Breaking
18 Apr 2025, Fri

হালিশহর উপনগরী—-একটি সমীক্ষা লিখছেন এইকাল-এর সাম্মানিক প্রতিনিধি ডঃ রবীন্দ্রনাথ মুখার্জি (প্রাক্তন পৌর প্রধান । হালিশহর পৌরসভা)

রামপ্রসাদের মন্দিরের পুরোনো চিত্র

ভূতত্ত্ববিদদের মতে২৫০০ বছর আগে বাংলার সম্পূর্ণ ব-দ্বীপ অঞ্চলটি অবস্থান করতো বঙ্গোপসাগরের তলায়। আর গঙ্গার মোহনা টি ছিল গৌড়ের কাছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আমাদের হালিশহর সমেত সমগ্র উত্তর 24 পরগনার অবস্থান ছিল গভীর জলের তলায়। পরিব্রাজক ইবন বতুতার ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের বর্ণনা অনুযায়ী, It(Satgaon is a large city on the shore of Bay of Bengal) হালিশহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পূর্ব বাহিনী গঙ্গার পূর্ব পাড়ে রয়েছে ত্রিবেণী সঙ্গম। ত্রিবেণী সঙ্গম এখানে মুক্তবেণী অর্থাৎ গঙ্গা যমুনা ও সরস্বতীর বিচ্ছেদ স্থল। এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গম যুক্তবেণী এখানে তিন নদী মিলিত হয়েছে। একদা এখানে যমুনা নদী পূর্ব বাহিনী হয়ে ইছামতীতে মিলিত হয়েছিল। বর্তমানে যমুনা নদী সম্পূর্ণভাবে মজে গিয়ে একটি বিলের আকারে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সরস্বতী নদী তো সম্পূর্ণ মজেগিযে একটি খাল হিসেবে টিকে আছে।বাগেরমোড় সংলগ্ন অঞ্চলে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যে সংযোগকারী খালটি সংস্কার করেন আহমেদ বেগ যার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যতরী গঙ্গা থেকে যমুনা হয়ে ইছামতি পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করত। বর্তমানে যে খালটি অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে বাগের খাল হিসেবে পরিচিত এবং যেটি উত্তর 24 পরগনা ও নদীয়ার সীমানা নির্ধারণ করছে। একাদশ শতাব্দীতে পাল বংশের রাজা কুমার পাল নদীতীরে একটি জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র বা পোতাশ্রয় নির্মাণের ফলে তার নাম ও পোতাশ্রয় এর জন্য শ্রমিকদের বাসস্থান বা হট্য এর সমন্বয়ে অঞ্চল টির নাম হয় কুমারহট্য। সেই সময় থেকেই শুরু অধুনা হালিশহরের গরিমার ইতিহাস। প্রাচীন সপ্তগ্রাম এর সভ্যতা সংস্কৃতি, ব্যবসা বাণিজ্য এই জনপদকে সমৃদ্ধ করেছিল
শ্রীচৈতন্যের দীক্ষাগুরু শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী, শ্রীচৈতন্য পার্ষদ শ্রীবাস পন্ডিতের আবাসস্থল ছিল সেকালের কুমারহট্ট। শিক্ষা-সংস্কৃতি, পাণ্ডিত্য গৌরবের অগ্রদূত হিসেবে কুমারহট্ট সম্মানিত হয়েছিল।
সেন বংশের মহারাজ বিজয় সেন বঙ্গদেশ অধিকারের প্রথম পর্বে বঙ্গদেশের রাজধানী হিসেবে বিজয়নগর প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান বিজপুর হলো-প্রাচীন বিজয়নগর।

Advertisement

শেরশাহ দিল্লি অধিকার করলে কাজী ফজলতকে তিনি ফৌজদার পদে নিয়োগ করেন। জমি জরিপ কালে ভাগীরথীর পূর্বপ্রান্তের এই অংশটি কে একটি পরগনায় রূপান্তরিত করেন যার নাম হাবেলী শহর পরগনা। এই পরগনার অন্যতম বর্ধিষ্ণু অঞ্চল ছিল হাবেলি শহর। হবেলি শহরের অপভ্রংশ হল বর্তমান হালিশহর। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমান শাসনকালে অসংখ্য সুউচ্চ অট্টালিকা শোভিত বর্ধিষ্ণু জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠে বাগের মোড় ও মল্লিক বাগ সন্নিহিত অঞ্চল। এটি ছিল সাবর্ণ চৌধুরীদের আদি বাসভূমি। সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ) সাবর্ণ বংশীয় লক্ষীকান্ত রায়চৌধুরী কে সাতগাঁও সরকারের অধীনে যে পরগনা গুলির অধিকার দেন তারমধ্যে সেদিনের হাবেলী শহর পরগনা ছিল অন্যতম। সাবর্ণ চৌধুরীদের আদি বাসভূমি হালিশহরেই তৈরি হয়েছিল ইংরেজদের কাছে কলকাতা হস্তান্তরের খসড়া দলিল।
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন, রানী রাসমণি, ব্রিটিশ সিংহের ঘুম কেড়ে নেওয়া বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি, নেতাজির একান্ত সচিব সুশীল কুমার ঘোষ, নেতাজির সহযোগী আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সিপাহী বিদ্রোহের অমর শহীদ সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের রাজীব লোচন রায়, বঙ্কিমজায়া রাজলক্ষ্মী দেবী নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আনন্দমঠ খ্যাত সন্তান দলের স্মৃতিবিজড়িত আমাদের পুণ্যভূমি হালিশহর।
এবার গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে প্রবন্ধের মূল বিষয়ে আসা যাক। বর্তমান প্রবন্ধের মুন প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বিগত ১০ বছরের হালিশহর পৌরসভার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা।

নৈহাটি পৌরসভা আমাদের দেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা। এই পৌরসভাটি স্থাপিত হয়েছিল ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। বহু মনীষী ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের বাসভূমি ছিল নৈহাটি যথা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ব্যারিস্টার ও অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রমথনাথ মিত্র, ইতিহাসবিদ ও ভাষাবিদ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কোয়ান্টাম রসায়নবিদ এবং বহু বিশ্লেষের ক্লাস্টার তত্ত্বের প্রবক্তা দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, শিল্পী চিত্রা প্রসাদ ভট্টাচার্য, সমাজ সংস্কারক কেশব চন্দ্র সেন, ক্রিমিনোলজিস্ট পঞ্চানন ঘোষাল, রাজস্থানের জয়পুরের প্রধান স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ বিদ্যাধর ভট্টাচার্য, বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু, বিখ্যাত গায়ক শ্যামল মিত্র প্রমুখ।
1901 সালে আদমশুমারি অনুযায়ী নৈহাটি পৌরসভা অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল ২৩৭৫৩। হালিশহর ও কাঁচরাপাড়া অঞ্চল ছিল নৈহাটি পুরসভার অন্তর্ভুক্ত। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী নৈহাটি পৌরসভার জনসংখ্যা ২১৭৯০০। একদা নৈহাটি পৌরসভার পৌর প্রধানের আসন অলংকৃত করেছিলেন বন্দেমাতরম এর উদগাতা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
পরবর্তীকালে ১৯০০ সাল নাগাদ দাবি ওঠে হালিশহরে পৃথক পৌরসভা গঠন করতে হবে। নৈহাটি পৌরসভার পক্ষে এত বৃহৎ অঞ্চলের সঠিকভাবে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কর্নেল কেপি গুপ্ত, হালিশহর উপনগরীর রূপকার, 24 পরগনার জেলাশাসক মিস্টার এ্য‌লেনের সঙ্গে দেখা করে এই প্রস্তাব দেন। জেলাশাসকের পরামর্শমতো ১৯০১ সালের ২৬শে জানুয়ারি হালিশহর স্কুলে জনসভার আয়োজন করা হয়। হালিশহর ও বিজপুর নিয়ে একটি পৃথক পৌরসভা গঠনের প্রস্তাব নিয়ে তা জেলাশাসক ও নৈহাটি পুরসভার পুরপ্রধানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পৌরসভার পৌরপ্রধান মিস্টার জর্জ রবার্টসন সহ আরো তিনজন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও বাকি ৮ জন কমিশনার প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন। হালিশহর গুড উইল ফ্রেটারনিটি এই সিদ্ধান্তে হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। বাংলাদেশের মিউনিসিপাল সংক্রান্ত ১৮৮৪ সালে বঙ্গীয় ৩ আইন এর ৯ ধারায় (সি) ও বি উপধারার বিধান অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট গভর্নর সাহেবের অভিপ্রায় ঘোষণা করিয়া ১৯০২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর একটি বিজ্ঞপ্তি (নং১৯৫৭ টি-এম) উক্ত সালের পয়লা অক্টোবর তারিখের কলকাতা গেজেট এর প্রথম খন্ডের “বি”অংশের ১৮৮ পৃষ্ঠায় প্রকাশ করা হয়। নৈহাটি পৌরসভার কমিশনারদের এক সভায় ওই বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক হালিশহর পৌরসভার সীমানা সম্পর্কে সুপারিশ করা হয় এবং ওই সীমানা অনুযায়ী নৈহাটি পৌরসভা হইতে ৩,৪ও ৫ নং ওয়ার্ড গুলি লইয়া দ্বিতীয় পৌরসভা গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। “ওই দুইটি পৌরসভা যথাক্রমে নৈহাটি পৌরসভা ও হালিশহর পৌরসভা নামে খ্যাত হইবে।” উক্ত সুপারিশের ভিত্তিতে লেফটেন্যান্ট গভর্নর সাহেব হালিশহর পৌরসভার সীমানা সম্পর্কিত সুপারিশ অনুমোদন করেন।(সূত্র-মধুসূদন বন্দোপাধ্যায় রচিতঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পৌর ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ : সুবে বাংলা; মার্চ ১৯১২ সাল পর্যন্ত।)
তখন কাঁচরাপাড়া অঞ্চল‌ও ছিল হালিশহর পৌরসভার অন্তর্গত। পরবর্তীকালে কাঁচরাপাড়া পৌরসভা আলাদাভাবে গঠিত হয়।

