মামন ভট্টাচার্য:
‘চেনামুখ অচেনা মানুষ’ – তহমীনা খাতুনের এই গ্রন্থে লেখিকার সমাজকে দেখার চোখ, ভাবনার অনুভূতি, যুক্তিবাদী বিশ্লেষণের ক্ষমতায় সমাজ অভ্যন্তরের নানা চেহারার অমানবিক আবরণ উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেওয়া বলতে যা বোঝায় এক কথায় সেই কাজটি করেছেন সাবলীল সোজাসাপটা লেখনির মাধ্যমে। এই গ্রন্থে আলোচনায় উঠে এসেছে ধর্ম, রাজনীতি, প্রগতিশীলতা, নারীবাদী জীবন সংকট, ট্রেন যাত্রীদের সংলাপ, মন্দির-মসজিদ, পুজোয় অঞ্জলির মন্ত্রে পুরুষতান্ত্রিকতা, প্রত্নতত্ত্ব, আঞ্চলিক ইতিহাস, মিশ্র বিবাহ, মৌলবাদী আর উদারবাদী প্রসঙ্গ, সংখ্যালঘু আর সংখ্যাগুরু প্রসঙ্গ, রান্নায় ধর্মভেদ, চেনা মুখ যখন অচেনা, কালো মেয়ে, পুত্রাং দেহি, ছোটি, ইদ, দুর্গাপুজো ও গোরাচাঁদের মেলা, আমিষ নিরামিষ, হিন্দু হোটেল ও মুসলিম হোটেল, প্রচারের আড়ালে যে কথা, আন্ডা ও ডিম, রোজা না রাখায়, বোরখা-সিঁদুর, শরিয়ত শব্দটির সঙ্গে পরিচয়, তৈরি হচ্ছে জতুগৃহ, একান্নবর্তী মন, দিদির সঙ্গে শবরমেলায়, কে বড়ো, কেন মাতৃভূমি, পুরুষতন্ত্র ও সাম্প্রদায়িকতা, বাবরি মসজিদ ভাঙা, তারপর…, শুধু সামনে হাঁটা, আর কত অপেক্ষাদ, অর্ধেক আকাশ দখলের লড়াই-এইরকমই মোট ১০০টি বিষয় নিয়ে আলোচনা। মুখবন্ধে লেখিকা গ্রন্থ সম্পর্কে লিখতে গিয়ে লিখেছেন, ‘প্রতিদিন পৃথিবী বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে মানুষ। সেই বদল সব সময় সুখের হচ্ছে এ দাবি করছি না। আমিও তো নিজের অজান্তে বদলে যাচ্ছি নাকি পরিস্থিতি বদলাতে বাধ্য করছে ঠিক বলতে পারব না। নিজের সম্পর্কে এমনটা ভাবা আসলে দায় এড়ানোর ছল। একটা মুখোশ বলা যেতেই পারে। এক সময় যে সব মানুষ আমার চারপাশে ছিলেন তাঁদের অনেকেই যখন তখন নিজেদের চরিত্র বদল ঘটাচ্ছেন। তাঁদের চিন্তাচেতনা যেন সেই আগের মতো নেই। বারবার মনে হচ্ছে এক সময়ে যে মানুষগুলো সাদামাঠা কথা বলতেন বা প্রগতির কথা বলতেন তাঁরা এখন কেমন অন্যরকম। বলা যায় ঘনঘন মুখোশ বদল করছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় সত্যিই কী এই মানুষজনেরা আমার চেনা ঠিক ছিল নাকি মানুষজনেরা আদতে এরকম-ই। আমি কি তাহলে মানুষগুলো চিনতে ভুল করেছি? সেই চেনামুখগুলো অচেনা মানুষ হয়ে যাচ্ছেন ক্রমশ।’ না-ধার্মিক লেখিকা ব্যাক্তিগত জীবনে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছেন না-ধার্মিক মানুষ সুকুমার মিত্রকে। সেই বিয়ের পর জীবন সংগ্রাম নতুন দিকে মোড় নিয়েছে। বিয়ের আগে ও বিয়ের পরে প্রগতিশীল মানুষগুলোর পার্থক্য সুন্দরভাবে ধরে তা লেখনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন না বলে বলা যায়-মুখোশ টেনে খুলে দিয়েছেন। ১৭৪ পাতার এই বইয়ে মানুষের ভিতরের মানুষকে খোঁজার প্রয়াস নিয়েছেন ঠিক নয়, সেই মানুষগুলিই ধরা দিয়েছেন তাঁদের ব্যবহারে। এক কমিউনিস্ট ও স্বাধীনতা সংগ্রামী পরিবারে জন্ম নেওয়া লেখিকার শৈশব থেকে কমরেড সম্বোধন শুনে কান তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কালক্রমে সেই কমরেডরা ক্ষমতার অলিন্দে যাওয়ার পর কিভাবে ‘বাবু’ হয়ে গেলেন তাও তাঁর নজর এড়ায়নি। আবার এক দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের উধৃতি দিয়ে লিখেছেন, এক সিপিএম নেতাকে হাজি না বলে কমরেড বললে গোঁসা হত। ‘বাবু’ ও ‘হাজি’-দের দলের প্রতি যে স্বাভাবিকভাবে তাঁর জীবনে মোহমুক্তি ঘটেছে তা বলার অপেক্ষা্ রাখে না। আত্মজৈবনিক এই গ্রন্থে লেখিকা পরিশেষে আশার কথাই শুনিয়েছেন। লিখেছেন, ‘পরিবর্তনশীল রুচি ও মননের প্রতি আস্থায় রোজ বাঁচি, মানুষের বিবেকবোধ বাঁচুক।’ মানুষের এই বিবেকবোধ-এর প্রতি আস্থাশীল লেখিকা হয়তো তার মধ্যেই সমাজ পরিবর্তনের আশা রাখছেন।সমাজের দর্পন এই গ্রন্থটি পাঠক সমাজে সমাদৃত হবে একথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।
চেনামুখ অচেনা মানুষ
তহমীনা খাতুন
গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ
মূল্য- ২২০ টাকা
যোগাযোগ- ৯০৬৪৭৫৭৬৮৪