Breaking
11 Apr 2025, Fri

|| অবৈধ || তারকনাথ দত্ত

আমি মল্লিকা— মল্লিকা বোস। ছোট করে ‘মলি’।
আমি বিবাহিতা। বছর পাঁচেক হলো আশুতোষের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছে। না, লাভ ম্যারেজ নয়, অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ। দু’বাড়ির মাথারা মিলে দফায় দফায় বৈঠক করে, ঠিকুজিকুষ্ঠি মিলিয়ে তবে আমাদের বিয়ে হয়েছে। বিয়ের আগে আমি ‘মিত্র’ ছিলাম। বাবার টাইটেল মিত্র, তাই আমিও মল্লিকা মিত্র ছিলাম। আশুতোষরা বোস। কাজেই আর পাঁচজন বাঙালি মেয়ের মত বিয়ের পর রাতারাতি পরিচয় পালটে, ভোল পালটে, উপাধি-গোত্র পালটে এখন আমি মল্লিকা বোস।
আমার পতিদেবতাটি এমনিতে ভালই। স্কুলে পড়ায়। বিদ্যাবুদ্ধি ভাল। এখন আমাকে আর আগের মত করে চোখে হারায় না এটা যেমন ঠিক, আবার খুব একটা যে খারাপ ব্যবহারও করে তাও না। সেই টাইপের মানুষই না। সবকিছুর সাথে মানিয়ে গুছিয়ে চলার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ওর মধ্যে আছে। মনে যাই থাক, ওপর ওপর ‘সব ঠিক আছে’ এমন একটা ভাব দিনের পর দিন কী অসাধারণ দক্ষতার সাথে করে যেতে পারে, বলে বোঝানো যাবে না‌। এইজাতীয় মানুষগুলো আরো বেশি ভয়ংকর। মনে মনে জিলিপির প্যাঁচ কষতেই থাকবে, অথচ বাইরের কেউ ঘুণাক্ষরেও কিছু টের পাবে না।
প্রথমদিকের পাগলামীটা এখন আর নেই। থাকার কথাও না। পাঁচবছরের পুরনো বৌ, মানে বেশ পুরনোই‌। তবুও রাতের দিকে কখনও সখনও যখন ক্ষেপে ওঠে, তখন আর তালজ্ঞান বলে কিছু থাকে না। এই তো সেদিন রাতে আশুতোষের ভেতরের পুরুষটা দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে থাকার পর হঠাৎ করেই আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। বাঘের মত আমার উপর চড়াও হয়ে আঁচড়ে-কামড়ে সে কি পাশবিক উল্লাস! মনে হচ্ছিল, আজ আর আস্ত রাখবে না। জল ছাড়াই আমাকে আস্ত গিলে ফেলবে‌। আমি কিন্তু ওর এই জাতীয় পাগলামীতে মোটেও উত্তেজিত হচ্ছিলাম না। আমার তো রীতিমত বিরক্তই লাগছিল। মনে হচ্ছিল এক ধাক্কা মেরে ওকে খাট থেকে নীচে ফেলে দিই। নাইটল্যাম্পের স্বল্প আলোয় ওকে তখন ক্ষ্যাপা কুকুরের মতই দেখাচ্ছিল। কিন্তু ওই লম্ফঝম্পই সার। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার পতি দেবতাটির সমস্ত লম্ফঝম্প নিস্তেজ হয়ে এলো। আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। বাইরে যাবার জন্য উঠে বসতেই দেখি, পাশেই আশুতোষ চিৎ কেলিয়ে পড়ে আছে। সমস্ত লাফালাফি, সমস্ত দাপাদাপির বুদ্ধি শেষ। শত ডাকাডাকিতেও আর কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাবে না।
অসহ্য! অথচ এমনটা কিন্তু আগে ছিল না। বিয়ের পর প্রথম প্রথম বছরখানেক ওর মাত্রছাড়া ভালবাসার উৎপাতে আমি মাঝেমধ্যে অতিষ্ঠ হয়ে যেতাম। মিথ্যে বলব না, সবে নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে, স্বামীর এমন আদর-সোহাগ কার না ভাল লাগে! জোড়া বেঁধে কত জায়গায় আমরা বেড়াতে গেছি! অবশ্যই আমার শাশুড়ি মায়ের অনুমতি নিয়েই গেছি। ওর খামখেয়ালিপনায় নিজেকে মিশিয়ে দিতে চেয়েছি। হেসেছি, গেয়েছি, ঝরণার মত নেচেছি। জীবনটাকে তখন কত না সুন্দর, কত না উপভোগ্য মনে হয়েছে। আমাকে নিয়ে ওর পাগলামীটা সময় সময় যখন মাত্রা ছাড়াত, অসহ্য লাগলেও আমার দিক থেকে কিন্তু প্রশ্রয়ই ছিল। ছেলেরা এমন হয়। সৃষ্টিকর্তার তৈরী করা সবথেকে বোকা দু-পেয়ে জীবটির নামই বোধহয় পুরুষ। যতই ওরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভেবে আত্মশ্লাঘা বোধ করুক না কেন, আদতে মেয়েদের কাছে ওরা কত অসহায়। ভাবলেও করুণা হয়। আমরা ওদের জিতিয়ে দিই, তাই ওরা জিতে যায়। আমাদের মধ্যে আছে ত্যাগ আর সহনশীলতার এক আশ্চর্য ককটেল। সৃষ্টিকর্তার এও হয়তো এক অদ্ভুত ধরনের খামখেয়ালিপনা!