এবার আসা যাক রাজ্যে তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে হালিশহর পৌরসভার পৌর পরিচালন ব্যবস্থা। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন কিছু পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার মধ্যে অন্যতম হালিশহর পৌরসভা। উক্ত নির্বাচনে জনতার রায়ে বামপন্থীরা বিপুলভাবে জয় যুক্ত হয়ে পৌরবোর্ড গঠন করে। বর্তমান লেখক ওই পৌরসভায় পৌর প্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তৎকালীন বিরাজমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পৌরসভার কাজ শুরু হয়। পৌর বোর্ডের প্রথম সভাতেই তৃণমূলের কাউন্সিলররা বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। সভাকক্ষের বাইরে তৃণমূলী বহিরাগতরা জমায়েত হন। ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই অত্যাচার চরমে ওঠে। চারিদিকে সন্ত্রাসের পরিস্থিতি। পশু শক্তির জোরে বামপন্থী পার্টির কর্মীদের উপর নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে বামপন্থীদের বেশিরভাগ অফিস দখল করে নেওয়া হয় এমনকি কাঁচরাপাড়া ঐতিহ্যপূর্ণ কংগ্রেস ভবন‍ও এই দখলের রাজনীতি থেকে রেহাই পায়না।জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত হালিশহর পৌরসভার প্রতিনিয়ত সন্ত্রাস, কর্মচারীদের ওপর দৈহিক আক্রমণ, মূল্যবান যন্ত্রাদি ভাঙচুর করা, গুরুত্বপূর্ণ নথি নষ্ট করা, পৌর প্রধানের ঘরে প্রতিদিন দলবদ্ধভাবে প্রবেশ করে কুৎসিত গালিগালাজ চলতেই থাকে। প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে টেন্ডারপত্র বিক্রি করার সময় তৃণমূল ছাড়া অন্যান্য কন্ট্রাকটারদের বলপূর্বক টেন্ডারপত্র ক্রয় বাধা দান ও দৈহিক নির্যাতন এসমস্ত ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
একদিন পৌর বোর্ডের মাসান্তে রুটিন বৈঠকের সময় তৃণমূলের বাহিনী পৌরসভার গেটে জমায়েত হযে বৈঠকে আগত বামপন্থী কাউন্সিলরদের বৈঠকে যেতে বাধা দান ও দৈহিক নিপীড়ন চালায়। তার আগে পৌর প্রধান কে পৌরসভার মধ্যে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় এবং তিনিও দৈহিকভাবে আক্রান্ত হন ও পা দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। কিন্তু পৌর প্রধান সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করে অফিসে প্রবেশ করেন পৌরসভার মেডিক্যাল অফিসার তাকে প্রাথমিক শুশ্রূষা করেন ও ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেধে দেন। যথারীতি বিজপুর পুলিশ স্টেশনে ফোন করা হয়। একদল পুলিশ অল্প সময়ে পরে পৌরসভায় হাজির হন কিন্তু তারা কোনরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দর্শক হিসেবে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন যদিও তখনো পর্যন্ত বামপন্থী কাউন্সিলরদের ওপর দৈহিক আক্রমণ চলছিল। থানার আইসির কাছে পৌর প্রধান এর পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললে আইসি অদ্ভুত এক উত্তর দেন। তিনি বলেন আগে থেকে জানানো হয়নি কেন? পৌর প্রধান বলেন এটি পুরো বোর্ডের মাসান্তে রুটিন সভা। এই সভাকে কেন্দ্র করে আজকে হঠাৎ এই ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে তা কারো জানার কথা নয় কাজেই আগে থেকে পুলিশে জানানোর প্রশ্নটিই অবান্তর। পৌর প্রধান তাকে জিজ্ঞাসা করেন কোন বাড়িতে ডাকাতি হলে আপনি কি গৃহকর্তাকে বলবেন যে আজকে আপনার বাড়িতে ডাকাতি হবে সেটি আগে থেকে থানায় জানাননি কেন?
যাই হোক এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই বামপন্থী বোর্ড হালিশহরের উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যান। ২০১০ সালের জুন মাসে হালিশহর পৌরসভার বামপন্থী বোর্ড গঠনের পর নাগরিক পরিষেবা শিক্ষা স্বাস্থ্য সংস্কৃতি ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি ঘটায়
১) প্রথমেই পৌরবোর্ড যে কাজটি করতে পেরেছিল তা হল গঙ্গার তীরে 17 টি ঘাটের উন্নয়ন। Riverfront Development প্রকল্পে পৌরসভা তৎকালীন কেন্দ্রে র ইউ পি এ সরকারের কাছ থেকে 15 কোটি টাকা র অনুমোদন আদায় করে। মজার বিষয় হলো প্রকল্পের কাজ চলাকালীন গঙ্গার ঘাট এবং অন্যত্র “গঙ্গার ঘাট উন্নয়নের জন্য বিধায়ক কে অভিনন্দন”এই শিরোনামে অনেকগুলি ফেস্টুন টাঙানো হয়ে যায় যদিও এই প্রকল্পের সম্পর্কে বিধায়কের কোন কিছুই জানা ছিল না এবং এই প্রকল্পটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে তার কোনো ভূমিকাই ছিল না
২)শত বাঁধাবিপত্তি সত্ত্বেও হালিশহর পৌরসভার একক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকারের বি এস ইউ পি প্রকল্পে ৪৯৪৫টি বাসগৃহ ও আনুষঙ্গিক পরিকাঠামো যথা কংক্রিট ও পিচের রাস্তা, পাইপলাইন, নর্দমা, ল্যাম্পপোস্ট ও কমিউনিটি সেন্টারের অনুমোদন পাওয়া যায়। মাত্র এক বছরে নজিরবিহীনভাবে 125 কোটি টাকা মঞ্জুর হয়। পরবর্তীকালে আরো 54 কোটি টাকার অনুমোদন পাওয়া যায়। সরকারি উচ্চপদস্থ আমলার উপর নির্ভর না করে পৌর প্রধান স্বয়ং দিল্লিতে নগর উন্নয়ন মন্ত্রকে Central sanctioning and monitoring committee(CSMC)র সভায় উপস্থিত থেকে পৌরসভার অন্তর্গত এলাকায় বাসগৃহ নির্মাণের উপযোগিতা সম্পর্কে PowerPoint projection এর মাধ্যমে তুলে ধরে। এর কারণ হালিশহরের উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা পৌরবোর্ড‍ই এলাকার সমস্যা গুলি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। একাধিকবার দিল্লিতে পৌরবোর্ড কে এই কমিটির সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবারই কমিটির সদস্যগণ পৌর প্রধানের deliberationএ সন্তুষ্ট হন এবং যথারীতি পৌর বোর্ডের আবেদনকে স্বীকৃতি দিয়ে অর্থ মঞ্জুর করেন। তিনটি পর্যায়ে ৪৯৪৫টি বাসগৃহের জন্য প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়।
৩) পৌর ভবনের বিপরীতে গঙ্গা তীরবর্তী স্থানটি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু উক্ত জায়গায় পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকাটি এবং পতাকা দণ্ডটি এখন পৌরসভার সংগ্রহশালায় সযত্নে সংরক্ষিত আছে। পরবর্তীকালে হুকুম চাঁদ জুট মিলের ম্যানেজার W.W.Craig ওই স্থানটিতে একটি পার্ক নির্মাণ করেন, তার নামানুসারেই ওই পার্কটির নাম হয় ক্রেগ পার্ক। বামপন্থী পৌর বোর্ডের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ওই পার্কটির নাম পরিবর্তন করে হালিশহরের সু-সন্তান প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির নামাঙ্কিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের Ganga Action Plan(GAP) এ বাম বোর্ডের নিজস্ব তহবিল সমেত ১ কোটি ২৬লোক্ষ্ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী পার্কের সৌন্দর্যায়ন সম্পন্ন হয় কেন্দ্রের নগর উন্নয়ন দপ্তরের উচ্চ পদস্থ অফিসার এবং কেএমডিএর পূর্বতন চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও কলকাতার মিলেনিয়াম পার্কের পরিকল্পনা কার শ্রী চূনার দের পরামর্শক্রমে। কিন্তু সেটি উদ্বোধনের ক্ষেত্রে নানা রকম বাধা বিপত্তি আসতে থাকে। পৌরবোর্ড কে বল পূর্বক অপসারণের পর বর্তমান বিধায়ক এটির উদ্বোধন করেন।
৪) পূর্বেই বলা হয়েছে সহস্রাধিক বছরের অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত কাহিনী হালিশহর কে দান করেছে অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। আধুনিক মনন ভাবনায় সেই অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য এখন হালিশহর বাসির গৌরব। বৈষ্ণব শাক্ত ও শৈব ভাবনার মিশ্রণ প্রথম থেকেই এই পবিত্র ভূমি কে যেন মহাতীর্থে পরিণত করেছিল। একদা এখানেই অগ্রগতির হাত ধরে গড়ে উঠেছিল নগর, বন্দর ও সুভদ্র জনপদ। কুমারহট্যের বিদ্বৎ সমাজ ছিল বাংলার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন জ্ঞান তীর্থ। কুমারহট্যের বিদ্যাপীঠ বয়সের হিসেবে ও খ্যাতিতে নবদ্বীপ ও ভাটপাড়ার চেয়েও সারস্বত চর্চার ক্ষেত্রে প্রাচীন কেন্দ্রভূমি হিসেবে চিহ্নিত। এই গৌরবগাথা কে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য বামপন্থী পৌরবোর্ড একটি সংগ্রহশালা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।’পশ্চিমবঙ্গ পৌরসভার আইন ২০০০(সংশোধিত) মোতাবেক ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পৌর বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হালিশহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কে নিয়ে গঠিত হয়—হেরিটেজ কনজারভেশন কমিটি। এই কমিটির তত্ত্বাবধানে প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যবাহী কুমার হট্য–হাবেলী শহর অধুনা হালিশহরের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে রাখার প্রয়াসে হালিশহর সংগ্রহশালা গড়ে তোলার মহতী কর্মযজ্ঞ আরম্ভ হয়। একে রূপ দেওয়ার কাজে এগিয়ে আসেন সমভাবনার শরিক কয়েকজন ইতিহাসবেত্তা এবং সুলেখক নাগরিক। সংগ্রহশালার নির্মাণ এবং সংগৃহীত নিদর্শনগুলি প্রদর্শনের জন্য নকশা প্রস্তুত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রখ্যাত প্রযুক্তিবিদ ও স্থপতি, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি ঐতিহ্যপূর্ণ সংগ্রহশালার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত শ্রী অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সংগ্রহশালার অন্যতম বিশেষজ্ঞ শ্রী গোপী দে সরকার। প্রস্তাবিত হয় তিনটি হলে বিভাজিত করে সংগ্রহশালাটি নির্মিত হবে। প্রথম হলটিতে সংরক্ষিত থাকবে সহস্রাধিক বছরের পুরনো ইতিহাস থেকে প্রাকস্বাধীনতা পর্ব পর্যন্ত। দ্বিতীয় হলটিতে থাকবে অডিও ভিসুয়াল তথ্য চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা এবং তৃতীয় হলটিতে থাকবে স্বাধীনতা-উত্তর হালিশহরের গড়ে ওঠার ইতিহাস। স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, সাবর্ণ চৌধুরী পরিবার পরিষদ, সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের স্মৃতিবিজড়িত গরানহাটার জমিদার বাড়ি ইত্যাদির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে সংগৃহীত হয় ১৮৭১ সালে প্রকাশিত জানকীনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত দুষ্প্রাপ্য হালিশহর পত্রিকার পূর্ণাঙ্গ প্রতিলিপি। এই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে রানী রাসমণি ও তার কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বার স্বাক্ষরিত একাধিক স্মারক ও দলিলপত্র। এখানে রক্ষিত আছে রানী রাসমণি বিশেষজ্ঞ ডক্টর শিশুতোষ সামন্তর কাছথেকে সংগৃহীত রাসমনির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাসের বংশ তালিকা, আছে রাসমণি প্রতিষ্টিত বারাণসীতে অবস্থিত রানী রাসমনির ছত্র, ত্রৈলোকেশ্বর মন্দিরের নকশা, জানবাজারের প্রাসাদ এবং রাসমণি ব্যবহৃত বহু সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র প্রভৃতি। