এইকাল নিউজঃ
‘এম.এ.জব্বার জন্মশতবার্ষিকী স্মারক সম্মান’-এ সম্মানিত হলেন বিশিষ্ট শ্রমিক নেতা ও সমাজকর্মী শক্তিমান ঘোষ। রাজ্য তথা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে অসংগঠিত হকারদের সংগঠিত করা, করোনা অতিমারি ও আম্ফান বিধ্বস্ত সুন্দরবন এলাকায় ধারাবাহিক ছয় মাস ধরে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যে ত্রাণ বিলির পাশাপাশি কলকাতা মহানগরীতে তিনটি কমিউনিটি কিচেন দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনার জন্য তাঁকে এই সম্মানে পুরষ্কৃত করা হয়। শক্তিমান ঘোষকে নিয়ে গত চারবছরে চারজন বিশিষ্ট মানুষ এই সম্মানে সম্মানিত করা হল।
প্রসঙ্গত, সুন্দরবন অঞ্চলের কৃষক, কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও পুরাইতিহাসবেত্তা প্রয়াত এম.এ.জব্বারের জন্মশতবার্ষিকী শুরু হয়েছে ১৪ নভেম্বর, ২০২০। এই উপলক্ষেে এম.এ.জব্বার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি, গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ ও উত্তর ২৪ পরগনা ইতিহাস পরিষদ-এর উদ্যোগে ২২ নভেম্বর, ২০২০ বেলা সাড়ে চারটেয় এক ওয়েবনিয়ারের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই শক্তিমান ঘোষের হাতে মানপত্র, স্মারক, পুষ্পস্তবক, উপহারাদি যথাক্রমে তুলে দেন উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, মুরাদ হোসেন, পাঁচুগোপাল মিত্র ও অনিতা দাস। মানপত্রটি পাঠ করেন উজ্জ্বল সেনগুপ্ত। ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান হলেও এদিন হকার সংগ্রাম কমিটির দপ্তরে বহু বিশিষ্ট মানুষেরা শক্তিমান ঘোষের এই সম্মান প্রদান অনুষ্ঠান প্রত্যক্ষ করার জন্য উপস্থিত ছিলেন। সম্মান প্রাপ্তির পর শক্তিমান ঘোষ তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে প্রয়াত এম.এ. জব্বারের সঙ্গে তাঁর কৈশোর ও যৌবনকালে পরিচয়ের স্মৃতিচারণা করে বলেন, এই সম্মান তিনি হকার সংগ্রাম কমিটি ও ন্যাশনাল হকার ফেডারেশনের একজন প্রতিনিধি হিসেবে গ্রহণ করে গর্ব বোধ করছেন। এদিনের ওয়েবনিয়ার অনুষ্ঠানের সভাপতি বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক দীপককুমার দাঁ স্বাগত ভাষণ দেন। তিনি বলেন, এম. এ. জব্বার প্রাক্ জন্মশতবর্ষে গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ তাঁর সমস্ত দুষ্প্রাপ্য বই একত্রে সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছে। স্বশিক্ষি ত এই সংগ্রামী ও ইতিহাস অনিসন্ধিৎসু মানুষটির মূল্যায়ন হওয়া বিশেষ জরুরি।
এদিনের অনুষ্ঠানে ‘বিশ শতকের কৃষক আন্দোলন’ প্রসঙ্গে বক্তব্য পেশ করেন বিশিষ্ট লেখক ও সমাজকর্মী বাসু আচার্য। তিনি স্বল্প সময়ে একটি মনোজ্ঞ বক্তব্য তুলে ধরেন। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকের কৃষক আন্দোলনের সূত্র তুলে ধরে বিশ শতকের কৃষক আন্দোলনের বিস্তার ব্যাখ্যা করেন। কৃষক আন্দোলন ও কৃষক সভা তথা কমিউনিস্ট পার্টির আন্তসম্পর্কের পাশাপাশি আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ব্যাখ্যা করেন। তবে একবিংশ শতাব্দীতে এসে কৃষককে ছেড়ে সেদিনের আন্দোলনকারীদের উত্তরাধিকারীরা পুঁজির সঙ্গে আপোষ করতে গিয়ে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম পর্বে মারাত্মক ভুল পথে হেটেছেন। এর মাসুল দিতে হবে বহুকাল ধরে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, কৃষক যাঁকে একবার বন্ধু হিসেবে হাত ধরে তার সঙ্গে বহুকাল থাকে। বিপরীতে কৃষক যখন সেই মানুষটিকে অভিমানে বা ক্ষোসভে ছেড়ে যায় তা বহুকালের জন্য ছেড়ে যায়। তেভাগা, তেলেঙ্গানা আন্দোলনের আগেও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যেসব কৃষক আন্দোলন হয়েছে তা সুন্দরভাবে তিনি তুলে ধরেন। এছাড়া নকশালপন্থীদের একাংশের প্রচার নকশালবাড়িতেই কৃষক আন্দোলনের সূত্রপাত এমন ভাবনাও কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসকে অস্বীকার করা বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
অন্যদিকে, সভার অপর আলোচক পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপ কৃষি অধিকর্তা ড. অনুপম পাল ‘বর্তমান ভারতের কৃষির সংকট’ শীর্ষক আলোচনায় গত তিন শতকের কৃষি উৎপাদনের তথ্য তুলে ধরে স্পষ্ট করেন যে আধুনিক চাষের নামে কৃষি উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে, কমেছে উৎপাদনশীলতা। এছাড়া জৈবচাষ থেকে সরে এসে রাসায়নিক ও কীটনাশক নির্ভর চাষের ফলে নানা রোগের প্রাদুর্ভাব বেড়ে চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে বহু গুণ। এতে লাভ হয়েছে বহুজাতিক পূঁজির, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন কৃষক। এমন পরিস্থিতিতে জৈবচাষ ও দেশীয় প্রজাতির বীজ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণই পারে কৃষি ও কৃষককে শুধু নয় দেশের খাদ্য সুরক্ষামর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে নিশ্চিত করতে। সম্প্রতি পাশ হওয়া কেন্দ্রের কৃষি আইনের ফলে যে দেশের সমুহ সর্বনাশ হবে সেই বিষয়টির ওপর তিনি আলোকপাত করেন। এই কৃষি আইনের পক্ষে্ সওয়াল করার মত কোনও যুক্তি রয়েছে বলে তিনি মনে করেন না।
এদিনের ওয়েবনিয়ারের অন্যতম আকর্ষণ লন্ডন থেকে বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী ও সাংবাদিক নাজমুল হোসেন বালন্দা প্রত্ন সংগ্রহশালার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত এম.এ.জব্বার প্রসঙ্গে প্রণবেশ সেনের ‘একটি ধূসর পাণ্ডুলিপির লেখক’ লেখাটি পাঠ করেন। এছাড়া লেখিকা ও বালান্দা প্রত্ন সংগ্রহশালার প্রাক্তন কিউরেটর তহমীনা খাতুন এম.এ.জব্বার-এর উদ্দেশ্যে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন। এই অনুষ্ঠানে রাজ্যের বিভিন্ন জেলা থেকে আগ্রহী ও শুভানুধ্যায়ীরাও ওয়েবনিয়ারে যোগ দিয়েছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সাংবাদিক সুকুমার মিত্র।