
এইকাল নিউজ: করোনা কালের ভয়কে জয় করে যেভাবে সমস্ত ক্ষেত্র ছন্দে ফিরছে সেই একই ভাবে সমস্ত প্রতিকূলতাকে মানিয়ে নিয়ে নতুন রূপে জেগে উঠেছে থিয়েটারও। আর সেই নতুন রূপের জাগরণকে সঙ্গে নিয়েই গত ২০ থেকে ২৪ জানুয়ারি ইছাপুর আলেয়া ভারত সরকারের অর্থ সহায়তায় নৈহাটি ঐকতান মঞ্চে আয়োজন করল “ভারত নাট্য-রঙ্গোলী-৫” নাট্যোৎসবের। সহযোগিতায় ছিল বন্ধু দল শ্যামনগর নাট্যবিতান।
প্রথমদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উদ্বোধক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট নাট্য গবেষক আশিস গোস্বামী। প্রথমে প্রদীপ প্রজ্জ্বলন এবং তাঁর থিয়েটার বিষয়ক নাতিদীর্ঘ অথচ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মধ্য দিয়ে নাট্যোৎসবের সূচনা ঘটে।
এই নাট্যোৎসবে ইছাপুর আলেয়ার নিজস্ব ৫ টি এবং অন্যান্য দলের ৬টি, মোট ১১ টি নাটক অভিনীত হয় ঐকতান মঞ্চে। প্রথম দিন অভিনীত হয় ইছাপুর আলেয়ার ছোটদের ওস্তাদি, দীপক মিত্রের নির্দেশনায় দেবশংকর হালদারের নাটক “ক্ষমা চাওয়াটাই সোজা”। নাচে গানে রণপায় লাঠিখেলায় ইছাপুর আলেয়ার পরবর্তী প্রজন্ম যে দর্শকদের মনে এক আলাদা জায়গা করে নিয়েছে, তা বলাই যায়। এরপরই অভিনীত হয় হালিশহর ইউনিটি মালঞ্চের প্রযোজনায় দেবাশিস সরকার নির্দেশিত নাটক “বিশ্বাস”।
দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম, প্রতিটি দিনই প্রথমে শুভেন্দু মজুমদারের নির্দেশনায় অভিনীত হয় সঙ্গীতা চৌধুরীর মোট চারটি নাটক। দ্বিতীয় দিন আলেয়ার প্রযোজনা ছিল “e-মানবিক”। বর্তমান সময়ে মানুষের সোস্যাল মিডিয়ার নেশা এবং সেই সূত্রে ঘটে চলা সোস্যাল ক্রাইম এবং এতে জড়িয়ে পরা এক নির্দোষ গৃহবধূর সামাজিক সংকটের কথা বলে এই নাটক। দ্বিতীয় দিনের পরবর্তী প্রযোজনা ছিল সুনিত ভট্টাচার্য রচিত ও নির্দেশিত যাত্রিক প্রযোজনা ” আগুন নিয়ে খেলা”।
তৃতীয় দিন তিনটি নাটক মঞ্চস্থ হয়। প্রথম প্রযোজনা ছিল ইছাপুর আলেয়ার “6:1″। প্রকৃতি নিধন এবং কন্যাভ্রুণ হত্যার ফল অদূর ভবিষ্যতে কী হতে পারে, তাই নিয়ে এক কল্প-বিজ্ঞানের গল্প বলে এই নাটক। সাথী মিত্রের ছোট গল্পের ছায়ায় রচিত সঙ্গীতা চৌধুরীর এই নাটক দর্শকদের হাসির মোরকে এক ভয়ংকর সম্ভাব্য ভবিষ্যতের সামনে দাঁড় করায়। এই দিনের দ্বিতীয় নাটক ছিল আবহমান প্রযোজনা তীর্থঙ্কর চন্দের নির্দেশনায় “হারুন-আল-রশিদ”। সংবেদনশীল মানুষের মনের কথা বলা এই নাটক দর্শকদের মনকেও সংবেদনশীল করে তোলে। এই দিনের তৃতীয় প্রযোজনা ছিল বিহঙ্গের “গল্পে যেমন বলে”। একদল তরূণ নিয়ে তৈরি এই দল নাচ গান আর গল্পের ছলে বর্তমান সময়ের সাম্প্রদায়িক সমস্যার কথা তুলে ধরে।
চতুর্থ দিনের আলেয়ার নাটক ছিল “তমসা সহসা”। বর্তমান সময়ে সকল সন্তানই সাকসেসফুল হওয়ার তাড়নায় বিদেশগামী, আর তাতেই একা হয়ে যাচ্ছেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। আর সেই একা হয়ে গিয়ে তাঁর নিজেরই সন্তানের কাছে প্রবঞ্চিত হওয়া এক বৃদ্ধার কথা বলে এই নাটক। এই দিনের পরবর্তী প্রযোজনা ছিল গরিফা নাট্যায়নের কনক মুখার্জি নির্দেশিত নাটক “অরণ্য সংবাদ”।
পঞ্চম দিনের প্রথম প্রযোজনা ছিল ইছাপুর আলেয়ার “স্পর্শ”। প্রায় পঁচিশ বছর কর্মজীবন অতিবাহিত করার পর এক সরকারি স্কুলের গেম টিচারকে পেতে হয় এক ছাত্রীকে “Bad touch” করার অপবাদ, আর তার পরই সেই নীরিহ ছাত্রী এবং নির্দোষ স্যারের মানসিক ও সামাজিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করে এই নাটক। নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা-সহ সব কলাকুশলীর শৈল্পিক গুণে দর্শকদের মনকে অন্যভাবে স্পর্শ করে নাটক ‘স্পর্শ’। এর পরবর্তী প্রযোজনা ছিল সঞ্জয় আচার্যের নির্দেশনা নৈহাটি বঙ্কিম নাট্য সংস্থার প্রযোজনা “রামযাত্রা”। নাচ গান কৌতুকের মাধ্যমে বর্তমান রাজনৈতিক আবহের কথা বলে এই নাটক।
করোনা পরিস্থিতিতে সমস্ত বিধিনিষেধ মেনে ইছাপুর আলেয়া আয়োজিত নাট্যৎসব যে নৈহাটি অঞ্চলে বিশেষ সাড়া ফেলেছে, তা এই পাঁচদিনের দর্শক সমাগমই বুঝিয়ে দিয়েছে। শেষ দিন দর্শকদের প্রতিনিধি হিসেবে এক দর্শককে একটি চারাগাছ উপহার দেওয়া হয় ইছাপুর আলেয়ার পক্ষ থেকে। এছাড়াও শেষ দিন সকল দর্শককে ইছাপুর আলেয়ার সব সদস্যর সাথে পরিচয় করিয়ে দেন সংস্থার কর্ণধার শুভেন্দু মজুমদার। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যও রাখেন তিনি। শিশু-কিশোর, যুব ও প্রবীণদের ইছাপুর আলেয়ার এই বাহিনীকে এইরকম উৎসব আয়োজনের জন্য অভিনন্দন জানান তিনি।