এসব ভেতরের কথা বাদ দিলে আশুতোষ মানুষটা এমনিতে খারাপ না। কিন্তু বড্ড মায়ের আঁচলধরা। মায়ের প্রতি ছেলের টান থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক, তাই না? কিন্তু তাই বলে মায়ের অনুমতি ছাড়া একপা’ও এগোবো না, এ কেমন কথা! মা’ও তেমনি, ছেলে ছেলে করে এমন আদিখ্যেতা করেন, জাস্ট অসহ্য মনে হয়। হলোই না হয়, একটা মাত্র ছেলে। দুনিয়াতে কোন মায়ের কি এমন ছেলে নেই? না সেইসব মায়েরা তাদের ছেলেদের ভালবাসে না? টান থাকা ভাল, টানটা অধিকারের সীমা ছাড়ালেই বিপত্তি।
আমি জানি আশুতোষের মনে একটা চাপা দুঃখ আছে। এটাকে অবশ্য দুঃখ না বলে না-পাওয়ার হতাশা থেকে আসা ক্ষোভ বলাই ভাল। সেই ক্ষোভ বা দুঃখ যাই বলি না কেন, সেটা এই কারণে, এখনও আমাদের কোন ইস্যু নেই৷ মানে আমাদের কোন বাচ্চাকাচ্চা এখনও পর্যন্ত হয়নি।
আশুতোষের জ্বালাটা যে বুঝি না, তা না। বুঝি, সব বুঝি। অথচ বুঝেও আমি নিরুপায়। হাত-পা বাঁধা।
আমিও চাই মা হতে। একটা ফুটফুটে বাচ্চা, কচিকচি দুটো হাত, সুন্দর সুন্দর জামা, খেলনা, আরো কত কী!
আমি আশুতোষের স্ত্রী। তারপর?
এইতো সেদিন আমার ননদ, পাশের পাড়াতেই থাকে। প্রেম করে বিয়ে করেছে। ছেলেটা— থুড়ি আমার শাশুড়ি মায়ের আদরের জামাই বাবাজী, বাড়িতে আসত পড়াতে। এই পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কিন্তু মুশকিলটা হলো, ওদিকে ছাত্রী আর মাস্টারমশাইয়ের সম্পর্কটা যে তলে তলে কখন মাখো মাখো পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, বাড়ির কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। আর আমার শাশুড়ি মা তিনি নাকি বুঝতেই পারেননি, মেয়ের প্রাইভেট মাস্টার জামাই হবার সব জোগাড়যন্ত্র নিঃশব্দে পাকা করে বসে আছে। বোঝ কাণ্ড! মেয়ে ডুবে ডুবে জল খাচ্ছে, ঘরের চারদেওয়ালের মধ্যে বসে প্রেমলীলা চালাচ্ছে, উনি নাকি কিচ্ছুটি টের পাননি! বিশ্বাস করতে হবে?
