মিশ্র বিয়ে বা আন্তঃধর্ম বিয়ে নিয়ে সংঘ পরিবার তৈরি করেছে ‘লাভ জিহাদ’-এর এক আজগুবি তত্ত্ব। প্রেম, প্রণয়, ভালবাসার বিয়ের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার তকমা লাগিয়ে সমাজে অস্থিরতা তৈরি করতে অসাংবিধানিক, বেআইনি এই শব্দ বন্ধ ‘লাভ জিহাদ’-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার লেখিকা ও সমাজকর্মী তহমীনা খাতুন। তিনি নিজে ‘না-ধার্মিক’ মানুষ। বিয়ে করেছেন বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪ অনুযায়ী বিশিষ্ট সাংবাদিক সুকুমার মিত্রকে। তহমীনা খাতুনের জীবন সংগ্রাম বিশিষ্ট লেখক, লেখিকাদের উপন্যাস, গল্প ও নাটকে স্থান পেয়েছে। সম্প্রতি অলংকার প্রস্তুতকারক সংস্থা তানিষ্ক-এর একটি বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে যে বির্তক উঠেছে সেই ঘটনার প্রেক্ষিরতে প্রতিবাদে এইকালের জন্য কলম ধরলেন তহমীনা খাতুন।
সম্প্রতি হিন্দু মুসলিম ঐক্য তুলে ধরতে একটি বাণিজ্যিক অলংকার প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘তানিষ্ক’ একটি বিজ্ঞাপণ প্রচার করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে। বিজ্ঞাপণের বিষয়বস্তু ছিল একটি হিন্দু পরিবারের মেয়ে মুসলিম পরিবারে বিয়ে করার পর গর্ভবতী হলে তাঁর শাশুড়ি তাঁকে স্বাদ ভক্ষণ করাতে গেলে মেয়েটি শাশুড়িকে জিজ্ঞাসা করেন যে মুসলিম পরিবার হিন্দু রীতি মেনে স্বাদ ভক্ষণ করানোর রীতি কেন? শাশুড়ি উত্তরে বলেন, মেয়েদের খুশি করতে সব জায়গায় মায়েরা এমনটাই করে। এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। এই বিজ্ঞাপনে আমরা মুসলিম পরিবার বা মুসলিম সমাজের মধ্যে সহনশীলতা দেখতে পেলাম। বহুত্ববাদী এই দেশ ভারতে এই ধরনের ভূমিকার একটা সামাজিক, মানবিক, নৈতিক মূল্যবোধের এর সুদুরপ্রসারী প্রভাব পড়ে। এসব কথা মৌলবাদীদের ভাল লাগার কথা নয়। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি বেজায় ক্ষেমপে গেল। তারা ওই তানিষ্ককে এমন হুমকি দিতে শুরু করে যে শেষ পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদীদের কাছে লিখিত ক্ষমা প্রার্থনা করে সংস্থাটি তাদের বিজ্ঞাপন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। সংঘ পরিবার এ ধরনের মিশ্র বিয়েকে মানে না তারা এই ধরনের বিয়েকে নয় ‘লিভ টুগেদার’ অথবা ‘লাভ জিহাদ’ বলে প্রচার করে থাকে। সংঘের প্রচার- মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়েদের নানাভাবে প্রতারিত করে, প্রলোভন দেখায় বা ফুসলিয়ে কখনওবা জোর করে বিয়ে করে নিয়ে যায়। তারপর তাদের অর্থাৎ ওই হিন্দু মেয়েদের নানাভাবে প্রতারিত করে। বাস্তবে দেখা যায় অন্য ছবি। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আজ অবধি যে সব হিন্দু মেয়েরা মুসলিম ছেলেদের বিয়ে করেছেন তাঁরা কেউ অসুখী নন। আদতে লাভ জেহাদ একটি অসাংবিধানিক তত্ত্ব। যার আইনি বা সাংবিধানিক কোনও ব্যাখ্যা নেই। এটা সংঘ পরিবারের পরিকল্পিত একটি সাজানো মুখরোচক ও উস্কানিমূলক তত্ত্ব। এই তত্ত্বকে সামনে রেখে এ ধরনের মিশ্র বিয়েকে রুখে দেওয়ার পথে নেমেছে সংঘ পরিবার। একেবারে অসাংবিধানিক ও বেআইনি তাদের এই উদ্যোগ হিন্দুত্ববাদীদের মদত পেলেও দেশের সাধারণ বিবেকবাণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আর তাই যতদিন এগুচ্ছে ততই এই ধরনের মিশ্র বিয়ের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। এতেই আরও চটছে সংঘ পরিবার। ক্রমশ মারমুখী ভূমিকায় এইসব বিয়ের দম্পতিদের বা পরিবারের সদস্যদের ওপর নৃশংস হামলা থেকে খুন পর্যন্ত ঘটছে। যা অনভিপ্রেত ও অমানবিক শুধু নয় সভ্যতার কলংকও। প্রেম, প্রণয়, ভালবাসাকে কোনও সময়ের মধ্যে বা ধর্মের অনুশাসনের গণ্ডিতে জোর করে বেঁধে রাখা যায় না, যাবেও না। একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ একজন প্রাপ্তবয়স্কা নারীকে ভালবেসে বিয়ে করবে তা ধর্মের এত আপত্তি কেন। ধর্ম তো চিরকাল মানুষকে পিছনে ঠেলে আরও আরও অন্ধকারে ফেলে দিচ্ছে। সেই সময় ভালবাসা যদি দুটি পৃথক ধর্ম সম্প্রদায় থেকে উঠে আসা মানুষকে একত্রে আনে তাতে দোষের তো কিছু দেখি না। বিয়ের পর বহু ক্ষেয়ত্রে মেয়েদের ধর্মান্তরিত হতে দেখেছি, পুরুষও ধর্মান্তরিত হন। আসলে পুরুষশাসিত সমাজে মেয়েদের উপর ধর্মীয় আদব কায়দাগুলি সুকৌশলে চাপিয়ে দেওয়া হয়। আর এই চাপিয়ে দেওয়ার কাজটি এখন আর পুরুষকে করতে হয় না। পুরুষতন্ত্রের প্রভাবে সেই দায়িত্বটি পালন করে থাকেন মেয়েরাই। এখন দিন বদলে যাচ্ছে নতুন প্রজন্ম নতুন সূর্য দেখছে তাই তাদের চিন্তা ভাবনায় আধুনিকতা খেলে বেড়াচ্ছে। তাই দুই ধর্মের মধ্যে বিয়ে হওয়ার পর যেমন ধর্মান্তরিত হওয়া আমরা দেখি তেমনি আধুনিক নিয়ম অনুযায়ী বিয়ে করলে ধর্মান্তরিত হওয়ার কোনও প্রশ্নই থাকে না। এ দেশে বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪ মতে বিয়ে করলে কোনও মেয়ে বা ছেলেকে ধর্ম, পদবি কিছুই পাল্টাতে হয় না। ধর্ম উল্লেখ করতেও হয় না। একেবারে ধর্মনিরপেক্ষ বিয়ে বলতে যা বোঝায় তা এই আইনে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪ অনুযায়ী এই বাংলায় প্রথম বিয়ে করেছিলেন ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে ও শেরে বাংলা খ্যাত ফজলুল হক-এর নাতনি নাসিমা বানু। এই আইন অনুযায়ী বিয়ে করলে দম্পতিদের ধর্ম মানা না মানার বিষয়টি একেবারে তাঁদের একান্ত ব্যাক্তিগত বিষয় বলে গণ্য হয়। দম্পতিদের কোনও একজন অপরের ধর্ম গ্রহণ করলেও এই আইন তার প্রতিবন্ধক নয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি ধর্মান্তরিত বিষয়টি পছন্দ করি না। সে তো আমার ব্যক্তিগত বিষয়।
আমি ১৯৯১ সালে ১১ অক্টোবর সুকুমার মিত্রকে বিয়ে করি বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪ মতে। বলা বাহুল্য আমরা দুজনেই ‘না-ধার্মিক’ মানুষ। ধর্ম আমাদের কারও জীবনকে প্রভাবিত করে না কোনও মতে। আমাদের প্রভাবিত না করলে কি হবে তথাকথিত সমাজ, প্রগতিশীল তকমাধারী বামপন্থীনেতাদের একাংশকে দেখেছি সংঘ পরিবারের সুরে কথা বলতে। বিয়ের পর ঘরভাড়া পেতে অসুবিধা হয়েছে। বারবার ঘর পাল্টাতে হয়েছে। পড়শিদের বাঁকা চোখের চাউনি টেরাবাঁকা কথা ছুড়ে দেওয়ার অন্ত ছিল না। সে সব এখন ইতিহাস। ১৯৯৩ সালে হাবড়া গান্ধি সেন্টিন্যারি বি.