Breaking
11 Apr 2025, Fri

আধুনিক বাংলা সাংবাদিকতার দিশারী সুমন চট্টোপাধ্যায়

সুকুমার মিত্র


সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় খুব শীঘ্রই বাংলা সংবাদ মাধ্যমে বুক চিতিয়ে দাপিয়ে ফিরবেন এমনটাই আশা বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক পুরস্কারপ্রাপ্ত

Advertisement

(কেসিকে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ইন প্রিন্ট জার্নালিজম ফর ‘আগলি ট্রুথ ইন নন্দীগ্রাম’, প্রসাদ সাহিত্য পুরস্কার-সহ বহু সম্মানে সম্মানিত) সাংবাদিক সুকুমার মিত্র-র। তিনি সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন- সম্পাদক

আমি সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষকে খুব কাছের থেকে দেখেছি, মিশেছি। তবে তাঁর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাইনি। পেয়েছি তাঁর আন্তরিক স্নেহ, ভালবাসা ও শুভেচ্ছা। সে অন্য প্রসঙ্গে, একেবারে পারিবারিক জীবনের সংগ্রামের সাথী হিসাবে। আনন্দবাজার পত্রিকা দফতরে বেশ কয়েকদিন আমাকে ও আমার স্ত্রী তহমীনা খাতুনকে ডেকে নিয়ে আড্ডা দিয়েছেন। নিছক আড্ডা নয়, দুপুরে ভরপেট খাইয়েও দিয়েছেন। তাঁর আগে ‘ভারত কথা’ পত্রিকায় সম্পাদক বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়-এর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। রবিবারের পাতায় বিশেষ নিবন্ধ লেখার সুবাদে। সত্যি কথা বলতে কী, নয়ের দশকের শুরুতে আমি যে দৈনিক পত্রিকায় কাজ করতাম, এক চক্রান্তের শিকারে সেই পত্রিকার সম্পাদক ধৃত হলেন। আমাদের বেতন বন্ধ হয়ে গেল। পত্রিকা বাঁচাও কমিটি গড়ে কয়েক মাস পত্রিকাটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করলেও দৈনিক পত্রিকা চালানোর মতো রসদ তৎকালীন বাম শাসকদের চোখ রাঙানির ভয়ে কেউ আমাদের দিতে রাজি হননি। সব মিলে শ’দুয়েক কর্মীর চাকরি চলে গেল। চাকরি হারানোর কী জ্বালা, তা বাংলা সংবাদপত্রের বেশ কিছু সাংবাদিক ও সংবাদকর্মী গত এক দশক ধরে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এরপর নানা পত্রিকায় কাজ করেছি। চাকরি গিয়েছে, বেঁচে থাকার জন্য, সংসার চালানোর জন্য কী না করেছি। সেসব বলার জন্য এই লেখা নয়। তবে সাংবাদিকদের চাকরি গেলে সুমনদার মন যে খারাপ হয়, তা বন্দি জীবনের লেখাতেও ধরা রয়েছে। আধুনিক বাংলা সংবাদের দিশারী যাঁকে বলতেই হয়, সেই সাংবাদিক-সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের কথা বলছি। এই প্রসঙ্গে বলতে হয় যেমনটি বাংলা আধুনিক গানকে এক মোচড় দিয়ে ঘুরিয়ে আলোড়ন ফেলে ছিলেন নাগরিক কবিয়াল কবীর সুমন (সেই সময় সুমন চট্টোপাধ্যায়)। দুই সুমনই একসঙ্গে কাজ করেছেন আজকাল ও কলকতা টিভিতে। এইসব কথা বলার জন্য এই লেখা না।

সম্পাদক-সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায় প্রসঙ্গে আমার একটা দায়বদ্ধতা ও কৃতজ্ঞতা থেকে বেশ কয়েক মাস ধরে লেখার প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। ফেসবুকে প্রবাদপ্রতীম এই সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে খিল্লি করতে দেখেছি তাঁদেরকে, যাঁদের পেশাগত পরিচয় সাংবাদিক। লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে যায়। এটা হয়তো এই বঙ্গের বা বিশেষত কলকাতার বাঙালি সাংবাদিকদের বৈশিষ্ট্য । সাংবাদিক না বলে এঁদের ‘সংবাদ জগতের মাফিয়া’ বলাই ভালো। নানাভাবে সুমনদার কাছে উপকৃত এমন সাংবাদিকরা যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় জ্ঞানগর্ভ পোস্ট দিয়ে থাকেন, তখন স্বার্থপরতা ও নীচুতার কোন স্তরে এঁরা নামতে পারেন, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এমনকী, সম্প্রতি সুমনদার অসুস্থতা নিয়েও নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে পরিকল্পিতভাবে।