তো মেয়ে একদিন কলেজে যাবার নাম করে হাওয়া হয়ে গেল। খোঁজ খোঁজ, পরে জানা গেল, মেয়ে সেই প্রাইভেট মাস্টারের সঙ্গেই ভেগেছে।
আমার শ্বশুরমশাই তখনও জীবিত ছিলেন। তিনি তো একেবারে রেগে ফায়ার। ও-মেয়ের মুখ দর্শন করবেন না বলে দিলেন। ওনার নাকি একটাই ছেলে, মেয়ে-টেয়ে কোনদিনই ছিল না। বোঝ ঠ্যালা! দুম করে একটা কথা বলে দিলেই হলো? আর বললেই সবাই তা মেনে নেবে? মামাবাড়ির আবদার!
আসলে হয়েছে কী, প্রথম কথা বিয়েটা অসবর্ণ। অর্থাৎ ছেলে সমগোত্রীয় নয়, নীচু জাত। তার উপর কাজকাম বলতে বাড়ি বাড়ি বাড়ি ঘুরে মাস্টারি করা। স্টেটাস বলেও তো একটা কথা আছে না কী? মনে মনে মেয়ের জন্য যে অঙ্ক কষে রেখেছিলেন, মেয়ে তাতে একেবারে ডাহা ফেল। মানসম্মান কিছুই আর বাকি রাখল না। এখন গোবিন্দর চায়ের দোকানই বলো কিংবা পাড়ার বুড়োহাবড়াদের তাসের ঠেক, কোথাও মুখ বলে কিছু থাকল? এখন যদি রজতবাবুর মেয়ে কোন অজ্ঞাতকুলশীল ছেলের হাত ধরে কেটে পড়ে,পড়বেই বলছি না, যদি পড়ে, তখন বড় বড় মুখ করে রসিয়ে রসিয়ে লম্বা চওড়া বক্তৃতা করা যাবে? রজতবাবু তখন ছেড়ে দেবেন ভেবেছেন! উল্টে দু-চার কথা শুনিয়ে দেবেন না— “আরে রাখুন তো মশাই, আপনার মেয়েই বা কী এমন শোভন কাজটা করেছে শুনি? সেইতো প্রাইভেট মাস্টারের সাথে ভেগেছে। তাও যদি বুঝতাম কোন চাকরি-বাকরি করা ছেলের সাথে ভেগেছে—”
বলবেই। তখন মুখ লুকোনোর জায়গা থাকবে? অতএব মেয়ে ফেয়ে বলে কেউ নেই। ব্যস, ল্যাটা চুকে গেল। হাত ধুয়ে ফেললাম আর কী।
তা, আমার শ্বশুর মশাই ভদ্রলোকের নিন্দে করব না। তারপর কোনদিন দেখিনি যাকে। মানে আমার বিয়ের আগেই উনি ইহলোকের মায়া কাটিয়েছিলেন। শুনেছি ভদ্রলোক যতদিন বেঁচে ছিলেন, মেয়েকে এ-বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেঁসতে দেননি। সে শাশুড়ির রাতদিন মড়াকান্না সত্বেও না। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভদ্রলোকের তেজ ছিল অফুরন্ত।
কিন্তু ওই যে, মেয়ে অমন কাণ্ডখানা করার পর টেকেননি বেশিদিন। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই টসকে গেলেন।
আমি পরের বাড়ির মেয়ে, এসব আমার জানার কথা না। কেন না আমি বউ হয়ে এ-বাড়িতে এসে ওনাকে দেখিনি। তার আগেই খুলে নিয়েছিলেন। তাহলে আমি এতসব কথা জানলাম কী করে? না, আশুতোষ আমাকে কিছু বলেনি। নিজের বোনের কীর্তিকাহিনী ফলাও করে বৌয়ের কাছে বলার মত মানুষ সে না। বললে ছোট হয়ে যেতে হবে না! এমন রসালো গল্প জানার জন্য খুব একটা মেহনতের দরকার নেই। দুনিয়ায় গল্প বলার লোকের অভাব নেই। তেমনি কোন সোর্স অযাচিতভাবে আমাকে এ-বিষয়ে সমৃদ্ধ করে থাকবে।
এদিকে আমার শ্বশুর মশাই পটকাতেই মেয়ে-জামাইয়ের জন্য এ-বাড়ির দীর্ঘদিনের বন্ধ দরজাটা হাট করে খুলে গেছে। এখন প্রায় প্রায়ই আসে, ঘনঘন আসে। তা আসুক গে। মেয়ের বাপের বাড়ি, জামাইয়ের শ্বশুরবাড়ি। আসতেই পারে। আমি বলার কে? বলি না তো।
তো সেদিন হয়েছে কী, আমার ননদিনী আমাকে বলে বসল,”বউদি, অনেকদিন তো হলো, বাচ্চাকাচ্চা কবে নেবে? দাদা কী বলে?”
