Breaking
11 Apr 2025, Fri

‘বালান্দা মহাবিহার ও চন্দ্রকেতুগড়’-স্ব-শিক্ষিতের ইতিহাস কথা, লিখছেন সাংবাদিক ও আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ সুকুমার মিত্র

সুকুমার মিত্র

‘ইতিহাস দেশের গৌরবকথা বলিবার জন্য নহে, সত্য প্রকাশ করিবার জন্য।’ এই কথার যথার্থ মর্ম উপলব্ধি করে ইতিহাস অনুসন্ধানে নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন এম. এ. জব্বার। আর সেই সত্য প্রকাশের যে নানা উপকরণ তা সুসজ্জিতভাবে রক্ষাথ করার জন্য পরম যত্নে হাড়োয়ার খাসবালান্দা গ্রাম পঞ্চায়েতের মাঝেরআইট গ্রামে স্থাপন করেছিলেন বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালা। ইতিহাস কে লিখিবে? বহুচর্চিত সেই কথাটি- ‘তুমি লিখিবে, আমি লিখিব’ স্মরণে রেখে এম.এ.জব্বার পুঙ্খানুপঙ্খভাবে বালান্দা মহাবিহার, অতীতের হাড়োয়া ও চন্দ্রকেতুগড়ের ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করেছেন বৈজ্ঞানিক চেতনায় সমৃদ্ধ মন নিয়ে। তাঁর সেই সমস্ত লেখা কয়েকটি গ্রন্থ ও পুস্তিকায় ধরা ছিল। সেই সবগুলিকে দু’মলাটের মধ্যে এনে ‘বালান্দা মহাবিহার ও চন্দ্রকেতুগড়’ এই নামে সুনিপুন সংকলন ও সম্পাদনার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করেছেন তহমীনা খাতুন ও দীপককুমার দাঁ। গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ এম.এ.জব্বার-এর প্রাক্ জন্মশতবর্ষে এটি প্রকাশ করে সময়োচিত দায়িত্ব পালন করেছেন বলতেই হবে। আগামি ১৪ নভেম্বর,২০২০ শতবর্ষে পা রাখবেন। এই সময় তাঁর দুষ্প্রাপ্য বইগুলিকে ফের আগ্রহী ইতিহাস অনিসন্ধিৎসু মানুষদের হাতে সুবিন্যস্ত ছয়টি অধ্যায় ভাগ করে সংকলিত করা হয়েছে। রয়েছে অতীতের হাড়োয়া, বালান্দা চন্দ্রকেতু ইতিকথা(সচিত্র), অতীতের হাড়োয়াঃ পির গোরাচাঁদ-গড় চন্দ্রকেতু, বালান্দায় প্রাচীন সভ্যতার প্রবাহ ও গোরাই গাজি, পশ্চিমবঙ্গে বালান্দা মহাবিহার, সুন্দরবনে মেছোঘেরি, শ্রদ্ধায় স্মরণ, ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষ‌ণের প্রতিবেদন, ফটো অ্যালবাম। ছাত্রবস্থায় আঞ্চলিক ইতিহাসের দিকে এম.এ.জব্বারকে যে প্রভাবিত করেছিল তা তাঁর লেখার উদ্ধৃতি থেকেই অনুমান করা যায়। তিনি আমাদের কথা লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘ছেলেবেলায় ঘাড়কাটা পির, গোরাই গাজি, রাজা চন্দ্রকেতু, বেড়ায় চাপাফুল, রাঙা(লাল) মসজিদ আর ফুল ও কাঁটায় ভরা বেঁড়ুবাঁশ নিয়ে রূপকথার মতো বহু গল্প শুনেছি। সেই সঙ্গে জ্যৈষ্ঠ ও কার্তিকে ঝড়, বান আর নদীর ‘বাঁধের ভাঙনে), বিপর্যয়ে দুঃখের গপ্পো শুনেছি। আমার পূর্বপুরুষেরা প্রাকৃতিক বিপ্লবে জেলাস্তরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন একথাও শুনেছি দাদার(ঠাকুরদার)কাছে।’ তিনি আবার অন্যত্র লিখছেন ছাত্রজীবনে জানার আগ্রহ আরও বেড়ে ওঠে। কিন্তু ১৯৩৫ সালে পোর্ট ক্যানিং কোম্পানির বিরুদ্ধে উচিলদহে, ১৯৩৮-এ কামারগাঁতিতে কৃষকদের লড়াই, বাবার লবণ সত্যাগ্রহে অংশ গ্রহণ, বিদেশি দ্রব্য বর্জনে গান্ধিজির ডাক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, জনযুদ্ধ, ৪২-এ ভারত ছাড়ো, নেতাদের গ্রেপ্তার-আমার চলার পথ ঘুরে যায়। ইতিহাস চর্চাকে ঠেলে স্বাধীনতা সংগ্রাম, তেভাগা আন্দোলন, নৌ-বিদ্রোহ, রসিদ আলি দিবস। স্বাধীনতার পর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষণা হল- এ আজাদি ঝুটা হ্যায় ডাক দেওয়ার জন্য। কিছুকাল আত্মগোপন। লিখছেন গোরাই গাজি আর গড় চন্দ্রকেতু আমার কাছে কিংবদন্তিই থেকে যায়। সংগৃহীত প্রত্নবস্তু, দলিল দস্তাবেজ ১৯৪৮-এ সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এরপর ফের ১৯৫৩ সালে ‘অতীতের হাড়োয়াকে চিনুন’ এই শিরোনামে প্রদর্শনী দিয়ে বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালার শুরুর ইঙ্গিত। এম.এ.জব্বার-এর জন্মশতবর্ষে বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালার বয়স ৪২ বছর অতিক্রান্ত। সংগ্রহশালার প্রত্ন সামগ্রীর উপর পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা ইতিহাসের বহু বির্তকিত প্রশ্নের সমাধানে দিশা দিয়েছেন এম. এ. জব্বার। ভারতের লুপ্ত গৌরবকে উদ্ধার করে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার জন্য তিনি ছিলেন তথ্যনিষ্ঠ। বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের উপকরণ উদ্ধারে তাঁর প্রয়াস তাঁর লেখার ছত্রেছত্রে ধরা রয়েছে। তিনি বালান্দায় প্রাপ্ত টেরাকোটার মৃৎপাত্র ও অন্যান্য পুরাসামগ্রীতে মৌর্য, শুঙ্গ, কুষাণ যুগের পুরাসামগ্রীতে গ্রিক ও রোমান শিল্পশৈলীর সাদৃশ্য তুলে ধরেছেন। বালান্দায় প্রাপ্ত মৃৎপাত্রে খরোষ্ঠি লিপির সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন, যা পরে লিপি বিশারদের লেখায় সমর্থিত হয়েছে। বালান্দা-চন্দ্রকেতুগড়কে কেন্দ্র করে যে সভ্যতা তিনি তা হরপ্পা সমকালীন তো বটেই প্রাক্ হরপ্পা আমরি সভ্যতার সঙ্গে তুলনা টেনেছেন যুক্তি দিয়ে। হরপ্পায় প্রাপ্ত কৃষ্ণবর্ণের ধাতব শব্দযুক্ত মৃৎপাত্র ও আমরি সভ্যতায় সূর্যতাপে শুকানো ধাতব শব্দযুক্ত মৃৎপাত্রের অপূর্ব তুলনা টেনেছেন, যাকিনা তাঁর সংগ্রহশালা সংরক্ষিপত রয়েছে। এমনকী মানুষের নি্ম্নচোয়ালের প্রস্তুরীভুত পাঁচটি দাঁতের রেডিও কার্বণ ডেটিং করিয়েছেন হায়দ্রাবাদের ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি থেকে। যা ১০ হাজার বছরের বেশি প্রাচীন বলে চিহ্নিত করেছেন বিজ্ঞানীরা। এসব প্রমাণ সাপেক্ষেে ইতিহাসকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন একজন স্বশিক্ষিাত সুন্দরবনের কৃষক পরিবার থেকে উঠে আসা একটি মানুষ। এম.এ. জব্বার-এর বালান্দা ‘মহাবিহার ও চন্দ্রকেতুগড়’ সংকলন গ্রন্থটিতে সেগুলি সুন্দরভাবে তুলে ধরে তহমীনা খাতুন ও দীপককুমার দাঁ একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এম.এ.জব্বার-এর এই গ্রন্থটি আগামী দিনে ইতিহাস গবেষকদের কাছে বহুমুখী গবেষণার দ্বার উন্মোচিত করে দেবে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
বালান্দা মহাবিহার ও চন্দ্রকেতুগড়- এম.এ.জব্বার
সংকলন ও সম্পাদনা- তহমীনা খাতুন ও দীপককুমার দাঁ
গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ,
প্রকাশ- ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
মূল্য-২৫০ টাকা
যোগাযোগ- ৯০৬৪৭৫৭৬৮৪

Advertisement
Developed by