উত্তরপ্রদেশে পরপর দুটি গণধর্ষণের অভিযোগের ঘটনা বিশেষত দলিত কিশোরীকে যেভাবে গণধর্ষণের পর মৃতার পরিবারকে মরদেহ না দিয়ে পুলিশি ঘেরাটোপে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তা নিয়ে উত্তাল বিরোধী শিবির। আইনের প্রহসন ও প্রশাসনকে কুক্ষিহগত করার কুৎসিৎতম নির্দশন প্রত্যক্ষ করল বিশ্ববাসী। সেই ঘটনার প্রতিবাদে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গীতে প্রতিবাদী কলমে কুৎসিততম প্রশাসনের চেহারাটা তুলে ধরেছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক বা বলা যায় প্রতিবাদী সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।
‘মণীষা নামে মেয়েটি দলিত পরিবারের। ওর দারু(মদ)পানের নেশা ছিল। অত্যাধিক মদ্যপানের জন্য হার্টফেল করে বা বিষক্রিয়ায় মারা গিয়েছে। সেই সঙ্গে ওর দেহে করোনা সংক্রমণ ছিল। তাই পুলিশ দেহটি পরিস্থিতিজনক কারণে পুড়িয়ে দিয়ে করোনা প্রোটোকল মেনেছে। এটি কোনও অপরাধ নয়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পুলিশ কর্মীরা যে কাজ করেছেন তার জন্য তাঁদের সরকার থেকে বিশেষভাবে সম্মানিত করা উচিত। এছাড়া ধর্ষণের জন্য যে অভিযোগ চার যুবকের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছিল, ওরা নির্দোষ শুধু নয়, ওরা মদ্যপ মণীষাকে বাঁচানোর জন্য শেষ চেষ্টাটুকু করেছিল। তাই ওদের বিরুদ্ধে দায়ের করা সমস্ত অভিযোগ মনুবাদী সংবিধান মতে প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। ওই চার যুবকের মানসিক আঘাত সামালানোর জন্য ওদের প্রত্যেককে ব্যবসা করার জন্য অনুদান হিসেবে ১ কোটি করে টাকা মুখ্যমন্ত্রীর বিশেষ ত্রাণ তহবিল থেকে সাতদিনের মধ্যে ওদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে রাজ্য সরকারকে। ভারত সরকারের অর্থমন্ত্রকের মাধ্যমে আয়কর দপ্তরকে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে এই টাকা কোনও মতেই আয়করের আওতায় আসবে না।’ আদালত এই রায়ের পাশাপাশি তাদেরকে ভর্ৎসনা করছে, ‘যে বা যারা মণীষার ঘটনা নিয়ে প্রতিবাদে সরব হয়েছেন। ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রচার মনুবাদী সংবিধানের ৪২০ ধারা মতে শাস্তিযোগ্য দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।’ না বন্ধুরা এটা কোনও আদালতের রায় নয়, একেবারে ভোর রাতে দেখা স্বপ্ন। স্বপ্ন নিয়ে যাঁরা বিচার করেন, তাঁরা বলে থাকেন ভোরবেলার স্বপ্ন সত্যি হয়। আমার এক বন্ধু তাঁর আবার পাল্টা ভাববাদী তত্ত্ব। বর্তমান ত্রেতা যুগে যেটা ঘটে সেটা আগাম স্বপ্ন হয়ে দেখা দেয় দেশবাসীর কাছে। ফলে স্বপ্ন যেটা, সেটাই বাস্তব- এটাই ত্রেতাযুগের নিয়ম। এইসব স্বপ্নের ঘোর কাটতে না কাটতেই হাতে চলে এল ময়না তদন্তের রিপোর্ট। তার আগেই অবশ্য উত্তরপ্রদেশের হাথরাসের জেলা পুলিশ সুপার বিক্রান্ত বীর জানিয়েছেন, আলিগড় হাসপাতাল থেকে যে মেডিক্যাল রিপোর্ট পেয়েছেন তাতে ধর্ষণের উল্লেখ নেই। তিনি বলেন, “ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। এখনও পর্যন্ত চিকিৎসকরা ধর্ষণের বিষয়টি । ফরেনসিক রিপোর্টের পরই নিশ্চিত জানাতে পারবেন তাঁরা।”
যে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিটতে দেশ আজ উত্তাল তা নৃশংসতম ঘটনা বললেও কম বলা হয়। কুৎসিত বিভৎসা তাও কি যথেষ্ট? জানি না।উত্তরপ্রদেশ-নেপাল সীমান্তবর্তী লখিমপুর খেরি জেলায় ১৪ বছরের এক নাবালিকাকে যৌন নিপীড়নের পর খুন করা হয়েছে এমনটাই অভিযোগ। পুলিশ প্রাথমিকভাবে জানিয়েছিল, নাবালিকার উপড়ে নেওয়া হয়েছে চোখ ও জিভ কাটা অবস্থায় ছিল।২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০ একটি আখ খেত থেকে ওই দলিত নাবালিকার ক্ষতবিক্ষত দেহ উদ্ধার করে তার পরিবার। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, গত ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২০ থেকে নিখোঁজ ছিল ১৪ বছরের কিশোরীটি।