কেন আজও সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে এত ভয়? এই প্রশ্নের অনুসন্ধান করতে বেশি চিন্তার প্রয়োজন নেই। সু্মন চট্টোপাধ্যায় মিডিয়া জগতে পুরোদমে ফিরে এলে এঁদের অনেকের নেতাদের বাড়ির বাজার করার চাকরি করতে হবে। এ ব্যাপারে আমার কোনও সংশয় নেই। আসলে এঁদের অনেকেই হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ফলে সাংবাদিকতার নৈতিকতা বন্ধক রেখে যা খুশি তাই করছেন সাংবাদিকতার নামেই।

তখন আমি কলকাতার একটি দৈনিকে এক সংবাদ মাফিয়ার অনৈতিক দৌরাত্মের প্রতিবাদে (যদিও সেই পত্রিকার সম্পাদক-সহ সাংবাদিকরা আমাকে ভালবাসতেন বা আজও ভালবাসেন) চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে কিছু দিন অন্য কাজ করছি। এই সময় বন্ধু পার্থ দাশগুপ্ত ও প্রবীরদা (ভট্টাচার্য) সুমন চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘একদিন’ পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে একটি করে উত্তর সম্পাদকীয় লেখার সুযোগ করে দেন এবং লেখার বিনিময়ে নির্দিষ্ট অর্থও আমাকে দিয়ে সাহায্য করেছেন। একদিন প্রবীরদাকে (প্রবীরদা সুমনদার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়) বললাম, ‘দাদা একটা চাকরির ব্যবস্থা করা যায় না?’ প্রবীরদা বললেন, ‘সুমন (সম্পাদক, একদিন) তো তোমায় জানে। তুমি সরাসরি ওকে একদিন দুপুরে এসে প্রস্তাব দাও।’ পরের দিন একটি জীবনপঞ্জী (বায়োডাটা) পকেটে নিয়ে সুমনদার ঘরের দরজা ঠেলে বললাম, ‘সুমনদা আমার নাম সুকুমার মিত্র। আপনার কাছে একটা আবেদেন আছে।’ উনি ডেকে বসতে বললেন। জানতে চাইলেন কী আবেদন? আমি তাঁকে বললাম, ‘চাকরিটা তো চলে গেল। না খেয়ে মরতে হবে, ঘরভাড়া দিতে পারব না। আপনি একটা চাকরি দিতে পারেন না?’ তিনি শুনে বললেন, ‘তোকে কাজ দিলে তুই তো নন্দীগ্রাম চলে যাবি। তাছাড়া তোর সর্বশেষ বেতন ২৫ হাজার টাকা তো দিতে পারব না। এই বেতন এখানে নিউজ এডিটর পায় না।’ আমি বললাম, ‘আমার ওই টাকাটা লাগবেই।’ বেশ মনে আছে, নিউজ এডিটর সৌভিক ঘোষকে ডেকে বললেন, ‘সুকুমার তো তোর থেকে বেশি বেতন চাইছে। তোর কোনও আপত্তি রয়েছে?’ অত্যন্ত ভদ্র, বিনয়ী সৌভিক সেদিন বলেছিলেন, ‘সুকুমারদা সিনিয়র জার্নালিস্ট। ওনাকে বেশি দিলে আমার কোনও আপত্তি থাকার কারণ নেই।’ সুমনদা আমাকে বললেন, স্পেশাল করসপন্ডেন্ট হিসেবে লেফট বিটে কাজ করতে হবে। লেফট বিট-দিলেন আর মজা করে বললেন, ‘এটা তোর শাস্তি। আর চিফ রিপোর্টারকে নয়, খবর হয় নিউজ এডিটর বা আমাকে দিবি।’ যতদিন ছিলাম, কাজ করেছি। তারপর সুমনদার ‘একদিন’ কাগজের হাত বদল হয়ে গেল। সুমনদা চলে গেলেন ‘এই সময়’-এর সম্পাদক হয়ে। আমাদের কয়েকজনকে রেখে গেলেন। কিন্তু যাঁদের রেখে গেলেন, তাঁদের সঙ্গে এক মাসও কাজ করার মতো পরিস্থিতি ছিল না। মান-সম্মান বাঁচাতে চাকরি ছাড়তে হল। কিন্তু এক অভিমানে সুমনদার কাছে সেই সময় গেলাম না। কষ্টে দিন কেটেছে। তবে সুমনদার প্রতি অভিমান ছিল ঠিকই, কিন্তু তা ছিল শ্রদ্ধা ও ভালবাসা মিশ্রিত। সুমনদাকে প্রথমদিন কথাবার্তার পর যখন বায়োডাটার কাগজটি আগিয়ে দিয়েছিলাম, উনি বললেন, ‘ওটা কী?’ আমি বললাম, ‘বায়োডাটা’। তার উত্তরে সম্পাদক সুমনদা বলেছিলেন, ‘সাংবাদিকের বায়োডাটা দেখে যদি চাকরিতে নিতে হয়, তাহলে তাঁর সম্পাদক না থাকাই উচিত।’ ওই বায়োডাটা এইচআর ডিপার্টমেন্টে জমা দিয়ে যেতে বললেন। এও বললেন, ওদের প্রেসকার্ড, বেতন ইত্যাদি কারণে প্রয়োজন হয়। এই কথাটি আমি আমার কর্মজীবনে কোনও সম্পাদকের নিকট শুনিনি। বরং আমাদের মতো সিনিয়র রিপোর্টারদের লিখিত পরীক্ষায় বসতেও বাধ্য করা হয়েছে। আসলে চাকরিটা তো দরকার।
আমি বিশ্বাস রাখি, বাংলা সংবাদ মাধ্যমে আবারও সুমন চট্টোপাধ্যায় বুক চিতিয়ে দাপিয়ে বেড়াবেন। সেই দিনের হয়তো বেশি দেরি নেই। তিনি সংবাদপত্র ও বৈদ্যুতিন সংবাদ মাধ্যম দুইই গড়তে জানেন, সাংবাদিক চেনেন। আর তাঁকে যে কারণে হাজতবাস করতে হয়েছে, তার ভিত্তি কী জানি না। তবে ‘একদিন’ পত্রিকাকে বাঁচানোর জন্য সুমনদা অনেকের কাছে ছোট হয়েছেন। পত্রিকা বাঁচলে অনেকগুলি পরিবার বাঁচবে, এই লক্ষ‌্য নিয়েই সুমনদা নানা প্রতিষ্ঠান ও মানুষের কাছে হাত পেতেছেন। অল্পদিনের মধ্যে একটা বিশেষ মানের দৈনিক হিসেবে ‘একদিন’ পাঠক সমাজে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষ‌ম হয়েছিল। বাঙালি সাংবাদিক হিসাবে একদিনকে ঘিরে আমারও গর্ব রয়েছে। কলকাতা টিভি-র রমরমা দিনগুলিও ভুলব কীভাবে? রাজ্যে এই পটপরিবর্তনে মুষ্টিমেয় যে ক’জন সাংবাদিক আজকের শাসকদল ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন বাজি রাখার সংগ্রামের সংবাদকে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছেন, বরুণ সেনগুপ্তর পর সুমন চট্টোপাধ্যায় তাঁদের অন্যতম, এটা স্বীকার করতেই হবে।

সুমন চট্টোপাধ্যায়-এর শক্তিশালী সাবলীল কলম কিন্ত জেলখানা থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় যা এসেছে, বিশেষত করোনা নিয়ে তাঁর দীর্ঘ সংবেদনশীল লেখা আমি আমার নিউজ পোর্টালে দু’-কিস্তিতে তা প্রকাশ করেছি। এই কারণে ছোট্ট হোক একটি নিউজ পোর্টালের সম্পাদক ও সুমনদার সঙ্গে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার সুবাদে তাঁর সেই লেখা প্রকাশ করে আমি নিজেকে ধন্য মনে করেছি। সাংবাদিক সুমনদা ছিলেন, সুমনদা আছেন, সুমনদা থাকবেন-স্বমহিমায়। একটু সময়ের অপেক্ষামাত্র।

Developed by