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই হাবেলিশহর পরগনার আধিপত্য নেন শেরশাহের সেনাবাহিনীর অন্যতম সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের পঞ্চানন বা পাঁচু শক্তি খা। তার প্রপৌত্র লক্ষীকান্ত‌ই কলকাতার পত্তন করেন। হালিশহরের সাবর্ণ পরিবারের কোন একটি বাড়িতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে মাত্র 13 শ’ টাকায় তিনটি গ্রাম হস্তান্তরের সনদটি প্রস্তুত হয়েছিল। এই খসড়া সনদের একটি অনুলিপি হালিশহর সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে। লক্ষীকান্তের প্রপৌত্র বিদ্যাধর রায়চৌধুরী সাড়ে 300 বছর আগে গঙ্গাস্নানকালে গঙ্গা জলে শিলাখণ্ডের সন্ধান পান এর থেকে নির্মিত তিনটি বিগ্রহ–বুড়োশিব শ্যামরায় ও কালিকা মূর্তি স্থাপন করা হয় তিনটি মন্দিরে। বর্তমান বকুলতলার কাছে মূর্তির মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। একদা গঙ্গাবক্ষে ইংরেজ ও ওলন্দাজদের সংঘর্ষের সময় মন্দিরটি গোলার আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মূর্তিটি পরবর্তীকালে বর্তমান বলিদা ঘাটায় স্থানান্তরিত করা হয় যাহা বর্তমানে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির হিসেবে পরিচিত। অধুনা সেই মূর্তি টির‌ও সন্ধান নেই। পুরনো মন্দিরের।ধ্বংসাবশেষটির চিহ্ন এখন‌ও বর্তমান। এগুলির আলোকচিত্র আছে এই সংগ্রহশালায়।
হালিশহরের কুমোর পাড়ার সন্নিকটে অবস্থিত অতি প্রাচীন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাগের মসজিদ। আওরঙ্গজেবের মাতুল শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবেদার থাকার সময়ে এই মসজিদটি তৈরি হয়েছিল। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারদের উপাসনার জন্য। নির্মাণকাল ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ (১১০৭ হিজরী)।মসজিদ নির্মাণের সময় প্রোথিত শিলালিপিটি রাখা আছে এই সংগ্রহশালায়।
ভূগর্ভস্থে প্রোথিত কিছু শিলা মুর্তি হালিশহর কে বিশিষ্টতা প্রদান করেছে যেমন সেন বংশের আমলে নির্মিত এখনো ঝকঝকে ও অমলিন গণেশ মূর্তি যার দক্ষিণ হস্ত ভাঙ্গা। সাঁপুকুর খননকালে এটি এবং আরও তিনটি শিলা মুর্তি পাওয়া গিয়েছিল। মূর্তিটি অত্যন্ত অযত্নে এক জায়গায় পড়ে থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিকূলতায় সেটি সংগ্রহশালায় রাখা যায়নি। এর আলোকচিত্রটি সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। সেন বংশের আমলে নির্মিত একটি মন্দিরের দেবদেবীর মূর্তি খোদিত একটি দেউল এর অংশ সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে।
এই সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক তার সচিব ও সহযাত্রী সুশীল কুমার ঘোষ এর কাছে লেখা একটি অপ্রকাশিত পত্র (১৯৩৯) এবং নেতাজির হালিশহরে অবস্থানকালে ব্যবহৃত পোশাক ও অন্যান্য স্মৃতি বাহিত দ্রব্যাদি।
নেতাজির ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি আইএনএ র(১৯৪৩-৪৪) মেডিকেল অফিসার ক্যাপ্টেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমূখ ব্যক্তিবর্গের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও হালিশহরবাসির গৌরবময় রূপকথার নায়ক নায়িকাদের পরিচিতি এই সংগ্রহশালার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
কলকাতা পুলিশ মিউজিয়ামের কর্তৃপক্ষ থেকে সংগৃহীত এবং আই বি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে রক্ষিত বিপিনবিহারীর কার্যকলাপ সম্পর্কে গোয়েন্দা ও পুলিশ রিপোর্ট সংগ্রহশালার সম্পদ। ১৯১৪ সালের ছাব্বিশে আগস্ট রডা কোম্পানির রোমহর্ষক অস্ত্র লুণ্ঠন এর সময় বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী কর্তৃক ব্যবহৃত পিস্তলটি পুলিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। হালিশহর মিউজিয়ামে রাখা আছে এই পিস্তলটির আলোকচিত্র ও বিপিনবিহারীর আবক্ষ মূর্তি।
পুরসভার এই সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে চৈতন্য ডোবার মঠাধ্যক্ষ প্রয়াত কিশোরী দাস বাবাজির কাছ থেকে সংগৃহীত শ্রীচৈতন্যের সমকালের প্রাচীন পুথি ও শ্রীচৈতন্য কর্তৃক শ্রীবাস পন্ডিত এর কাছে অর্পণ করা শালগ্রাম শিলার রেপ্লিকা এবং প্রাচীন ও বর্তমান চৈতন্য ডোবার আলোকচিত্র। রাখা আছে শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর কাছে নিমাই পণ্ডিতের দীক্ষা গ্রহণের মডেল। আছে এরূপ আরো অসংখ্য মূল্যবান সামগ্রী।
সংগ্রহশালার প্রবেশদ্বার নির্মিত হয়েছে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে হালিশহর বারেন্দ্র গলিতে টেরাকোটার শিব মন্দির গুলির প্রবেশদ্বারের অনুকরনে। সংগ্রহশালার বিশেষ আকর্ষণ গঙ্গা বক্ষ থেকে দৃশ্যমান হালিশহরের বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থানের একটি ডায়োনামা সংগ্রহশালার প্রবেশ দ্বার এর পাশেই রাখা হয়েছে। এই শৈলীটি সৃষ্টি করেছেন প্রখ্যাত শিল্পী শ্রী তাপস মিত্র। সংগ্রহশালায় অঙ্গসজ্জার রূপকার শ্রী গোপীদে সরকার ও ম্যুরাল বা মডেল গুলি নির্মাণ করেন কৃষ্ণনগরের প্রখ্যাত শিল্পী শম্ভু পালের পুত্র শ্রী শশাঙ্ক পাল।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বর্তমানে ওই সংগ্রহশালাটির রক্ষণাবেক্ষণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অসাধারণ শিল্পকর্ম ডায়োনামাটি নষ্ট হওয়ার পথে।
৫) কেন্দ্রীয় সরকারের NGRBA(National Ganga River Basin Authority) প্রকল্পে পৌরসভাকে হালিশহর শ্মশান ঘাটে দ্বিতীয় বৈদ্যুতিক চুল্লির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ওই বোর্ডের আমলেই এই চুল্লির পরিকাঠামোগত কাজ এবং ট্রান্সফর্মার বসানো হয়, শুধুমাত্র বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার কাজটি বাকি থাকে। পৌরবোর্ড কে বল পূর্বক অপসারণের পর বাকি কাজটি সমাধা হয় এবং পরবর্তীকালে বর্তমান বিধায়ক এটির উদ্বোধন করেন।
৬) LED(local economic development) এর তহবিল থেকে পৌরসভা সংলগ্ন জায়গায় State Bank of India র এটিএম, দিবা রাত্র বিক্রির জন্য ঔষধের দোকান স্বনির্ভর যুবকদের জন্য বেশ কয়েকটি দোকান ঘর তৈরীর পর ওই তহবিলে পৌরসভার পক্ষ থেকে আরো অর্থ দিয়ে গঙ্গাতীরের মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশে মিউনিসিপাল টুরিস্ট লজ ও পিকনিক গার্ডেন নির্মাণ করা হয়।
৭)NGRBA প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থানুকুল্যে হালিশহরের ভূগর্ভস্থ নিকাশি প্রকল্পে 276 কোটি টাকা অনুমোদন এসেছিল বিগত বামপন্থী বোর্ডের আমলে 2013 সালের নভেম্বর মাসে। এর প্রাক্কালে বিশ্বব্যাংকের একজন পুরুষ ও অপরজন মহিলা প্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় সরকারের দুজন আধিকারিক কে পৌর প্রধান ও সিআইসি সদস্যদের নিয়ে পৌরসভার গেস্ট হাউসে একটি বৈঠক করেন। ওই সভাতেই প্রকল্পটি চূড়ান্ত হয়। অতঃপর দিল্লির একটি সংস্থাI IP Global Cell কে দিয়ে DPR(detailed project report) তৈরি করা হয় এবং ডি পি আর টি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। শর্ত দেওয়া হয় ২০১৭ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করে পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করা হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় পরবর্তী বোর্ড ২০১৭ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু করে, প্রকল্পটির কাজ অর্ধ সমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। সাতটিSewage Treatment Plant তৈরির প্রস্তাব ছিল, সেগুলির কি অবস্থা আমার জানা নেই। কবে এই প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে তাও জানিনা।
৮) হালিশহরের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল অত্যন্ত করুণ একথা হালিশহরের প্রতিটি পৌর নাগরিক উপলব্ধি করেন। বামপন্থী বোর্ডের আমলে নাগরিকদের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত সুলভে এক্সরে, ইউএসজি, থাইরয়েড সমেত সমস্ত রকম প্যাথলজিক্যাল ও রক্তের যাবতীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বলা ভালো বৃটেনের ডি আর ডি এ প্রকল্পে নগর উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু অর্থ মঞ্জুর করা হয়। স্বাস্থ্য প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থ হালিশহর পৌরসভা পুরোটাই ব্যয় করতে সমর্থ হয়। বহু পৌরসভায় কিন্তু এই বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। সুতরাং ডি আর ডি এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার মুখেও বহু অর্থ উদ্বৃত্ত ছিল। হালিশহর পৌর বোর্ডের অনুরোধে SUDA(state urban development authority) র বদান্যতায় হালিশহর পৌরসভার জন্য বেশ কয়েক লক্ষ টাকা মঞ্জুরীকৃত হয়। এবং ওই অর্থে পৌরসভা তার রোগ নির্ণয়কারী বিভাগকে অনেকটাই আধুনিক পর্যা‌য়ে উন্নত করে ।