আমার ননদিনী আবার আমার শাশুড়ি মাতার কার্বনকপি। কথাবার্তার ধরনখানা একেবারে মা-মাসীদের মত। বোঝো, বাচ্চাকাচ্চা যেন দোকানে কিনতে পাওয়া যায়! ইচ্ছে হলো, আর ফট করে কিনে ফেললাম। ঝাট জ্বালানো কথাবার্তা শুনলে মাথা গরম হয়ে যায়। মনে হয়, আচ্ছা করে দু-চার কথা শুনিয়ে দেই। ভাবলেও বলি না। আমি পরের বাড়ির মেয়ে, কী বলতে কী বলব, শেষে এই নিয়ে আবার একপ্রস্থ নাটক হয়ে যাক আর কি। আমি অত বোকা নই। আমি এখন বুঝে গেছি, সংসারে টিকে থাকতে হলে অনেক কায়দা রপ্ত করতে হয়। কথা মেপে মেপে বলতে হয়। কখন কোন কথায় কার আঁতে ঘা লেগে যায় তার ঠিক আছে? তাই আমি হেসে বললাম,”এত উতলা হবার কী আছে, ঠাকুরঝি? আর কিছুদিন যাক, সবে তো পাঁচ বছর!”
তো আমার কথা শুনে চোখ কপালে তুলে আমার ননদটি বলল,” বল কী গো, বউদি? পাঁচটা বছর কি কম? এরমধ্যেই আমি তিলু আর বুলু’র মা হয়ে গেছি! নীলু তো পরে হলো।”
এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কথাই হয়ত বলতে পারতাম। বলতে পারতাম,”আমাকে বড় বড় কথা না শুনিয়ে, নিজের চরকায় তেল দাও। তোমার সংসার নিয়ে তুমি থাকো না বাপু! আবার আমাকে নিয়ে অযথা টানাটানি কেন? বাচ্চা হচ্ছে না, তার দায় কি আমার একার? তোমার দাদার নেই? আমি কি আর জানি না, কেন এতদিনেও একটা বাচ্চা হয়নি? সব জানি‌। ডঃ চ্যাটার্জীর কাছ থেকে সব জেনেছি। উনি তো আমায় বলেইছেন, দোষ আমার নয়। বাচ্চার মা হবার সমস্ত যোগ্যতাই আমার আছে। আমি ঠিকঠাকই আছি। তোমার দাদারই বাচ্চা জন্ম দেবার মুরোদ নেই৷ কোনদিনই ও-কম্মটি তার দ্বারা হবে না৷ জানি সবই, বলি না কিছু। এমনিতেই আমার শাশুড়ি মা জনে জনে বলে বেড়ান, তার অমন সুবোধ বালক ছেলেটা বউয়ের পাল্লায় পড়ে নাকি ভেড়া হয়ে গেছে।
আমার কপাল! তাই যদি হত, তাহলে কি আর আমার চিন্তা ছিল? না এত কথা বলতে হত? ছেলে যে এখনও মায়ের আঁচলের তলাতেই বাঁধা পড়ে আছে। নট নড়নচড়ন। হাগা-মোতা করতে গেলেও তার মায়ের পারমিশন লাগে। এমনিতেই প্রায় প্রত্যেকটা শাশুড়ির মত আমার শাশুড়ি-মা’র একটা বস্তাপচা ধারণা হলো, বিয়ের পর ছেলে পর হয়ে যায়। আর বিয়ের পর মেয়ে হয় আপন। যাক গে, মরুকগে, আমি ওসব নিয়ে খুব একটা ভাবি-টাবি না। ভাবতে আমার বয়েই গেছে। শুধু এটুকু জানি, আমি ঠিক আছি।
আমার শাশুড়ির পুজো-আচ্চার শেষ নেই। আজ বারের পুজো, তো কাল গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো। বারোমাসে তেরো পার্বণ লেগেই আছে। বলি, এরজন্য যাবতীয় খরচাপাতি আসে কোত্থেকে থেকে শুনি? সেই তো আমার পতিদেবতাটির পকেট কেটেই আসে! এ-নিয়ে আমি কি কিছু বলি? বলি না। জানি এই বয়সে এমন একট-ুআধটু ভক্তিরসে মাখামাখি হয়। তা হোক, তাতে তো বাঁধ সাধি না। বুঝি না আমাকে নিয়ে এদের এত সমস্যা কেন?
