Breaking
11 Apr 2025, Fri

ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি ভারতরত্ন প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রয়াত

এইকাল নিউজ:

নক্ষত্র পতন। চলে গেলেন ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য প্রণব মুখোপাধ্যায়।বয়স হয়েছিল প্রায় ৮৫ বছর। সোমবার বিকেল পৌনে ছ’টা নাগাদ তাঁর পুত্র অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় টুই ট করে এ খবর জানিয়েছেন।
2019 সালে ভারতরত্নে ভূষিত হন তিনি। 2012 থেকে 2017 তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন।

Advertisement

এক দিকে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এবং অস্ত্রোপচার, তার উপর করোনা সংক্রমণ— জোড়া ধাক্কা সামলাতে পারলেন না তিনি।
দিল্লির আর্মি হসপিটাল রিসার্চ অ্যান্ড রেফারালেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলেন স্বাধীনতা উত্তর সর্বভারতীয় রাজনীতির সফলতম বাঙালি এবং দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

গত ৯ অগস্ট রাতে নিজের দিল্লির বাড়িতে শৌচাগারে পড়ে গিয়েছিলেন প্রণববাবু। পর দিন সকাল থেকে তাঁর স্নায়ুঘটিত কিছু সমস্যা দেখা দেয়। বাঁ হাত নাড়াচাড়া করতে সমস্যা হচ্ছিল। চিকিৎসকদের পরামর্শে দ্রুত ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। এমআরআই স্ক্যানে দেখা যায়, তাঁর মাথার ভিতর রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নেন চিকিৎসকরা। কিন্তু অস্ত্রোপচারের পর অবস্থার উন্নতি হয়নি। ১৩ অগস্ট থেকে তিনি গভীর কোমায় চলে যান। তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীসহ অনেকে।

প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় ১১ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। ৩১ আগস্ট ২০২০ সোমবার প্রয়াত হলেন।

ভারতের ত্রয়োদশ রাষ্ট্রপতি হয়ে জুলাই, ২০১২-এ কার্যভার গ্রহণ করেন। তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবন ছয় দশকব্যাপী। তিনি ছিলেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা। বিভিন্ন সময়ে ভারত সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছিলেন। ২০১২ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী ও কংগ্রেসের শীর্ষস্থানীয় সমস্যা-সমাধানকারী নেতা।

১৯৬৯ সালে তদনীন্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাহায্যে প্রণব মুখোপাধ্যায় ভারতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় কংগ্রেস দলের টিকিটে নির্বাচিত হন। এরপর রাজনৈতিক কর্মজীবনে তার দ্রুত উত্থান শুরু হয়। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর একজন বিশ্বস্ত সহকর্মীতে পরিণত হন এবং ১৯৭৩ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ক্যাবিনেট মন্ত্রিসভায় স্থান পান। ১৯৮২-৮৪ পর্বে তিনি ছিলেন ভারতের অর্থমন্ত্রী। ১৯৮০ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত তিনি রাজ্যসভার দলনেতাও ছিলেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় বিভিন্ন সময়ে ভারতের বিদেশ, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ, রাজস্ব ইত্যাদি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের দায়িত্ব পালনের বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। ভারত-মার্কিন অসামরিক পরমাণু চুক্তি সাক্ষরের মতো বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার অবদান অনস্বীকার্য। দলের প্রতি আনুগত্য ও অসামান্য প্রজ্ঞা এই বাঙালি রাজনীতিবিদকে কংগ্রেস দলে ও এমনকি দলের বাইরেও বিশেষ শ্রদ্ধার পাত্র করেছে। দেশের প্রতি অবদানের জন্য তাকে ভারতের সর্বোচ্চ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন ও পদ্মবিভূষণ এবং শ্রেষ্ঠ সাংসদ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। ১৯৮৪ সালে,যুক্তরাজ্যের ইউরোমানি
পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হন।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার কীর্ণাহার শহরের নিকটস্থ মিরিটি গ্রামে। তার পিতার নাম কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ও মাতার নাম রাজলক্ষ্মী দেবী।

বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী কামদাকিঙ্কর ১৯২০ সাল থেকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনকালে তিনি দশ বছর কারারুদ্ধ ছিলেন। পরে কামদাকিঙ্কর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি এবং পশ্চিমবঙ্গ বিধান পরিষদের সদস্য (১৯৫২-৬৪) হন; তিনি বীরভূম জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতির পদও অলংকৃত করেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজের ছাত্র ছিলেন; এই কলেজটি সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল।

প্রণব মুখোপাধ্যায় একজন কলেজ শিক্ষক রূপে তার কর্মজীবন শুরু করেন। পরে তিনি সাংবাদিকের কাজও করেন কিছুকাল। এই সময় তিনি দেশের ডাকনামে একটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ট্রাস্টি ও পরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য-সম্মেলনের সভাপতিও হন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় কর্মজীবনে প্রথম দিকে হাওড়া জেলার বাঁকড়ায় অবস্থিত “বাঁকড়া ইসলামিয়া হাইস্কুল”র ২ বছর শিক্ষকতা করেছেন।

প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রায় পাঁচ দশক ভারতীয় সংসদের সদস্য। ১৯৬৯ সালে তিনি প্রথম বার কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিস্বরূপ রাজ্যসভায় নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭৫, ১৯৮১, ১৯৯৩ ও ১৯৯৯ সালেও তিনি রাজ্যসভায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে কেন্দ্রীয় শিল্পোন্নয়ন উপমন্ত্রী হিসেবে তিনি প্রথম ক্যাবিনেটে যোগদান করেন।

ক্যাবিনেটে ক্রমান্বয়ে পদোন্নতির পর ১৯৮২ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে ইউরোমানি পত্রিকার একটি সমীক্ষায় তাকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ পাঁচ অর্থমন্ত্রীর মধ্যে অন্যতমের শিরোপা দেওয়া হয়। তাঁর মন্ত্রীত্বকালের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল ভারতের আন্তর্জাতিক অর্থভাণ্ডারের ঋণের শেষ কিস্তির ১.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থ না তোলা। তার এই মন্ত্রীত্বকালে ড. মনমোহন সিংহ ছিলেন ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর। ইন্দিরা হত্যার অব্যবহিত পরে একটি দলীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের শিকার হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। এই সময় রাজীব গান্ধী তাকে নিজের ক্যাবিনেটে স্থান দেননি। কিছুকালের জন্য তাকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। এই সময় তিনি রাষ্ট্রীয় সমাজবাদী কংগ্রেস নামে নিজস্ব একটি দলও গঠন করেছিলেন। তবে ১৯৮৯ সালে রাজীব গান্ধীর সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার পর এই দল নিয়ে তিনি আবার কংগ্রেসে যোগ দেন।

Developed by