Breaking
16 Apr 2025, Wed

তারকনাথ দত্তের ছোটগল্প ছোবল

ছোবল

দরজা খোলার ভাব দেখেই কদম টের পেয়েছে মিনসেটা এসে ঢুকেছে ঘরে। কুত্তার বাচ্চাটা এদ্দিন বাদে আবার এসেছে। দিনের বেলায় আসার সাহস নেই। যখনই আসে রাত বিরেতে, চোরের মত। এত যে লাথি খায়, গালাগালি খায়, তবু কি ওর লজ্জা আছে? বারো জায়গায় পাছা ঘষে শ্লা ঘুরে ফিরে আবার সেই কদম। কদম ছাড়া গতি নেই। কদম জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনের বেলা কয়েক পা এগোলেই যত দূর চোখ যায় মাঠকে মাঠ চষা জমি। বিশাল মাঠের ওধারে কী আছে জানে না কদম। টিকলি একবার বলেছিল, ওধারে একখানা গির্জা আছে। বিরাট গির্জা। একেবারে হাইরোডের গায়ে। বড়দিনের সময় বিল্টুর সাথে আগে দু-একবার নাকি গেছে ওখানে। হেব্বি ভিড় হয়।
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েই পিছন ফিরেছে কদম। ঠিক যা ভেবেছে তাই— পবন। ওকে দেখেই ভ্রু কুঁচকেছে কদম। আপদটা আবার এদ্দিন বাদে কী মনে করে? মেজাজটা এমনিতেই বিগড়ে আছে। সন্ধেবেলা জলিল এসেছিল। জলিল আজকাল অন্য জায়গায় খেপ মারছে, কদমের কাছে পাক্কা খবর আছে। জলিল এবার অনেকদিন বাদে এলো। ওর বউ-বালবাচ্চা আছে কদম জানে। তাতে কী? আগে তো সারাটাদিনই কদমের এখানে পড়ে থাকত। এখন আসে না। অন্য ফুলের মধু খাচ্ছে। এদ্দিন বাদে এলো, কদম ভেবেছিল কিছু বলবে না। এমনিতেই ক’দিন আসে না। টিকলি সেদিন জিজ্ঞেস করছিল, “কী রে কদম, জলিলকে দেখি না অনেকদিন—”
কদম কিছুই হয়নি এমন মুখ করে বলেছে,”আসে না তুই কী করে জানলি?”
—”জানি, জানি, সব খবর আছে আমার কাছে। জলিল এখন দাসপাড়ায় ময়নার ঘরে যাচ্ছে।”
—”তোকে কে বলল?”
—”বিল্টুই তো বলল, ময়নার বাড়িতে বেশ ক’দিন ঘুরঘুর করতে দেখেছে ওকে। ময়না যা ঢলানি মাগী, ওই বেটিকে দিয়ে বিশ্বাস নেই। তুই পাতা লাগা, সব জানতে পারবি।”
কদম অবশ্য এইরকম কিছু একটা অনুমান করেছিল। জলিল আগে ঘনঘন আসত। এখন আসা কমিয়ে দিয়েছে। প্রথমটায় অত পাত্তা দেয়নি। জলিলের সংসার আছে। সেদিকটা সামলে তবে তো আসবে। টিকলির কথা শুনে মনে হচ্ছে ভুল কিছু বলেনি। গড়বড় কিছু একটা তো আছেই। কদম দেখতে পাচ্ছে না, এই যা।
বিল্টুর ফড়িংয়ের মত চেহারা। গাঁয়ে মাংস নেই। থ্যাবড়া নাক। থোবরাখানা ঠিক হনুমানের মত। টিকলির বর ওর সঙ্গে থাকে না, দুবাইতে না কোথায় সেন্টারিংয়ের কাজ করে। দীর্ঘদিন তার কোন পাত্তা নেই। উড়া উড়া খবর ছড়িয়েছে লোকটা নাকি দুবাইতে অন্য মেয়েছেলে নিয়ে নতুন করে সংসার পেতেছে।
টিকলি ঢলানি মেয়েছেলে। বর নেই বলে ওর কোন শোকতাপ আছে বলে মনে হয় না। বর নেই তো কী হয়েছে? বিল্টু আছে। বিল্টুর মধ্যে ও কী দেখেছে কে জানে? কদম জানে, টিকলি বিল্টুর সাথে শোয়। কদমও শোয় জলিলের সাথে। এর আগে দু-দুবার পেট বাঁধিয়েছে টিকলি। বিল্টু ওস্তাদ ছেলে। প্রতিবারই নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে ঠিক খালাস করে এনেছে। এখানে সব চলে। কে কখন কার সাথে শুচ্ছে এসব নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা নেই। সবাই সব জানে, বলে না কিছু। সবার পিছনেই গন্ধ আছে। কারো কম কারো বেশি। সন্ধের একটু পরে পরেই জলিল ঢুকেছে ঘরে। কদম টের পেয়েছে ঠিক, তবুও চোখ বুজে পড়েছিল বিছানায়। ভাবখানা এমন যেন, জলিলের উপস্থিতি ও টের পায়নি। গোড়ালির কাছটাতে হাতের স্পর্শে সুড়সুড়ি লাগছে। হাতটা একটু একটু করে উপরের দিকে উঠে আসছে। উপরে আরো উপরে। হাঁটুর কাছে পৌঁছতেই খপ করে হাতটা চেপে ধরল কদম। জলিল হাতটা ছাড়ানোর কোনরকম চেষ্টাই করল না। অন্য হাতে টান মেরে কদমের বুকের কাপড়টা সরিয়ে দিল। সরাতেই পাহাড় পর্বত প্রকট হলো। পর্বতের নীচে মহার্ঘ্য খাঁজ। কদম চোখ বুজে আছে। জলিলের অবাধ্য হাত ওর বুকে পেটে অনবরত ঘোরাফেরা করছে। জলিলের গায়ের সেই অতি পরিচিত বোটকা গন্ধটা আজও কদমের নাকে এসে ঝাপটা মারল। বিশ্রী মাংসের গন্ধ। দিনের বেলায় ও কসাই। ভয়ঙ্কর রূপ তখন। তার ফতুয়া, লুঙ্গি, বুকে, মুখে নিরীহ অবলা প্রাণীর তাজা রক্তের দাগ। সাবান দিয়ে ঘষলেও সে দাগ যায় না কিছুতেই। উৎকট গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠে কদমের। দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে থাকে। আজ অবিশ্যি সেরকম কিছু হলো না। বলা ভালো, কদমই হতে দিল না। ধাক্কা মেরে জলিলকে সরিয়ে দিল। ধাক্কাটা কি একটু বেশিই জোরে হয়ে গেল? টাল সামলাতে না পেরে জলিল সোজা মাটিতে। ”আহ্!” করে কঁকিয়ে উঠলো। ভালই লেগেছে বোধহয়। কদম ততক্ষণে উঠে বসেছে। মেঝেতে বসেই জলিল খিস্তাচ্ছে,”মাগী, খুর রস হয়েছে তোর। আজ তোর রস ভাঙবো!”
কদম চুপ। একবার ফিরেও তাকালো না জলিলের দিকে। জলিল উঠে দাঁড়িয়েছে। কিছু একটা করতে যাচ্ছিল, ফটিক এসে ঘরে ঢুকল। ফটিককে দেখে দাঁত খিঁচিয়ে উঠল জলিল,”শুয়োরের বাচ্চা! তোকে না কতবার বলেছি, এখানে আসবি না!”
ফটিক হাঁপাচ্ছে। মনে হয় অনেকটা দৌড়ে এসেছে। হাঁপাতে হাঁপাতেই বলল,”এসেছি কি আর সাধে? ওদিকে জোর লাফরা বেঁধেছে—”
—কীসের লাফরা?”
—”নিম-তলার ঠেকে রেড মেরেছে পুলিশ—”
—”পুলিশ? তুই কোথা থেকে খবর পেলি?”
—”আমি ঠেকের আশেপাশেই ছিলাম। পল্টার ছেলে হয়েছে শোননি? তিন মেয়ের পর ছেলে। আজ পার্টি দিল। দুই পেগও পেটে পড়েনি, হঠাৎ দেখি সবাই ছোটাছুটি শুরু করেছে। লম্বু পালিয়েছে— বিশুয়া শ্লা ধরা পড়ে গেছে।”
জলিলের চোখমুখের চেহারা বদলে যাচ্ছে। তাকে বিরাট চিন্তিত দেখাচ্ছে—”তুই ঠিক জানিস বিশুয়া ধরা খেয়েছে?”
—”একদম পাক্কা।”
জলিল আর দাঁড়ায়নি। আপনমনে বিড়বিড় করতে করতে বেরিয়ে গেছে। ও বেরিয়ে যেতেই কদম বিছানা থেকে নেমে এসেছে। যাওয়ার সময় দরজাটায় এক লাথি মেরে গায়ের জ্বালা মিটিয়েছে জলিল। হঠাৎ করে ফটিক না এসে পড়লে কি হতো বলা যাচ্ছে না। কদম অবশ্য এসব নিয়ে ভাবছে না। এতে ঘাবড়াবার কিছু নেই। এসব দেখতে দেখতে ওর চোখ পচে গেছে। মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত। এদের যত দাপাদাপি মেয়েমানুষের সামনে।
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে আবার এসে চৌকিতে উঠেছে কদম। বসেছে জানালার দিকে মুখ করে। কতক্ষণ কে জানে। কদমের আজ কিছুই ভালো লাগছে না। জীবনটাকে যেভাবে গোছাতে চেয়েছিল সেভাবে হয়নি। একদিন যার হাত ধরে ঘর ছেড়েছিল, সেই মুখোশ পরা শয়তানটা আজ কোথায় আছে? কী করছে, কে জানে? বিশ্বাসের বিরাট দাম দিয়েছে শয়তানটা। যাকে একদিন রক্ষক ভেবেছিল সে-ই তাকে অন্যের রক্ষিতা বানিয়ে ছেড়েছে। মানুষ চিনতে এতবড় ভুল! ওর জীবনের গতিপথটাকেই ঘন অন্ধকার বাঁকের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এর শেষ পরিণতি কী, জানে না কদম।

