামূলক কাজে নিয়োজিত করতে পারব।’
নৈহাটির সেফ হোমের পরিষেবার প্রশংসা করেন সোনাই। জানান, ‘দুই বেলা ডাক্তার দেখছেন। খাওয়া-দাওয়া খুবই উন্নত মানের। পরিষেবা খুবই ভালো।’ সূত্রের খবর, ক্রমশ সুস্থ হয়ে উঠছেন সোনাই। এক-দু’দিনের মধ্যেই সুস্থ হয়ে ফিরতে পারেন বাড়ি। একইভাবে খুব শীঘ্র করোনাকে জয় করে বাড়ি ফিরবেন শম্ভুবাবু ও সমীর বাবুও।
সমীর ওরফে নন্দুবাবুর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি ভর্তি আছি রাজারহাট কোভিড হাসপাতালে। ঝা-চকচকে হাসপাতাল। একথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে, চিকিৎসা ব্যবস্থা এককথায় অভূতপূর্ব।’
এইকাল -এর পক্ষথেকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে করোনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে ফিরে আসার পরে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই তিন ফ্রন্ট লাইনার সুপারস্টারকে এইকাল স্মারক সম্মানে ভূষিত করা হবে।