Breaking
11 Apr 2025, Fri

আন্তর্জাতিক কিংবদন্তি সুরকার আলাউদ্দিন ও কুমার শানুর যুগলবন্দী গান অবিস্মরণীয়

লিখছেন এইকাল এর প্রতিনিধি তারকনাথ দত্ত

Advertisement

২০২০ সালটা এবারে একবারে খালি হাতে আসেনি। সঙ্গে করে এনেছে এক মারণ বিষ। একটি অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ভাইরাসের বিষাক্ত ছোবল বিশ্বকে কাঁপাচ্ছে, কাঁদাচ্ছে। যে বিষের বিষক্রিয়ায় গোটা পৃথিবীটা যেন বিনাশের প্রাক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে অন্তিম যাত্রার প্রহর গুনছে। যার ফল স্বরূপ এখনও পর্যন্ত বেশ কয়েকজন গুণী মানুষকে আমরা অকালে হারিয়েছি। সেই তালিকায় নতুন সংযোজন আলি সাহেব। বাংলা সংগীত জগতের এ এক অপূরণীয় ক্ষতি।

যাঁরা তাঁকে চেনেন না, তাঁদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, কে এই আলাউদ্দিন আলি? আলাউদ্দিন আলি ১৯৫২ সালের ২৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের টংগিবাড়ি থানার বাঁশবাড়ি গ্রামের এক সাংস্কৃতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। আলাউদ্দিন আলি সেই ব্যক্তি, যিনি ১৯৬৮ সালে একজন যন্ত্রশিল্পী হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু করেছিলেন। তারপর কালে কালে তাঁর বাংলাদেশের একজন প্রথম সারির সংগীত পরিচালক হয়ে ওঠার জার্নিটা নেহাত কম ঘটনাবহুল নয়। এই গোটা জার্নিতে তিনি অগুনতি ভালো মানের বাংলা গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। তাঁর কর্মই তাঁকে উপমহাদেশের একজন দিকপাল সংগীত পরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করার প্রেক্ষিতে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। ওপার বাংলার বিখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি তিনি ভারতীয় সংগীত শিল্পীদের নিয়েও প্রচুর কাজ করেছেন। এই পর্যায়ে তিনি সব থেকে বেশি যার সঙ্গে কাজ করেছেন, তিনি আমাদের সকলের প্রিয় কুমার শানু। নয়ের দশকে কুমার শানু, আলাউদ্দিন জুটি দুই বাংলায় রীতিমত সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশের একের এক পর বাণিজ্যকে ভাবে সফল ছবির মূল গায়ক হিসেবে কুমার শানুর বিরাট ভাবে আত্মপ্রকাশের পিছনে আলি সাহেবের অবদান অস্বীকার করার কোনও জায়গা নেই। লক্ষণীয় বিষয় হল, বাংলাদেশি শ্রোতারা শানুদাকে নিয়ে বরাবরই বাড়তি উচ্ছ্বাস দেখিয়ে এসেছেন। তারকাঁটার বেড়া এক্ষেত্রে কোনওভাবেই অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। সে দেশে শানুদা’র জনপ্রিয়তার একটা বড় কারণ, তিনি একজন বাঙালি।

নয়ের দশকে বাংলাদেশ রেডিওতে কান পাতলেই শোনা যেত সে দেশের চলচ্চিত্রগুলোতে শানুদার গাওয়া বিখ্যাত বিখ্যাত সব গান অনবরত বেজে যাচ্ছে। তার মধ্যে বেশির ভাগ গানেরই সুরস্রষ্টা ছিলেন সদ্য প্রয়াত আলি সাহেব। মনে আছে, আমি তখন অনেক ছোট। সুযোগ পেলেই রেডিওর নব ঘুরিয়ে বাংলাদেশ রেডিও চালিয়ে বসে থাকতাম। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম কখন একটা কুমার শানুর গান বেজে উঠবে। বাংলাদেশ রেডিওর মিষ্টভাষী ঘোষক বা ঘোষিকা যখন ঘোষণা করতেন, এবারে ‘আত্মত্যাগ’ ছবি থেকে একটি গান—’এ জীবন তোমাকে দিলাম বন্ধু, তুমি শুধু ভালোবাসা দিও…’
গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন কুমার শানু ও মিতালি মুখার্জি। গানটিতে সুর দিয়েছেন আলাউদ্দিন আলি। গানটি শুনতে চেয়ে অনুরোধ করেছেন চট্রগ্রাম থেকে আবেদ আলি (নামটা অবশ্য প্রতীকী)।’
কখনও বা ‘চরম আঘাত’ ছবির—
‘ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয়, তোমায় নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে বড় ইচ্ছে হয়…’
এই গানেও গায়ক গায়িকা অপরিবর্তিত। সেই কুমার শানু, মিতালি মুখার্জি। সুরকার আবারও সেই প্রবাদপ্রতিম আলাউদ্দিন আলি। কিংবা ‘প্রিয় তুমি’ ছবি থেকে আলি সাহেবের মন মাতানো সুরে সেই বিখ্যাত গান—’তুমি এমন কোনও কথা বলো না…’
এই গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন ওপার বাংলার উমা খান ও কুমার শানু।
উপরে যে তিনটে গানের কথা বললাম, বাংলাদেশি শ্রোতাদের হৃদয়ের খুব কাছাকাছি থাকা তিনটে গান। এখনও শ্রোতাদের মুখে মুখে ফেরে। আরও আছে।