Advertisement

জলিল বেরিয়ে যাবার কিছুক্ষণ বাদেই পবন এসে ঘরে ঢুকেছে। ওকে দেখেই কদমের মেজাজ খাট্টা হয়ে উঠেছে। শয়তানের নাম মনে করতেই শয়তান সামনে এসে হাজির। জগতে কিছু কিছু মানুষ থাকে যাদের দেখলেই মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত বিরক্তিভাব চলে আসে‌। পবন সেই টাইপের একটা মানুষ। মানুষ? আর কেউ পবনকে মানুষ ভাবলেও কদম ভাবে না। অথচ…
থাক, এখন ওসব কথা। কদম খুব ভালো করেই জানে, মাস দুয়েক ডুব মেরে থেকে পবন কেন আজ ওর কাছে এসেছে। নির্ঘাত পকেটে টান পড়েছে। এক্ষুনি বেহায়ার মত হাত পাতবে। দীর্ঘদিন ধরে দেখতে দেখতে এসব কদমের মুখস্থ। কদম মনের জ্বালা মেটাতে উল্টোপাল্টা মুখে যা আসবে বলে যাবে। পবন অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে। মুখে কিচ্ছুটি বলবে না। যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না। ব্যস, এই পর্যন্তই। তারপর আবার হাত পাতবে। কাকুতি মিনতি করবে। কদম দেবো না দেবো না করেও দু-একশো ওর দিকে ছুঁড়ে মারবে। বেহায়াটা নির্লজ্জের মতো টাকা ক’টা কুড়িয়ে নিয়ে পকেটে ঢোকাবে। তারপর দাঁত কেলিয়ে বলবে,”তুই খুব ভালো কদম। ওরা শুধু শুধু তোর নামে আলতু ফালতু কথা বলে বেড়ায়। কদম এই, কদম ওই… আমি তো জানি, তুই কেমন মেয়েমানুষ। তোর শরীরে প্রচণ্ড দয়ামায়া। তাই তো মনে পড়লেই তোর কাছে চলে আসি। হাত পাতি। তুই খুব ভালো রে, তুই খুব ভালো!”
এসব কথায় চিড়ে ভিজবে না পবন জানে। কদম যে ওকে দু’চোক্ষে দেখতে পারে না, সেটা কি আর পবন জানে না? জানে, খুব জানে। তবুও এইসব কথা বলবে। আসলে এতদিনে ও এটা বুঝে গেছে কদম দশ কথা শোনাবে ঠিকই, শুনিয়ে আবার দেবেও। যে গরু দুধ দেয় তার লাথি খেয়েও আরাম আছে। টাকা নিয়েই পবন চলে যাবে না। দাঁড়িয়ে থাকবে। পকেট থেকে বিড়ি বার করে কানের কাছে নিয়ে রগড়াতে থাকবে। এটা বিড়িটা কড়কড়ে আছে না নেতিয়ে গেছে সেটা বোঝার একটা কৌশল। পাকা বিড়ি খোড়দের মধ্যে এই অভ্যাসটা আছে। এত কিছুর পরেও বিড়িটা কিন্তু জ্বালাবে না পবন। ততক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করবে, যতক্ষণ না কদম দাঁত খিঁচিয়ে বলবে,”কী হলো এখনও দাঁড়িয়ে থাকলে যে! টাকা নেওয়া হয়েছে, এবার এখান থেকে ফোটো তো। তোমাকে দেখে আমার মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।”
—”এত ক্ষেপে যাচ্ছিস কেন? যাবো তো। বিড়িটা খেয়েই চলে যাবো।”
—”তা খাচ্ছো না কেন? বিড়িটা নিয়ে সেই থেকে দেখছি নাটক করে যাচ্ছো। ঝটপট বিড়িটা খাও, তারপর বিদেয় হও।”
—”না, মানে বলছিলাম, শুধু মুখে বিড়িটা খাবো? যদি এক কাপ চা খাওয়াতিস, বিড়িটা বেশ আয়েশ করে টানতে পারতাম—হে হে হে—”
কদম রেগে গিয়ে একটা ভয়ংকর বাজে কথা বলবে। পবন আর দাঁড়াবে না। তাড়া খাওয়া কুকুরের এক ছুটে ঘর থেকে পালিয়ে যাবে। তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ কদম দাঁড়িয়ে থাকবে। নয়তো ধপ করে মাটিতে পা ছড়িয়ে বসে পড়বে। বসে বসে কিছুক্ষণ নিজের মাথার চুল ছিঁড়বে। প্রত্যেকবার এমনটাই হবে। খুব বেশী এদিক সেদিক হবে না।

আজ অবশ্য সেরকম কিছু হলো না। ঘরে ঢুকে পবন দুই হাত জড়ো করে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ওর এই ধরনের ভাবভঙ্গি কদমের কাছে নতুন। এর আগে যত বার এসেছে একগাল হাসি দিয়ে এটা সেটা অদরকারি কথা বলে সময় নষ্ট করেছে। এটা আসলে ওর একটা চাল। আসল কথা শুরু করার আগে খানিকটা ভূমিকা করে নেওয়া। এটা নতুন কিছু না। প্রত্যেকবার এসে এটাই করে। এমনটা করার পিছনেও কারণ আছে। এসব করে কদমের মেজাজটা ঠিক কোন পর্যায়ে ঘোরাফেরা করছে তা কিছুটা আন্দাজ করে ফেলার চেষ্টা।
পবনকে দেখেই কদমের মুখে এক ধরনের বিরক্তি ভাব চলে এসেছে। এই সময়ে ওকে একেবারেই আশা করেনি। গলায় যতখানি সম্ভব বিরক্তি মিশিয়ে কদম বলল,”তুমি? কী মনে করে? তোমার কি লজ্জা শরম বলে কিছুই নেই? তোমার কি মনে হয়, আমার টাকার গাছ আছে? ঝাড়া দিলেই টুপটাপ করে টাকা পড়বে?”
পবন কিছু বলতে চাইল। কদম হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল—”থাক। কথা বাড়িয়ে লাভ হবে না কিছু। আমি কিন্ত এবারে নয়া পয়সাও দিতে পারবো না আগে থাকতেই বলে দিচ্ছি।”
—”আমি জানি রে কদম, তোর এখন খুব হাত টানটানি যাচ্ছে। জলিলটা খুব বদ। হারামজাদাটা এখন অন্য ফুলের মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে।”
পবনের কথা শুনে কদমের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। বদমাশটা সব খবরই রাখে তাহলে! এমন ভাবে কথা বলছে, যেন কদমের জন্য দুঃখে বেচারার বুক ফেটে যাচ্ছে। দরদ একেবারে উথলে উঠছে। কদমের জন্য ভেবে ভেবে শরীরখানা প্রায় অর্ধেক বানিয়ে ফেলেছে। মরণ! পাক্কা শয়তান একটা! মুখে মিষ্টি মিষ্টি কথা আছে খুব। এই টাইপের লোকগুলোকে দেখলে কদমের মাথা গরম হয়ে যায়। ইচ্ছে করে মুড়ো ঝাঁটা দিয়ে আচ্ছা করে ধুয়ে দেয়। নির্লজ্জ, মাতাল, লম্পট, লোভী কোনো বিশেষণই বোধহয় পবনের জন্য ঠিক মানানসই নয়। পবনকে মানুষ বলে ভাবতেই কদমের ঘেন্না করে। কোনভাবেই ও মনে রাখতে চায় না এই লোকটার সাথে ওর কোনো সম্পর্ক ছিল। একদিন এই লোকটার জন্য বাবা-মা-ভাই-বোন সবাইকে পিছনে রেখে ঘর ছেড়েছিল।
স্বপ্ন দেখিয়েছিল লোকটা। লোকটার মন ভোলানো কথার জালে আটকা পড়ে গিয়েছিল কদম।

(২)