ইতিমধ্যে আমার শাশুড়ি-মা কোথা থেকে একখানা মন্ত্রপূত তাবিজ এনে আমার হাতে লটকে দিয়েছেন। কই, আমি তো কোন প্রতিবাদ করিনি! আমি ভাবি, আমার না হয় ওসবে ভক্তিশ্রদ্ধা নেই, তাই বলে অন্যের বিশ্বাসে আঘাতও দিতে চাই না। এসব করে কেউ যদি মনে শান্তি পায়, পাক। ক্ষতি কী?
তবুও যখন আমার শাশুড়ি-মা সবার কাছে আক্ষেপ করেন,”কত সাধ ছিল, নাতিপুতি নিয়ে শেষ জীবনটা আনন্দ করে কাটিয়ে দেব। কোথায় কী? সবই আমার কপাল!”
শুনলে গা জ্বলে যায়। মনে হয়, আচ্ছা করে যাহোক কড়া কথা দু’টো শুনিয়ে দেই। কিন্তু ওই যে, আমার স্বভাব— শুধু ভাবি, বলি না কিছুই। বললে কথায় কথা বাড়বে। বোবার শত্রু নেই। অতএব চুপ করে থাকাটাই বুদ্ধিমানের।
মেয়েবেলাতেই কিছু বলিনি। যখন দেখতাম, দাদার জন্য বাবা এনে দিত অটোমেটিক খেলনা রিভলবার, যুদ্ধজাহাজ, ট্যাঙ্ক আরো কত কী। দাদাকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন ছিল। মিথ্যে বলব না, দাদা সেটা ষোলোআনা পূরণও করেছে। বর্তমানে সেনাবাহিনীর উঁচু পদে আছে আমার দাদা।
আজ ভাবতে গিয়ে মনে হয়, সেই ছোট্টবেলাতেই বাবা আমাদের দু-ভাইবোনের জন্য আলাদা পথ নির্বাচন করে দিয়েছিল। আমাকে নিয়ে কোন উচ্চাশা তার সেদিনও ছিল না, আজও নেই।
মেয়ে মেয়েই হবে৷ সীমারেখা একটা ছিলই। মেয়েদের ভবিষ্যত জীবনটা যেন শিশুকালের সেই রান্নবাটি-বরবউ খেলার মধ্যে দিয়েই আঁকা হয়ে যায়। আমি বলব, সচেতনভাবেই এটা করা হয়। যাতে করে পরে এটা নিয়ে কথা শুনতে না হয়৷ সবটাই যেন সমাজের অলিখিত সিস্টেম। যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ আজ চাঁদে পৌঁছে গেল, সেখানে ঘূণেধরা সমাজটা যেন আজও সেই প্রাগৈতিহাসিক যুগের ধ্যানধারণাগুলোকে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। যুগ বদলেছে, কিন্তু সমাজটা যেন সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একেবারে নট নড়নচড়ন।

Advertisement

( ২ )

প্রতুল এ-বাড়িতে মাঝেমধ্যেই আসে । প্রতুল হলো, আমার শাশুড়ির লতায়পাতায় জড়ানো কোন তুতোভাইয়ের ছেলে। সম্পর্কে আমার দেওর। কী সব সমাজ সেবা টেবা করে বেড়ায়। একটা পলিটিক্যাল পার্টিরও নাকি অ্যাকটিভ মেম্বার। এ-চত্বরে নামডাক আছে বেশ। যদিও এসব নিয়ে বাবুর বিনয়ের শেষ নেই। বলে,”ওসব কিছু না বউদি, নিছকই সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে যৎসামান্য মানুষের কাজে় লাগি আর কী। সবটাই সোশ্যাল কমিটমেণ্ট বুঝলেন? টানটা ওখান থেকেই আসে়।”
ছোঁড়া কথা জানে খুব। আর জানবে নাই বা কেন? এসব লাইনে কথাই তো সব। আসলে কথা বলাটাও একটা আর্ট। শুধু বকবক করলেই তো আর কথা বলা হয় না।
তা মনে পড়লেই এ-বাড়িতে চলে আসে প্রতুল। আমার শাশুড়ি মায়ের হৃদয়খানা তখন তুতো ভাইয়ের ছেলের জন্য একেবারে বিগলিত হয়ে ওঠে। তো সেদিন হয়েছে কী, ভরদুপুরে প্রতুল এসে হাজির। আমি জেগে ছিলাম। আমার আবার দুপুরবেলায় পড়ে পড়ে ঘুমানোটা একেবারেই ধাতে সয় না। আশুতোষ পারে, ছুটির দিনটা ঘুমিয়েই কাটায়। আমার শাশুড়ি মা’ও তাই। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে বিছানায় একটু গড়াগড়ি না দিলে ওনার নাকি মাথা ধরে।
আমি বারান্দায় বসে সেদিনের খবরের কাগজখানা একটু নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। কিছুই কিন্তু পড়ছিলাম না। পেপার-টেপার পড়ার মত অত ধৈর্য আমার নেই। নেহাত সময় কাটানোর জন্য উলটেপালটে দেখা। প্রতুল আমাকে বসে থাকতে দেখে একগাল হেসে বলল,”কী বউদি, এখানে বসে? দাদা নিশ্চয়ই স্কুলে?
