আজ লেখাটা লিখতে বাধ্য হলাম।
সুকুমার মিত্র নন্দীগ্রামে আছেন, (Embeded journalist) নন্দীগ্রামের খবর দেওয়ায় সুকুমার মিত্র যে ভূমিকা নিয়েছেন, একজন দক্ষ সৎ সাংবাদিকতার যে নজির রেখেছেন সে জন্য ওকে কুর্নিশ জানাই।
কবীর সুমন লিখেছেন, ওর মতো একজন নিঃস্বার্থ সাংবাদিকের ছবি ঘরে ঘরে রাখা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
***কবীর সুমনের লেখা, “নিশানের নাম তাপসী মালিক”গ্রন্থের ৯২ পাতায় এই কথা লিখেছেন।
২৪০ পাতার বইটিতে প্রতি ছত্রে ছত্রে যে নামটি উঠে এসেছে তিনি “সুকুমার মিত্র”।
ওই বই- এর ৯৭ পাতায় লিখেছেন,”…আমি চাইছি সুকুমারের খবর পেতে,কিন্তু আমি জানি এখানেই এক জনের দায়িত্ব চিনিয়ে দেওয়ার।
ঘাতক? কে খুন করবে সুকুমার কে?…কে খুন করবে সুকুমার কে? চিনিয়েই বা দেবে কে? আগেই খবর পেয়েছি, একটি বিশেষ চ্যানেলের এক সাংবাদিক বা প্রকৌশলী….সুকুমার মিত্রর কি ভাঙ্গা হবে,মাননীয় সরকার, রাষ্ট্র?”… কবীর সুমন ১৩৮ পাতায় লিখেছেন, “সুকুমার উঠে গেছেন আমাদের অন্য গাড়িটাই শিশির অধিকারী ও শেখ সুপিয়ান আসছেন আলাদা।”…১৪৫ পাতায় লিখেছেন, “সাতেঙ্গাবাড়ি থেকে ফেরার পথে সুকুমার আমাদের গাড়িতে।”….এসবই ১৪ই মার্চ ২০০৭ থেকে শুরু করে সূর্যোদয়ের আগের পর্বের নানা সময়ের ঘটনার বিবরণ।
নন্দীগ্রাম, খেজুরি সীমান্তবর্তী ফ্রন্টলাইন এলাকায় যাওয়া বা ফেরার ঘটনা কবীর সুমনের গ্রন্থে।
***শিল্পী শুভাপ্রসন্ন লিখেছিলেন, রাষ্ট্রীয় মদতে সংত্রাস হলে তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর মতো ক্ষমতা খুব কমজনের থাকে। তবে তা করে দেখালেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র। সমকালীন সাংবাদিকতায় এই ধরণের সাহস ও নির্ভিকতা দেখা যায় না।
***কবি জয় গোস্বামী লিখেছেন,যে কোন মুহূর্তে মৃত্যু হতে পারে জেনেও যিনি গণহত্যার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ঘটনার সঠিক বিবরণ সাধারণ মানুষকে জানানোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন তাঁর নাম “সুকুমার মিত্র”।
***মহাশ্বেতা দেবী লিখেছেন,নন্দীগ্রাম কে…আমার তোমার সবার নাম নন্দীগ্রাম। এ কথা বোঝালেন যাঁরা তাঁদের মধ্যে সুকুমার মিত্রের নাম ওপরের সারিতে থাকবে।
জননী ইটভাটা,মিলন জানার টালিভাটা, ভাঙা বেড়ার ওপারে সাতখন্ড, সাহেবনগর,খেজুরি বটতলায় হার্মাদবাহিনীর ক্যাম্প,চুনপীড়ি খাল পেরিয়ে হার্মাদবাহিনী ঢুকে হামলার খবর, তেখালী ব্রিজের ওপারে খেজুরির শেরখাঁচক দিয়ে হার্মাদ বাহিনীর হামলার খবর।