কদমদের পাশের বাড়ির উজ্জ্বল বলে ছেলেটা সুরভির হাত দিয়ে চিঠি পাঠিয়েছিল। কদম ছাড়া তার জীবন নাকি অচল। কদমের জন্য সবকিছু করতে পারে সে, সব কিছু। ন্যাকা ষষ্টি! উজ্জ্বলের মা, যাকে কদমরা সবক’টা ভাই-বোন ‘ছবি পিসি’ করে ডাকে, তিনি আবার ছেলের চেয়ে এককাঠি উপরে। বলে কিনা কদমরে ছেলের বউ করবে। ইস্ কী সখ বুড়ির! দিয়েছে না? দিয়েছে কদম মুখে একেবারে ঝামা ঘসে। বাপকে দিয়ে সোজা পঞ্চায়েতে নালিশ ঠুকে দিয়েছে। বাপখানাও তেমন। একেবারে কেঁদে কেটে মাতবরদের পায়ের কাছে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে—”ছেলেটা বড় বাচাল, আমার মেয়েটারে বিরক্ত করে মারে। আপনারাই আমার ভগবান। এর একটা বিহিত চাই, বিহিত চাই!”
পঞ্চায়েত শুনেছে সে কথা। উজ্জ্বল আর ওর বিধবা মাকে পঞ্চায়েত অফিসে ডেকে এনে আচ্ছা করে কড়কে দিয়েছে। ভদ্রলোকের মেয়েকে বিরক্ত করো? এসব চলবে না। কদমের বাপ পাঁচু মিস্ত্রী সাত সেয়ানার এক সেয়ানা। নিজের মায়ের পেটের ভাইটাকে কলকাঠি নেড়ে বাড়ি ছাড়া করেছে। ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ছাড়া হয়েছে। তার চোখের জলে অভিশাপ কি ছিল না ভেবেছ? ফল একদিন ঠিক হাতে নাতে পাবে। তখন বুঝবে কত ধানে কত চাল। ধান্ধা ছিল উজ্জ্বলের মায়ের কাছ থেকে বড় ধরনের মালকড়ি হাতিয়ে নেবার। মেয়ে তার সতী লক্ষ্মী। আজকালকার মেয়েদের মত না যে ডুবে ডুবে জল খাবে, অথচ শিবের বাবাও টের পাবে না। মেয়ে সেরকম পদের না মোটেই। তা নাহলে কি আর ছ্যামড়ার প্রেমপত্র এনে সোজা বাপের হাতে তুলে দেয়?
উজ্জ্বলের মা পরের বাড়ি কাজ করে খায়। অত টাকা সে পাবে কোথায়? পঞ্চায়েতের মাতব্বরেরা পাঁচ কথা শুনিয়ে সাবধান করে এবারের মত রেহাই দিয়ে দিল। তাই নিয়ে পাঁচু মিস্ত্রীর সে কী রাগ। বাড়ি ফিরে মাতব্বরদের চৌদ্দগুষ্টির মুণ্ডুপাত করে তবে ছেড়েছে। উজ্জ্বলকে আর কোনদিন দেখতে পায়নি কদম। বেচারা বোধহয় সত্যি সত্যিই বিরাট লজ্জায় পড়ে গিয়েছিল।
পবনকে এই এলাকার প্রায় প্রত্যেকেটা মানুষ চেনে। পার্টি ফার্টি করে। পাঁচু মিস্ত্রী পাক্কা মালখোড়। রোজ রাতে গলা অব্দি গিলে বাড়ি ফেরে। বাড়ি ফিরে চেঁচামেচি করে মাঝরাত পর্যন্ত পাড়া গরম করে। এসব দীর্ঘদিন ধরে দেখতে দেখতে কদমের গা-সওয়া হয়ে গেছে। পাড়ার সবার মতো ও নিজেও জানে ওর বাপ পাঁচু মিস্ত্রী দিনে সাধু আর রাতে মাতাল। বেহেড মাতাল। তবে জ্ঞানী মাতাল। মাতাল অবস্থায় তার মুখ দিয়ে অনবরত জ্ঞানের ফুলঝুরি ছোটে। পবনের সাথে পাঁচু মিস্ত্রীর আবার বিরাট ভাব। তার কথা অনুযায়ী আজকালকার দিনে পবনের মত নাকি ছেলে হয় না। দিলদার ছেলে। এই যে রোজ রোজ মাল খাওয়ায় বলে না। এমনিতেও বাড়ি বয়ে এসে খোঁজখবর করে। কখনই প্রায় খালি হাতে আসে না। এটা সেটা নিয়ে আসে। কদমের মা প্রতিমা সেবার এই মরে সেই মরে অবস্থা। ওই ছেলে রাতারাতি নিজে অ্যাম্বুলেন্স জোগাড় করে এনে হাসপাতালে নিয়ে গেল। হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার নার্সদের সামনে সে কী হম্বিতম্বি! পার্টি ফার্টি করে তো, হাতে বিরাট ক্ষমতা। সেবার পবন ছিল তাই রক্ষে। বাড়ির মানুষ কেমন সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরল। পাঁচু মিস্ত্রী পবনের হাতখানা ধরে গদগদ গলায় বলেছে,”তুমি বাপ সাক্ষাৎ ভগবান। তোমার জন্যই যমের মুখ থেকে এ যাত্রা বেঁচে ফিরল আমার কদমের মা।”
পবন বিনয়ের অবতার। কান চুলকাতে চুলকাতে বলেছে,” কী যে বলেন, জ্যাঠামশাই! মানুষ হয়ে যদি মানুষের পাশে দাঁড়াতে না পারি, তাহলে কীসের মানুষ?”
পাঁচু মিস্ত্রী গলে জল—”বেঁচে থাকো বাবা, বেঁচে থাকো। আশীর্বাদ করি শতায়ু হও।” এ যেন সেই পুরোনো সিনেমার ডায়লগ। বহু ব্যবহারেও পুরোনো হয় না।
শুধু পাঁচু মিস্ত্রী যে একাই গলেছে তা না, গলেছে কদমও। একেবারে গলে গেছে। আহা, মানুষটার কোনো তুলনা হয় না!
সেই রাতে পবন যখন ডাক দিল— “কদম চল্, আমরা পালাই। দূরে, অনেক দূরে কোথাও চলে যাই। যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। শুধু তুই আর আমি।”
বিশ্বাস করেছিল কদম। ঋণ শোধ করার এর চেয়ে ভালো উপায় আর হয় না। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো, পাঁচু মিস্ত্রীর সঙ্গে যখন পবনের এত দহরম মহরম, পবন তাকে খোলাখুলি বললেই পারত, তোমার মেয়েকে আমার পছন্দ। তোমার মেয়েও আমাকে পছন্দ করে। পবন যে কথাটা একেবারে পাঁচু মিস্ত্রীকে বলার চেষ্টা করেনি তা না, আকারে ইঙ্গিতে ওর আর কদমের বিষয়টা বোঝানোর একটা চেষ্টা অবশ্য করেছিল। কিন্তু তাতে লাভ কিছু হয়নি। পবন বুঝে গেছে, পাঁচু মিস্ত্রী একখানা আস্ত ঘাগু মাল। মুখে যতই পবন পবন করুক না কেন, পবনের হাতে মেয়েকে এত সহজে তুলে দেবে বলে মনে হয় না। পবনরা জাতে মাহিষ্য। ছোট জাত। তাছাড়া লোকটার সাথে কথা বলে যদ্দূর মনে হয়েছে, মেয়েকে নিয়ে এর বিশেষ কোনো পরিকল্পনা আছে। পরিকল্পনার কথা অবশ্য পবন জানতে পারেনি।
রাতের ট্রেনেই ময়ূর হাট ছেড়ে কদমকে নিয়ে পালিয়েছে পবন। আগে থেকেই ঘর ঠিক করা ছিল। এসব ব্যাপারে পবন খুব ওস্তাদ ছেলে। বন্দোবস্ত সব পাকা। পবনের সাথে চলে এসে কদম ভেবছিল ওর মতো ভাগ্যবতী ওদের পাড়া গাঁয়ে আর দু’টি নেই। কদম গ্রামের সাধাসিধে মেয়ে হলেও ঘটে এটুকু বুদ্ধি ধরে। আসবার সময় বুদ্ধি করে বাপের ট্র্যাঙ্কের তালা ভেঙে হাজার পাঁচেক টাকা হাতিয়ে এনেছিল। বলা যায় না কখন কোথায় প্রয়োজন পড়ে যায়। পবন এসবের কিছুই জানত না। কদম খুব ভালো করেই জানত, তার বাপের যা চরিত্র তাতে করে মেয়ে গেছে বলে তার যে দুঃখে বুক ফেটে যাবে এমন সম্ভাবনা কম। কিন্তু এতগুলো টাকা খোয়া যাওয়া লোকটাকে পাগল করে ছাড়বে। মেয়ে গেছে মানে আপদ বিদেয় হয়েছে। ঘরে সমত্ব মেয়ে থাকার হাজারটা সমস্যা। বদ ছেলেদের উপদ্রব তো আছেই। তারপর মেয়ে থাকলে তাকে তো আর দীর্ঘদিন ঘরে পুষে রাখা যায় না। একটা মন মতো ছেলে জোগাড় করে তার বিয়ে দেওয়া, সে মেলা খরচের মামলা। এত টাকা আসে কোথা থেকে? নিজে গেছে একদিক থেক ভালোই হয়েছে। দায়িত্ব কমেছে। কিন্তু হারামজাদী গেছে তো গেছে সঙ্গে করে এতগুলো টাকা নিয়ে যাবার কী দরকারটা ছিল? এর থেকে যদি বড় একখানা লোহার রড দিয়ে মাথায় জোরে বাড়ি দিয়ে যেত, তাহলেও বোধহয় এতটা কষ্ট হতো না। টাকার শোক বড় শোক। নিজের বাপকে কি আর চেনে না কদম? হাড়ে হাড়ে চেনে। টাকার শোকে লোকটা এদ্দিনে হয়ত পাগল টাগল কিছু একটা হয়ে গেছে।
পবনকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিল কদম। এভাবে একজন স্বল্প পরিচিত যুবকের সাথে আগুপিছু না ভেবে দুম করে সমস্ত কিছু ছেড়েছুঁড়ে চলে আসার জন্য ওকে যে চড়া মূল্য চোকাতে হতে পারে এই ভাবনাটা ওর কোনভাবেই মাথাতে আসেনি। আসলে এই জাতীয় প্রেমের ক্ষেত্রে হয় কী, যে মানুষগুলো প্রেম পর্যায়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে তাদের মনের মধ্যে একধরনের আলস্য ভাব চলে আসে। কোন এক অদ্ভুত মন্ত্রবলে তারা গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করতে ভুলে যায়। কিংবা তারা হয়তো চায় না এসব নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনাচিন্তা করতে গিয়ে তাদের প্রেম ভালোবাসার মধ্যে এমন কোন জটিলতা ঢুকে পড়ুক, যাতে করে তাদের এই নেশাতুর অবস্থাটা কেটে যায়। তারা মনে করে প্রেমে করতে গিয়ে এত ভাবনাচিন্তা করা অর্থহীন। শুধু সময়ের অপচয় আর মনের উপর অকারণে চাপ বাড়ানো। তাদের প্রেম ব্যাপারটা অনেকটা হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মুখে দিয়ে স্বাদ বোঝার আগেই ভ্যানিশ। এবং সবাই এটা জেনেই খায়, এক্ষেত্রে স্বাদ বোঝার কোন দরকার নেই। খাওয়াটাই আসল। কদমের মাথার মধ্যেও সম্ভবত এইধরনের ভাবনাচিন্তা কাজ করে থাকবে। তার মনের মধ্যে তখন একটা বিষয়ই প্রাধান্য পেয়েছিল সেটা হলো, পবনের বউ হতে পারার সৌভাগ্য। বউ? কথাটা মনে পড়তেই কদমের ঠোঁটের কোণায় হাসি চলে এলো। ও বউ? তাও আবার পবনের? অবশ্য সে রাতে চোরের মত গ্রাম ছেড়ে পালানোর সময় পর্যন্ত এমনটাই জানত কদম। কথা তো সেরকমই কিছু ছিল। শহরে পৌঁছেই একটা মন্দিরে গিয়ে তারা চট করে বিয়েটা সেরে ফেলবে। পবন বুঝিয়েছিল কদমের সাবালিকা হতে তখনও মাস আষ্টেক বাকি, রেজিস্ট্রি ম্যারেজের ঝামেলায় গেলে ফেঁসে যাওয়ার চান্স আছে। পরে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেলে ধীরেসুস্থে রেজিস্ট্রিটা সেরে ফেলা যাবে। কদম তাই বিশ্বাস করেছে। কথা ছিল শহরে যাওয়ার। শহর বলতে কোলকাতা বা অন্য কোথাও। কিন্তু পবন ওকে নিয়ে এলো পায়রাডাঙ্গায়। কলকাতা থেকে অনেক দূরে রানাঘাটের আগের স্টেশন পায়রাডাঙ্গা। এই জায়গাটাকে আর যাইহোক শহর বলা যায় না। আবার গ্রাম বলতে কদম এতদিন ওদের যে গ্রামকে চিনে এসেছে, এ তার থেকে কিছুটা আধুনিক। তাই বলে শহর কোনমতেই না।
এখানে এসে পবন কেমন যেন থম মেরে গেছে। হাতে কোনো কাজকর্ম নেই। সারাটা দিন ঘরের মধ্যেই থাকে। মাঝে মাঝে সন্ধের পরে পরে বাইরে বেরোয়। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করে আবার ঘরে চলে আসে। কোথায় যায়, কী করে? কদম জানে না। জানতেও চায় না। ব্যাটাছেলে মানুষ হুট করে নতুন জায়গায় এসে পড়ে সমস্যায় পড়ে গেছে। কাজের ধান্ধায় হয়ত এদিক সেদিক যায়। এসব নিয়ে কদমের কোনো কৌতূহল নেই। বাবা বলত, “মেয়েছেলের বেশি কৌতূহল থাকা ভালো না।”