আমিও মুচকি হেসে বললাম,”হ্যাঁ৷”
—”পিসিমা?”
—”দিবানিদ্রা।”
ভরদুপুরে একজন বাড়ি বয়ে এসে খোঁজখবর নিচ্ছে, তাকে তো আর বিনা আপ্যায়নে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। তারপর শাশুড়ি মা যদি একবার জানতে পারেন যে, তার ভাইপোটিকে কোন আদর যত্ন করিনি, তাহলে আর রক্ষে নেই। হপ্তাখানেক মুখখানা হাঁড়ি করে বসে থাকবেন।
আমি বললাম, “বসুন, কী খাবেন বলুন?”
বারান্দার মেঝেতে বসতে বসতে প্রতুল বলল,”খাওয়াবেন? কী খাওয়াবেন?”
—”আপনিই বলুন, কী খাবেন?”
একটু চিন্তা করে প্রতুল বলল,”নাহ্, একটু জলই খাওয়ান৷”
—”শুধু জল?”
—”হ্যাঁ, স্রেফ একগ্লাস জলই দিন। ভালোমন্দ খাওয়াটা না হয় অন্যদিনের জন্য তোলা থাক—” বলেই হোহো করে হেসে উঠল। আমিও হাসলাম। কেন হাসলাম জানি না। অনেকসময় হয় না, কখনও কখনও অন্যের হাসি দেখে কোনকিছু না বুঝেই আমরা অকারণে হেসে উঠি, এটাও হয়ত তেমনি হাসি।
জল দিতে গিয়ে দু’জনের আঙুলের ডগায় ছোঁয়াছুঁয়ি হয়ে গেল। অনিচ্ছাকৃতই হলো। তা হোক, ক্ষতি কী?
—”এই দুপুরবেলা কোথা থেকে এলেন?” এতক্ষণে প্রশ্নটা আমার মনে হলো। প্রত্যুত্তরে প্রতুল আলতো করে হাসল, বলল না কিছু।
কী মনে হতেই আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম,”এত যে লোকের উপকারের জন্য ঝাঁপাচ্ছেন, পাচ্ছেন কিছু?”
আবার হাসল প্রতুল। বলল,”পাবার আশায় কি আর ঝাঁপাই? ওই যে,আপনারা বলেন, সমাজসেবার ভূত। আসলে কী জানেন, আমাদের সকলেরই একটা সোশ্যাল কমিটমেন্ট থাকা দরকার। নইলে সমাজটা এগোবে কী করে? ওই যে একটা কথা আছে না, ‘সকলের তরে সকলের আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’— এও কতকটা তাই।”
—”সোশ্যাল কমিটমেণ্ট! ভালো বলেছেন। তা আমার জন্য কিছু করতে পারবেন?”
দুম করে কথাটা বলেই ভাবলাম, যাঃ, কী বলতে কী বলে ফেললাম? আর কেনইবা বললাম?
