রাজ্যে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি মানুষের কোনও আস্থা নেই। নেই বিরোধী রাজনৈতিক দলে নেতৃত্ব দেওয়ার মত বিশ্বাসযোগ্য কোনও মুখ। বাম ও কংগ্রেস পরস্পর পরস্পরের হাত ধরে অস্তিত্বের জানান দিচ্ছে। আর বিজেপি ফাঁদ পেতে বসে রয়েছে কবে কে কোন দল থেকে বেরিয়ে তাদের দলে ভিড় বাড়াবে সেই দিকে তাকিয়ে। নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির উপর আস্থা নেই বঙ্গ বিজেপির। তাছাড়া তৎকাল বিজেপি বনাম সংঘ ঘরানার বিজেপি বিরোধ সর্বত্র এখন বেশ তুঙ্গে। কৈলাশ বিজয়বর্গীয়র সঙ্গে বিরোধ রয়েছে রাজ্য বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ ও তাঁর অনুগামীদের। কে্ন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে গিয়ে যে রিপোর্ট সর্বভারতীয় নেতৃত্বকে দিয়েছেন তা বঙ্গ বিজেপির ভবিষ্যৎ খুব আশাব্যঞ্জক যে না এমনটাই বিজেপি মহলেই জানাজানি হয়ে গিয়েছে। রাজ্য বিজেপিকে পাঁচটি ভৌগোলিক জোনে ভাগ করে এখন সাংগঠনিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। তবে রাজ্যের ২৯৪টি বিধানসভার আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য পরিচিত রাজনৈতিক মুখ তাঁদের সামনে নেই। আর সেই কারণে অন্য দলের ঘর ভাঙার খেলায় বেশি সময় ব্যয় করছেন বিজেপির তৎকাল নেতৃত্ব। এই প্রেক্ষাবপটে পশ্চিমবঙ্গে ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃতীয়বারের জন্য খুব সহজেই ফের ক্ষমতায় আসছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেসই। তফশিলী জাতি, উপজাতি, সংখ্যালঘু ভোট-সহ রাজ্যের প্রান্তিক মানুষদের ভোট জয় করেই এই সাফল্য আসছে।
নির্বাচনী প্রচার কৌশল ঠিক করে দলের হেভিওয়েট সব নেতা-মন্ত্রীদের পাশে নিয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের দুর্দিনের কর্মীদের মাঠে নামিয়ে যে ঝড় তুলবেন তা আম্ফানের থেকেও ভয়ংকর হয়ে দেখা দেবে বিরোধী শিবিরের সামনে। রাজনৈতিক মহলের ধারনা নির্বাচনে রাজ্যের শাসক দলের প্রচার ও সাংগঠনিক নেটওয়ার্কের কাছে খড়কুটোর মত বিরোধীরা উড়ে যাবে। কংগ্রেস ও বামেরা রাজ্যের অধিকাংশ বুথে পোলিং এজেন্ট দেওয়ার মত সামর্থ্য হারিয়েছে।
তবুও তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আত্মসন্তুষ্টিতে কোনও সময় নষ্ট করতে চান না। গোটা রাজ্য জুড়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে দলকে সর্বত্র খুব শীঘ্রই মাঠে নামাচ্ছেন। দশ বছরের সরকারের সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি একাংশ কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে যে অভিমান নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দানা বেঁধেছে সেই বাস্তবতাকে ভাবনায় রেখে ঘর সাজানোর কাজে এবার খোদ হাত দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নেত্রী এখন একের পর এক জেলা ধরে ধরে সাংগঠনিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে লড়াইয়ের ঘুটি সাজানোর কাজে হাত দিয়েছেন। দলের মধ্যে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে নেত্রী যখন প্রচারে নামবেন তখন দলীয় কর্মী বা নেতাদের মধ্যে ছোট-খাটো ক্ষোবভ-বিক্ষোাভ তিনি সামাল দিয়ে দলের সমস্ত কর্মীকে নির্বাচনী লড়াইয়ে মাঠে নামাতে সক্ষম হবেন। তৃণমূলের অভ্যন্তরেই রয়েছে এই মমতা জাদু। তাঁর সেই সম্মোহিনী ক্ষমতা বা স্বকীয় সাংগঠনিক দক্ষতা দিয়ে তিনি গত ২২ বছরে বহু ঝড়-ঝাপ্টা সামলে এগিয়ে চলেছেন। তাঁর ঘর ভাঙার খেলা ছাড়া বিরোধীদের যে কোনও অস্ত্র নেই সেটা তাঁর থেকে আর কে ভাল বোঝেন? সেই চিন্তা মাথায় রেখে একের পর এক উদ্ভুত সমস্যা সমাধান করে চলেছেন। মুকুল রায়ের মত সাংগঠনিক ব্যক্তিত্ব দল থেকে বেরিয়ে গেলেও তৃণমূল কংগ্রেসের সংগঠনে কোনও বড়সড় প্রভাব ফেলতে পারেননি। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে যদি তৃণমূল কংগ্রেসে কোনও ফাটল ধরাতে মুকুল রায় না পারেন তাহলে বিজেপিতে তাঁর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। রাজ্যের সর্বত্র বুথ কমিটি গঠন করা নিয়ে বিজেপি মহলে রয়েছে জোর সংশয়।