টি. কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে চরম বিপাকে পড়তে হয় আমাকে। সেখানে ভর্তির আবেদন পত্রে ধর্মের কলামে আমি X (ঢ্যারা কেটে) দিয়েছিলাম। আমার নাম তহমীনা খাতুন লেখার জন্য বামফ্রন্ট পরিচালিত কলেজ কর্তৃপক্ষোর বিশাল গাত্রদাহ হল। তাঁদের আব্দার ছিল ধর্ম কলামে আমাকে ‘হিন্দু’ লিখতে হবে ও স্বামীর পদবি ‘মিত্র’ উল্লেখ করতে হবে। এখানেও সেই পুরুষতান্ত্রিক ধর্মবেত্তাদের (যদিও একজন বাদে সকলেই তথাকথিত কমিউনিস্ট বলে পরিচিত) আবদার যা আমি মানতে পারিনি ফলে ওই কলেজে আমার ভর্তি হওয়া হল না। ইন্টারভিউ-এর নামে দুদিন ধরে আমাকে নিয়ে সিলেকশন কমিটির নাটক চলল। অবশেষে আমি বারাসত মুন্সেফ আদালতে মামলা করি। মামলায় নিম্ন আদালত সমূহের রায় সর্বদা আমার পক্ষেব থাকলেও আমি ভর্তি হতে পারিনি। বার চারেক গর্ভনিং বডি বদল হলেও আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ধর্ম কলামে ‘হিন্দু’ না লেখা এবং পদবি ‘মিত্র’ না লেখার অভিযোগে ভর্তি খারিজের পূর্বতন কর্তৃপক্ষে্র সিদ্ধান্তে অনুমোদন দিয়ে গিয়েছে। অবশেষে ওই মামলা কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে গড়ায়। কলেজ কর্তৃপক্ষেনর আপিলের প্রেক্ষি তে সেখানে মামলার শুনানি চলে। উচ্চ আদালতের রায় আমার পক্ষেে-প্রার্থীর ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁকে ভর্তি নিতে হবে মেধার ভিত্তিতে। মেধা ছাড়া অন্য কিছু বিবেচ্য হতে পারে না এমনটাও আদালত বারবার মন্তব্য করেছে। ইতিমধ্যে দশটা বছর পার হয়ে গিয়েছে। বি.এড পড়ার বয়সের উর্ধসীমা ৩৫ বছর সেটাও পেরিয়ে এসেছি। কিন্তু অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে আদালতের রায়ে ভর্তি হলেও বি.এড ক্লাস আর করিনি। কারণ ওই ডিগ্রি যে পেশার কারণে সেখানে অর্থাৎ শিক্ষিএকার চাকরির বয়স ৩৭ বছর। আমি বি. এড পড়ে পাশ যখন করতাম তখন আমার বয়স দাঁড়াত ৩৮ বছরের একটু বেশি। আমার বি.এড পড়া হয়নি কিন্তু এই রায়ের পর তৎকালীন সরকারের শিক্ষাি দপ্তর জি.ও দেয় যে, শিক্ষাা ক্ষেরত্রে ধর্ম লেখা বাধ্যতামূলক নয়। এটাই বড় সাফল্য। আমার লড়াইয়ের ফলে এই রাজ্যে আর কাউকে ধর্ম, পদবি লিখতে সরকারি, সরকার পোষিত শিক্ষাা প্রতিষ্ঠান বাধ্য করতে পারবে না। মহাশ্বেতা দেবী, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, সুনীল গাঙ্গুলীর উপন্যাসে এই কাহিনী উঠে এসেছে। মঞ্জুলা পদ্মনাভন নাটক লিখেছেন, লিখেছেন নবনীতা দেবসেন, ডাঃ ভবানীপ্রসাদ সাহু সহ অনেকেই।
নিজেকে তহমীনা খাতুন রাখার লড়াই-এর কাহিনী এখানেই শেষ নয়। ১৯৯৫ সাল। সুন্দরবনে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসজনিত বন্যার খবর সংগ্রহ করতে যান সুকুমার। পেশাগত কারণে ওর সেই সফরে আমিও সঙ্গি ছিলাম। আমিও একটি পাক্ষিুক পত্রিকায় তখন নিয়মিত লিখছি। সন্দেশখালির ন্যাজাতে হোটেল পান্থনিবাস-এ একটি ঘর বুকিং করে মালপত্র রেখে সংবাদ সংগ্রহে প্রত্যন্ত দ্বীপাঞ্চলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যাই। রাতে ফিরে হোটেলে চেক ইন-এ নাম, ঠিকানা, বিবরণ লিখতে গেলে হোটেলের