ultrasonography-echocardiographyর জন্য উন্নত মানের যন্ত্র। হরমোন অ্যাসেসমেন্টের যন্ত্র, লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে উন্নত মানের ডেন্টিস্ট চেয়ার ইত্যাদি ক্রয় করা হয়। সমস্ত রকম পরীক্ষার খরচ ছিল অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক কম। হূদরোগ অস্থি সংক্রান্ত রোগ নারী ও শিশু চিকিৎসা চক্ষু দন্ত ইএনটি মেডিসিন প্রভৃতি সমস্ত বিভাগের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্বারা নামমাত্র অর্থে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ৫০ টাকায় একমাস চিকিৎসকের কাছে দেখানো যেত সপ্তাহে দুই দিনের জন্য।সুডার সমপরিমাণ অর্থ চিকিৎসকদের জন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা হয়েছিল যদিও উক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকদের জন্য তা ছিল অকিঞ্চিৎকর। যেহেতু হালিশহরে হাসপাতালে চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই সুতরাং হাসপাতাল ও বিভিন্ন রকম অপারেশনের জন্য অপারেশন থিয়েটার, সার্জেন এর ঘর, নার্সের ঘর, রোগীর নিরীক্ষণ ঘর এবং সাথে সাথে দুইটি ওয়ার্ড, পুরুষ ও স্ত্রী বিভাগের জন্য পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। বামপন্থী বোর্ড আর দুমাস সময় পেলে হাসপাতালটি চালু করা সম্ভব হত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাসপাতাল তো চালু হয়নি উপরন্তু অপারেশন টেবিল, যাবতীয় সরঞ্জাম সবকিছু অব্যবহার্য হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের সুবিধা না থাকায় সমস্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাই পৌরসভায় আসা বন্ধ করেছেন। প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিও
প্রায় বন্ধের মুখে।
৯) হালিশহরে খেলাধুলার উন্নতির জন্য বামপন্থী বোর্ড প্রচেষ্টা শুরু করে এবং পৌরসভার 23 টি ওয়ার্ডের মধ্যে অনূর্ধ্ব ১৬ বৎসর আন্ত ওয়ার্ড ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ।বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে এই টুর্নামেন্টে প্রায় সাড়ে চারশ অল্প বয়সী ফুটবলার অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী ফুটবলারদের মধ্য থেকে 50 জনকে বাছাই করে কলকাতার এ ডিভিশন কোচদের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। প্রত্যেক ফুটবলারের জন্য একটি বল, ট্রাকসুট, ফুটবল বুট এবং অন্যান্য সরঞ্জাম পৌরসভার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। প্রতিদিন প্রশিক্ষণ শেষে টিফিনের ও বন্দোবস্ত করা হয়। দু’বছর অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা “এ”ডিভিশনের হালিশহরের প্রখ্যাত ফুটবলার শ্রী দীপক দাসের নেতৃত্বে এবং অন্যান্য কোচেদের সুযোগ্য পরিচালনায় প্রশিক্ষণ পর্ব চলতে থাকে। শাসক রাজনৈতিক দলের ঝটিকা বাহিনী হালিশহর পৌরসভার খেলাধুলার উন্নতি উদ্যোগকেও আক্রমণের মাধ্যমে বানচাল করতে ছাড়েনি ওদের বাহিনী কোচদের ওপর নৃশংস দৈহিক আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত খেলার সরঞ্জাম লুট করে কোচিং ক্যাম্প ও প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দিল। এছাড়াও পৌরসভা কর্তৃক প্রতি বৎসর নিয়মিত বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অ্যাথলেটদের উৎসাহ দেওয়ার‍ও প্রচেষ্টা চলেছে। বর্তমানে তার ইতি টানা হয়েছে।
১১) হালিশহর পৌরসভার অন্তর্গত বিদ্যালয় গুলি থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কৃত করা হতো। সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ছাত্র বা ছাত্রী কে তারপরের পাঠক্রমের ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।
১২) এছাড়া গান, আবৃত্তি, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল
১৩)। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে পার্ক তৈরি করার সিদ্ধান্ত‌ও বোর্ড সভায় গ্রহণ করা হয় এবং এবং অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু অধিকাংশ ওয়ার্ড‌‌ই এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে পারেনি সময়ের অভাবে।
১৪)। হালিশহরে বসবাসকারী বিখ্যাত লেখক আনন্দ বাগচীর প্রয়াণে লেখক এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এর উদ্দেশ্যে তার পরিবারকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয় বিশেষ করে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য।
১৫) হালিশহরের কবি লক্ষীনারায়ন পারুই এর কবিতার বই প্রকাশ করার দায়িত্ব নেয় হালিশহর পৌরসভা এবং হালিশহর লোক সংস্কৃতি সভাকক্ষে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেটি উদ্বোধন করা হয়। বিভিন্ন পুরস্কার প্রাপক হালিশহরের সু-সন্তান প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার পর লোক সংস্কৃতি মঞ্চ তাকে সম্বর্ধিত করা হয়। এছাড়াও সম্মানিত করা হয় প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক বর্তমানে প্রয়াতঃ রণেন মুখোপাধ্যায় মহাশয় কে।
হালিশহরের গর্ব এর ভূমিপুত্র সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী মহাসমারোহে ও সাড়ম্বরে হালিশহর পৌরসভার হেরিটেজ কমিটির তত্ত্বাবধানে পালিত হয়। এই উপলক্ষে একটি আকর্ষণীয় প্রদর্শনীর‌ও আয়োজন করা হয়।
১৬) এর পাশাপাশি দ্বিতীয় হলটিতে প্রদর্শনের জন্য হালিশহরের প্রাচীন এবং বর্তমান ইতিহাসকে অবলম্বন করে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা হয় এবং সেইমতো প্রখ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা এডিনবরা, লন্ডন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হন বিশেষ করে রবি ঠাকুরের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র “সেই সময়”নির্মাণের জন্য। তথ্যচিত্রটি লন্ডন, এডিনবরা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরFilm Study বিষয়ে পাঠক্রমের ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া নজরুল বিষয়ক বিবেকানন্দ সম্পর্কে এইরকম আরো বহু তথ্যচিত্রের স্রষ্টা তিনি। নজরূল বিষয়ক তথ্যচিত্রটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পায় ও ছবিটি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। এইরকম একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হালিশহরের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
সুন্দর একটি গল্পের পরিসরে হালিশহরের ইতিহাস বিধৃত হয়। এই তথ্যচিত্রটিতে অভিনয় করেন প্রখ্যাত এবং সুপরিচিত অভিনেতা শ্রী দীপঙ্কর দে। তথ্যচিত্রটির নির্মাণ শেষ হয় এবং শুধুমাত্র এটির রিভিউ বাকি থাকে। এই অবস্থায় বামফ্রন্ট পরিচালিত বোর্ডিং পেশী শক্তির জোরে দখল নেওয়া হয়।
সংক্ষিপ্তভাবে এটি হলো হালিশহর উপনগরীর আখ্যান।
হালিশহরের পৌরবোর্ড অপসারিত হওয়ার পর বিগত বছরগুলোতে এই নগরীর কতটা উন্নয়ন হয়েছে সেই সম্পর্কে আমি কোন মন্তব্য করছি না। সেটি বিচারের ভার আমি হালিশহর বাসির উপর ন্যাস্ত করলাম।

************************************

হালিশহর উপনগরী—-একটি সমীক্ষা
ডঃ রবীন্দ্রনাথ মুখার্জি, প্রাক্তন পৌর প্রধান । হালিশহর পৌরসভা
ভূতত্ত্ববিদদের মতে২৫০০ বছর আগে বাংলার সম্পূর্ণ ব-দ্বীপ অঞ্চলটি অবস্থান করতো বঙ্গোপসাগরের তলায়। আর গঙ্গার মোহনা টি ছিল গৌড়ের কাছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে আমাদের হালিশহর সমেত সমগ্র উত্তর 24 পরগনার অবস্থান ছিল গভীর জলের তলায়। পরিব্রাজক ইবন বতুতার ১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দের বর্ণনা অনুযায়ী, It(Satgaon is a large city on the shore of Bay of Bengal) হালিশহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পূর্ব বাহিনী গঙ্গার পূর্ব পাড়ে রয়েছে ত্রিবেণী সঙ্গম। ত্রিবেণী সঙ্গম এখানে মুক্তবেণী অর্থাৎ গঙ্গা যমুনা ও সরস্বতীর বিচ্ছেদ স্থল। এলাহাবাদের ত্রিবেণী সঙ্গম যুক্তবেণী এখানে তিন নদী মিলিত হয়েছে। একদা এখানে যমুনা নদী পূর্ব বাহিনী হয়ে ইছামতীতে মিলিত হয়েছিল। বর্তমানে যমুনা নদী সম্পূর্ণভাবে মজে গিয়ে একটি বিলের আকারে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সরস্বতী নদী তো সম্পূর্ণ মজেগিযে একটি খাল হিসেবে টিকে আছে।বাগেরমোড় সংলগ্ন অঞ্চলে গঙ্গা ও যমুনার মধ্যে সংযোগকারী খালটি সংস্কার করেন আহমেদ বেগ যার মধ্য দিয়ে বাণিজ্যতরী গঙ্গা থেকে যমুনা হয়ে ইছামতি পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করত। বর্তমানে যে খালটি অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে বাগের খাল হিসেবে পরিচিত এবং যেটি উত্তর 24 পরগনা ও নদীয়ার সীমানা নির্ধারণ করছে। একাদশ শতাব্দীতে পাল বংশের রাজা কুমার পাল নদীতীরে একটি জাহাজ নির্মাণ কেন্দ্র বা পোতাশ্রয় নির্মাণের ফলে তার নাম ও পোতাশ্রয় এর জন্য শ্রমিকদের বাসস্থান বা হট্য এর সমন্বয়ে অঞ্চল টির নাম হয় কুমারহট্য। সেই সময় থেকেই শুরু অধুনা হালিশহরের গরিমার ইতিহাস। প্রাচীন সপ্তগ্রাম এর সভ্যতা সংস্কৃতি, ব্যবসা বাণিজ্য এই জনপদকে সমৃদ্ধ করেছিল
