অবশেষে। হ্যাঁ, অবশেষে বহু প্রতীক্ষিত কুলি নং ওয়ান (২০২০) ছবির একটি গান শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। এটি আদতে মূল ছবি কুলি নং (১৯৯৫) এর রিমেক ভার্সন। মূল ছবিটিতে অভিনয় করেছিলেন গোবিন্দা ও করিশ্মা কাপুর। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য দু’টি ছবিরই পরিচালক ডেভিড ধাওয়ান। নতুন ছবিটিতে এবারে তিনি গোবিন্দার পরিবর্ত হিসেবে বেছে নিয়েছেন তাঁরই সুযোগ্য পুত্র বরুণ ধাওয়ানকে। নায়িকা সারা আলি খান। বিবিধ টালবাহানার পর এ ছবির যে গানটি প্রথম আত্মপ্রকাশ করল, সেই গানটির জন্য কুমার শানুর ভক্তরা দীর্ঘদিন ধরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন।
যে গানটিকে নিয়ে লিখতে বসা, হোক না তারই গাওয়া বহুল জনপ্রিয় গানের রিমেক ভার্সন। ক্ষতি কী? এ তো আর নতুন কিছু নয়। এখন তো আকছার রিমেক হচ্ছে। এবং বিরাট সংখ্যক পাবলিক সেগুলি পছন্দও করছে। সুতরাং ভক্তদের কাছে গানটা এক্ষেত্রে গৌন, কুমার শানুর উপস্থিতিটাই বড় কথা। ভিতরে ভিতরে প্রচুর আনন্দ জমাট বাঁধছিল, সেই সঙ্গে একধরনের আশঙ্কার চোরা স্রোত বয়ে যাচ্ছিলো। এই যে এত আনন্দ, এত উচ্ছ্বাস, এত আবেগ শেষ পর্যন্ত মাঠে মারা যাবে না তো? ইদানিং যেটা দেখা যাচ্ছিল যে, পুরনো বেশ কিছু কালজয়ী গানকে নতুন করে আবার রিমেক করা হচ্ছিল। আজকাল এই এক ট্রেন্ড চালু হয়েছে। সুরকার থেকে প্রযোজক, প্রযোজক থেকে পরিচালক কেউই নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। নতুন কিছু করা মানেই নতুন নতুন আইডিয়া, নতুন নতুন উদ্ভাবনী শক্তির পিছনে এনার্জি খরচ করা। তদুপরি বিভিন্ন খাতে বিরাট অঙ্কের টাকা খরচের ব্যাপারটা তো আছেই। সম্পূর্ণ রূপে একটি গান তৈরির পিছনে তো শুধু আর গায়ক বা গায়িকার একার ভূমিকা থাকে না। একাধিক মানুষের সমষ্টিগত প্রয়াস একটি গানের প্রাণ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে কথা বলাই বাহুল্য। আজকাল সেই চেষ্টাটাই কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। তার পরিবর্তে চলে এসেছে সস্তায় বাজিমাত করার এক নিম্নমানের প্রতিযোগিতা। পুরনো জিনিসকে উগ্র রঙ চড়িয়ে নতুন মোড়কে পরিবেশন করার যে ধারাবাহিকতা আমরা আজকাল দেখছি, এর ভয়াবহতা সম্পর্কে যারা এই কাজটি করছেন তারাও যথেষ্ট অবগত। তারপরেও পেট চালাতে এক একটি গানের বারোটা বাজাতে এরা যেন রীতিমত আদাজল খেয়ে আসরে নেমে পড়েছেন। এর নাম নাকি এক্সপেরিমেন্ট!