সব খবর নিয়মিত পেতাম দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকাতে সুকুমারের প্রতিবেদনগুলি থেকেই।
***একদিন কথা প্রসঙ্গে অধ্যাপক “সৌগত রায়” বলেছিলেন, সুকুমার মিত্র খুব সাহসী সাংবাদিক। ও প্ৰকৃত ঘটনার ভিতরে গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে।
এখন তো ঘরে বসে খবর নিয়ে অনেক সাংবাদিক খবর করেন কিন্তু সুকুমার সেটা করেন না।
নীচে যে যে জায়গার নাম গুলো উঠে আসছে সবই সুকুমারের খবর থেকেই পাওয়া।
যেমন, আমদাবাদ, বাহারগঞ্জ, জাহানাবাদ, কলাগাছিয়া, কুঞ্জপুর, অন্যদিকে রেয়াপাড়া, ফুলনি মোড়, আর একদিকে কেন্দেমারির ওপারে হলদিয়ায় হার্মাদবাহিনীর চেকপোস্ট।
এসবই ছবির মতো বর্ণনা দিয়ে তুলে ধরতেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।
কাদিরাবাদ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট- এ খেজুরির ঘরছাড়া হাজার হাজার মানুষের ছবি ও সংবাদ দৈনিক স্টেটসম্যানের প্রথম পাতায় আমরা দেখেছি ও পড়েছি।
অন্যও কোন সংবাদপত্র ওই দুঃসাহসিক বেপরোয়া সংবাদ পরিবেশন করতে পারেনি।
সুকুমার লিখেছেন, গুলি করা হয়েছে মানুষ মারার জন্যই, ক্যাডারদের মাথায় ছিল নীল টুপি,
কোন রকম প্ররোচনা ছাড়াই গুলি চালাতো,
নন্দীগ্রাম ঢোকার প্রস্তুতি, খেজুরি উদ্ধার এর জন্য সুপার বদলি, সি পি এম-এর যত রাগ ছিল সুপারের উপর,খেজুরিতে অস্ত্র জমা হচ্ছিল, ম্যাপ তৈরি করেছিলেন সরকারি অফিসার আর খেজুরি থানায় তৈরী হয়েছিল গণহত্যার ছক,গোয়েন্দারা সতর্ক করেছিল, জেদ ছাড়েনি লক্ষণ অনুগামীরা।
পুলিশের দোসর ছিল সি পি এম কর্মী নেতারা।
সুকুমার আমার ভালো বন্ধু। প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যায় নন্দীগ্রামের খবর নিতাম।
***১০ই নভেম্বর।
বনগাঁর ব্যস্ত রাস্তা রামনগর রোডে আমি
বক্তব্য রাখছিলাম। হঠাৎ সুকুমার মোবাইল ফোনে যে সংবাদ দিল তাতে আমি একেবারে স্তম্ভিত। ও বললো সি পি এম এই সময় খেজুরি- নন্দীগ্রামে কয়েকশো মানুষ কে পিঠমোড়া করে বেঁধে জোর করে মিছিলে হাঁটাচ্ছে। তার মধ্যে কংগ্রেস- এর জেলা কমিটির সম্পাদক এর ৭৫ বছরে বৃদ্ধ বাবাকে ওরা ছাড়েনি, মনে করিয়ে দিচ্ছিল ক্রীতদাস প্রথা।
“আজ নন্দীগ্রাম নিয়ে নানা জন নানান দাবী করেন। “ভালো” সেই দাবি করার যোগ্যতা হয়তো তাঁদের সকলেরই আছে বা রয়েছে।
কিন্তু যাঁর প্রতিবেদন পড়ে আলোড়িত হয়ে মানুষ পথে নামতেন সেই সাংবাদিক সুকুমার মিত্রর নাম কেন একবারের জন্যও উচ্চারণ করেন না?
সুকুমার কি তাঁর অবদানের স্বীকৃতি আমাদের কাছ থেকে পেয়েছেন?