ম্যানেজারের সে কি হম্বিতম্বি। আমাদের ক্লাবের ছেলেদের হাতে তুলে দিয়ে মার খাওয়ানোর হুমকি দিতে থাকে। তাঁর সাফ কথা- এসব দুনম্বরি কেস এখানে থাকতে দেব না। আমরা আমাদের সাংবাদিক পরিচয় পত্র দেখাই, বিয়ের সার্টিফিকেটের ফটোকপি দেখাই। কোনও সুরাহা হয়নি। আমি তখন চিকিৎসকের নির্দেশে মানসিক চাপ কমাতে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ খাচ্ছিলাম যার জের এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। ১৯৯৫ সালে সন্দেশখালির মত একটি জায়গায় বৃষ্টির রাতে ভরা কোটালে হোটেলের বারান্দায় আমাদের রাত কাটাতে হয়েছিল। মাঝরাতে পুলিশ ক্যাম্পে গেলে তারাও অভিযোগ না নিয়ে হোটেল মালিক ঠিক করেছে বলে দরজা বন্ধ করে দেয়। ডাসা নদীর পাড়ে ফেরিঘাটে রাত কাটাতে হয়েছিল। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন একটি ইংরেজি সংবাদপত্রের সংবাদ দেখে পুলিশ ক্যাম্পে কর্মরত পুলিশদের বিরুদ্ধে স্বতপ্রণোদিত মামলা শুরু করে। বারাসতে ডিস্ট্রিক্ট কনজিউমার ফোরামে হোটেল কর্তৃপক্ষেদর বিরুদ্ধে মামলা করি। সেই মামলার রায় আমাদের পক্ষে যায়। বিশাল অংকের ক্ষতিপূরণের অর্থ-এর পরিবর্তে আমরা প্রতীকী ‘একটাকা’ ক্ষতিপূরণ নিয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষকে রেহাই দিই। আমাদের আইনজীবী অসীম চট্টোপাধ্যায় শুধু বলেছিলেন, ‘টাকা নেওয়ার জন্য ওরা মামলা করেননি। মামলাটি ছিল অবিচারের বিরুদ্ধে অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই। এবার ওরা ওদিকে গেলে যত্নআত্তি করবেন।’ তারপর আর আমাদের এখনও ন্যাজাতে যাওয়া হয়নি। সেদিন এই মামলার নিষ্পত্তির পর বিচারক তাঁর চেম্বারে আমাদের আইনজীবী অসীম চট্টোপাধ্যায় ও আমাদের দুজনকে ডেকে চা খাইয়েছিলেন। প্রকাশ্য আদালতে বলেছিলেন এমন মামলাকারী আমি এ পর্যন্ত দেখিনি।
এই সময় চিকিৎসার জন্য দক্ষিাণ কলকাতার একটি সরকারি মানসিক হাসপাতালে গেলে সেখানে ধর্মের কলামে নাস্তিক লেখার জন্য চিকিৎসা তো পাইনি উল্টো দুর্ব্যবহার ও পরে ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়ি। তবু আমরা কোথাও কোনও আপোষ করিনি। লড়াই চালিয়েছি দাঁতে দাঁত চেপে। জানি লড়াইটা কঠিন আমাদের মত অতি নিম্নবিত্ত মানুষদের জন্য লড়াইতো করতেই হবে নীতির স্বার্থে, আদর্শের স্বার্থে, জীবনবোধের স্বার্থে। লড়াই যত কঠিন হোক জয় যখন আসে তখন তো ঢেউ ভাঙা আনন্দ নিয়ে আসে। আমাদের লড়াইকে বহু প্রতিষ্ঠিত মানুষ ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করলেও বহু সাধারণ মানুষ পাশে থেকেছেন সাহস জুগিয়েছেন। বিয়ের পর ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে তাঁর বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বিয়ের বহু আগে থেকে তাঁর সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল পারিবারিক কারণে। তাঁকে কাকু বলে ডাকতাম তিনি বলেছিলেন, ভয় পেও না, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। আসলে তিনি জানতেন এমন বিয়েতে কেমন ঝামেলা হয়। কারণ তিনি নিজেও এমন বিয়ে করে কম ঝামেলা পোয়াননি। বিশিষ্ট সাংবাদিক গৌরকিশোর ঘোষ তখন