(৩)
কিছুদিন যাবৎ পবনের মুখে একটা নাম ঘোরাফেরা করছে। সেই নামটা হলো, জলিল। এই জলিলটা যে কে, কদম জানে না। আগে কখনও পবনের মুখ থেকে এইধরনের নাম শুনেছে বলেও মনে পড়ে না। খুব সম্ভবত নতুন জায়গায় এসে এই জলিল লোকটির সাথে তার আলাপ হয়েছে। এবং আলাপটা খুব বেশিদিনের না।
জলিল মাংস কাটে। লোকে বলে কসাই, কিন্তু পবন বলে জলিলের মত নাকি মানুষই হয় না। জলিল ভাই এমন, জলিল ভাই তেমন, শুনতে শুনতে কদমের কান পচে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। জলিল প্রথম যেদিন ওদের ঘরে এলো, তখন দুপুর বেলা। কদম সবে স্নান সেরে ভেজা কাপড়ে ঘরে ঢুকেছে। জলিলকে সঙ্গে করে পবনই নিয়ে এসেছিল। কদম কিছু বোঝার আগেই জলিলকে নিয়ে সোজা ঘরে ঢুকে পড়েছে পবন। হাসি হাসি মুখ করে বলল,”দেখো কাকে নিয়ে এসেছি— তুমি যাকে দেখতে চেয়েছিলে এই হলো জলিল ভাই—”
কদমের মনে পড়ছিল না কবে ও জলিলকে দেখতে চেয়েছে। কদমের রাগ হচ্ছিল‌। খানিকটা লজ্জাও‌। পবনের কি কাণ্ডজ্ঞান বলে কিছুই নেই? বলা নেই কওয়া নেই এভাবে একজন বাইরের লোককে নিয়ে হুট করে কেউ ঘরে ঢুকে পড়ে? বাইরে থেকে একটা আওয়াজ তো অন্তত দেওয়া যেত! যাকে ঘরে ডেকে নিয়ে এসে পবন এমন উচ্ছ্বসিত, সেই জলিল মিয়া তখন কদমের ভেজা শরীরের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তার তাকানোর ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে ভেজা কাপড়ে কোন মেয়েমানুষকে সে এর আগে কখনও দেখেনি। কদম এমনিতে দেখতে শুনতে খারাপ না। গায়ের রঙ খানিকটা চাপা হলেও চোখেমুখে আলগা শ্রী আছে। ভেজা কাপড়ে ওকে আরো আকর্ষণীয়া লাগছে। জলিল এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা কোনো প্রস্ফুটিত গোলাপের প্রতিটা খাঁজ, প্রতিটা ভাঁজ সে গভীর মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছে। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে গোলাপটাকে একবার ছুঁয়ে দেখতে। ওর সাথে চোখাচোখি হতেই কদম চোখ সরিয়ে নিল। মনে মনে একটা বিকট গালাগালিও দিল। কাকে দিল সেটা অবশ্য ও নিজেও জানে না।
জলিলের তাড়া ছিল। কায়েতপাড়ায় দুটো জব্বর খাসির খবর আছে। ইচ্ছে আছে দরদামে পোষালে দুটোকেই তুলে নেবে। ব্যবসার খাতিরেই এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সে সবসময় একাই করে থাকে। কী দামে কী মাল কিনছে সেটা অন্য কেউ জেনে ফেলুক এটা বোধহয় সে চায় না। চলে যাবার সময় পিছন ফিরে তাকাতে গিয়ে অসাবধানতায় হোঁচট খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল জলিল। আড়াল থেকে সব লক্ষ্য করেছে কদম। সে আবারও মনে মনে একটা বিশ্রী গালাগালি দিল।

এর ঠিক দু’দিনের মাথায় দুপুরের দিকে জলিল আবার এলো। দরদর করে ঘামছিল জলিল। পরনে সেই একই ধরনের পোশাক। হাঁটুর উপর লুঙ্গি ভাঁজ করে পড়া। রক্তের দাগে মাখামাখি হাফ হাতা সার্টের উপরের দিককার বেশ কয়েকটা বোতাম খোলা। তার ফাঁক দিয়ে ওর ঘেমো বুকখানা দেখে কদম প্রায় আঁৎকে উঠেছিল। ব্যাটাছেলের খোলা বুক যে এর আগে কখনও দেখেনি তা না, কিন্তু জলিলেরটা তাদের থেকে আলাদা। সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী জলিলের চলন-বলন সবেতেই একধরনের পুরুষালী রুক্ষতা চোখে পড়ে। ওর গা থেকে বেরোনো কাঁচা রক্তের গন্ধে কদমের দম বন্ধ হয়ে আসছিল। ওর মত একজন নোংরা, অভদ্র লোকের মধ্যে পবন এমন কী দেখল যে, সারাক্ষণ খালি জলিল ভাই! জলিল ভাই! করে একেবারে অস্থির হয়ে ওঠে? এদিন জলিল অবশ্য খালি হাতে আসেনি। কালো রঙের ক্যারিব্যাগে করে খানিকটা খাসির মাংসও এনেছে। পবনের চাপাচাপিতে সেই মাংস কদম রেধেছিল বেশ পরিপাটি করে। পবন সিনা খেতে পছন্দ করে। খেতে বসে পবনের সে কী উল্লাস! বলল,”এই হলো জলিল ভাই। ক’দিনের আলাপ বলো? অথচ দেখো এতগুলো মাংস নিয়ে এসে হাজির। এটা বেঁচলে বেচারা কম করেও তিন-চারশো টাকা দাম পেত। ভালবাসা না থাকলে আজকালকার দিনে কেউ এমনটা করে?”
কদমের ভ্রু কোঁচকানো স্বভাব। পবনের কথা শুনে এবারও তার ভ্রু কুঁচকে গেছে। নিজে হাতে রান্না করলেও এক টুকরো মাংসও কদম দাঁতে কাটেনি। খাওয়ার জন্য পবন অনেক জোরাজুরি করেছে। কদম পাত্তা দেয়নি। বলেছে,”যাই বলো, তোমার ওই জলিলকে কিন্তু আমার একটুও পছন্দ হয়নি। খুব বাজে লোক। কী বিশ্রীভাবে তাকায়।”
পবন একগাল হেসে বলেছে,”তোমরা মেয়েছেলেরা মানুষের উপরটা দেখেই তার চরিত্রের বিচার করো। ভেতরটা দেখতে পাও না।”
কদম আর কথা বাড়ায়নি। সে বেশ বুঝতে পারছিল পবনকে এসব কথা বলা বৃথা। জলিল ওকে পুরোপুরি বশ করে ফেলেছে।
জলিল এখন প্রায় প্রায়ই আসে। পবন থাকলেও আসে, না থাকলেও আসে। পবনের থাকা না থাকায় তার বিশেষ কিছু যায় আসে বলে মনে হয় না। জলিলের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে জানতে পারলে পবন আবার রাগ করতে পারে। সুতরাং জলিল সম্পর্কে কদমের মনে যাই থাকুক না কেন ওপরে ওপরে যতটুকু না বললে নয়, ঠিক ততটুকুই জলিলের সাথে কথাবার্তা বলে। জলিল তাতেই বিরাট খুশি। তার সাহস আগের তুলনায় আরো বেড়ে গেছে। এখন সে কথায় কথায় কদমের শরীর স্পর্শ করার অছিলা খোঁজে। কদম যতটা সম্ভব গা বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করে। ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করে জলিলের এ-জাতীয় আচরণ সে মোটেও পছন্দ করছে না। জলিল কি আর সেসব বোঝে না? এই বিষয়ে সে যাকে বলে পাকা খেলোয়াড়। কদমের মত মেয়েমানুষকে কীভাবে বাগে আনতে হয় সেটা তার খুব ভালোভাবেই জানা আছে। এক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। ধৈর্য ধরতে হবে, অসীম ধৈর্য। তারপর আলগোছেই একদিন পাখি নিজে থেকেই ধরা দেবে। না দিয়ে যাবে কোথায়?