আমি কোনও সঙ্গীত বিশারদ নই। কুমার শানুর গানের সূত্র ধরেই আলি সাহেবের কাজের সঙ্গে আমার পরিচয়। তাতে করে আমার যেটা মনে হয়েছে,
আলি সাহেবের সুর করার ধরন অন্যান্য দিকপাল সুরকারদের তুলনায় অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি। অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা নিরীক্ষায় তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল বলে মনে হয় না। অযথা দেখনদারির কচকচানিতে না গিয়ে সনাতনী ধারার সুরের প্রতিই তাঁর গভীর আস্থা ছিল। যে সুর সাধারণ শ্রোতাদের হৃদয়কে খুব সহজেই আন্দোলিত করে। শ্রোতার বোধগম্য হবে এমন সুর। এই জাতীয় সুরের বিশেষত্ব হল, সাধারণ শ্রোতারা এই ধারার সুরের সঙ্গে খুব সহজেই নিজেকে রিলেট করতে পারেন। এপার বাংলার আরেকজন বিখ্যাত সুরকার প্রয়াত অজয় দাশের মধ্যে এই প্রচেষ্টা ভীষণ ভাবে ছিল। এবং অবশ্য করেই এটি একটি ফলবতী প্রচেষ্টা। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্য যে, সমাজের তথাকথিত উঁচু তলার মানুষেরা একজন শিল্পীকে স্টার বানায় না। মাটির কাছাকাছি থাকা সাধারণ মানুষগুলোই এক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা নিয়ে থাকে। আলি সাহেব এটা বিলক্ষণ বুঝতেন। তিনি নিজেকে এই সম্প্রদায়ের মানুষ বলেই আজীবন মনে করে এসেছেন। সহজিয়া সুর, যার আয়ুষ্কাল দীর্ঘস্থায়ী। কুমার শানু এই উপমহাদেশের সর্বকালের সেরা গায়কদের অন্যতম, এটা নিয়ে খুব বেশি দ্বিমত থাকার কথা না। বস্তুত তিনি তাঁর পূর্বসূরীদের মতো নিজের বিশাল কর্মকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে একটা নিজস্ব ‘ঘরানা’ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আদর্শ পরিসর এটা অবশ্য নয়।

আমরা কথা বলছিলাম আলাউদ্দিন আলি আর কুমার শানুর যুগলবন্দী নিয়ে। অসংখ্য ভালো গান এঁরা আমাদের উপহার দিয়েছেন। বাংলাদেশে কুমার শানুর ধারাবাহিক জনপ্রিয়তা পাওয়ার মুখ্য কারিগর যে আলি সাহেব, সে বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ নেই। একের পর এক বিখ্যাত গান তিনি কুমার শানুকে দিয়ে গাইয়েছেন। আমাদের এখানে একটা সময় কুমার শানু আর অলকা ইয়াগনিক জুটি বিরাট জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে কাজ করার সুবাদে এঁদের দু’জনের মধ্যে একটা দুর্দান্ত বোঝাপড়া তৈরি হয়েছিল। আক্ষরিক অর্থেই এনারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে উঠেছিলেন। পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এই পরিমাণ বিশালতা না থাকলেও এর অনেকটা কাছাকাছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র গানেও কুমার শানু আর মিতালী মুখার্জির একটা সুন্দর যুগলবন্দী আমরা দেখতে পাই। এই জুটি বেশ কিছু চমৎকার মেলোডিয়াস গান আমাদের উপহার দিয়েছেন। বিখ্যাত বিখ্যাত সব গান। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এই সমস্ত গানের ৯৯ শতাংশেরই সুরকার ছিলেন আলাউদ্দিন আলি সাহেব। প্রতিটা গানই সুখশ্রাব্য। গানগুলির মধ্যে অদ্ভুত এক মন ছুঁয়ে যাওয়া ব্যাপার আছে।
বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর একটা আন্তরিক সাক্ষাৎকার চাক্ষুষ কবার সৌভাগ্য হয়েছিল। অন্তরঙ্গ আলাপচারিতায় একটা সময় অবধারিতভাবে কুমার শানুর প্রসঙ্গ চলে এল। কুমার শানুর নাম উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আটবারের জাতীয় পুরস্কার বিজয়ী সংগীত পরিচালকের চোখেমুখে যেন একরাশ মুগ্ধতাই ঝরে ঝরে পড়ছিল। তাঁর কথাবার্তা শুনে বেশ বোঝা যাচ্ছিল, কুমার শানুর সঙ্গে কাজ করে তিনি তৃপ্ত। প্রসঙ্গত বলে রাখি, আলাউদ্দিন আলি সাহেব যে একজন উচ্চমানের সংগীত পরিচালক ছিলেন তাই না, তিনি অসাধারণ গীতিকারও ছিলেন। ওঁর আটবার জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্যে সাতবার সংগীত পরিচালক হিসেবে, আর একবার গীতিকার হিসেবে।

