
(স্থান : কোনও এক প্রেস ক্লাব। শীতের সন্ধে। সবুজ ঘাসের লনে আলাে-আঁধারি পরিবেশ। লাল প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিলে মুখােমুখি দুই সাংবাদিক। বাবন গুপ্তা ও রুচিবান ঘটক। সামনে পানপাত্র। আবহে মৃদু স্বরে সুবিনয় রায়ের গলা থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রনাথের গান : এ কী সুধারস আনে, আজি মম মনে প্রাণে… ধরা দিল অগােচরা নব নব সুরে তানে।। শুরু হল কথােপকথন)
বাবন : আর সুধারস! একে ঘাের করােনা কাল, দোকানপাট বন্ধ, তার উপর সুধাররসের সাড়ে সর্বনাশ ঘটিয়ে দিয়েছে তােদের সরকার!
রুচিবান : ব্যাপারটাকে পুরােহিতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভাব। দেখবি, আনন্দ পাবি। সুধারসের প্রতিটি চুমুক মনে হবে সমাজের জন্য কিছু করলাম!
বা: পুরােহিত?
রু: আরে, এ তােদের পূজারী নয়। পুরােহিত। মানে, পুরজনের হিতার্থে কাজ করেন যিনি। পানপাত্র হাতে নিলেই আমার তাে ইদানীং নিজেকে বাবা আমতে বলে ভ্রম হয়। মনে হয়, এই যে সরকারের এত জনকল্যাণমুখী প্রকল্প… অন্ধজনে দেহ আলাে, মৃতজনে দেহ প্রাণ, ছাত্রজনে দেহ ট্যাব, দুর্গাপুজোয় দেহ দান, সকলেরে দেহ সুস্বাস্থ্য, বিগড়ে যাওয়া পল্লিবাসীরে দেহ পেনশন… আরও কত কী! সুধাপাত্র হাতে নিলেই নিজেকে গর্বিত মনে হয়। ভাবি, একগুলাে জনমুখী প্রকল্পের একটা বড় অংশের খরচ জোগান দিচ্ছি আমরা, সুধাপ্রেমীরা।
বা: তাই বলে এই ভাবে? ৯ মাসের মধ্যে প্রায় ১০০ পারসেন্ট দাম বাড়িয়ে ? গত বছর লকডাউন শুরু হওয়ার আগেও যে রদ্দি গাঁদার দাম ছিল ৪৩০ টাকা, ৯ মাসের মধ্যে সেটাই ৭২০ টাকা? একটু উন্নত ৫৪০ টাকার গাঁদার গুচ্ছ বেড়ে হল ৯৮০ টাকা! যে জবার দাম ছিল ৩৬০ টাকা, তা এখন ৬৪০ টাকা! পৃথিবীতে কোনও বস্তুর দামে এভাবে, ইতিহাসে কখনও উল্লম্ফন হয়েছে নাকি? কত টাকা মাইনে পাই! সংসার চালিয়ে কী থাকে ! সেভিংয়ের বারােটা বাজিয়ে দিয়েছে এই উল্লম্ফন। সপ্তাহের দু তিন সন্ধ্যায় পুজোয় বসি। ফুল বেলপাতা নিয়ে ১০ মাস আগেও যা খরচ ছিল, সেখান থেকে সটান বেড়ে গেল ২-৩ হাজার টাকা! পুজো দেব, না ভবিষ্যতের জন্য কিছু জমাব? ফুলের আকাশছোঁয়া দাম, সেই কারণেই তাে ভরা মরসুমেও আমরা বেলপাতা চিবােচ্ছি!
(গাঁদা, জবা, বেলপাতা.. এ সব সুধাপ্রেমীদের নিজস্ব ভােকাবুলারি। গাঁদা মানে হুইস্কি, জবা হল রাম, বেলপাতা হল বিয়ার। তুলসিপাতা মানে ওয়াইন। আর উচ্চমানের বিলিতি সুধা হল চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা এই সব)
রু: সরকারের যুক্তি কিন্তু একদম আলাদা। সরকারের বক্তব্য হচ্ছে, দাম বাড়ানাে হয়নি, মানুষের জন্য সুধার মূল্যনীতিতে বদল ঘটানাে হয়েছে মাত্র। গাঁদা-জবার মতাে যে সব ফুলে অ্যালকোহল কনটেন্ট বেশি, বাড়ানাে হয়েছে শুধু তাদের দাম। বুঝলি কিছু? দ্য মােস্ট কমার্শিয়ালি ইউজড ফ্লাউয়ার্স উইচ আর ফেবারিটস ইন কমন ডেইটিস লাইক আস! আর বেল, তুলসির মতাে যে সব পত্রগুচ্ছে সেই কনটেন্ট কম, তাদের দর প্রায় খাদে নামিয়ে আনা হয়েছে। এভাবে নাকি দামে ভারসাম্য বজায় রাখা হয়েছে! এখানেই শেষ নয়। উচ্চমানের বিলিতি ফুল যেমন গ্ল্যাডিয়াস, লিলিয়াম, অর্কিড, চন্দ্রমল্লিকা এদের দাম কমানাে হয়েছে। যে সব ফুলে পুজো দেন ডালমিয়া গােয়েঙ্কারা !
বা: কিন্তু, এই করতে গিয়ে তাে দিনের শেষে আবগারি রাজস্বই কমবে?