যে সাংবাদিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার আনার দিন দিল্লীতে না গিয়ে নন্দীগ্রামের মাটিতে দাঁড়িয়ে বলেন, এই নন্দীগ্রামের জন্য আমার এই সম্মান, সেই আন্দোলনের বর্ষপূর্তিতে আমি নন্দীগ্রামে না থেকে দিল্লীর প্রাসাদপম পাঁচতারা হোটেলে থেকে পুরষ্কার নিতে যেতে পারবো না। অবশেষে
অন্য বন্ধু সাংবাদিককে প্রতিনিধি হিসেবে পাঠিয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেছিলেন।
বলুন তো, যে মানুষটা জীবন বাজি রেখে
লড়াই করলো তাঁর যোগ্য সম্মান কি আমরা দিয়েছি?
মাননীয়া বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থানের ( প্রথম দিন) সিঙ্গুর যাওয়ার পথে ডানকুনি মোড়ে সুকুমার হার্মাদবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হন এবং সিঙ্গুর হাপাতালে ভর্তি হন। কয়েক ঘন্টা পর রিস্ক বন্ডে সই করে বাজেমেলিয়া গ্রাম ঘুরে কলকাতায় ওর সংবাদ পত্র দপ্তরে নিজের লেখার দায়িত্ব শেষ করে আবার চিকিৎসকের কাছে চলে যান।
এই দায়িত্বশীল সমাজমনস্ক সাংবাদিক- এর নাম কি কোন নেতা একটি বারের জন্যও উচ্চারণ করেন?
কবীর সুমনের কথায়, জহুরী জহর চেনে, সাংবাদিক কবীর সুমন চিনেছিলেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্রকে।
এখন আমরা যখন অনেকের নাম ধরে নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের জয়ধ্বনি শুনি, সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান দেখি তখন কোথায় সুকুমারের উপস্থিতি? তাঁকে ডাকা হয়েছে কখনও?
আমার এই লেখার আগে সুকুমারকে জানতে চেয়েছিলাম, নন্দীগ্রামে ১০ই নভেম্বর, ২০২০ যা হয়েছিল সে ব্যাপারে তোমার মত কি?
ও সাফ জানিয়েছে নন্দীগ্রামের মানুষ, সিঙ্গুরের মানুষের সঙ্গে গোটা রাজ্যবাসীর সংহতি আন্দোলন – আন্দোলনে সাফল্য এনে দিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দুর অবদান খাট করে দেখার কোন মানে হয় না।সুকুমার বলেছিলেন, আমি সাংবাদিক সেই নিরিখে আমি সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম, জঙ্গলমহল পর্বের সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে কোনও আপস করিনি।আর ৩৪ বছরের জগদ্দল পাথরটা সরিয়ে দেওয়ার লড়াইয়ে প্রথম সারিতে থেকে খবর করে যে আনন্দ পেয়েছি, সাধারণ মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি সেটাই যথেষ্ট।একদল মানুষ বিশেষ মর্যাদার আদায়ের জন্য লড়াইয়ে থাকেন-আমি সেই দলভুক্ত নই আমার যোগ্যতাও নেই।
” সুকুমার মিত্র বলেছেন ওর মর্যাদা পাওয়ার যোগ্যতা নেই। এর থেকে বড় শ্লেষ আর কি হতে পারে?
আমি প্রশ্ন রেখেছিলাম, তুমি তো দাবি করো তুমি একজন “এক্টিভিস্ট জার্নালিস্ট” তুমি বর্তমান সময়ে কার অনুগামী?….ও বলেছিল, ফ্যাসিস্ট শক্তিকে হঠাতে যিনি আন্তরিকভাবে লড়াই করবেন ও তার অনুগামী।
কৃষি জমিরক্ষার আন্দোলন যে কৃষক করেছিল তাঁরা কেন্দ্রীয় কৃষি আইন এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে থাকবেন না তা কি করে হয়?
আমি সুকুমারকে অনেক দিন ধরেই চিনি
ওর মতো সৎ সাংবাদিক ও সৎ মানুষ খুবই বিরল।
এই সম্প্রতির বাংলাকে যাঁরা কলুষিত করছেন তাঁদের বিরুদ্ধে আর একটা লড়াই শুরু হোক।
বাংলা হারবে না, বাংলা জিতবেই।।