বিগত বছরগুলোতে আমরা যারা আশি বা নব্বইয়ের দশকের গান শুনে বড় হয়েছি তারা অন্তত এই জাতীয় মাছিমারা অনুকরণ শুনতে শুনতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম। এর শেষ কোথায় আমরা কেউ জানি না।
তা যে কথা হচ্ছিল, যেদিন থেকে এই তথ্য প্রকাশ্যে এলো যে, কুমার শানু কুলি নম্বর ওয়ান (2020) ছবিতে গাইছেন, শোনা মাত্রই কুমার শানুর ভক্তদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ ক্রমশ উর্ধ্বগামী হচ্ছিল। এবং সেটাই ছিল ফ্যানেদের খুব স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। যদি বলা হয় সেই সঙ্গে তারা এক সম্ভাবনাময় দুর্ভাবনায় আতঙ্কিত হচ্ছিলেন, তাহলে কি খুব একটা ভুল বলা হবে? বোধহয় না। কেননা বিগত বছরগুলোতে এমন কিছু গানের কথা বলা যায়, যার সাথে কুমার শানুর নাম জড়িত ছিল। বলা হচ্ছিল, আলোচিত গানগুলি কুমার শানুই গাইছেন। এই খবরে আপামর কুমার শানুর ভক্তদের খুশি হওয়াটা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। কারণ তারা আজও সর্বান্তকরণে বিশ্বাস করেন, গায়কের নাম যখন কুমার শানু তখন ভালো কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তারা যে ভুল কিছু ভাবেন তাও না। মিডিয়াগুলোও সেই ভাবেই ক্রমাগতভাবে ভিত্তিহীন খবর ছড়িয়ে ফ্যানেদের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করছিল। বহু ঢাকঢোল পিটিয়ে সেই সমস্ত ফুটেজ খাওয়া গান (কুমার একদা জনপ্রিয় গান) যখন বাজারে এলো, তখন আমরা কী দেখলাম? কোথায় কুমার শানু? সমস্তটাই আদতে ভাঁওতাবাজি ছাড়া কিচ্ছু ছিল না। বারংবার সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে দেখতে শ্রোতারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। এই যখন অবস্থা, তখন বহু আলোচিত কুলি নম্বর ওয়ানের রিমেক ভার্সনে শেষমেশ আদৌ কি কুমার শানুর সক্রিয় উপস্থিতি আমরা দেখতে পাবো? নাকি আবারও সেই ঢপের চপ খেয়ে, ‘তেলা ভাজা খেয়ে জল খাওয়া উচিত নয়’ গুরুজনের পইপই করে বোঝানো যুক্তি-বুদ্ধির তোয়াক্কা না করে, টুক করে এক ঘটি জল খেয়ে একটা চোঁয়া ঢেকুর তুলে ছবির প্রডিউসার, মিউজিক ডিরেক্টরের বাপবাপান্ত করে, পুরনো দুঃখ ভুলে নতুন আশায় বুক বাঁধবো। সেইদিন খুব দূরে নয় যেদিন কুমার শানু আবার স্বমহিমায় ফিরে আসবেন। নাকি আবারও নিদেনপক্ষে ‘আঁখ মারে’র মত কুমার শানুর নামকে ওয়াস্তে উপস্থিতির মত সান্তনা পুরষ্কার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে?
আশঙ্কাটা যে একেবারে অমূলক ছিল না, বিগত বছরগুলোতে চোখ ফেরালেই বিষয়টা আরো খোলসা করে বোঝা যাবে।
সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে কুলি নম্বর ওয়ানের ‘ম্যায় তো রাস্তে সে যা রাহা থা…’র নতুন ভার্সনটি কুমার শানু ও তাঁর অসংখ্য ভক্তদের কাছে অনেকটা ‘সোনার পাথর বাটি’র মত। যাক এবার অন্তত তাদের নিরাশ হওয়ার মত ঘটনা ঘটেনি।