এই নৃশংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসনকে নিশানা করছে বিরোধী শিবির। বহুজন সমাজবাদী পার্টির নেত্রী মায়াবতী নাবালিকাকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনার নিন্দা করে বলেছেন, ‘এই ধরনের ন্যাক্কারজনক কাজ হয়েই চলেছে, তাহলে সমাজবাদী পার্টি ও বিজেপি শাসনের মধ্যে কী ফারক রয়েছে?’ যোগী আদিত্যনাথ সরকারের আমলে দলিত নিপীড়ন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে বলে অভিযোগ করেছেন ভীম সেনা প্রধান চন্দ্রশেখর আজাদ।
এদিকে চাপের মুখে সামাল দিতে হাথরসে গণধর্ষণকাণ্ডে নির্যাতিতার মৃত্যুর তদন্তে সিট গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে উত্তরপ্রদেশ সরকার।ওই সিট দলে স্বরাষ্ট্র সচিব ছাড়াও রয়েছেন ডিআইজি এবং এক আইপিএস অফিসার। গোড়া থেকে তদন্ত এবং সাত দিনের মধ্যে রিপোর্ট পেশের নির্দেশ মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে দ্রুত অপরাধীদের চিহ্নিত করা কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদর দাস মোদী। সিদ্ধান্তগুলি বা ঘোষণাগুলি শুনলে বা পড়লে মনে হয় কি কঠিন আইনি শাসন দেওয়ার জন্য নিদ্রাহীন দুই চৌকিদার।
দেশবাসী তথা বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছে হাথরাস গণধর্ষণ কাণ্ডে মৃত তরুণীর দেহ বলপূর্বক দাহ করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। গোটা দেশজুড়ে প্রতিবাদ, অনলাইন পিটিশন, সোস্যাল মিডিয়ায় লেখালেখির শেষ নেই। সর্বত্রই উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনকে তুলোধোনা করা হয়েছে। সরব হয়ে সঙ্গতভাবেই ময়দানে নেমেছে বিরোধী দলগুলিও। ১ অক্টোবর, ২০২০ হাথরাসের পরিস্থিতি ধুন্ধুমার। উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে উত্তরপ্রদেশ পুলিশ। মৃতার পরিবারের কাছে ঘেষতে দেওয়া হচ্ছে না কংগ্রেস, সপা-সহ একাধিক বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের।
উত্তরপ্রদেশ পুলিশের ঘটনায় নিন্দায় সরব হয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নিজের অফিসিয়াল টুইটার হ্যান্ডেলে ক্ষোভ উগরে দিলেন যোগী আদিত্যনাথ প্রশাসনের বিরুদ্ধে। এদিন মুখ্যমন্ত্রী টুইট করে লেখেন, “হাথরাসের পাশবিক ও লজ্জাজনক ঘটনার নিন্দা জানানোর কোনও ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। মৃতার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা রইল। আরও লজ্জার বিষয়, যেভাবে পরিবারের অমতে জোর করে মৃতার দেহ দাহ করেছে পুলিশ তাতে ভোটব্যাংকের রাজনীতি করা ব্যক্তিদের মুখোশ খুলে দিয়েছে।” তৃণমূল সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ও তিনিও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। টুইট করে লিখেছেন, “হাথরাসের নির্যাতিতা সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারল না, আর বিজেপি সরকার তাঁকে সম্মানের সঙ্গে মরতেও দিল না। একজন মাকে তাঁর সন্তানের মুখ শেষবারের মতো দেখতে না দেওয়া পাশবিক আচরণের শামিল। নারীশক্তির উন্নয়ন ও বেটি বাঁচাও বেটি পড়াওয়ের নামে এটাই হল বিজেপি সরকারের স্বরূপ।”
হাথরাসের চিতার আগুন নিভলেও দেশজুড়ে সেই আগুন দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়েছে। এরই মধ্যেই ফের আরও এক দলিত মহিলার গণধর্ষণের খবর উঠে এসেছে।এবারের ঘটনাস্থল উত্তরপ্রদেশের বলরামপুর। ২২ বছরের এক দলিত ছাত্রীকে গণধর্ষণ করে মেরে ফেলা হয়েছে। এই ঘটনাটিও শিউরে ওঠার মত।বি কমের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী কলেজে অ্যাডমিশনের জন্য গিয়েছিলেন। ফেরার পথে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় দু’জন। তারা তাকে ধর্ষণ করে বলে অভিযোগ পরিবারের।অভিযোগ, ওই ছাত্রীর পা ও স্পাইনাল কর্ড ভাঙা অবস্থায় পাওয়া যায়। এইভাবে অজ্ঞান অবস্থায় তাঁকে রিক্সায় তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে, সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। একই রাজ্যে পরপর দুটি নৃশংসতম ঘটনাকে আড়াল করতে বিরোধী কণ্ঠ স্তব্ধ করার পথই নিয়েছে যোগী আদিত্যনাথের প্রশাসন।