Breaking
15 Apr 2025, Tue

প্রাচীন জনপদ ও বাংলার বিলুপ্ত রাজধানী বিজয়পুরের কথা

স্বপন কুমার দাস (ক্ষেত্র গবেষক),

Advertisement

এইকাল নিউজ:

এই বাংলার বর্তমান রাজধানী কলকাতা যদিও এখন কার্যক্রম করা হয় নবান্ন থেকে কিন্তু খাতায়-কলমে বাংলার রাজধানী কলকাতা। কলকাতা অবশ্য সেই সময় গোটা ভারতবর্ষের রাজধানী ছিলো, 1911 সালে রাজধানী চলে যায় দিল্লিতে। আমরা যদি অতীতের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাবো এই বাংলায় বিভিন্ন সময় বিভিন্ন শাসকবর্গ তাদের রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠা করে দেশ শাসন করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বলা চলে ইংরেজ আমলে কলকাতা রাজধানী ছিল তার আগে বাংলা বিহার উড়িষ্যার রাজধানী ছিল মুর্শিদাবাদ, মুঘল আমলে সুবে বাংলার পরিচালনা করা হতো বিভিন্ন স্থান থেকে, সুলতানি আমলে বাংলার রাজধানী ছিল গৌড়, মহারাজা শশাঙ্কের আমলে বাংলার রাজধানী ছিল কর্ণসুবর্ণ, সেন বংশের আমলে বাংলার রাজধানী ছিল নবদ্বীপ এবং বিজয়পুর আজ আমরা আলোচনা করব এই বিজয়পুর কে নিয়ে।সেন বংশের এই রাজধানী বিজয়পুর আমরা অতীত ইতিহাস থেকে জানতে পারি। কিন্তু এই বিজয়পুর কোথায় ছিল তা নিয়েই এই আলোচনা। রাজধানী বিজয়পুর নিয়ে ঐতিহাসিক গানের মধ্যে মতভেদ থাকলেও বহু ঐতিহাসিক তথ্যাবলী দিয়ে প্রমাণ করেছেন বর্তমান বিজপুর অতীতের সেই রাজধানী বিজয়পুর। বিজপুর এই প্রাচীন জনপদটির অবস্থান কাঁচরাপাড়া স্টেশন সংলগ্ন স্থানে। আজও এই নামে মৌজা রয়েছে। বিজপুর নামকরণ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় অতীতের বিজয়পুরের অপভ্রংশ এই বিজপুর। বিজপুর সংলগ্ন স্টেশনের নাম কাঁচরাপাড়া হলেও এই এলাকার থানার নাম বীজপুর এবং বিধানসভার নামও বিজপুর রাখা হয়েছে। এই বিজপুর বা বিজয়পুর হল বাংলার হিন্দু যুগ বলে খ্যাত সেন বংশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বিজয় সেনের রাজধানী। তিনি পিতা হেমন্ত সেনের পর সেন বংশের উত্তরাধিকারী হয়ে তার সাম্রাজ্যকে নিজ বাহুবলে অবিভক্ত বঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশে প্রসার করেছিলেন এবং তার এই রাজ্যকে পরিচালনা করার জন্য রাজধানী হিসেবে তৈরি করেছিলেন গঙ্গা তথা ভাগীরথী এবং যমুনার মধ্যবর্তী স্থানে যা পরবর্তীকালে বিজয়পুর নামে জনপদে পরিচিতি লাভ করে। বিখ্যাত ভাষাবিদ সুকুমার সেন তাঁর “বাংলা স্থাননাম” নামক গ্রন্থে ‘পুর’ নামাঙ্কিত জনপদের কথা আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, পুর কথাটি সংস্কৃত শব্দ থেকে উদ্ভূত এবং তা সংস্কৃত সাহিত্যে বহুল প্রচলিত। পুর শব্দটি অষ্টম নবম শতাব্দীতে ব্যবহৃত হতো। পুর নামাঙ্কিত জনপদ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের নামে সঙ্গে যুক্ত করেই জনপদের নাম করণ করা হতো। সাধারণত নামের পরেই এর ব্যবহার। বিজপুর জনপদের নাম মহারাজা বিজয় সেনের সঙ্গে সম্পর্কিত। আজ থেকে প্রায় হাজার বছর পূর্বে বিজপুর গ্রামের নামকরণ করা হয়েছিল বিজয়পুর। মহারাজা বিজয় সেন সেই সময়কার বাংলার সামন্ত রাজাদের পরাজিত করে বিশাল সাম্রাজ্য তৈরি করেছিলেন। তারপর রাজধানীকে সুরক্ষিত স্থানে নির্মাণের জন্য যমুনা ও ভাগীরথী নদী বেষ্টিত বর্তমান কাঁচরাপাড়া তথা বিজপুর থানা এলাকায় তার রাজধানী স্থাপন করেন। তার রাজধানী যে এই অঞ্চলে ছিল তার প্রমান মহারাজা লক্ষণ সেনের সভাকবি ধোয়ী লিখে গেছেন তাঁর পবন দূতম কাব্যগ্রন্থে। বল্লাল সেন এবং লক্ষণ সেনের