এতদিন যা কিছু রটেছে, শেষ পর্যন্ত সেটাই ঘটেছে। ছবির নির্মাতা বা মিউজিক ডিরেক্টরকে ধন্যবাদ তারা নতুন কিছু শ্রোতাদের উপহার দিতে অপারগ হলেও, এক্ষেত্রে অন্তত আলোচ্য গানটিতে মূল গায়ক-গায়িকার প্রতিই তারা আস্থা রেখেছেন। খুব বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষার রাস্তায় হাঁটেননি। সেটা হলে শ্রোতারা আরো একটি জনপ্রিয় গানের অন্তর্জলী যাত্রার সাক্ষী হতেন, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এবার চলে আসি গানের কথায়। যে গানটি নিয়ে আলোচনা করতে বসেছি সেই গান নিয়ে নতুন করে বলার মত আদৌ কি কিছু আছে? নিন্দুকেরা বলতে পারেন এ আর এমন কী? সেই তো নতুন বোতলে পুরনো মদ ভরে চালানোর চেষ্টা। এই নিয়ে এত লাফালাফির কী আছে? আমি বলব, লাফালাফির কারণ আছে বৈকি। কিছুদিন যাবৎ যেটা হয়ে আসছে, অতীতের কোন জনপ্রিয় গানকে বিকৃত ভঙ্গিতে পরিবেশন করে নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়ার ভয়ঙ্কর প্রবণতাটা যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল, তাতে অন্তত কিছুটা হলেও লাগাম পড়ানো গেছে।
আর যাই হোক এক্ষেত্রে অন্তত অরিজিনাল গানটির রাতারাতি মালিকানা হস্তান্তর হয়নি।
এবার একটু মূল গান, যেটি কুলি নম্বর ওয়ান (১৯৯৫) ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছিল, তার দিকে চোখ ফেরানো যাক। ৯৫তে সুরকারদ্বয় আনন্দ-মিলিন্দ যখন এই গানটির সুর করেন, তখনও তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন না গানটি কাকে দিয়ে গাওয়াবেন। আলোচ্য গানটির কথা লিখেছিলেন সেইসময়কার জনপ্রিয় গীতিকার সমীর আনজান। কথা প্রসঙ্গে আনন্দ-মিলিন্দ তাঁকে জানান যে, তাঁরা এই গানটি নিয়ে ব্যতিক্রমী কিছু ভাবনা-চিন্তা চালাচ্ছেন। তা কী সেই ব্যতিক্রমী ভাবনা-চিন্তা? যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে, সেই সময়টাতে কুমার শানু বলিউডের এক নম্বর গায়কের জায়গাটা দখল করে বসে আছেন। মূলতঃ মেলোডি আশ্রিত রোমান্টিক গানের জন্য তিনি তখন শ্রোতাদের নয়ণের মণি। নিরলসভাবে অসংখ্য হিট গান তিনি শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন, দিয়ে যাচ্ছন। বলতে গেলে সারাটা বছর নিত্য নতুন গান গেয়ে শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছেন। আনন্দ-মিলিন্দ যখন সমীর সাহেবকে জানালেন যে, তাঁরা এই গানটি (ম্যায় তো রাস্তে সে যা রাহা থা…) টাইগারকে (কুমার শানু। বলিউড সংগীত মহলে তিনি এই নামেই পরিচিত) দিয়ে গাওয়ানোর কথা ভাবছেন, সমীর সাহেব যেন সামান্য হলেও ধাক্কা মত খেলেন। ইতিমধ্যে কুমার শানু সব ধরনের গানের ক্ষেত্রেই নিজের জাত চিনিয়ে ছেড়েছেন। তাঁর স্বকীয় অননুকরণীয় উপস্থাপনা নিয়ে কারো মনে কোন সন্দেহ থাকার কথা না। সমীর সাহেবেরও ছিল না। কুমার শানুকে তিনি হাড়ে হাড়ে চেনেন। বস্তুত কুমার শানুকে তিনি একজন ক্ষণজন্মা শিল্পী হিসেবেই আগাগোড়া মান্যতা দিয়ে এসেছেন।
তারপরেও সমীর সাহেবের ধাক্কা খাওয়ার কারণ, এই জাতীয় ‘টাপোরি’ টাইপ সং কুমার শানু ইতিপূর্বে বড় একটা গাননি। সুতরাং এক্ষেত্রে তিনি কদ্দুর কী সফল হবেন, সবথেকে বড় কথা শ্রোতারা কী ভাবে নেবেন, সেটা নিয়েই তিনি ঈষৎ চিন্তিত ছিলেন। কিন্তু তিনি কুমার শানু। ‘পারি না’ শব্দটা এই মানুষটার অভিধানে নেই। তিনি গাইলেন। এবং গানটি তাঁর গায়কীর গুণে যথারীতি একটা অন্যমাত্রা পেয়ে গেল। এখানে একটা ঘটনার উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। কুলি নম্বর ওয়ান (১৯৯৫)ছবিতে এই গানটি ছাড়াও কুমার শানু বেশ কয়েকটি গান গেয়েছিলেন। মূলতঃ তিনিই ছিলেন এ ছবির লীড সিংগার। তাঁর গাওয়া প্রতিটি গানই বহুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। অথচ ছবির নির্মাতারা চেয়েছিলেন কুমার শানুর গাওয়া গান নয়, নব্বই দশকের আরেক দ্যুতি ছড়ানো গায়ক অভিজিতের গাওয়া ‘হুস্ন হ্যায় সুহানা…’ গানটি দিয়ে ছবির পাবলিসিটি করাকে পাখির চোখ করে এগোচ্ছিলেন। কিন্তু এক্ষেত্রে বাঁধ সাধলো কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া ‘ম্যায় তো রাস্তে সে যা রাহা থা’র চোখ ধাঁধানো সাফল্য। গানটিকে নিয়ে শ্রোতাদের উন্মাদনা দেখে তারা তাদের পরিকল্পনা বাতিল করতে একপ্রকার বাধ্য হলেন। ছবি রিলিজ হবার পর দেখা গেলো ছবি ও ছবির এই গানটি এককথায় সমার্থক হয়ে উঠেছে। ছবিটির মারকাটারি সাফল্যের পিছনে এই গানটির ভূমিকা অনস্বীকার্য।
দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর সেই গান আরো একবার নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে আত্মপ্রকাশ করে ফেলেছে। ইউ টিউবের দৌলতে লক্ষাধিক মানুষ ইতিমধ্যে গানটিকে দেখে ফেলেছেন। আশার কথা সংখ্যাটা একজায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নেই। এখন যেহেতু শ্রোতারা গান শোনার থেকে গান দেখার প্রতি বেশি আগ্রহী, সেই নিরিখে ভিউয়ার্সের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে যাওয়ার ট্রেন্ড দেখে এবং তাদের উচ্ছসিত মতামত জানতে পেরে, একটা বিষয় ক্রমশ প্রকট হচ্ছে যে, ‘পুরনো চাল ভাতে বাড়ে’ কথাটা একেবারে অন্তঃসারশূন্য নয়। বিদগ্ধ মানুষ বাজারে গিয়ে কেন চকচকে নতুন চাল ছেড়ে রঙ মরা পুরনো চালের প্রতিই আগ্রহ দেখান, এই গানটি তা আরো একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
তা কেমন গাইলেন কুমার শানু? আমার মনে হয় তাঁর গাওয়া অরিজিনাল গানটির সাথে এই গানটির তুলনা না টানাই ভালো।
গোটা নব্বই দশক জুড়ে যে ধরনের মেলোডি আশ্রিত গান তৈরি হচ্ছিল, এই গানটিও তার ব্যতিক্রম নয়। মেলোডি এমন একটি ব্যাপার যার আবেদন চিরকালীন। একদিকে মেলোডি অন্যদিকে কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিকের বহুল জনপ্রিয় কেমিস্ট্রি ‘ম্যায় তো রাস্তে সে যা রাহা’র মত একটি অতি সাধারণ চটুল গানকেও অবধারিতভাবে কালোত্তীর্ণ হিট গানের তালিকাভুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল তা নিয়ে খুব বেশি বিতর্কের অবকাশ নেই বলেই মনে হয়। লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, দুটি ভার্সনে যে জিনিসটি ভীষণভাবে উপস্থিত তা হলো, গানের মেজাজ। বাইরের খোলনলচে যথাসম্ভব বদলে ফেললেও গানের মেজাজ বা আবেদন কোনটাই কিন্তু খুব বেশি এদিক-সেদিক হয়নি। বাড়তি সংযোজন হিসেবে নতুন ভার্সনটিতে অটো টিউন ব্যবহার করা হয়েছে। যে কারণে গানটি শুনতে হয়ত একটু অদ্ভুত লাগছে, কিন্তু সে জন্য গোটা গানটিকে আজেবাজে সমালোচনায় বিদ্ধ করাটা অর্থহীন। তাছাড়া সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এই জাতীয় এক্সপেরিমেন্ট তো করাই যায়। তবে অবশ্যই মূল গায়ক বা গায়িকাকে অপরিবর্তিত রেখে। কেননা নিজের গাওয়া গানের প্রতি সুবিচার করার যে পরিমাণ দায়বদ্ধতা মূল শিল্পীর মধ্যে থাকবে, তা কখনই অন্য শিল্পীর থেকে আশা করা যায় না।