আলাউদ্দিন আলি সাহেবের সুর করা আরও একটা গানের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ে যাচ্ছে— ‘সাগরিকা’ ছবি থেকে, ‘হৃদয়ের মাঝে তুমি আছো তবু, নয়নের মাঝে কেন পাই না…’
আরও আছে। যেমন পরদেশি বাবুর সেই মনকাড়া গান—
‘কখনও দেখিনি আমি, কখনও আঁকিনি আমি এমন রূপসী কোনও ছবি…’

যে গানগুলি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করলাম, এই বাইরেও বেশ কিছু গান আলাউদ্দিন সাহেবের সুরে শানুদা গেয়েছেন। আলি সাহেবের সুর করা মনমাতানো সেইসব গানগুলির তালিকায় একটু চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক—

১. পাবার সময় হতে না হতেই যাবার সময় হয়ে গেল (ছবি- বাঁচার লড়াই)
২.ভালোবাসার স্বাদ পূর্ণ তো হয় না কারো কোনদিন (ছবি-বাঁচার লড়াই)
৩.শতবার পৃথিবীতে আসব আমি, তোমাকেই শুধু ভালোবাসবো আমি (ছবি-এ জীবন তোমার আমার)
৪.আমাকে দুঃখ দিয়ে তুমি কাঁদবে (এ জীবন তোমার আমার)
৫.ভালোবাসা পেলে চাওয়া বেড়ে যায়(পৃথিবী তোমার আমার)
৬. অন্তর কাটিয়া দেব, কলিজা ছিঁড়িয়া দেব তোমারে (অ্যালবাম- অন্তরে তুমি)
৭. রূপসী এই বুকে জ্বেলেছ আগুন (ছবি- আত্মত্যাগ)
৮.এখন থেকে ভালোবাসায় নেই কারফিউ (ছবি- প্রিয় তুমি)
৯. আমাদের পৃথিবীতে তোমরা দু’জন ( ছবি- প্রিয় তুমি)
১০. আমার হবে সেই বউ (শেষ রক্ষা)
১১. তোমার পথে তুমি যাও (শেষ রক্ষা)

২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। সালটা ছিল ২০১৮। এই বছর স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আলাউদ্দিন আলি সাহেব চমৎকার একখানি গান বাঁধলেন। গানের কথা লিখেছিলেন প্রয়াত জিয়া আহমেদ শেলি। গানের শিরোনাম ছিল ‘সবুজ গ্রাম’। এটা আদতে দেশ মাতৃকাকে বন্দনা করার একটা ফলবতী প্রচেষ্টা। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল দীর্ঘ বিরতির পর আলি সাহেব এই গুরুত্বপূর্ণ গানটি গাওয়ালেন শানুদাকে দিয়ে। ভাবা যায়!
গানটি ছিল—
‘একটা সবুজ গ্রাম আমায় ঘুরে ফিরে ডাকে,
আমার মন বলে যাই যাই, আর বাংলার গান গাই…’
শানুদা গেয়েছিলেনও ভারি চমৎকার।
আলাউদ্দিন আলি সাহেব আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ফুসফুসের প্রদাহ ও রক্তজনিত সংক্রমণে ভুগছিলেন। উপর্যুপুরি গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মত ক্যান্সার নামক মারণ ব্যাধি তাঁকে ভীষণভাবে কাবু করে ফেলেছিল। দীর্ঘসময় ধরে লাইফ সাপোর্টে থাকার পর গত রবিবার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মাঝে মাঝে মনে হয়, মানুষের আয়ু কাল খুবই সংক্ষিপ্ত। এমন বিরল প্রতিভা নিয়ে যে মানুষটি সৌর জগতে এসেছিলেন, তাঁর কর্মকাল সীমাবদ্ধ।
জগতে কোনও আঘাতের যন্ত্রণাই দীর্ঘস্থায়ী নয়। সময় সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। কোন যন্ত্রণার তীব্রতা যত বাড়ে যন্ত্রণার অনুভূতি তত বিলীন হতে থাকে। মানুষ চলে যায়, রেখে যায় তাঁর যাবতীয় কর্মকাণ্ড। আমরা তাঁর সেই কর্মকাণ্ড গুলোর মধ্যে দিয়ে তাঁকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করি। আসুন, আলাউদ্দিন সাহেবের সুর করা শানুদার গাওয়া সেই বিখ্যাত গানটি দিয়ে তাঁর বিদায় বেলায় শেষ শ্রদ্ধাটুকু নিবেদন করি—

ভালোবসা যত বড় জীবন ততো বড় নয়,
তোমায় নিয়ে হাজার বছর বাঁচতে বড় ইচ্ছে হয়…

Developed by