শ্রীচৈতন্যের দীক্ষাগুরু শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরী, শ্রীচৈতন্য পার্ষদ শ্রীবাস পন্ডিতের আবাসস্থল ছিল সেকালের কুমারহট্ট। শিক্ষা-সংস্কৃতি, পাণ্ডিত্য গৌরবের অগ্রদূত হিসেবে কুমারহট্ট সম্মানিত হয়েছিল।
সেন বংশের মহারাজ বিজয় সেন বঙ্গদেশ অধিকারের প্রথম পর্বে বঙ্গদেশের রাজধানী হিসেবে বিজয়নগর প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান বিজপুর হলো-প্রাচীন বিজয়নগর।
শেরশাহ দিল্লি অধিকার করলে কাজী ফজলতকে তিনি ফৌজদার পদে নিয়োগ করেন। জমি জরিপ কালে ভাগীরথীর পূর্বপ্রান্তের এই অংশটি কে একটি পরগনায় রূপান্তরিত করেন যার নাম হাবেলী শহর পরগনা। এই পরগনার অন্যতম বর্ধিষ্ণু অঞ্চল ছিল হাবেলি শহর। হবেলি শহরের অপভ্রংশ হল বর্তমান হালিশহর। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলমান শাসনকালে অসংখ্য সুউচ্চ অট্টালিকা শোভিত বর্ধিষ্ণু জনপদ হিসেবে গড়ে ওঠে বাগের মোড় ও মল্লিক বাগ সন্নিহিত অঞ্চল। এটি ছিল সাবর্ণ চৌধুরীদের আদি বাসভূমি। সম্রাট জাহাঙ্গীর (১৬০৫-১৬২৭ খ্রিষ্টাব্দ) সাবর্ণ বংশীয় লক্ষীকান্ত রায়চৌধুরী কে সাতগাঁও সরকারের অধীনে যে পরগনা গুলির অধিকার দেন তারমধ্যে সেদিনের হাবেলী শহর পরগনা ছিল অন্যতম। সাবর্ণ চৌধুরীদের আদি বাসভূমি হালিশহরেই তৈরি হয়েছিল ইংরেজদের কাছে কলকাতা হস্তান্তরের খসড়া দলিল।
সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন, রানী রাসমণি, ব্রিটিশ সিংহের ঘুম কেড়ে নেওয়া বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলি, নেতাজির একান্ত সচিব সুশীল কুমার ঘোষ, নেতাজির সহযোগী আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম সিপাহী বিদ্রোহের অমর শহীদ সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের রাজীব লোচন রায়, বঙ্কিমজায়া রাজলক্ষ্মী দেবী নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আনন্দমঠ খ্যাত সন্তান দলের স্মৃতিবিজড়িত আমাদের পুণ্যভূমি হালিশহর।
এবার গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে প্রবন্ধের মূল বিষয়ে আসা যাক। বর্তমান প্রবন্ধের মুন প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বিগত ১০ বছরের হালিশহর পৌরসভার বস্তুনিষ্ঠ পর্যালোচনা।
নৈহাটি পৌরসভা আমাদের দেশের অন্যতম প্রাচীন পৌরসভা। এই পৌরসভাটি স্থাপিত হয়েছিল ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে। বহু মনীষী ও উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বের বাসভূমি ছিল নৈহাটি যথা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ব্যারিস্টার ও অনুশীলন সমিতির প্রতিষ্ঠাতা প্রমথনাথ মিত্র, ইতিহাসবিদ ও ভাষাবিদ মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, কোয়ান্টাম রসায়নবিদ এবং বহু বিশ্লেষের ক্লাস্টার তত্ত্বের প্রবক্তা দেবাশিস মুখোপাধ্যায়, শিল্পী চিত্রা প্রসাদ ভট্টাচার্য, সমাজ সংস্কারক কেশব চন্দ্র সেন, ক্রিমিনোলজিস্ট পঞ্চানন ঘোষাল, রাজস্থানের জয়পুরের প্রধান স্থপতি এবং নগর পরিকল্পনাবিদ বিদ্যাধর ভট্টাচার্য, বিখ্যাত ঔপন্যাসিক সমরেশ বসু, বিখ্যাত গায়ক শ্যামল মিত্র প্রমুখ।
1901 সালে আদমশুমারি অনুযায়ী নৈহাটি পৌরসভা অঞ্চলের জনসংখ্যা ছিল ২৩৭৫৩। হালিশহর ও কাঁচরাপাড়া অঞ্চল ছিল নৈহাটি পুরসভার অন্তর্ভুক্ত। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী নৈহাটি পৌরসভার জনসংখ্যা ২১৭৯০০। একদা নৈহাটি পৌরসভার পৌর প্রধানের আসন অলংকৃত করেছিলেন বন্দেমাতরম এর উদগাতা সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।
পরবর্তীকালে ১৯০০ সাল নাগাদ দাবি ওঠে হালিশহরে পৃথক পৌরসভা গঠন করতে হবে। নৈহাটি পৌরসভার পক্ষে এত বৃহৎ অঞ্চলের সঠিকভাবে পরিষেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। কর্নেল কেপি গুপ্ত, হালিশহর উপনগরীর রূপকার, 24 পরগনার জেলাশাসক মিস্টার এ্য‌লেনের সঙ্গে দেখা করে এই প্রস্তাব দেন। জেলাশাসকের পরামর্শমতো ১৯০১ সালের ২৬শে জানুয়ারি হালিশহর স্কুলে জনসভার আয়োজন করা হয়। হালিশহর ও বিজপুর নিয়ে একটি পৃথক পৌরসভা গঠনের প্রস্তাব নিয়ে তা জেলাশাসক ও নৈহাটি পুরসভার পুরপ্রধানের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পৌরসভার পৌরপ্রধান মিস্টার জর্জ রবার্টসন সহ আরো তিনজন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেও বাকি ৮ জন কমিশনার প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেন। হালিশহর গুড উইল ফ্রেটারনিটি এই সিদ্ধান্তে হতাশ না হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। বাংলাদেশের মিউনিসিপাল সংক্রান্ত ১৮৮৪ সালে বঙ্গীয় ৩ আইন এর ৯ ধারায় (সি) ও বি উপধারার বিধান অনুযায়ী লেফটেন্যান্ট গভর্নর সাহেবের অভিপ্রায় ঘোষণা করিয়া ১৯০২ সালের ২৪শে সেপ্টেম্বর একটি বিজ্ঞপ্তি (নং১৯৫৭ টি-এম) উক্ত সালের পয়লা অক্টোবর তারিখের কলকাতা গেজেট এর প্রথম খন্ডের “বি”অংশের ১৮৮ পৃষ্ঠায় প্রকাশ করা হয়। নৈহাটি পৌরসভার কমিশনারদের এক সভায় ওই বিজ্ঞপ্তি মোতাবেক হালিশহর পৌরসভার সীমানা সম্পর্কে সুপারিশ করা হয় এবং ওই সীমানা অনুযায়ী নৈহাটি পৌরসভা হইতে ৩,৪ও ৫ নং ওয়ার্ড গুলি লইয়া দ্বিতীয় পৌরসভা গঠনের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। “ওই দুইটি পৌরসভা যথাক্রমে নৈহাটি পৌরসভা ও হালিশহর পৌরসভা নামে খ্যাত হইবে।” উক্ত সুপারিশের ভিত্তিতে লেফটেন্যান্ট গভর্নর সাহেব হালিশহর পৌরসভার সীমানা সম্পর্কিত সুপারিশ অনুমোদন করেন।(সূত্র-মধুসূদন বন্দোপাধ্যায় রচিতঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে পৌর ব্যবস্থার ক্রমবিকাশ : সুবে বাংলা; মার্চ ১৯১২ সাল পর্যন্ত।)
তখন কাঁচরাপাড়া অঞ্চল‌ও ছিল হালিশহর পৌরসভার অন্তর্গত। পরবর্তীকালে কাঁচরাপাড়া পৌরসভা আলাদাভাবে গঠিত হয়।
এবার আসা যাক রাজ্যে তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার প্রাক্কালে হালিশহর পৌরসভার পৌর পরিচালন ব্যবস্থা। ২০১০ সালে বামফ্রন্ট সরকার থাকাকালীন কিছু পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তার মধ্যে অন্যতম হালিশহর পৌরসভা। উক্ত নির্বাচনে জনতার রায়ে বামপন্থীরা বিপুলভাবে জয় যুক্ত হয়ে পৌরবোর্ড গঠন করে। বর্তমান লেখক ওই পৌরসভায় পৌর প্রধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। তৎকালীন বিরাজমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পৌরসভার কাজ শুরু হয়। পৌর বোর্ডের প্রথম সভাতেই তৃণমূলের কাউন্সিলররা বিশৃংখল পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। সভাকক্ষের বাইরে তৃণমূলী বহিরাগতরা জমায়েত হন। ২০১১ সালে পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এই অত্যাচার চরমে ওঠে। চারিদিকে সন্ত্রাসের পরিস্থিতি। পশু শক্তির জোরে বামপন্থী পার্টির কর্মীদের উপর নৃশংস আক্রমণ চালিয়ে বামপন্থীদের বেশিরভাগ অফিস দখল করে নেওয়া হয় এমনকি কাঁচরাপাড়া ঐতিহ্যপূর্ণ কংগ্রেস ভবন‍ও এই দখলের রাজনীতি থেকে রেহাই পায়না।জনগণের দ্বারা নির্বাচিত বামপন্থীদের দ্বারা পরিচালিত হালিশহর পৌরসভার প্রতিনিয়ত সন্ত্রাস, কর্মচারীদের ওপর দৈহিক আক্রমণ, মূল্যবান যন্ত্রাদি ভাঙচুর করা, গুরুত্বপূর্ণ নথি নষ্ট করা, পৌর প্রধানের ঘরে প্রতিদিন দলবদ্ধভাবে প্রবেশ করে কুৎসিত গালিগালাজ চলতেই থাকে। প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের ক্ষেত্রে টেন্ডারপত্র বিক্রি করার সময় তৃণমূল ছাড়া অন্যান্য কন্ট্রাকটারদের বলপূর্বক টেন্ডারপত্র ক্রয় বাধা দান ও দৈহিক নির্যাতন এসমস্ত ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
একদিন পৌর বোর্ডের মাসান্তে রুটিন বৈঠকের সময় তৃণমূলের বাহিনী পৌরসভার গেটে জমায়েত হযে বৈঠকে আগত বামপন্থী কাউন্সিলরদের বৈঠকে যেতে বাধা দান ও দৈহিক নিপীড়ন চালায়। তার আগে পৌর প্রধান কে পৌরসভার মধ্যে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয় এবং তিনিও দৈহিকভাবে আক্রান্ত হন ও পা দিয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। কিন্তু পৌর প্রধান সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করে অফিসে প্রবেশ করেন পৌরসভার মেডিক্যাল অফিসার তাকে প্রাথমিক শুশ্রূষা করেন ও ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বেধে দেন। যথারীতি বিজপুর পুলিশ স্টেশনে ফোন করা হয়। একদল পুলিশ অল্প সময়ে পরে পৌরসভায় হাজির হন কিন্তু তারা কোনরূপ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দর্শক হিসেবে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকেন যদিও তখনো পর্যন্ত বামপন্থী কাউন্সিলরদের ওপর দৈহিক আক্রমণ চলছিল। থানার আইসির কাছে পৌর প্রধান এর পক্ষ থেকে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললে আইসি অদ্ভুত এক উত্তর দেন। তিনি বলেন আগে থেকে জানানো হয়নি কেন? পৌর প্রধান বলেন এটি পুরো বোর্ডের মাসান্তে রুটিন সভা। এই সভাকে কেন্দ্র করে আজকে হঠাৎ এই ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে তা কারো জানার কথা নয় কাজেই আগে থেকে পুলিশে জানানোর প্রশ্নটিই অবান্তর। পৌর প্রধান তাকে জিজ্ঞাসা করেন কোন বাড়িতে ডাকাতি হলে আপনি কি গৃহকর্তাকে বলবেন যে আজকে আপনার বাড়িতে ডাকাতি হবে সেটি আগে থেকে থানায় জানাননি কেন?