রাজত্বের সময় বাংলায় সংস্কৃত চর্চা উচ্চাসনে চলে গিয়েছিল। গোটা ভারতবর্ষে সেকথা পৌঁছে গিয়েছিল। সেই সময় উমাপতি ধর, জয়দেব, শরণ, কবিরাজ চক্রবর্তী ধোয়ী, গোবিন্দাচর্যরা খ্যাতির উর্ধগগনে বিচরণ করতেন। কবি ধোয়ী শ্রুতিধর বলে বিখ্যাত ছিলেন। তার পবনদূত কাব্য গ্রন্থটি পুঁথি নৈহাটির সুসন্তান হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কার করেছিলেন। এই পুঁথিটি পাবার পর ১৩০৫ বঙ্গাব্দে সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় ধোয়ী কবির পবন দূতম শীর্ষক একটি প্রবন্ধ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন। তবে বিজয়পুরের এই দাবি যে শুধু খাতা-কলমে সীমাবদ্ধ বা পুরনো গ্রন্থাদির মধ্যে রয়েছে তাই নয় পাথুরে প্রমাণ রয়েছে এই দাবির পক্ষে। এই অঞ্চলের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিনয় ঘোষ উল্লেখ করে গেছেন তার পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি গ্রন্থতে। এখানকার ইতিহাস যে সেন আমল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাতে সন্দেহের বিশেষ কারণ আছে বলে মনে হয় না। এ অঞ্চলের ডাঙ্গাপাড়ার শা-পুকুর নামে একটি প্রাচীন পুস্কুরিনী থেকে একটি পাথরের চতুর্ভুজ গণেশ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এই গণেশ মূর্তি সম্বন্ধে তিনি বলেছেন শাপুকুর থেকে খুঁড়ে পাওয়া পাথরের চতুর্ভুজ গণেশের মূর্তিটি সেন আমলের সাক্ষী দিচ্ছে। এই মূর্তিটি উচ্চতায় প্রায় দুই ফুট এবং পদ্মাসনে উপবিষ্ট। চার হাতের মধ্যে অবশ্য দুটি হাত খোঁড়ার সময় ভেঙ্গে গেছে। হিন্দু যুগের আরো একটি বুদ্ধ মূর্তি পাওয়া গিয়েছে বিজপুর মৌজা সংলগ্ন বারুইপুর থেকে। এছাড়াও 2012 সালে এই বিজয়পুরের অন্তর্গত নাগদহ গ্রামে একটি প্রাচীন কষ্টিপাথরের মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছিল একটি পুকুর খননের সময় । সেই দেব মূর্তিটি পুকুর পাড়ে একটি ছোট দেবালয় গড়ে সেখানে পুজো শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যদিও সেই সময় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মূর্তিটি সংগ্রহশালায় রাখার জন্য অনেক চেষ্টা করা হয়েছিল কিন্তু স্থানীয় মানুষজন দেবজ্ঞানে পুজো করবেন তাই সেই মূর্তি প্রশাসন হাতে তুলে দেন নি। এই মূর্তিটিও বহু প্রাচীন। তাই এই স্থান যে সেই প্রাচীন সেন বংশের রাজধানী বিজয়পুর তা শুধু কথার কথা নয় পাথরে প্রমাণও রয়েছে এবং সেই শেরশাহের আমল থেকে আজও বিজপুর মৌজা বর্তমান ।বিজয়পুরের আদিম অধিবাসীদের মধ্যে নাবিক ও কৈবর্ত সম্প্রদায়ের সাহায্যে সেন বংশের মহারাজা বিজয় সেন বিজয়পুরে বিরাট সামরিক নৌঘাঁটির কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। কবিরাজ চক্রবর্তী ধোয়ী তাঁর পবনদূতম কাব্যগ্রন্থে কবি মলয় পর্বত থেকে গন্ধর্ব কন্যার সাহায্যে মলয় পবনকে দূত করে রাজধানী বিজয়পুরে পাঠিয়ে ছিলেন। সেই দূত রামেশ্বর থেকে কাঞ্চীপুর হয় অন্ধ্রপ্রদেশ পেরিয়ে কলিঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলিঙ্গ নগরী গিয়েছিল। তারপর যযাতিনগর হয়ে সর্বশেষে সুহ্মদেশে যাবার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই সুহ্মদেশে যমুনা নদীর তীরে সে দেশের রাজধানী বিজয়পুর অবস্থিত। একথা তিনি পরিষ্কার ভাবে লিখে গেছেন– ” স্কন্ধবারাং বিজয়পুর মিত‍্যুন্নাতাং রাজধানীং”। পবনদূতম কাব্য গ্রন্থের 36 তম শ্লোকে তিনি রাজধানী বিজয়পুরের নাম উল্লেখ করেছিলেন।

Developed by