Breaking
11 Apr 2025, Fri

ভুল তথ্য মোদির! প্রতিবাদে পথে নৈহাটির বুদ্ধিজীবীরা, প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি বঙ্কিমভবনের

শোভনলাল রাহা, এইকাল নিউজ: সোমবার হুগলির জনসভা থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অভিযোগ করেন, রাজ্য সরকারের উদাসীনতায় বন্দেমাতরমের জন্মস্থান ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। আর তারপরই প্রতিবাদের ঝড় তোলেন বঙ্কিমপ্রেমীরা। প্রধানমন্ত্রী ভুল তথ্য দিয়েছেন, এই অভিযোগে পথে নামেন বঙ্কিম-জন্মভূমি নৈহাটির বুদ্ধজীবীরা। মঙ্গলবার সাহিত্য সম্রাটের বসতভিটেতে গড়ে ওঠা বঙ্কিমভবনের সামনে কালো ব্যাজ পরে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন তাঁরা। অন্যদিকে, সাংবাদিক বৈঠক ডেকে প্রধানমন্ত্রী ভুল তথ্য দিয়েছেন বলে দাবি করেছেন বঙ্কিমভবন গবেষণা কেন্দ্র ও সংগ্রহশালার অধ্যক্ষ ড. রতনকুমার নন্দী। ভুল শুধরে দিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে নথি-সহ চিঠি দেবেন বলেও জানান রতনবাবু।

রতনবাবু জানান, ১৯৯৯ সালে তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রাজ্যের উচ্চশিক্ষা দফতরের উদ্যোগে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের এই বসতবাড়িটি অধিগ্রহণ করে হেরিটেজ ঘোষণা করা হয়। গড়ে ওঠে বঙ্কিমভবন গবেষণা কেন্দ্র। পরবর্তীতে রাজ্যের বর্তমান সরকার ধারাবাহিকভাবে ভবনের সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভবনের কর্মীদের বেতন থেকে শুরু করে ভবন চালানোর অন্যান্য ব্যয়ভার, সবই বহন করে রাজ্য সরকার। তিনি আরও বলেন, এই ভবন থেকেই নিয়মিত প্রকাশিত হয় বঙ্গদর্শন পত্রিকা।
বঙ্কিমভবনের অধ্যক্ষ বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে সবটা জানা হয়তো সম্ভব নয়। তবে কেউ তাঁকে ভুল তথ্য দিয়েছেন। সেটা যাচাই না করেই তিনি প্রকাশ্য জনসভায় অভিযোগ এনেছেন। কিন্তু এই অভিযোগ সত্য নয়। এই কাঁটালপাড়াতেই নিজের জন্মভিটেয় বসেই বন্দেমাতরম রচনা করেছিলেন বঙ্কিম। তাঁর এই পবিত্র জন্মস্থান সরকারি উদ্যোগে হেরিটেজ ঘোষণা করে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সংগ্রহশালা গড়ে তুলে বঙ্কিমচন্দ্রের মাথার পাগড়ি থেকে শুরু করে ব্যবহৃত নানা জিনিস সংরক্ষিত হয়েছে। এমনকী, যে স্থানে বঙ্কিম জন্মগ্রহণ করেছিলেন, সেই সুতিকাগৃহটিও পূর্ণ মর্যাদায় সংরক্ষিত।’ এই বঙ্কিমভবনে বঙ্কিমচন্দ্রের সৃষ্টি ও ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সংরক্ষণের পাশাপাশি বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে ধারাবাহিক গবেষণার কাজ চলছে বলেও জানান তিনি।