মাস দুয়েক বাদে এক ঝড়-জলের রাতের কথা কদমের আজও স্পষ্ট মনে আছে। রাতারাতি ওর জীবনটা কেমন করে পাল্টে গেল, মনে না থেকে উপায় আছে?
সেদিন ঠিক সন্ধের মুখে বলা নেই কওয়া নেই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। তুমুল বৃষ্টি! বৃষ্টির হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল আজ গোটা পৃথিবীটাকে বুঝি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। অসময়ে বৃষ্টি নামায় পবনকে ভীষণ বিরক্ত বলে মনে হলো। হতচ্ছাড়া বৃষ্টিটা আর আসার সময় পেল না! সে সেজেগুজে রেডি হচ্ছিল বেরোবে বলে। এমন বৃষ্টির কোন মানে হয়? এইসময় পবনের ঘরে থাকার কথা না। অন্যদিন এতক্ষণে বেড়িয়ে পড়ে। ফেরে সেই রাত্রি একটা-দেড়টা বাজিয়ে। কোথায় যায়? কী করে? কিচ্ছু জানে না কদম। জিজ্ঞেস করলে বলে,”কোথায় যাই তা জেনে তোমার কী দরকার? পুরুষ মানুষ ঘরে বসে থাকলে চলবে?‌ পুরুষ মানুষদের নানান ধান্দায় থাকতে হয়। তোমাদের আর কী? বাইরে তো বেরোও না দুনিয়ার খবরাখবর তোমরা কী রাখবে?” সেই সময়টাতে পবনের কথাবার্তা শুনলে মনে হবে ওরা দু’জন স্বামী-স্ত্রী। এলাকার লোকজন অবশ্য সেটাই জানে। কদমের হাতে শাঁখা, সিঁথিতে সিঁদুর। মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। কত ছেলেমেয়ে বাড়ির অমতে পালিয়ে এসে বিয়ে করে। এমন ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। বাড়ির লোকেরা প্রথম প্রথম খুব হম্বিতম্বি করে। তারপর কিছুদিন গেলেই সমস্ত কিছু স্বাভাবিক। এমন কত আসে। দেখতে দেখতে সবার চোখ পচে গেছে। তাই এসব নিয়ে কেউ অত মাথা ঘামায় না। হঠাৎ করে নতুন কোন জোড়া এলে দু-একদিন হয়ত কৌতূহল দেখায়, তারপর আবার সব আগের মত। যে যার ধান্দায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে। কদম বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বাইরে বৃষ্টিতে মাখামাখি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বাইরেটা দিনের আলোর মত মুহূর্তের জন্য জেগে উঠেই মিলিয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির একটানা শব্দে কদমের মাথা ঝিমঝিম করছে। অন্যদিকে পবনকে দেখে মনে হচ্ছে সে যথেষ্ঠ বিরক্ত হয়েছে। হঠাৎ করে আসা দুর্যোগ তাকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। সে আপাতত ঘরময় পায়চারী আর ঘনঘন বিড়ি টানার মধ্যে দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দ। “কে?” পবন পাইচারি থামিয়ে দরজার দিকে তাকালো।
বাইরে থেকে উত্তর এলো, “আমি পবন ভাই। দরজা খোলো।” জলিলের গলা পবন, কদম দু’জনেই শুনতে পেয়েছে। কদম ভাবল, আশ্চর্য! এই ঝড়জল মাথায় করে জলিল এসময়ে কী মনে করে? কদমকে সামান্য চিন্তিত মনে হলো। তবে জলিলের এমন অভাবনীয় আগমনে পবনকে ভারী উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছে। তার কাছে এই অসময়ে জলিল ভাই কেন এসেছে, সেটা বড় কথা নয়। জলিল ভাই এসেছে এটাই বড় কথা। পবন তাড়াহুড়ো করে দরজাটা খুলে দিল। জলিল মাথাটা সামান্য নীচু করে ঘরে ঢুকলো। বৃষ্টিতে একেবারে কাকভেজা অবস্থা। পবন দৌড়ে গিয়ে লুঙ্গি আর গামছা নিয়ে এলো। জলিলের মুখে মায়া বাড়ানো হাসি। পবনের কাছে ঠেলা খেয়ে সে গেল বারান্দায় পোশাক বদলাতে। সে এসেছে, তবে একেবারে খালি হাতে আসেনি। গোটা তিনেক বাংলার বোতলও সঙ্গে করে এনেছে। বাঘ মার্কা—বেঙ্গল টাইগার। সঙ্গে দু-তিন রকমের ভাজাভুজি। আর ঠিক সেদিনের মত বেশ খানিকটা খাশির মাংস। আয়োজন বেশ পরিপাটি। মদ খেতে বসে চাট ভালো না হলে আসর ঠিক জমে না।
মদ খেতে বসে পবন অন্য মানুষ। পুরো পেঁচো মাতাল। দু পেগ মাল পেটে পড়তে না পড়তেই, ভাট বকা শুরু। কান্নাকাটি, খিস্তির ফুলঝুরি ছোটে। বলে নিজের জীবনের কথা। বলে পার্টির কথা। পার্টির জন্য কী না করেছে একটা সময়। এম.এল.এ কেতু রায়ের চামচাগিরি করে বেশ কাটছিল দিনগুলো। সেসময় এলাকায় ওর দাদাদাগিরি ছিল দেখার মত। অনেক আচ্ছা আচ্ছা লোক সেই সময়টাতে পবনকে খাতির করে ‘পবনদা’ বলে ডাকত। আড়ালে বলত কেতু রায়ের পোষা কুত্তা। সত্যি সত্যি দিনকে দিন ও যেন কেতু রায়ের পোষা কুকুর হয়ে গিয়েছিল। কেতু রায়ের নির্দেশে ছুটখাট ঘোঁট পাকানো থেকে শুরু করে একে তাকে চমকানো। ভোট লুঠ করে একের পর এক নির্বাচনে কেতু রায়কে বিপুল ভোটে জিতিয়ে আনা, এসব ছিল পবনের বাঁয়ে হাত কা খেল। কেতু রায়ের বাগান বাড়িতে বাবু আর তার বন্ধুবান্ধবেরা সবাই মিলে একটু ফুর্তিফার্তা করবে, তার জন্য নতুন নতুন মেয়ে সাপ্লাই, সব পবন একার হাতে সামলেছে। যে কারণে পবনের উপর কেতু রায়ের ছিল অগাধ ভরসা। ছেলেটা যাকে বলে একেবারে করিৎকর্মা ছেলে। গতবার বিধানসভা ইলেকশনে বিরোধীদের কান ভাঙানিতে নির্বাচন কমিশন এমন টাইট সিকিউরিটির ব্যবস্থা করল যে, পবনের সমস্ত জারিজুরির একেবারে দফারফা। স্কুল মাস্টার তমাল বিশ্বাসের ছেলের বউয়ের কাছে কেতু বাবু বিশ্রীভাবে হেরে গেলেন। আর হুট করে পবনের বাজারও পড়ে গেল। এখন আর আগের মত ওকে কেউ পাত্তা দেয় না। পবন রাস্তায় বেরলেই অকথ্য ভাষায় গালাগালি উড়ে আসে। পবন দাঁতে দাঁত চেপে এই জাতীয় অপমান সহ্য করে। সেবার মহালয়ার দিন মাল খেয়ে বাওয়ালী করতে গিয়ে ‘উদয় সংঘ’ ক্লাবের বাচ্চা ছেলেগুলোর হাতে রাম কেলানি খেয়ে গেল। কেতু রায় সব শুনলেন। মুখ ভার করে বললেন,”এখন আমাদের সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে, পবন। চেপে যা। সব ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখ। সময় ফিরলে সমস্ত কিছু সুদে আসলে তুলে নিস।” এইরকম পরিস্থিতিতে দেওয়াল লিখন পড়তে পবনের অসুবিধা হয়নি। দুনম্বরি করে খুব বেশিদিন ক্ষমতা ধরে রাখা যায় না। কেতু রায় বা তার সাঙ্গপাঙ্গদের কার্যকলাপ এলাকার মানুষ কোনদিনই ভালভাবে মেনে নিতে পারেনি। তারা দীর্ঘদিন ধরেই ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিল। সুযোগ পেতেই হিড়হিড় করে চেয়ার থেকে টেনে নামিয়ে দিয়েছে। এতে করে সব থেকে খারাপ অবস্থা হয়েছে পবনের। এলিতেলি ছেলেপেলেরা সব চান্স পেলেই ঝেড়ে দিচ্ছে। অবস্থা কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে কেতু রায় বুদ্ধি দিলেন,”এলাকাসুদ্ধ লোকজন ক্ষেপে লাল হয়ে আছে। আমাকে খুব বেশি ঘাটানোর সাহস তারা পাবে না। সমস্যায় পড়বি তুই। আমিও কিছু করতে পারব না। সুতরাং তুই এখন কিছুদিনের জন্য গা ঢাকা দিয়ে থাক। পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হোক। পরে না হয় সময় সুযোগ মত আমিই তোকে ডেকে নেব।”
পবন আর দেরি না করে রাতের অন্ধকারে কদমকে নিয়ে এলাকা ছাড়া হলো।
এসব কথা পবনের মুখ থেকে কদম অন্তত একশোবার শুনেছে। শুনতে শুনতে কান পচে গেছে।
কদমের ইচ্ছে করছিল না। তবুও পবনের জোরাজুরিতে জলিলের আনা মাংস রান্না করতে বসে গেল।
কদমের হাতের রান্না করা মাংস খেয়ে জলিল মিয়াকে রীতিমত উচ্ছ্বসিত মনে হলো। প্রশংসার বন্যা বইয়ে দিচ্ছে। এমন চমৎকার রান্না সে নাকি অনেকদিন খায়নি। পারলে রাঁধুনির হাতটাই খেয়ে ফেলে আরকি। প্রশংসা শুনে কদমের খুশি হবার কথা। তা না হয়ে ওর ভীষণ বিরক্ত লাগছে। তেল মারারও একটা সীমা আছে। বিরক্ত হলেও কদম বেশ বুঝতে পারছিল যে কোন উপায়ে জলিল তাকে খুশি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই যে আজ প্রচণ্ড দুর্যোগ মাথায় করে বন্ধু প্রীতি দেখাতে চলে এসেছে, এটা নিছকই একটা অছিলা। আসল উদ্দেশ্য কদমকে দেখতে আসা। কদমের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটানো। খুব সম্ভবত কদমকে তার বিশেষ পছন্দ হয়েছে।
বেহেড মাতাল অবস্থায় অতি উৎসাহে জলিল একটা কাণ্ড করে বসল। যার জন্য কদম একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। জলিল ওকে ওদের সঙ্গে বসে মদ খেতে অনুরোধ করল। কদম আকাশ থেকে পড়ল মনে হলো।
সে মাথা নেড়ে তার অসম্মতি প্রকাশ করল। জলিলের জেদ আরো বেড়ে গেল। সে উঠে এসে কদমের হাত চেপে ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। জলিলের হাতখানা লোহার মত শক্ত। কদমের মনে হলো বেশি টানাটানি করলে ওর হাতটা শরীর থেকে আলাদা হয়ে যাবে। সে করুণ চোখে পবনের দিকে তাকালো। পবনের তখন আরো করুণ অবস্থা। ঝড় জলের রাতে ফ্রিতে মাল টেনে আসলেই তার প্রচণ্ড নেশা হয়ে গেছে। জলিলের কাণ্ড দেখে সে খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসছে। যেন খুব একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। সে হাসতে হাসতে বলল,”অমন করছ কেন কদম? জলিল ভাই এত করে বলছে, খাও না এক পেগ। তুমি না খেলে জলিল ভাই ভীষণ দুঃখ পাবে।”
কদম আগে কখনও মদ খায়নি। টাউনের মেয়ে-বউরা দিব্বি নাকি এসব খায়-টায় শুনেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা গেল কদম জলিলদের সাথে বসে মদ খাচ্ছে। জলিল খুব আগ্রহ নিয়ে নিজেই পেগ বানিয়ে দিচ্ছে। প্রথম পেগ মুখের কাছে আনতেই বিকট গন্ধে কদমের গা গুলিয়ে উঠলো। সে একবার পবন, একবার জলিলের দিকে তাকালো। দেখল তারা দু’জনেই বেশ আগ্রহ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন জীবনে কোন মেয়েমানুষকে এরা মদ খেতে দেখেনি। সেরাতে একটু আধটু নয়, ফটাফট তিন-চার পেগ মদ গিলে কদমের সে কী হাসি! হাসি আর থামতেই চায় না। হাসতে হাসতে কখনও পবন, কখনও জলিলের গায়ে ঢলে ঢলে পড়ছিল। সে রাতে জলিল আর বাড়ি ফেরার ঝামেলায় যায়নি। বাইরে অনবরত বৃষ্টি হয়েই চলেছে। থামবার কোন লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পরে, নেশাগ্রস্ত অবস্থায় কদম তখনও মাটিতেই পড়েছিল। পবনটা কোথায় পড়ে আছে অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না। আর জলিল? কদম যেখানটায় পড়ে ছিল ওর ঠিক গা ঘেঁষে জলিল বসে বসে বিড়ি টানছিল। নেশা তারও হয়েছে। তবে তার অবস্থা পবন বা কদমের মত না। আরো বেশি রাতে জলিল কদমের শরীরের দখল নিল। কদম টের পাচ্ছিল একটা পুরুষালী রুক্ষ হাত ওর শরীরের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে অদ্ভুত অস্থিরতার সাথে ঘুরেফিরে বেড়াচ্ছে। জলিল ওর বুকে, গলায় পাগলের মত মুখ ঘষছে। কদম বাঁধা দেওয়ার একটা ক্ষীণ চেষ্টা করল, কিন্তু সে চেষ্টা কোন কাজে এলো না।
দীর্ঘদেহী জলিলের ভারি শরীর খানা ওর শরীরে আরো ভালোভাবে চেপে বসার মুহূর্তে কদম বুঝি জ্ঞান হারালো।

কদম এখন যে ঘরটায় থাকছে, এই ঘরটা পবনই প্রতি মাসে পাঁচশো টাকায় ভাড়া নিয়েছিল। মাস খানেক ও-ই ভাড়া দিয়ে এসেছে। তারপরে বেশ কয়েক মাসের ভাড়া বাকি পড়ে গেল। বাড়িওয়ালা প্রায়ই এসে হম্বিতম্বি করেন। ক্লাবের ছেলেদের দিয়ে পবনদের ব্যবস্থা করবেন বলে ভয় দেখান। পবন বাড়িওয়ালার হাতে-পায়ে ধরাধরি শুরু করে দেয়। বাড়িওয়ালা মুখ কালো করে চলে যান। আবার পরের মাসে আসেন। পরে সেই সমস্ত বকেয়া টাকা জলিল মিটিয়েছে। এখন বাড়ি ভাড়ার টাকাটা সে-ই দেয়। ঘর এবং ঘরের মানুষ দুটোই এখন তার দখলে। কে পবন? এখানে পবন টবনের কোন অস্তিত্ব নেই। জলিল তার ছিঁড়ে আনা টবের গোলাপ সুকৌশলে হাতিয়ে নিয়েছে। কোনরকমের সমস্যা ছাড়াই। এ তল্লাটে কদমের এখন একটাই পরিচয়— জলিলের রক্ষিতা।
পবন এখান থেকে চলে গেছে তাও বছর তিনেক হয়ে গেল। কেউ তাকে চলে যেতে বলেনি। আবার থাকতেও বলেনি। জলিল পুরোপুরি কদমের দখল নেবার পরেও বেশ কিছুদিন এখানে ছিল। সারাক্ষণ মদ গিলে পড়ে থাকত। জলিল যখন কদমের কাছে আসত পবন ঘর থেকে বেরিয়ে যেত‌। প্রথম দিকে জলিলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার সময় পবন আশেপাশে থাকলে কদমের কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হত। পবনের অসহায় মুখটা মনে পড়ে যেত।
পবন এখান থেকে চলে যাবার পরেও আগে প্রায় প্রায়ই আসত‌। বেশ কিছুদিন ধরে ওর এখানে আসা কমে গেছে। কোথায় থাকে? কী করে? এসবের কোনকিছুই কদম জানে না। জানতেও চায় না। পবন কে হয় তার? আত্মীয়-স্বজন? বন্ধু? না অন্য কিছু? কিছুই না। সুতরাং পবনের কথা ভাবতে তার বয়েই গেছে। তবুও পবন তার কাছে আসে। বিনা কারণে অবশ্য আসে না। পকেটে টান পড়লে আসে। কদমের ধারণা আজও ঠিক একই উদ্দেশ্যে পবন তার কাছে এসেছে। কদম যে এত খারাপ খারাপ কথা বলে। দূর্ব্যবহারের চরম করে তাতেও কি ওর লজ্জা আছে? বেহায়া কোথাকার! দেখবে দেখবে না করেও এই প্রথম পবনকে ভাল করে দেখল কদম। দু’মাস পর, না তারও বেশী পবনকে দেখছে। কোনদিনই খুব যে আহামরি স্বাস্থ্য পবনের ছিল, বলা যাচ্ছে না। অন্তত যতদিন ধরে কদম ওকে চেনে, চেহারা সেই পাটকাঠি মার্কা। মুখের হাসিটা শুধু অমায়িক। ওই হাসি দেখেই তো কদম পটে গিয়েছিল। হাসির সাথে এমনভাবে গুছিয়ে কথা বলে, যে মিথ্যে কথাও সত্যি বলে মনে হয়।
কিন্তু আজকে যে মানুষটা ওর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে পবন না। পবন হতেই পারে না। দীর্ঘদিন মানুষের তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়ানো কোন বন্য জন্তু, যার মুখের আদল খানিকটা পবনের মত।
“কদম, আমি টাকা চাইতে আসিনি রে—” কতকটা কৈফিয়তের ভঙ্গিতে কথাটা বলল পবন। পবনের মুখের এই কথাটাও ঠিক পবনের মত না। টাকাপয়সার প্রয়োজন ছাড়া পবন ওর কাছে আসতে পারে, কদমের বিশ্বাস হচ্ছে না। কেননা পকেটে টান না পড়লে পবন কদমের কাছে খুব একটা আসে না। ও খুব ভালো করেই জানে কদমের উপরটা কঠিন, ভিতরটা নরম। একবার সামনে গিয়ে হাত পেতে দাঁড়ালে, আজেবাজে কথা শোনাবে। ওর মুখ বড় বাজে। কোনকিছুই আটকায় না। এই ধরনের মানুষদের মন খুব দয়ালু হয়। কদম কথা শোনায়, আবার দেয়ও। এই ক’বছরে ওর থেকে পবন কত টাকা নিয়েছে তার কোন হিসেব কদম রাখেনি। ইচ্ছে করেই রাখেনি। অন্যকে টাকা ধার দিয়ে হিসেব রাখার কথা তখনই আসে, যখন তা ফেরৎ পাবার নিশ্চয়তা থাকে। টাকা ধার নিয়ে ফেরৎ দেবার লোক পবন না, সেটা কদম খুব ভালো করেই জানে। আজ পবনের কথা শুনে কদম অবাক হচ্ছে। এই লোকটার টাকা ছাড়া ওর কাছে অন্য কী দরকার থাকতে পারে? কদম বুঝে উঠতে পারছে না।
—”আচ্ছা, তা কী করতে এসেছেন শুনি?” কদম জিজ্ঞেস করল।
—”আজকের রাতটা আমাকে একটু থাকতে দিবি?” পবনের কথার ভঙ্গিতে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে সে মহা সমস্যার মধ্যে আছে। আজ রাতটা কদম ওকে ঠাঁই না দিলে বেচারা আরো গাড্ডায় পড়ে যাবে।
কদম কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না। পবন এসে কোনদিন এমন আবদার করতে পারে ভাবেনি কখনও। সত্যি সত্যিই লোকটা বিপদে পড়ে তার কাছে আশ্রয় চাইতে এসেছে? নাকি ওর কোন অন্য মতলব আছে? পবনের মত মানুষকে দিয়ে একফোঁটা বিশ্বাস নেই। নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য এরা সব করতে পারে, সব।

(৪)
পবনকে কেমন যেন সর্বস্বান্ত দেখাচ্ছে। ওর দাঁড়িয়ে থাকার মধ্যেও কেমন একটা অনিচ্ছা অনিচ্ছা ভাব‌। কদম এখনও নূন্যতম ভদ্রতা দেখিয়ে ওকে বসতে বলাটাও প্রয়োজন বোধ করেনি। মনেই হয়নি ওকে বসতে বলা উচিত। কদমের হঠাৎ মনে হলো, পবন কি অসুস্থ? বিরাট কোন মারণ রোগ ওকে ভেতরে ভেতরে হয়ত ফোঁপরা করে ফেলেছে। এবং সেটা সম্ভবত ও কোনভাবে জেনে ফেলেছে। “তোমার শরীর টরির খারাপ নাকি?” বলবে না বলবে না করেও কথাটা বলেই ফেলল কদম। পবন সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল,”একটু বসব রে?” বলে অনুমতির অপেক্ষা না করে ধপ করে মেঝেতেই বসে পড়ল। ও বোধহয় বুঝতে পেরেছে কদম ওকে বসতে বলবে না। যা ট্যাঁড়া মেয়েছেলে।

রাত বাড়ছে। পবন দরজায় হেলান দিয়ে মাথা নীচু করে বসে আছে। তার বসে থাকার মধ্যেও একধরনের অদ্ভুত গা-ছাড়া ভাব। দেখে মনে হচ্ছে সর্বসান্ত খুইয়ে কদমের সামনে নিজের মাথাটাকে নুইয়ে দিয়েছে। এখন কদম রাখলে রাখবে, কাটলে কাটবে। এই লোকটা কদমের অনেক ক্ষতি করছে। লোকটা তাকে শুধু রাস্তায় এনে দাঁড় করায়নি, ওর নারী সত্ত্বাকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। বহুবার ওকে চরম শিক্ষা দেওয়ার কথা ভেবেছে কদম। ওকে খুন করার কথাও ভেবেছে। আঁশ বঁটি দিয়ে ঘাড়ে এক কোপ, কিংবা খাবারের মধ্যে বিষ মিশিয়ে চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়াটা কোন ব্যাপারই না। অথচ ভাবাভাবিই সার, কাজটা আর করা হয়ে ওঠেনি। দুনিয়ায় কদমের যদি পরম শত্রু বলে কেউ থাকে সে হলো পবন। কদমের তো ওকে এখান থেকে গলাধাক্কা দিয়ে বার করে দেওয়ার কথা। সেটা না করে দিনের পর দিন ওকে সহ্য করে যাচ্ছে। অদ্ভুত নারীর মন।
হঠাৎ কদমের মনে হলো আচ্ছা, পবন নিশ্চয়ই অভুক্ত। শুধু আজ নয়, ক’দিন ধরেই হয়ত খাওয়া-দাওয়া কিছু হয়নি। পকেট শূন্য। পবনের এমন কোন হিতৈষী আছে বলে কদমের জানা নেই যে, ওকে জামাই আদর করে খাওয়াবে। সেরকম সুসম্পর্ক ও কারো সাথে বজায় রেখেছে বলে মনে হয় না। জগতে কিছু মানুষ থাকে যারা নিজেদের কর্মদোষে কখনই অন্যের আস্থা অর্জন করতে পারে না। পবন সেই প্রজাতির একজন। খুব সম্ভবত কদম তার ব্যতিক্রম। যে লোকটা ওর এত বড় ক্ষতি করেছে সেই লোকটাকেই যেন কোন দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে প্রশ্রয় দিয়ে আসছে। মুখে যতই আজেবাজে কথা বলুক অন্যদের মত কদম ততটা কঠোর হতে পারবে না, যতটা হওয়া দরকার ছিল। এবং সেটা পবন খুব ভালো করেই জানে। আর জানে বলেই এমন বেহায়ার মত বারে বারে ওর দরজায় এসে দাঁড়ায়।
কদমের ঘরে খাবার বলতে তেমন কিছু ছিল না। ও বেলায় বলার মত কিছু রান্না করেনি। ইচ্ছে করেনি। ডাল, আলু সেদ্ধ আর ভাত। তাও ঠিক করে খাওয়া হয়নি। মুখে তুলতে গিয়ে ওক চলে আসছিল। সেই ভাত কিছুটা ছিল। এবেলায় আর কিছু করার ইচ্ছে ছিল না। ক্ষিদে নেই। যা ছিল তাই পবনকে খেতে দিয়েছে। একবার ওর মনে হয়েছিল, পাড়ার দোকান থেকে চট করে একটা ডিম এনে সেদ্ধ বা ওমলেট করে দেয়। পবন ডিমের ওমলেট খুব পছন্দ করে। পরক্ষণেই সেই ইচ্ছে বাতিল করেছে কদম। এত খাতির যত্ন করার কোন দরকার নেই। যা আছে খেলে খাবে, না খেলে না খাবে। পবন তাই গোগ্রাসে গিলেছে। ওর খাওয়ার ভাব দেখে মনে হচ্ছিল মামুলি কোন খাবার নয় কোন মহার্ঘ্য খাবার খাচ্ছে। খাওয়ার সময় পবন কোনদিকে তাকায়নি। খেতে বসে ওর বকবক করা স্বভাব। অথচ আজ খাওয়ার সময় মুখ দিয়ে একটা শব্দ পর্যন্ত করেনি। একবার মুখের কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করেনি, কদম খেয়েছে কিনা। ওর ভাবভঙ্গি দেখে কদমের চোখদুটো হঠাৎ কেমন যেন জ্বালা করে উঠল। কদম কাজের অছিলায় ঘর থেকে বেড়িয়ে এসেছে। ওর চোখের কোণে চিকচিক করছে ওটা কী? জল? কদম কি কাঁদছে?