যাই হোক এই প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেই বামপন্থী বোর্ড হালিশহরের উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে যান। ২০১০ সালের জুন মাসে হালিশহর পৌরসভার বামপন্থী বোর্ড গঠনের পর নাগরিক পরিষেবা শিক্ষা স্বাস্থ্য সংস্কৃতি ও খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় অগ্রগতি ঘটায়
১) প্রথমেই পৌরবোর্ড যে কাজটি করতে পেরেছিল তা হল গঙ্গার তীরে 17 টি ঘাটের উন্নয়ন। Riverfront Development প্রকল্পে পৌরসভা তৎকালীন কেন্দ্রে র ইউ পি এ সরকারের কাছ থেকে 15 কোটি টাকা র অনুমোদন আদায় করে। মজার বিষয় হলো প্রকল্পের কাজ চলাকালীন গঙ্গার ঘাট এবং অন্যত্র “গঙ্গার ঘাট উন্নয়নের জন্য বিধায়ক কে অভিনন্দন”এই শিরোনামে অনেকগুলি ফেস্টুন টাঙানো হয়ে যায় যদিও এই প্রকল্পের সম্পর্কে বিধায়কের কোন কিছুই জানা ছিল না এবং এই প্রকল্পটি অনুমোদনের ক্ষেত্রে তার কোনো ভূমিকাই ছিল না
২)শত বাঁধাবিপত্তি সত্ত্বেও হালিশহর পৌরসভার একক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগে কেন্দ্রীয় সরকারের বি এস ইউ পি প্রকল্পে ৪৯৪৫টি বাসগৃহ ও আনুষঙ্গিক পরিকাঠামো যথা কংক্রিট ও পিচের রাস্তা, পাইপলাইন, নর্দমা, ল্যাম্পপোস্ট ও কমিউনিটি সেন্টারের অনুমোদন পাওয়া যায়। মাত্র এক বছরে নজিরবিহীনভাবে 125 কোটি টাকা মঞ্জুর হয়। পরবর্তীকালে আরো 54 কোটি টাকার অনুমোদন পাওয়া যায়। সরকারি উচ্চপদস্থ আমলার উপর নির্ভর না করে পৌর প্রধান স্বয়ং দিল্লিতে নগর উন্নয়ন মন্ত্রকে Central sanctioning and monitoring committee(CSMC)র সভায় উপস্থিত থেকে পৌরসভার অন্তর্গত এলাকায় বাসগৃহ নির্মাণের উপযোগিতা সম্পর্কে PowerPoint projection এর মাধ্যমে তুলে ধরে। এর কারণ হালিশহরের উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা পৌরবোর্ড‍ই এলাকার সমস্যা গুলি সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম। একাধিকবার দিল্লিতে পৌরবোর্ড কে এই কমিটির সম্মুখীন হতে হয়। প্রতিবারই কমিটির সদস্যগণ পৌর প্রধানের deliberationএ সন্তুষ্ট হন এবং যথারীতি পৌর বোর্ডের আবেদনকে স্বীকৃতি দিয়ে অর্থ মঞ্জুর করেন। তিনটি পর্যায়ে ৪৯৪৫টি বাসগৃহের জন্য প্রায় ১৭৫ কোটি টাকা অনুমোদিত হয়।
৩) পৌর ভবনের বিপরীতে গঙ্গা তীরবর্তী স্থানটি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ১৯৩৮ সালে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু উক্ত জায়গায় পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকাটি এবং পতাকা দণ্ডটি এখন পৌরসভার সংগ্রহশালায় সযত্নে সংরক্ষিত আছে। পরবর্তীকালে হুকুম চাঁদ জুট মিলের ম্যানেজার W.W.Craig ওই স্থানটিতে একটি পার্ক নির্মাণ করেন, তার নামানুসারেই ওই পার্কটির নাম হয় ক্রেগ পার্ক। বামপন্থী পৌর বোর্ডের সভায় সর্বসম্মতিক্রমে ওই পার্কটির নাম পরিবর্তন করে হালিশহরের সু-সন্তান প্রখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবী বিপিন বিহারী গাঙ্গুলির নামাঙ্কিত হয়। কেন্দ্রীয় সরকারের Ganga Action Plan(GAP) এ বাম বোর্ডের নিজস্ব তহবিল সমেত ১ কোটি ২৬লোক্ষ্ ৭০ হাজার টাকা ব্যয়ে বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী পার্কের সৌন্দর্যায়ন সম্পন্ন হয় কেন্দ্রের নগর উন্নয়ন দপ্তরের উচ্চ পদস্থ অফিসার এবং কেএমডিএর পূর্বতন চিফ ইঞ্জিনিয়ার ও কলকাতার মিলেনিয়াম পার্কের পরিকল্পনা কার শ্রী চূনার দের পরামর্শক্রমে। কিন্তু সেটি উদ্বোধনের ক্ষেত্রে নানা রকম বাধা বিপত্তি আসতে থাকে। পৌরবোর্ড কে বল পূর্বক অপসারণের পর বর্তমান বিধায়ক এটির উদ্বোধন করেন।
৪) পূর্বেই বলা হয়েছে সহস্রাধিক বছরের অসংখ্য স্মৃতিবিজড়িত কাহিনী হালিশহর কে দান করেছে অনন্য এক বৈশিষ্ট্য। আধুনিক মনন ভাবনায় সেই অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য এখন হালিশহর বাসির গৌরব। বৈষ্ণব শাক্ত ও শৈব ভাবনার মিশ্রণ প্রথম থেকেই এই পবিত্র ভূমি কে যেন মহাতীর্থে পরিণত করেছিল। একদা এখানেই অগ্রগতির হাত ধরে গড়ে উঠেছিল নগর, বন্দর ও সুভদ্র জনপদ। কুমারহট্যের বিদ্বৎ সমাজ ছিল বাংলার সর্বাপেক্ষা প্রাচীন জ্ঞান তীর্থ। কুমারহট্যের বিদ্যাপীঠ বয়সের হিসেবে ও খ্যাতিতে নবদ্বীপ ও ভাটপাড়ার চেয়েও সারস্বত চর্চার ক্ষেত্রে প্রাচীন কেন্দ্রভূমি হিসেবে চিহ্নিত। এই গৌরবগাথা কে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য বামপন্থী পৌরবোর্ড একটি সংগ্রহশালা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়।’পশ্চিমবঙ্গ পৌরসভার আইন ২০০০(সংশোধিত) মোতাবেক ২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পৌর বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হালিশহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কে নিয়ে গঠিত হয়—হেরিটেজ কনজারভেশন কমিটি। এই কমিটির তত্ত্বাবধানে প্রাচীন গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্যবাহী কুমার হট্য–হাবেলী শহর অধুনা হালিশহরের ইতিহাসকে সংরক্ষণ করে রাখার প্রয়াসে হালিশহর সংগ্রহশালা গড়ে তোলার মহতী কর্মযজ্ঞ আরম্ভ হয়। একে রূপ দেওয়ার কাজে এগিয়ে আসেন সমভাবনার শরিক কয়েকজন ইতিহাসবেত্তা এবং সুলেখক নাগরিক। সংগ্রহশালার নির্মাণ এবং সংগৃহীত নিদর্শনগুলি প্রদর্শনের জন্য নকশা প্রস্তুত করার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রখ্যাত প্রযুক্তিবিদ ও স্থপতি, পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি ঐতিহ্যপূর্ণ সংগ্রহশালার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত শ্রী অরুণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সংগ্রহশালার অন্যতম বিশেষজ্ঞ শ্রী গোপী দে সরকার। প্রস্তাবিত হয় তিনটি হলে বিভাজিত করে সংগ্রহশালাটি নির্মিত হবে। প্রথম হলটিতে সংরক্ষিত থাকবে সহস্রাধিক বছরের পুরনো ইতিহাস থেকে প্রাকস্বাধীনতা পর্ব পর্যন্ত। দ্বিতীয় হলটিতে থাকবে অডিও ভিসুয়াল তথ্য চিত্র প্রদর্শনীর ব্যবস্থা এবং তৃতীয় হলটিতে থাকবে স্বাধীনতা-উত্তর হালিশহরের গড়ে ওঠার ইতিহাস। স্থানীয় বিভিন্ন ব্যক্তি, সংস্থা, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, সাবর্ণ চৌধুরী পরিবার পরিষদ, সাধক কবি রামপ্রসাদ সেনের স্মৃতিবিজড়িত গরানহাটার জমিদার বাড়ি ইত্যাদির সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়।বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে সংগৃহীত হয় ১৮৭১ সালে প্রকাশিত জানকীনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত দুষ্প্রাপ্য হালিশহর পত্রিকার পূর্ণাঙ্গ প্রতিলিপি। এই সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে রানী রাসমণি ও তার কনিষ্ঠা কন্যা জগদম্বার স্বাক্ষরিত একাধিক স্মারক ও দলিলপত্র। এখানে রক্ষিত আছে রানী রাসমণি বিশেষজ্ঞ ডক্টর শিশুতোষ সামন্তর কাছথেকে সংগৃহীত রাসমনির জামাতা মথুরামোহন বিশ্বাসের বংশ তালিকা, আছে রাসমণি প্রতিষ্টিত বারাণসীতে অবস্থিত রানী রাসমনির ছত্র, ত্রৈলোকেশ্বর মন্দিরের নকশা, জানবাজারের প্রাসাদ এবং রাসমণি ব্যবহৃত বহু সামগ্রীর দুষ্প্রাপ্য আলোকচিত্র প্রভৃতি। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই হাবেলিশহর পরগনার আধিপত্য নেন শেরশাহের সেনাবাহিনীর অন্যতম সাবর্ণ চৌধুরী পরিবারের পঞ্চানন বা পাঁচু শক্তি খা। তার প্রপৌত্র লক্ষীকান্ত‌ই কলকাতার পত্তন করেন। হালিশহরের সাবর্ণ পরিবারের কোন একটি বাড়িতেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে মাত্র 13 শ’ টাকায় তিনটি গ্রাম হস্তান্তরের সনদটি প্রস্তুত হয়েছিল। এই খসড়া সনদের একটি অনুলিপি হালিশহর সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে। লক্ষীকান্তের প্রপৌত্র বিদ্যাধর রায়চৌধুরী সাড়ে 300 বছর আগে গঙ্গাস্নানকালে গঙ্গা জলে শিলাখণ্ডের সন্ধান পান এর থেকে নির্মিত তিনটি বিগ্রহ–বুড়োশিব শ্যামরায় ও কালিকা মূর্তি স্থাপন করা হয় তিনটি মন্দিরে। বর্তমান বকুলতলার কাছে মূর্তির মন্দিরটি অবস্থিত ছিল। একদা গঙ্গাবক্ষে ইংরেজ ও ওলন্দাজদের সংঘর্ষের সময় মন্দিরটি গোলার আঘাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। মূর্তিটি পরবর্তীকালে বর্তমান বলিদা ঘাটায় স্থানান্তরিত করা হয় যাহা বর্তমানে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির হিসেবে পরিচিত। অধুনা সেই মূর্তি টির‌ও সন্ধান নেই। পুরনো মন্দিরের।ধ্বংসাবশেষটির চিহ্ন এখন‌ও বর্তমান। এগুলির আলোকচিত্র আছে এই সংগ্রহশালায়।