এই রকম এক হতাশাজনক পরিস্থিতিতে বঙ্গ বিজেপি আসাদুল্লাহ ওয়াই সি-র মিম ও ফুরফুরা শরিফের এক পীর যদি নির্বাচনী লড়াইয়ে দল গড়ে মাঠে নামেন সেই দিকে তাকিয়ে। বিজেপি ভালই জানে যে এরা কোনও আসনে জিততে না পারলেও কিছু ভোট পেলে সেই ভোট বিভাজনের সুফলে তাদের ভাগ্যে কিছু আসন বাড়তে পারে। বিহারের মুসলিম ও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু মুসলিমদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে সেটা হয়তো বিজেপি নেতারা বুঝতে পারছেন না। পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের ওপর ধর্মীয় নেতাদের রাজনৈতিক প্রভাব কাজ করে না। তার প্রমাণ পেয়েছে সিপিএম ২০০৭ সালে। নন্দীগ্রামে দিল্লি থেকে বুখারি ইমামকে নিয়ে এসেছিল। কিন্তু নন্দীগ্রামের মুসলিমরাই বুখারিকে কথা বলা তো দূরের কথা এলাকায় ঢুকতেই দেয়নি। কার্যত নন্দীগ্রাম থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছিল ইমাম বুখারিকেও। সেখানে বাংলার মুসলিমদের মধ্যে মিম ফাটল ধরাবে এটা মুর্খের স্বর্গে বাস করার সামিল।
প্রসঙ্গত, দলের কর্মী, সমর্থক ছাড়াও রাজ্যের সাধারণ আপামর মানুষের ওপর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দক্ষ সরকার পরিচালনার পাশাপাশি জনমুখী উন্নয়ন ও সামাজিক সহায়তা প্রকল্প রূপায়ণ নিয়ে যে আস্থার জায়গা রয়েছে সেটাই নির্বাচনী সংগ্রামে তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম শক্তিশালী হাতিয়ার। আর এই জায়গায় ফাটল ধরাতে বিরোধীদের নেই কোনও সুনির্দিষ্ট পাল্টা উন্নয়ন কর্মসূচি। অন্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতা ও জাতপাত, সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়ে কিছু ফায়দা তোলার পুরোনো ছকে রাজ্যবাসী এখানে প্ররোচিত হবেন না।
করোনা অতিমারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো যেভাবে পরিষেবা দিয়ে চলেছে তা নিয়ে রাজ্যবাসী যথেষ্ট সন্তুষ্ট। এছাড়া লকডাউনের সময় রাজ্যের প্রান্তিক মানুষদের প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। নানা সরকারি প্রকল্পের সুবিধায় রাজ্যের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যেভাবে উপকৃত হয়েছেন তাতে ভোটের লড়াইয়ে অনেকটা এগিয়েই ময়দানে নামছেন নেত্রী। এই পরিস্থিতি বিরোধীদের কাছে অস্বস্তির।
বাম-কংগ্রেসদের কাছে এই লড়াই ক্ষমতা দখলের লক্ষ্যেী আস্ফালন থাকলেও এটা যে তাদের অস্তিত্ব বাঁচানোর লড়াই। আর এই লড়াইয়ে তাদের প্রধান দুটি শত্রুপক্ষ এক বিজেপি, দুই- তৃণমূল কংগ্রেস। সিপিএম প্রভাবিত বামফ্রন্টের এই লাইনকে এবার স্পষ্টতই চ্যালেঞ্জ জানিয়ে দিয়েছেন সিপিআই এম-এল(লিবারেশন)। লিবারেশনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দীপকংকর ভট্টাচার্য-র দল সাফ জানিয়ে দিয়েছে পশ্চিমবঙ্গে প্রধান ও একমাত্র শত্রু বিজেপি। বিজেপি বিরোধী লড়াইকে তৃণমূল কংগ্রেস বিরোধিতার নামে দুর্বল করা যাবে না। এমনটাই অভিমত দু-দফায় জানিয়ে দিয়েছেন দীপংকরবাবু। বিহার নির্বাচনে বামেদের সাফল্যের পিছনে দীপংকরবাবুদের দলের যে বড় ভূমিকা রয়েছে তা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। তাই দীপংকরবাবুর দল লিবারেশন এখন পশ্চিমবঙ্গে বৃহত্তম বামফ্রন্টে ‘কাবাব মে হাড্ডি’। লিবারেশনের এই অবস্থান ব্যাখ্যা করতে যত না ব্যস্ত দীপংকরবাবুর দল তার থেকেও বেশি ব্যস্ত সিপিএম নেতৃত্ব। খোদ সীতারাম ইয়েচুরি থেকে শুরু করে বিমান বসু সকলেই তৃণমূলকে পরাস্ত ও বিজেপিকে পর্যুদস্ত করার লাইনের পক্ষে সওয়াল করে চলেছেন। আর নীচুতলার সিপিএম কর্মীদের এক বড় অংশের মুখে মুখে ঘুরছে এক প্রচার ২০২১ বিজেপিকে আর ২০২৬ সিপিএমকে। এই প্রচার যে তলানিতে ঠেকা বাম ভোটকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাবে তা নিয়ে বামেদের একাংশ বেশ চিন্তিত ও ভীত। প্রাক্তন সিপিএম রাজ্যসভার সদস্য মইনুল হাসানও দীপংকরবাবুর সুরে সুর মিলিয়েই বক্তব্য রেখেছেন।
আর অন্যদিকে, বঙ্গ বিজেপিতে গোষ্ঠী কোন্দল সর্বত্র। বিশেষ করে বিজেপির প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করার পর সেই কোন্দল আরও বাড়বে এমনটাই আশংকা রয়েছে খোদ বিজেপির অন্দরমহলেই। বিজেপি প্রার্থী তালিকা প্রকাশ হওয়ার পর বিজেপি ছেড়ে ঘর ওয়াপসি কর্মসূচি চরম হতাশায় ফেলতে পারে দলকে। পরের ঘর ভাঙতে গিয়ে নিজের ঘরের চালচুলো উড়ে যাওয়ার দশা হতে পারে খোদ বিজেপিতেই।