স্থানীয় সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষজন বঙ্কিমভবনের সামনে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের পর দেখা করেন বঙ্কিমভবনের অধ্যক্ষের সঙ্গেও। তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পরই অধ্যক্ষ রতনকুমার নন্দী প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, ‘ঝা-চকচকে এই ভবন যদি ভগ্নস্তূপ হয়, তাহলে আমার প্রশ্ন, সঠিকভাবে সংরক্ষিত হেরিটেজ বিল্ডিং তাহলে কোনটা ? আমি ভবনের বিভিন্ন অংশের ছবি ও অন্যান্য যাবতীয় নথি-সহ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে চিঠি পাঠিয়ে এবিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ তাঁর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া বুদ্ধিজীবী তথা নৈহাটির সংস্কৃতিজগতের মানুষজন। ওই দলে ছিলেন বিশিষ্ট শিক্ষক ড. সুব্রত সরকার, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, অনিন্দ্যকান্তি দে, সঙ্গীতজ্ঞ রাজা চট্টোপাধ্যায়, রঞ্জনা বাচস্পতি, নাট্য ব্যক্তিত্ব অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবাশিস সরকার, নৃত্যশিল্পী অরুন্ধুতী ভট্টাচার্য প্রমুখ। তাঁদের সকলেরই বক্তব্য, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি রাজ্যসরকারের অবহেলার যে অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তার বিরোধিতা করেই এদিনের প্রতিবাদ কর্মসূচি। তাঁদের সাফ কথা, রাজনীতি থাক রাজনীতিতেই। সেখানে মণীষীদের নিয়ে টানা-হেঁচড়া ঠিক নয়।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নৈহাটির বিধায়ক পার্থ ভৌমিকও। তিনি বলেন, ‘ভোট ব্যাংকের লক্ষ্যে যতই বাঙালিয়ানা দেখান না কেন, আদতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বরাবরই ভীষণভাবে বাঙালি বিদ্বেষী। নৈহাটিতে বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মভিটেতেই গড়ে উঠেছে বঙ্কিমভবন গবেষণা কেন্দ্র। ঝা-চকচকে এই হেরিটেজ বিল্ডিংয়ের রক্ষণাবেক্ষণে যে কোনও ত্রুটি নেই, যে কেউ তা এখানে পা রাখলেই বুঝতে পারেন। অন্যদিকে, চুঁচুড়ায় বন্দেমাতরম ভবনেরও আদৌ ভগ্নদশা নয়। কিন্তু আক্ষেপ, আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে মুখে বাংলার মণীষীদের কথা বললেও আদতে বাংলার মণীষীদের প্রতি তাঁর কোনও আবেগ নেই।’ বিধায়ক বলেন, ‘যে বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে এত কথা বললেন, সেই বঙ্কিমের স্মৃতি বিজরিত বন্দেমাতরম ভবনের ঢিল ছোড়া দূরত্বে জনসভা করা সত্ত্বেও একবার সেখানে প্রবেশ করে বঙ্কিমচন্দ্রকে জানার চেষ্টা করলেন না। একবারও নৈহাটির বঙ্কিম ভবন গবেষণা কেন্দ্র ও সংগ্রহশালায় পা রেখে সাহিত্য সম্রাটের সৃষ্টি ও তাঁর জীবন সম্পর্কে জানলেন না। কারও মুখে শুনে একটা মিথ্যা অভিযোগ করে বসলেন প্রকাশ্য জনসভায়। তাঁর এই মিথ্যার প্রতিবাদেই নৈহাটির বুদ্ধিজীবী মানুষ পথে নেমেছন। আসলে বঙ্কিমচন্দ্র নৈহাটির মানুষের আবেগ। তাই কোনও রাজনৈতিক ব্যানার ছাড়াই প্রধানমন্ত্রীর মিথ্যার বিরুদ্ধে আজ প্রতিবাদ আন্দোলনে শামিল হয়েছেন নৈহাটির সংস্কৃতি প্রেমী মানুষ।’
ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন নৈহাটির পুরপ্রধান অশোক চট্টোপাধ্যায়ও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ‘পরিযায়ী পাখি’ বলে কটাক্ষ করেন তিনি। বলেন, ‘উনি বাংলার আবেগ, বাংলার সংস্কৃতির কিছুই বোঝেন না। শুধু ভোট-রাজনীতির জন্য মুখে বাংলার মণীষীদের বুলি আওড়াচ্ছেন। বাংলা ভাষার মানে না বুঝেই বলে চলেছেন। তাই তো তিনি বলেছেন, দোলের দিন রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া হয় ওরে গ্রহবাসী। গৃহ আর গ্রহের তফাৎ যিনি বোঝেন না, তিনি বাঙালিয়ানার নাটকে বাংলার ভোটারদের মন ভোলানোর চেষ্টা করছেন। আর সেই কারণেই প্রকাশ্য জনসভায় বঙ্কিমচন্দ্রকে নিয়ে মিথ্যা তথ্য তুলে ধরে বাংলার মানুষকে ভুল বোঝাতে চাইছেন। কিন্তু নৈহাটির বঙ্কিমপ্রেমী মানুষজন এর প্রতিবাদে সরব হয়েছেন।’

Developed by