এখন কথা হলো, ‘ম্যায় তো রাস্তে সে যা রাহা থা…’ এই একটা গান কুমার শানুকে আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা দেবে, এমনটা ভাববার কোন কারণ দেখছি না। কেননা নিজেকে নতুন করে প্রতিষ্ঠা করার ইচ্ছা বা দায়বদ্ধতা কোনটাই কুমার শানুর থাকার কথা না। বর্তমানের ইঁদুর দৌড়ে নিজেকে সামিল করার বান্দা তিনি নন। আর কেনই বা করবেন? তার তো হারানোর কিছু নেই। তার প্রাপ্তির ভাঁড়ার এতটাই সমৃদ্ধ যে বর্তমান সময়ের সমস্ত গায়কদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি, কুমার শানুর ধারেকাছে তো দূরের কথা, তাঁর নিজের হাতে ফলানো সোনালী শস্য ভাণ্ডারের ত্রি-সীমানায় প্রবেশ করার ন্যূনতম ক্ষমতা কারো মধ্যে আছে বলে মনে হয় না। এটা বললে এতটুকুও অতিশয়োক্তি হবে না, তাঁর তুলনা শুধু তিনি নিজেই। কুমার শানু এমন প্রজাতির গায়ক যে তাকে নির্দিষ্ট একটা ছাঁচে ফেলে মূল্যায়ন করতে যাওয়াটা তাঁর শিল্পী সত্বাকে আদতে চূড়ান্ত অসম্মান করা।
জগতে শ্রোতা দুই ধরনের হয়। এক হলো হুজুকে শ্রোতা। যাদের নির্দিষ্ট কোন পছন্দ বা অপছন্দ নেই। এরা সাধারণত অস্থির মস্তিকের হয়। সময়ের সাথে সাথে এদের রুচিবোধ পাল্টাতে থাকে। একসময় হয়ত ‘ম্যায়নে প্যার তুমি সে কিয়া হ্যায়…’ কিংবা ইয়ে কালি কালি আঁখে…’ গানে কোমর দুলিয়েছেন, তারপর মাঝখানে ‘মুন্নি বদনাম…’ হয়ে ‘ভেবিকল’ মেখে ‘টুনির-মা’র প্রতি অনাস্থা এনে আপাতত এখন ‘টুম্পা’র কোমর ধরে নাচানাচি করছেন। তাদের আগ্রহ যে আগাগোড়া এই টুম্পাতেই আটকে থাকবে তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। আজ টুম্পা আছে তো কাল অন্য কেউ তাদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নেবে। আর একদল আছে যারা গানকে অন্তরে ধারণ করেন। কুমার শানুর মত শিল্পীর গান যারা পছন্দ করেন তারা দ্বিতীয় দলের। গান তাদের জীবনের প্রতিটা ওঠা-পড়ায়, ঘাত-প্রতিঘাতে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সেই অর্থে ‘ম্যায় তো রাস্তে সে যা রাহা থা…’ কুমার শানুর গাওয়া শ্রেষ্ঠ গানগুলোর একটা তা হয়ত নয়, তবে তাঁর হিট গানগুলোর মধ্যে অন্যতম একথা বলাই যায়। ‘হিট’ এবং ‘শ্রেষ্ঠ’ এই দু’টি শব্দের মধ্যে ব্যকরণগত পার্থক্য আছে। একাধিক হিট গান হয়ত একজন শিল্পীকে জনপ্রিয় করে, কিন্তু দিনের শেষে তাঁর গাওয়া শ্রেষ্ঠ গানগুলিই একজন সার্থক গায়কের মান নির্ধারণ করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
এখন কথা হলো গান তো রিলিজ করল। কিন্তু ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখনই বিরাট কিছু আশা করাটা বোধহয় বোকামি হবে। কেননা বিগত ঘটনা পরম্পরায় বলিউড সিনেমার প্রতি সাধারণ মানুষের আগ্রহের গ্রাফ ক্রমশ নিম্নগামী। বলিউড তারকাদের প্রতি একধরনের বিদ্বেষ সাধারণ মানুষের মনে পাকাপাকিভাবে জায়গা করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক কালের বেশ কিছু তারকাসমৃদ্ধ ছবি বিশ্রীভাবে মুখ থুবড়ে পড়া সেই ভাবনাটাকেই আরো বেশি করে উস্কে দিয়েছে। এই ছবিটির ক্ষেত্রে পাবলিক তাদের চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে এসে ছবিটিকে একটি বানিজ্য সফল ছবিতে রূপান্তরিত করতে সক্রিয় ভূমিকা নেবেন?নাকি বলিউড ছবির প্রতি তাদের আক্রোশের ধারাবাহিকতা বজায় রাখবেন? সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন।
কুলি নং ওয়ান (২০২০)
পরিচালক : ডেভিড ধাওয়ান
অভিনয় : বরুণ ধাওয়ান, সারা আলি খান
কথা : সমীর আনজান
সংগীত পরিচালনা : আনন্দ-মিলিন্দ