রু: সরকারের হিসাব উল্টোটা বলছে। কী বলছে শােন… ২০১৯ সালের নভেম্বর ডিসেম্বরে ফুল বেলপাতা বেচে সরকারের ঘরে এসেছিল যেখানে ১৮৪০ কোটি টাকা, এখন দরনীতিতে বদল করার ফলে ২০২০ সালের নভেম্বর ডিসেম্বরে ঘরে এসেছে ২২৭৯ কোটি টাকা। বুঝেছিস? আগের বছরের তুলনায় রাজস্ব বেড়েছে ৪৩৯ কোটি টাকা, ২৮ শতাংশ বেশি। ২০১৯ এর নভেম্বর ডিসেম্বরে বেলপাতা বেচে যেখানে ঘরে এসেছিল ৭৮ কোটি ২৪ লাখ টাকা, সেখানে দাম কমার ফলে বিক্রি বেড়েছে ৯৩ শতাংশ! গত নভেম্বর ডিসেম্বরে শুধু বেলপাতা সরকারকে রাজস্ব দিয়েছে ১৫০ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ভাবা যায়! আর দিশি ডাঁটি? সেখানেও বান এসেছে। ১৯ এর নভেম্বর ডিসেম্বরে এসেছিল ৫৬৮ কোটি টাকা। সেখান থেকে ৪৯ শতাংশ বেড়ে এসেছে ৮৩৫ কোটি ৪২ লাখ টাকা।
বা: আর গাঁদা জবা দোপাটি চন্দ্রমল্লিকা রজনীগন্ধা সব ফুল মিলে? তাতেও কি এবার বেশি কড়ি এসেছে? ফিগার আছে কিছু?
রু: আছে। কম এলেও গত বারের চেয়ে বেশিই এসেছে। গতবারের শীতের এই দুমাসে এসেছিল ১১৭১ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, সেখানে এবার ৭.৬ পারসেন্ট বেড়ে এসেছে ১২৬০ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
বা: রুচি, তাের কিন্তু এবার দেখছি দেবভাব এসেছে। এ সব তথ্য কার দেওয়া ?
রু: খােদ অর্থ দপ্তরের। কোনও পাঁচুদার দোকান থেকে পাওয়া নয়। আরও শােন, চলতি অর্থ বছরে, মানে আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে আবগারি রাজস্ব বাবদ আয়ের লক্ষ্য জানিস? ১৫০০০ কোটি টাকা। হয়ে যাবে। আগে দুটো ফুল বেচে যদি ৯৫০ টাকা আসত, সেখানে এখন একটা বেচেই ৯৮০ টাকা চলে আসছে। পরিসংখ্যানবিদ কমল সরকার আমাকে বুঝিয়েছেন।
বা: তাের সরকার যাই যুক্তি দিক, আমাদের মতাে কেজরি, মানে আম আদমির পুজোয় সাড়ে বারােটা বেজে গেছে। এখন তাে শীতকাল। ভরা পুজোর মাস। হােলি পেরিয়ে যাক, দিঘা মন্দারমণির ঢল কমে যাক, পাতা ঝরতে শুরু করুক অযােধ্য পাহাড়ে… তখন দেখিস, বাজারে শুধু কিছু বেলপাতা আছে, গাঁদা জবাগুলাে নীরস হয়ে তাকে ডিম পাড়ছে। চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধা? এই ঘন আবাদির রাজ্যে ও সব ভগ্নাংশেই আসে না রে!
রু: রং। সরকারকে বােকা ভাবিস? এবার গ্রীষ্মেও বিক্রি কমবে না। এবারের গ্রীষ্ম মানে হাইভােল্টেজ ভােটের মাস। অলিগলিতে পুজোর ধুম লাগবে। ধুম লাগবে কর্মী সমর্থকদের হৃদকমলে। তােদের নেতারা তাে দিল্লি থেকে এখানে এসে বলে যাচ্ছে, দুশাের উপর আসন নিয়ে তােরা বাংলার সুবে মসনদে বসবি। ফলে মারমার কাটকাট তাে হবেই। আর যত হবে, গাঁদা জবার তত বেশি বিক্রি বাড়বে। তাই বিক্রিতে টান ধরার তিলার্ধ প্রশ্ন নেই।
বা: ছাড়, আর ভাল লাগছে না। ক্লাবেও প্রচুর দাম বেড়েছে ফুলের। বুদ্ধবাবুও যখন সিএম, এখানেই এক পাত্র জবা খেতাম ২৮ টাকায়। এখন ৮০ টাকা! সুধাপ্রেমীদের অভিশাপ লাগবে না বলছিস? আমার পড়শি পরদীপ যাদব। নিউ টাউনে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি করে। সেদিন আমাকে কষ্ট করে বলছে, মাস মাইনে পেলে আগে একবার বারে যেতাম। যেতামই। এখন সেখানে গিয়ে একপাত্র রাম খাওয়ার বদলে সন্ধ্যায় ঘরে বসে রামধুন গাই। ও মনে করে, রামজিরা পাওয়ারে এসে সাধারণ মানুষের এই দুঃখ দুর্দশা ঘােচাবে।
রু: ওই আনন্দেই থাক। আমাদের সরকার তবু ফুল বেচে অন্ধজনে আলাে দিচ্ছে, মৃতজনে প্রাণ দিচ্ছে, ক্লাবজনে ডােল দিচ্ছে। আর তােদের সরকার এলে এই টাকায় পাড়ায় পাড়ায় গদা বিলােবে, বাকিটা শেয়ারে খাটাবে।
(দুজনেরই এবার ওঠার পালা। আবহে সুচিত্র মিত্রের গলা থেকে ভেসে আসছে রবীন্দ্রনাথের গান : ছুটির বাঁশি বাজল যে ওই নীল গগনে, আমি কেন একলা বসে এই বিজনে!!)।
ডিসক্লেমার : এই লেখার স্থান কাল পাত্র কাল্পনিক। তথ্যগত পরিসংখ্যান ছাড়া বাকি কোনও কিছুর সঙ্গে মিল পাওয়া গেলে তা নেহাতই কাকতালীয়।