কদমের একজায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়াতে ইচ্ছে করছে না। ভাবল একটু হাঁটাহাঁটি করলে বোধহয় ভালো লাগবে। সে উঠোনে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। টিকলির ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। টুকটাক কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। মনে হয় বিল্টু ফিরেছে। এটা অবশ্য নতুন কিছু না। ওর যা কাজের ধারা ঘরে ফেরার সময়ের কোন ঠিক ঠিকানা নেই। তার উপরে বছরের মধ্যে কম করেও চল্লিশদিন থাকে খাঁচায়।

পবনের খাওয়া হয়ে গিয়েছিল অনেকক্ষণ। কদম যখন ঘরে ঢুকল পবন তখন খাবারের থালার পাশেই শুয়ে পড়েছে। মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। কত রাত ঘুমোয় না তাই বা কে জানে। মানুষের যখন খারাপ সময় আসে নোংরা, এঁটোকাটা এসবের কোন বাছ বিচার থাকে না।
কদমের একবার মনে হলো, ওকে ডেকে তুলে চৌকিতে শুতে বলে। এক চৌকিতে দুজন— এটা তো নতুন কিছু না। এর আগেও এমনটা বহুবার হয়েছে। আজ হতে অসুবিধা কোথায়? ডাকতে গিয়েও কী মনে করে আর ডাকল না। এটা ঠিক হবে না। পবন আস্কারা পেয়ে অন্য মানে করতে পারে। এতটা বাড়াবাড়ি করা বোধহয় ঠিক হবে না। কদম ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল। ওর বড্ড ঘুমঘুম পাচ্ছে। ঘনঘন হাই তুলছে। কদম যেমনটা ভেবেছিল, বিছানায় পড়ার সাথে সাথেই ঘুম চলে আসবে, তেমনটা কিন্তু হলো না। ওর ঘুম আসছে না। ভেতরটা কেমন যেন অস্থির অস্থির করছে। আসলে বেশ কিছুদিন ধরেই কদম ভীষণ একলা পড়ে গেছে। দীর্ঘদিন জলিলের কোন খোঁজ খবর নেই। ও বোধহয় ময়না মাগীটাকে নিয়ে বিশাল মস্তিতে আছে। এদিকে বড় একটা আসে টাসে না। আজ যদিও বা এলো তাও খুব বেশিক্ষণ থাকেনি। পবনের হাত ধরে গ্রাম ছেড়ে চলে আসার পর থেকে একের পর এক জীবনের অন্ধকার দিকগুলোর সাথে পরিচয় হয়েছে কদমের। কিন্তু কখনও এমন দুরবস্থা হয়নি। হাতে যা টাকাপয়সা ছিল সবই প্রায় শেষ। বড্ড হাত টানাটানি যাচ্ছে আজকাল। এমন দুঃসময়ে পবন এসে জুটলো। ওর মতলবটা যে আসলে কী কদম এখন ও ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি।