হালিশহরের কুমোর পাড়ার সন্নিকটে অবস্থিত অতি প্রাচীন প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাগের মসজিদ। আওরঙ্গজেবের মাতুল শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবেদার থাকার সময়ে এই মসজিদটি তৈরি হয়েছিল। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারদের উপাসনার জন্য। নির্মাণকাল ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দ (১১০৭ হিজরী)।মসজিদ নির্মাণের সময় প্রোথিত শিলালিপিটি রাখা আছে এই সংগ্রহশালায়।
ভূগর্ভস্থে প্রোথিত কিছু শিলা মুর্তি হালিশহর কে বিশিষ্টতা প্রদান করেছে যেমন সেন বংশের আমলে নির্মিত এখনো ঝকঝকে ও অমলিন গণেশ মূর্তি যার দক্ষিণ হস্ত ভাঙ্গা। সাঁপুকুর খননকালে এটি এবং আরও তিনটি শিলা মুর্তি পাওয়া গিয়েছিল। মূর্তিটি অত্যন্ত অযত্নে এক জায়গায় পড়ে থাকলেও রাজনৈতিক প্রতিকূলতায় সেটি সংগ্রহশালায় রাখা যায়নি। এর আলোকচিত্রটি সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে। সেন বংশের আমলে নির্মিত একটি মন্দিরের দেবদেবীর মূর্তি খোদিত একটি দেউল এর অংশ সংগ্রহশালায় স্থান পেয়েছে।
এই সংগ্রহশালায় রক্ষিত আছে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কর্তৃক তার সচিব ও সহযাত্রী সুশীল কুমার ঘোষ এর কাছে লেখা একটি অপ্রকাশিত পত্র (১৯৩৯) এবং নেতাজির হালিশহরে অবস্থানকালে ব্যবহৃত পোশাক ও অন্যান্য স্মৃতি বাহিত দ্রব্যাদি।
নেতাজির ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি আইএনএ র(১৯৪৩-৪৪) মেডিকেল অফিসার ক্যাপ্টেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমূখ ব্যক্তিবর্গের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও হালিশহরবাসির গৌরবময় রূপকথার নায়ক নায়িকাদের পরিচিতি এই সংগ্রহশালার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।
কলকাতা পুলিশ মিউজিয়ামের কর্তৃপক্ষ থেকে সংগৃহীত এবং আই বি পুলিশ ডিপার্টমেন্টে রক্ষিত বিপিনবিহারীর কার্যকলাপ সম্পর্কে গোয়েন্দা ও পুলিশ রিপোর্ট সংগ্রহশালার সম্পদ। ১৯১৪ সালের ছাব্বিশে আগস্ট রডা কোম্পানির রোমহর্ষক অস্ত্র লুণ্ঠন এর সময় বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী কর্তৃক ব্যবহৃত পিস্তলটি পুলিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে। হালিশহর মিউজিয়ামে রাখা আছে এই পিস্তলটির আলোকচিত্র ও বিপিনবিহারীর আবক্ষ মূর্তি।
পুরসভার এই সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত আছে চৈতন্য ডোবার মঠাধ্যক্ষ প্রয়াত কিশোরী দাস বাবাজির কাছ থেকে সংগৃহীত শ্রীচৈতন্যের সমকালের প্রাচীন পুথি ও শ্রীচৈতন্য কর্তৃক শ্রীবাস পন্ডিত এর কাছে অর্পণ করা শালগ্রাম শিলার রেপ্লিকা এবং প্রাচীন ও বর্তমান চৈতন্য ডোবার আলোকচিত্র। রাখা আছে শ্রীপাদ ঈশ্বরপুরীর কাছে নিমাই পণ্ডিতের দীক্ষা গ্রহণের মডেল। আছে এরূপ আরো অসংখ্য মূল্যবান সামগ্রী।
সংগ্রহশালার প্রবেশদ্বার নির্মিত হয়েছে ১৭৪৩ খ্রিস্টাব্দে হালিশহর বারেন্দ্র গলিতে টেরাকোটার শিব মন্দির গুলির প্রবেশদ্বারের অনুকরনে। সংগ্রহশালার বিশেষ আকর্ষণ গঙ্গা বক্ষ থেকে দৃশ্যমান হালিশহরের বিভিন্ন আকর্ষণীয় স্থানের একটি ডায়োনামা সংগ্রহশালার প্রবেশ দ্বার এর পাশেই রাখা হয়েছে। এই শৈলীটি সৃষ্টি করেছেন প্রখ্যাত শিল্পী শ্রী তাপস মিত্র। সংগ্রহশালায় অঙ্গসজ্জার রূপকার শ্রী গোপীদে সরকার ও ম্যুরাল বা মডেল গুলি নির্মাণ করেন কৃষ্ণনগরের প্রখ্যাত শিল্পী শম্ভু পালের পুত্র শ্রী শশাঙ্ক পাল।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বর্তমানে ওই সংগ্রহশালাটির রক্ষণাবেক্ষণের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। অসাধারণ শিল্পকর্ম ডায়োনামাটি নষ্ট হওয়ার পথে।
৫) কেন্দ্রীয় সরকারের NGRBA(National Ganga River Basin Authority) প্রকল্পে পৌরসভাকে হালিশহর শ্মশান ঘাটে দ্বিতীয় বৈদ্যুতিক চুল্লির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা হয়। ওই বোর্ডের আমলেই এই চুল্লির পরিকাঠামোগত কাজ এবং ট্রান্সফর্মার বসানো হয়, শুধুমাত্র বৈদ্যুতিক সংযোগ দেওয়ার কাজটি বাকি থাকে। পৌরবোর্ড কে বল পূর্বক অপসারণের পর বাকি কাজটি সমাধা হয় এবং পরবর্তীকালে বর্তমান বিধায়ক এটির উদ্বোধন করেন।
৬) LED(local economic development) এর তহবিল থেকে পৌরসভা সংলগ্ন জায়গায় State Bank of India র এটিএম, দিবা রাত্র বিক্রির জন্য ঔষধের দোকান স্বনির্ভর যুবকদের জন্য বেশ কয়েকটি দোকান ঘর তৈরীর পর ওই তহবিলে পৌরসভার পক্ষ থেকে আরো অর্থ দিয়ে গঙ্গাতীরের মনোরম নৈসর্গিক পরিবেশে মিউনিসিপাল টুরিস্ট লজ ও পিকনিক গার্ডেন নির্মাণ করা হয়।
৭)NGRBA প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের অর্থানুকুল্যে হালিশহরের ভূগর্ভস্থ নিকাশি প্রকল্পে 276 কোটি টাকা অনুমোদন এসেছিল বিগত বামপন্থী বোর্ডের আমলে 2013 সালের নভেম্বর মাসে। এর প্রাক্কালে বিশ্বব্যাংকের একজন পুরুষ ও অপরজন মহিলা প্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় সরকারের দুজন আধিকারিক কে পৌর প্রধান ও সিআইসি সদস্যদের নিয়ে পৌরসভার গেস্ট হাউসে একটি বৈঠক করেন। ওই সভাতেই প্রকল্পটি চূড়ান্ত হয়। অতঃপর দিল্লির একটি সংস্থাI IP Global Cell কে দিয়ে DPR(detailed project report) তৈরি করা হয় এবং ডি পি আর টি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। শর্ত দেওয়া হয় ২০১৭ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করে পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করা হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় পরবর্তী বোর্ড ২০১৭ সালে প্রকল্পটির কাজ শুরু করে, প্রকল্পটির কাজ অর্ধ সমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে। সাতটিSewage Treatment Plant তৈরির প্রস্তাব ছিল, সেগুলির কি অবস্থা আমার জানা নেই। কবে এই প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে তাও জানিনা।
৮) হালিশহরের স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল অত্যন্ত করুণ একথা হালিশহরের প্রতিটি পৌর নাগরিক উপলব্ধি করেন। বামপন্থী বোর্ডের আমলে নাগরিকদের কাছে স্বাস্থ্য পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য অত্যন্ত সুলভে এক্সরে, ইউএসজি, থাইরয়েড সমেত সমস্ত রকম প্যাথলজিক্যাল ও রক্তের যাবতীয় পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে বলা ভালো বৃটেনের ডি আর ডি এ প্রকল্পে নগর উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু অর্থ মঞ্জুর করা হয়। স্বাস্থ্য প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ অর্থ হালিশহর পৌরসভা পুরোটাই ব্যয় করতে সমর্থ হয়। বহু পৌরসভায় কিন্তু এই বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারেনি। সুতরাং ডি আর ডি এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার মুখেও বহু অর্থ উদ্বৃত্ত ছিল। হালিশহর পৌর বোর্ডের অনুরোধে SUDA(state urban development authority) র বদান্যতায় হালিশহর পৌরসভার জন্য বেশ কয়েক লক্ষ টাকা মঞ্জুরীকৃত হয়। এবং ওই অর্থে পৌরসভা তার রোগ নির্ণয়কারী বিভাগকে অনেকটাই আধুনিক পর্যা‌য়ে উন্নত করে ।