আনন্দবাজার পত্রিকায়। আমন্ত্রণ জানিয়ে সারাদিন তাঁর দপ্তরে আড্ডা ও ক্যান্টিনে নানা পদে ভুরি ভোজন করান। গৌরদা বলেছিলেন, মৌলবাদীদের ভয় পেলে চলবে না, তোরা যেভাবে লড়ছিস লড়ে যা, ফল পাবি। বিপ্লবী সুশীলকুমার ধাড়া তো মহিষাদল থেকে বারাসতে এসে আমাদের তখন ছোট্ট এক বাসায় ভাড়া থাকতাম সেখানে দুরাত কাটিয়ে গেলেন। লড়াইয়ে ভরসা শুধু নয়, সুকুমারের সংবাদপত্রে চাকরি বেতন সমস্যা খবর জেনে কলকাতায় কাজে এলে মাসে একবার করে হাতে টাকা গুজে দিয়ে বিনয়ের সঙ্গে বলতেন সংসার তো চালাতে হবে। মহাশ্বেতা দেবী তাঁকে দিদি বলে ডাকলেও তিনি মাতৃস্নেহে আমাদের আগলে রাখতেন। যখন যা ঘটবে তাঁকে জানাতে হবে এমনই ছিল তাঁর নির্দেশ। পাশে থেকে অভিভাবকের মত লড়াইয়ে মদত দিয়েছেন। একটা বটগাছের মত ছায়া ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। তৎকালীন শাসকদলের হুমকি ধমকির কথা দিদিকে জানালে সোজা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কর্তাদের ফোন করে বলতেন, ‘কি হচ্ছে তহমীনা-সুকুমারের সঙ্গে?’ অবিরাম লিখেছেন আমাদের সব লড়াইয়ের কাহিনী দৈনিকে তাঁর নিয়মিত কলামে। এত কথা লেখার তা স্বল্প পরিসরে লেখা সম্ভব না। কিছুটা লিখেছি আমার ‘চেনা মুখ, অচেনা মানুষ’ গ্রন্থে।
যাক ফের যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই কথায় আসি। আর.এস.এস হিন্দু মেয়েদের মুসলিম ছেলেদর বিয়েকে লাভ জিহাদ বলছে। তাহলে মুসলিম পরিবারের মেয়ে হিন্দু পরিবারের একটি ছেলেকে বিয়ে করলে তাঁদের কি বলবে? আমার জানা বেশ কয়েকটি মুসলিম মেয়ে হিন্দু পরিবারের ছেলেকে বিয়ে করে ধর্মান্তরিত হয়েছে। একে কি বলবে আর.এস.এস? বলিউডের নায়ক-নায়িকাদের মধ্যে তো আন্তঃধর্ম বিয়ে আকছার সেখানে কি সংঘ পরিবার লাভ জিহাদের তত্ত্ব শোনাচ্ছেন? সংঘ পরিবারের এই ‘লাভ জিহাদ’-এর তত্ত্বে মিশ্র বিবাহ বা আন্তধর্ম বিবাব বা ধর্মনিরপেক্ষ বিবাহকে রোধ করা যাবে না। প্রেম, ভালবাসা এক বেপরোয়া মনস্তাত্ত্বিক কঠিন সিদ্ধান্ত। যাকে হুমকি ধমকি দিয়ে রোখা যায় না। সম্প্রতি নদিয়ার হাঁসখালির এক মিশ্র বিয়ের দম্পতিকে কি নাজেহাল হতে হচ্ছে সংঘের উস্কানির ফলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আন সোশ্যাল মন্তব্যের ঝড় চলেছে ওই দম্পতি ও তাঁদের পরিবারদের উদ্দেশ্যে। গুটিকয়েক মানুষ প্রতিবাদ করলেও বাকিরা মুখে কুলুপ। এই চুপ থাকাটাই মৌলবাদীদের হাতিয়ার। আবারও বলছি বিশেষ বিবাহ আইন, ১৯৫৪ মতে বিয়ে করলে যে যার ধর্মে বহাল থাকতে পারেন, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আস্থাশীল নাও থাকতে পারেন। প্রাক-বিবাহ পদবি পরিবর্তনের দরকার হয় না। এসব একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এই ধরনের মিশ্র বিবাহ যত বাড়বে ততই বিদ্বেষ কমবে কেননা এখন দিন বদলেছে বহু পরিবার এ ধরনের বিয়েকে স্বাগত জানাচ্ছে। তাই দুটি পরিবারের মধ্যে সখ্যতা হলে একে অপরকে জানার সহজ সুযোগ হাতের নাগালে আসবে এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ কমবে। কমতে বাধ্য। আর একেই ভয় পাচ্ছে মৌলবাদী শক্তিরা। তারা যে ছাতার তলায় থাকুন না কেন।