কদম চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। চোখ বুজে ঘুমোবার চেষ্টা করছে। তবুও ঘুম আসছে না। আসবে বলেও মনে হচ্ছে না। আসার হলে এতক্ষণে ঠিক চলে আসত।
—”কদম, ঘুমিয়ে পড়লি না-কি?” পবনের ডাকটা কদম শুনতে পেয়েছে। ও বোধহয় কোন কারণে জেগে গিয়েছে। অথবা এমনটাও হতে পারে ও হয়ত আসলেই ঘুমোয়নি। এতক্ষণ ধরে ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল। অন্ধকারে কিছু দেখা যাচ্ছে না। তবুও কদমের মনে হলো পবন শুয়ে শুয়েই কথা বলছে। কদম কোন সাড়াশব্দ করল না। হাত পা শক্ত করে মটকা মেরে পড়ে থাকল। পবন আবার কথা বলল, “কদম! কথা বলছিস না কেন? আমি জানি তুই জেগে আছিস।”
কদম অবাক হলো, অন্ধকারের মধ্যে পবন কী করে বুঝলো যে ও ঘুমায়নি জেগে আছে? কদম বলল,”কী হলো তোমার আবার? বেশ তো ঘুমাচ্ছিলে।”
—”ঘুমাইনি রে। চোখদুটো একটু লেগে এসেছিল।”
কদম কিছু বলল না। ওর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া কথা বলার জন্য বিষয় দরকার। কার সাথে কথা বলছি সেটাও দেখা দরকার। পবন সেই মানুষ না যার সাথে কথা বলা যায়। এইসময় পবনের এখানে থাকার কথা না। তবুও সে আছে। কদম না চাইলেও আছে।
বেশ কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। বোধহয় দুজনার কেউই বলার মত কথা খুঁজে পাচ্ছে না। বা কী বলবে ঠিক করে উঠতে পারছে না।
পবনই নিরবতা ভেঙে পুনরায় বলল,”জানিস কদম, তুই যে এইমাত্র বলছিলি না আমি ঘুমাচ্ছিলাম, কথাটা খুব একটা ভুল বলিসনি। আমি বোধহয় ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে একটা চমৎকার স্বপ্ন দেখছিলাম।”
কদম এবারেও কোন কথা বলল না। পবন কী স্বপ্ন দেখেছে, সেটা জানার জন্য সে কোনরকম উৎসাহ বোধ করছে না। যে লোকটা ওর এতবড় ক্ষতি করেছে, যে লোকটা ওর মতে কোনো মানুষের পর্যায়ে পড়ে না, তার স্বপ্ন জানার কোনো ইচ্ছেই কদমের নেই।
পবন বলল,”জিজ্ঞেস করলি না তো কী স্বপ্ন দেখেছি?”
—”তোমার স্বপ্ন জেনে আমি কী করব?”
—”আসলে স্বপ্নটা তোকে নিয়ে—” পবনের কথা শুনে কদম একটু অবাকই হল। এই লোকটা ওকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছে? অদ্ভুত ব্যাপার! এসবের মানে কী? কী বলতে চায় ও? নতুন করে আবার কোন বদ মতলব আঁটছে না তো? আবার হয়তো কোন বড়সড় বিপদের মুখে ফেলতে চায়। জলিলের সাথে ওর সম্পর্কটা এখনও হয়তো ঠিকমত হজম করে উঠতে পারেনি। এটা নিয়ে কখনও কিছু বলেনি এটা যেমন ঠিক, তবে ভেতরে ভেতরে আক্রোশটা হয়ত পুষে রেখেছে। এখন সুযোগ বুঝে কাজে লাগাতে চাচ্ছে। কথাটা মনে হতেই কদম মনটাকে শক্ত করার চেষ্টা করল। এই লোকটাকে আর বাড়তে দেওয়া ঠিক হবে না। ন্যাড়া বেলতলায় ততক্ষণ যাওয়া আসা করে, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার মাথায় আস্ত একখানা বেল গাছ থেকে খসে পড়ছে। কদমের মাথায় হয়ত বেল পড়েনি তবে তার চেয়েও ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। শুধুমাত্র অন্ধের মত এই লোকটার উপরে ভরসা করে।
কদম মুখে আর দ্বিতীয় কোন শব্দ করল না। চুপ করে থাকলো। পবন ওকে নিয়ে কী ধরনের স্বপ্ন দেখেছে সেটা জানার জন্যও কোন রকমের আগ্রহ দেখাল না। যদিও খুব ভালো করেই জানে ও শুনতে না চাইলেও পবন স্বপ্নের কথাটা ঠিক শোনাবে। দেখা গেল কদম যেটা ভাবছে, সেটা ঠিক ভাবছে। পবন বলল,”স্বপ্নে দেখলাম তুই আর আমি এখান থেকে দূরে কোথাও চলে গেছি। দূরে—বহু দূরে। জায়গাটায় এর আগে কখনও আমরা যাইনি। একেবারে অচেনা একটা জায়গা। যেখানে আমাদের কেউ চেনে না। আমরাও কাউকে চিনি না। আমরা আবার নতুন করে সংসার পেতেছি। সম্পূর্ণ নতুন একটা জীবন। যে জীবনের সমস্ত কিছুই নতুন।”
পবনের কথা শুনে কদম খুশি হচ্ছে না। ওর খুব রাগ লাগছে। পুরুষ মানুষগুলো নিজেদের কী ভাবে কে জানে। ওরা প্রতিবার অন্যায় করে যাবে, আর মেয়েরা বারেবারে ওদের মন ভোলানো কথা শুনে সবকিছু ভুলে গিয়ে আহ্লাদে নাচতে আরম্ভ করবে? ভারি অদ্ভুত তো! কদমের ইচ্ছে করছে পবনকে আচ্ছা করে কতগুলো কড়া কড়া কথা শুনিয়ে দেয়। দুনিয়ার সবচাইতে বিষধর সাপটিকে প্রয়োজনে বিশ্বাস করা যেতে পারে, কিন্তু পবনকে নয়। একবার বিশ্বাস করে মহা ঠকা ঠকেছে। কাজেই দ্বিতীয়বার বিশ্বাস করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। কদম কিছু বলার আগেই পবন বলল,”স্বপ্নটা দেখে অনেকক্ষণ ভাবলাম বুঝলি। ভেবে দেখলাম একটা মানুষ জীবনে অনেকগুলো ভুল করে। মারাত্মক মারাত্মক সব ভুল। যে ভুলগুলোর কোন ক্ষমা হয় না। কিন্তু সেই ভুলগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষটা যদি ভুলগুলো শুধরে নিতে চায়, আমার মনে হয় তাকে অন্তত একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। তাই না? কদম তুই কি শুনছিস আমার কথা?”
কদম উত্তরে হ্যাঁ না কিছুই বলল না। আপাতত বলার কোন প্রয়োজনও বোধ করছে না। শুধু লোকটার সাহস দেখে অবাক হচ্ছে। এত কাণ্ডের পরেও ও কী করে ধরে নিলো যে, কদম ওর কথায় বিশ্বাস করবে? অসম্ভব।
পবন বলে চলে,”দ্যাখ্ কদম, আমি মানছি তোর সঙ্গে আমি বিরাট অন্যায় করেছি। আজকে তোর এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী। আমি চাচ্ছি আমার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে। চল না, আমরা দূরে কোথাও চলে যাই।”
কদম কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু বলা হলো না। হঠাৎ কেউ যেন দরজায় জোর ধাক্কা মারল। মনে হচ্ছে বাইরে থেকে কেউ অস্থিরভাবে দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করছে। তার এক মুহুর্তও তর সইছে না। এত রাতে কে হতে পারে? কদম আওয়াজ দিল,”কে?”
—”দরজা খোল, কদম!”
জলিল না? জলিলের গলার স্বর চিনতে কদমের ভুল হবার কথা না। এই অসময়ে কী মনে করে? এত জোরে জোরে ধাক্কাচ্ছে মনে হচ্ছে এক্ষুনি না খুললে দরজা ভেঙেই ভেতরে ঢুকবে। কদম পড়িমরি করে চৌকি থেকে নেমে গিয়ে দরজাটা খুলে দিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই জলিল ওকে এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ল। ধাক্কাটা এতটাই জোরে ছিল, টাল সামলাতে না পেরে কদম মাটিতে পড়ে গেল। জলিলের গলা শোনা গেল,”কোথায় শুয়োরের বাচ্চাটা!”
ও বোধহয় কোন কারণে ভীষণ রকমের ক্ষেপে আছে। আর সেই ক্ষেপে থাকার কারণ যে পবন সেটা বুঝতে কদমের অসুবিধা হলো না। কিছুদিন ধরে জলিলের ব্যবসার অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। ওর সবক’টা দুনম্বরি ধান্দার খবর পুলিশ জেনে ফেলেছে। আজকাল এরা খুব সমস্যা করছে। টাকাপয়সা দিয়েও ব্যাপারটাকে ম্যানেজ করা যাচ্ছে না। বলছে, উপর থেকে বিরাট প্রেসার আছে। এখন কোনভাবেই কিছু করা যাবে না। জলিলকে যে এখনও খাঁচায় ঢোকায়নি এটাই অনেক বেশি। আশ্চর্য! হঠাৎ করে এরা কি সব সতী হয়ে উঠল নাকি? এরকম দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকলে তো সমস্যা।
জলিলের কাছে বিশ্বস্ত সূত্রের খবর আছে, ওর দুনম্বরি ধান্দার সমস্ত খবরাখবর পবনই পুলিশকে সাপ্লাই করেছে। সুতরাং পবনের উপর ওর আক্রোশ থাকাটাই স্বাভাবিক। অনেকদিন ধরেই পবনকে গরু খোঁজা খুঁজছে জলিল। চারিপাশে লোক লাগানোই ছিল। পবন যে আজ এখানে এসেছে ঠিক ওর কানে খবর পৌঁছে গেছে। কদম কিছু বুঝে ওঠার আগেই তুমুল ধস্তাধস্তির শব্দ। অন্ধকার ঘরের মধ্যে কেউ যেন গোঙাচ্ছে। পবন না? পবনই তো মনে হচ্ছে। গোটা বিষয়টা বুঝে উঠতে কদমের খানিকটা সময় লেগে গেল। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। প্রথমে অন্ধকার হাতড়ে ঘরের আলোটা জ্বালল। তখনই ওর নজরে পড়ল পবন মাটিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। ওর পিঠের উপর শুয়ে পড়ে জলিল তার ডান হাতের বেষ্টনীতে পবনের গলা পেঁচিয়ে ধরেছে। পবন কাটা পাঁঠার মতো নাগাড়ে ছাট পাড়ছে। জলিলের গায়ে অসুরের শক্তি। এখন রেগে থাকার কারণে সেই শক্তি দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে। দুর্বল পবনের ওর সাথে এঁটে ওঠার কথা না। জলিলের চোখদুটো প্রবল আক্রোশে ভাঁটার মত জ্বলছে। ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে পবনকে সে খুন করে ফেলতে চায়। এবং সে জন্যে আজ ও তৈরি হয়েই এসেছে। পবন এখনও গোঙাচ্ছে। ওর গোঙানির মধ্যে এই ভয়াবহ আক্রমণের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার করুণ আর্তি কদমকে অস্থির করে তুলল। ও চাচ্ছে কিছু একটা করতে; কিন্তু কী করা উচিত সেটা চট করে ঠিক করে উঠতে পারছে না। হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল কদমের। ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা আঁশ বঁটিখানা তুলে এনে জলিলের ঘাড়ে সজোরে কোপ বসিয়ে দিল। একবার নয়, বারংবার। এমন অভাবনীয় আক্রমণের জন্য জলিল তৈরি ছিল না। গোটা ব্যাপারটা তার কাছে সম্পূর্ণ ভাবে অপ্রত্যাশিত ছিল। কদমের মুহুর্মুহু আক্রমণে ওর দিশেহারা অবস্থা। ঘাড় পিঠ ভীষণভাবে ক্ষত বিক্ষত হয়ে গেছে। সে মারণচিৎকার দিয়ে উঠল। তার আর্তচিৎকার রাতের নিস্তব্ধতাকে ফালা ফালা করে দিয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল।
কিছুক্ষণের ভেতরেই ওর হাতের বেষ্টনী আলগা হয়ে গেল। কদম একটা লাথি মেরে ওকে মাটিতে ফেলে দিল।
পবন গলায় হাত বোলাচ্ছে। গলায় চাপ খেয়ে ওর কাশি চলে এসেছে। মুখ দিয়ে অনবরত লালা ঝরছে। একটু আগেই সাক্ষাৎ মৃত্যুকে সে খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছে সে। নেহাত কপালে আজ মৃত্যু লেখা নেই। তাই কোনক্রমে এ যাত্রা বেঁচে গেছে। বলা ভালো কদম ওকে আজ বিরাট বাঁচা বাঁচিয়ে দিয়েছে। নিজেকে সামলে নিতে ওর এখন বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। পবন দেখতে পেল জলিলের অমন বিরাট শরীরটা চিৎ হয়ে মাটিতে পড়ে আছে। ওর বুকের উপর আঁশ বঁটির বেশ খানিকটা অংশ চেপে বসে গেছে। পাশেই কদম দাঁড়িয়ে আছে। মাথার চুল খোলা। সারা মুখ রক্তে প্রায় ঢেকে গেছে। যে রক্তের দাগ এসে লেগেছে ওর হাতে, শাড়িতে সমস্ত জায়গায়। রীতিমত মত ফুঁসছে মেয়েটা। মুখ দিয়ে অদ্ভুত একধরনের শব্দ বেরোচ্ছে। যে শব্দ নিস্তব্ধ রাত্রির বুক চিড়ে যেন কোন অশনি সংকেতের মত পবনের কানের কাছে এসে প্রবলভাবে আছড়ে পড়ছে। ওর মাথায় কিছুই ঢুকছে না। মাথার ভেতরটা যেন মনে হচ্ছে পুরোপুরি ফাঁকা হয়ে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও পবন কদমের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারল না। ওর কেমন যেন ভয় ভয় করছে। কদমের এই রূপ আগে কখনও দেখেনি পবন। এই কদমকে সে চেনে না। ওকে দেখে মনে হচ্ছে কোন অশরীরী আত্মা ওর ওপর ভর করেছে। রক্তের নেশায় পাগল হয়ে উঠেছে। এক্ষুণি হয়তো বিশ্রী শব্দ করে হেসে উঠবে। ভয়ংকর ধরনের হাসি। যে হাসি কোন মানুষের নয়, একজন রক্তলোভী হায়েনার। অথচ কদম হাসছে না। নির্লিপ্ত ভাবে মাথার চুল ঠিক করছে। ওর মুখচোখ অদ্ভুত রকমের শান্ত দেখাচ্ছে। যেন কিছুই হয়নি। ও যে এতবড় একটা ভয়ংকর কাজ করে ফেলেছে তার জন্য কোনরকমের তাপ উত্তাপ ওর মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অসুরদলনী দেবী দূর্গা এইমাত্র একটা ভয়ংকর অসুরকে নিধন করে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। পবন চেয়ে আছে নিস্পলকে । ওর চোখেমুখে ভয়-ভক্তি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। কদম নিশ্চিন্তে নিজের মাথার চুলগুলো ঠিক করে নিচ্ছে। দাঁত দিয়ে চুলের ক্লিপ চেপে ধরে আছে। ক্লিপটা খোঁপায় আটকে নিয়ে পবনের সামনে এসে দাঁড়ালো কদম। ডান হাতটা বাড়িয়ে ধরলো পবনের দিকে। পবন কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। বেচারা অদ্ভুত এক দোটানার মধ্যে পড়ে গেছে। সত্যি বলতে গেলে কদমকে সে এখন রীতিমত ভয় পাচ্ছে। কদম ওর মনের ভাব টের পেল কিনা বোঝা গেল না। এক ঝটকায় পবনকে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল। তারপর টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো।
বাইরে ঘন অন্ধকারে কিছুই প্রায় দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিন গলির মাথায় ইলেকট্রিক পোলে আলো জ্বলে। আজ কেন জ্বলছে না বোঝা যাচ্ছে না। এখন রাত কত হবে তাইবা কে জানে। পবনের পকেটে মোবাইল ফোন আছে। ইচ্ছে করলেই সে সময়টা দেখে নিতে পারে। কিন্তু পবন সেটা করছে না। সম্ভবত এই মুহূর্তে তার সমস্ত বাহ্যিক জ্ঞান পুরোপুরি লোপ পেয়েছে। মোবাইলের কথাটা তার আর মাথায় আসছে না। কদম হাঁটছে। পবনের হাতটা সে এখনও শক্ত করে ধরে রেখেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা দুজনে পাড়া ছেড়ে রাস্তায় চলে এলো। প্রকৃতি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। এ ঘুম চট করে ভাঙবে বলে মনে হয় না। কদম হাঁটছে তো হাঁটছেই, ওর সাথে সাথে পবন। অন্ধকারে কদমের মুখটা ভালকরে দেখা যাচ্ছে না। তবে এটুকু পবন বুঝতে পারছে কদমের মনের ভিতরে ঝড় উঠেছে। উথাল পাথাল ঝড়। যে ঝড়ের সামনে পড়ে গিয়ে জলিলের মত দানবও একটু আগেই বেঘোরে মারা পড়েছে। পবনের যেন কিছুই করার নেই। নিঃশর্তভাবে কদমের হাতে নিজেকে সঁপে দেওয়া ছাড়া। এখন তার একটাই কাজ কদমের হাত ধরে চলতে থাকা। এই চলা কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানে না। মেয়েটা যে কোন নিরুদ্দেশের পথে যাত্রা শুরু করেছে বলা যাচ্ছে না।

|| সমাপ্ত||

Developed by