ultrasonography-echocardiographyর জন্য উন্নত মানের যন্ত্র। হরমোন অ্যাসেসমেন্টের যন্ত্র, লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে উন্নত মানের ডেন্টিস্ট চেয়ার ইত্যাদি ক্রয় করা হয়। সমস্ত রকম পরীক্ষার খরচ ছিল অন্যান্য জায়গার তুলনায় অনেক কম। হূদরোগ অস্থি সংক্রান্ত রোগ নারী ও শিশু চিকিৎসা চক্ষু দন্ত ইএনটি মেডিসিন প্রভৃতি সমস্ত বিভাগের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দ্বারা নামমাত্র অর্থে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ৫০ টাকায় একমাস চিকিৎসকের কাছে দেখানো যেত সপ্তাহে দুই দিনের জন্য।সুডার সমপরিমাণ অর্থ চিকিৎসকদের জন্য পৌরসভার পক্ষ থেকে বরাদ্দ করা হয়েছিল যদিও উক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকদের জন্য তা ছিল অকিঞ্চিৎকর। যেহেতু হালিশহরে হাসপাতালে চিকিৎসার কোন সুযোগ নেই সুতরাং হাসপাতাল ও বিভিন্ন রকম অপারেশনের জন্য অপারেশন থিয়েটার, সার্জেন এর ঘর, নার্সের ঘর, রোগীর নিরীক্ষণ ঘর এবং সাথে সাথে দুইটি ওয়ার্ড, পুরুষ ও স্ত্রী বিভাগের জন্য পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছিল। বামপন্থী বোর্ড আর দুমাস সময় পেলে হাসপাতালটি চালু করা সম্ভব হত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হাসপাতাল তো চালু হয়নি উপরন্তু অপারেশন টেবিল, যাবতীয় সরঞ্জাম সবকিছু অব্যবহার্য হয়ে পড়েছে। হাসপাতালের সুবিধা না থাকায় সমস্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরাই পৌরসভায় আসা বন্ধ করেছেন। প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরিও
প্রায় বন্ধের মুখে।
৯) হালিশহরে খেলাধুলার উন্নতির জন্য বামপন্থী বোর্ড প্রচেষ্টা শুরু করে এবং পৌরসভার 23 টি ওয়ার্ডের মধ্যে অনূর্ধ্ব ১৬ বৎসর আন্ত ওয়ার্ড ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে ।বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে এই টুর্নামেন্টে প্রায় সাড়ে চারশ অল্প বয়সী ফুটবলার অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারী ফুটবলারদের মধ্য থেকে 50 জনকে বাছাই করে কলকাতার এ ডিভিশন কোচদের সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। প্রত্যেক ফুটবলারের জন্য একটি বল, ট্রাকসুট, ফুটবল বুট এবং অন্যান্য সরঞ্জাম পৌরসভার পক্ষ থেকে দেওয়া হয়। প্রতিদিন প্রশিক্ষণ শেষে টিফিনের ও বন্দোবস্ত করা হয়। দু’বছর অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা “এ”ডিভিশনের হালিশহরের প্রখ্যাত ফুটবলার শ্রী দীপক দাসের নেতৃত্বে এবং অন্যান্য কোচেদের সুযোগ্য পরিচালনায় প্রশিক্ষণ পর্ব চলতে থাকে। শাসক রাজনৈতিক দলের ঝটিকা বাহিনী হালিশহর পৌরসভার খেলাধুলার উন্নতি উদ্যোগকেও আক্রমণের মাধ্যমে বানচাল করতে ছাড়েনি ওদের বাহিনী কোচদের ওপর নৃশংস দৈহিক আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত খেলার সরঞ্জাম লুট করে কোচিং ক্যাম্প ও প্রতিযোগিতা বন্ধ করে দিল। এছাড়াও পৌরসভা কর্তৃক প্রতি বৎসর নিয়মিত বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতার মাধ্যমে অ্যাথলেটদের উৎসাহ দেওয়ার‍ও প্রচেষ্টা চলেছে। বর্তমানে তার ইতি টানা হয়েছে।
১১) হালিশহর পৌরসভার অন্তর্গত বিদ্যালয় গুলি থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার কৃতি ছাত্র-ছাত্রীদের পুরস্কৃত করা হতো। সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়া ছাত্র বা ছাত্রী কে তারপরের পাঠক্রমের ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল।
১২) এছাড়া গান, আবৃত্তি, বসে আঁকো প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে উৎসাহ দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল
১৩)। প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে পার্ক তৈরি করার সিদ্ধান্ত‌ও বোর্ড সভায় গ্রহণ করা হয় এবং এবং অর্থ বরাদ্দ হয়। কিন্তু অধিকাংশ ওয়ার্ড‌‌ই এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করতে পারেনি সময়ের অভাবে।
১৪)। হালিশহরে বসবাসকারী বিখ্যাত লেখক আনন্দ বাগচীর প্রয়াণে লেখক এর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এর উদ্দেশ্যে তার পরিবারকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয় বিশেষ করে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করার জন্য।
১৫) হালিশহরের কবি লক্ষীনারায়ন পারুই এর কবিতার বই প্রকাশ করার দায়িত্ব নেয় হালিশহর পৌরসভা এবং হালিশহর লোক সংস্কৃতি সভাকক্ষে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেটি উদ্বোধন করা হয়। বিভিন্ন পুরস্কার প্রাপক হালিশহরের সু-সন্তান প্রয়াত সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার পাওয়ার পর লোক সংস্কৃতি মঞ্চ তাকে সম্বর্ধিত করা হয়। এছাড়াও সম্মানিত করা হয় প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক বর্তমানে প্রয়াতঃ রণেন মুখোপাধ্যায় মহাশয় কে।
হালিশহরের গর্ব এর ভূমিপুত্র সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদক কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের দ্বিশত জন্মবার্ষিকী মহাসমারোহে ও সাড়ম্বরে হালিশহর পৌরসভার হেরিটেজ কমিটির তত্ত্বাবধানে পালিত হয়। এই উপলক্ষে একটি আকর্ষণীয় প্রদর্শনীর‌ও আয়োজন করা হয়।
১৬) এর পাশাপাশি দ্বিতীয় হলটিতে প্রদর্শনের জন্য হালিশহরের প্রাচীন এবং বর্তমান ইতিহাসকে অবলম্বন করে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা হয় এবং সেইমতো প্রখ্যাত তথ্যচিত্র নির্মাতা এডিনবরা, লন্ডন প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ প্রশংসিত এবং পুরস্কৃত হন বিশেষ করে রবি ঠাকুরের জীবন নিয়ে তথ্যচিত্র “সেই সময়”নির্মাণের জন্য। তথ্যচিত্রটি লন্ডন, এডিনবরা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়েরFilm Study বিষয়ে পাঠক্রমের ও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া নজরুল বিষয়ক বিবেকানন্দ সম্পর্কে এইরকম আরো বহু তথ্যচিত্রের স্রষ্টা তিনি। নজরূল বিষয়ক তথ্যচিত্রটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা পায় ও ছবিটি কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। এইরকম একজন অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হালিশহরের উপর তথ্যচিত্র নির্মাণে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
সুন্দর একটি গল্পের পরিসরে হালিশহরের ইতিহাস বিধৃত হয়। এই তথ্যচিত্রটিতে অভিনয় করেন প্রখ্যাত এবং সুপরিচিত অভিনেতা শ্রী দীপঙ্কর দে। তথ্যচিত্রটির নির্মাণ শেষ হয় এবং শুধুমাত্র এটির রিভিউ বাকি থাকে। এই অবস্থায় বামফ্রন্ট পরিচালিত বোর্ডিং পেশী শক্তির জোরে দখল নেওয়া হয়।
সংক্ষিপ্তভাবে এটি হলো হালিশহর উপনগরীর আখ্যান।
হালিশহরের পৌরবোর্ড অপসারিত হওয়ার পর বিগত বছরগুলোতে এই নগরীর কতটা উন্নয়ন হয়েছে সেই সম্পর্কে আমি কোন মন্তব্য করছি না। সেটি বিচারের ভার আমি হালিশহর বাসির উপর ন্যাস্ত করলাম।

Developed by