প্রতুল অবশ্য খুব স্বাভাবিক সমাজসেবীর ভঙ্গিতেই বলল,”বলুন না, আপনার প্রবলেমটা কী? আমার সাধ্যের মধ্যে—” কথাটা অসম্পূর্ণ রেখেই হেসে ফেলল সে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”আজ উঠি বৌদি, অনেক বেলা হলো। দক্ষিণ পাড়ার দিকে যেতে হবে একবার—”
প্রতুল চলে গেল। আমি তারপরেও বেশ কিছুক্ষণ ওর যাবার পথের দিকে চেয়ে থাকলাম।
“আপনার প্রবলেমটা কী?” প্রতুলের ছোট্ট কথাটাই তখন কানের পর্দায় ঘুরেফিরে আঘাত করছিল৷ সত্যিই কি আমার কোন প্রবলেম আছে? আশুতোষের আছে। আমার শাশুড়ির আছে৷ কিন্তু আমার? না, সেই অর্থে আমার কোন প্রবলেম নেই। আমি তো জেনেই গেছি, আর যাইহোক, আমি বন্ধ্যা নই। উপযুক্ত পরিবেশ-পরিস্থিতিতে আমিও মা হতে পারি।

এভাবেই সময় বয়ে যাচ্ছে। দিনের শেষে রাত নামছে। রাত শেষে আবার নতুন সকাল।
সবকিছুই যেমন চলে, গতানুগতিক চলছে। কোন বৈচিত্র নেই, সেই একঘেয়ে জীবন। সেই একইরকমের ঘ্যানঘ্যানানি,প্যানপ্যানানি, আর ভালো লাগে না। সৃষ্টিকর্তা কী কুক্ষণেই যে আমায় মেয়ে বানিয়ে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিল, বসে বসে তাই ভাবি। আমার হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো, সব ওলটপালট করে ছেড়ে দিতাম। বুঝিয়ে দিতাম, আমিও পারি। নিজের মত করে আমিও কারো থেকে কম যাই না। বয়সটা তো আর কম হয়নি৷ এরই মধ্যে তিরিশটা বসন্ত পার করে এসেছি। অনেকে বলে, মেয়েরা নাকি কুড়িতেই বুড়ি। তাই যদি হয়, তাহলে আমার বয়স হয়েছে। এতখানি বয়সে কম কিছু তো আর দেখিনি। দেখেছি যেমন, বুঝেছি তারও অনেক বেশি। সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছি। আমার বাবা মিলিটারিতে ছিলেন। মেজাজখানাও তার একেবারে যাকে বলে, মিলিটারি মেজাজ। সবসময় সপ্তমে চড়েই থাকে। পান থেকে চুন খসলে আর রক্ষে নেই, বাড়িসুদ্ধ একেবারে মাথায় করে তোলে। কী তার তেজ! কী তার প্রতাপ! মাঝেমাঝে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যেত, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসত। অথচ আমার সেই প্রবল প্রতাপশালী, বদমেজাজি বাবাকে দেখেছি, মা’র সামনে এলেই, কেমন কেঁচো হয়ে যেত। আমার মা দেখতে শুনতে খারাপ না। গায়ে গতরে একেবারে ঢলঢল। পাড়ার অনেক কাকু-জ্যেঠু তো ছিলই, সদ্য গোঁফ গজানো ছেলে-ছোকরাদেরও দেখেছি মাকে গোপনে ঝাড়ি মারতে। এখনও যে বয়স হয়েছে, তাও দেখি এখনও অনেকে টেরিয়ে টেরিয়ে তাকায়। মহিলার এখনও যা ফিগার, মাঝেমধ্যে আমারই হিংসে হয়।
আমার বাবার বন্ধুবান্ধব বলতে, ঐ বিপুল কাকু। শুনেছি ওরা নাকি সেই প্রাইমারী স্কুলের হাফপ্যান্টের বন্ধু। তো সেই বিপুল কাকু ঘনঘন আমাদের বাড়িতে আসত। বাবা থাকলেও আসত, না থাকলেও আসত। আমি তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি বোধহয়। সঠিক মনে নেই। তবে তখনও ফ্রক পরতাম, এটা বেশ মনে আছে। কাকু যখনই আসত, হাতে করে আমার জন্য, দাদার জন্য কিছু না কিছু আনতই। আমার তো বেশ মজাই হতো। ভালও লাগত। শুধু ভাল লাগত না, কাকু যখন আমাকে কোলে বসিয়ে আদর করার নাম করে আমার শরীরের যেখানে-সেখানে হাত দিত। খুব অস্বস্তি হত। প্রতিবাদও করতে পারতাম না, কাউকে কিছু বলতেও পারতাম না। আমার কথা শুনবেই কে? আর বিশ্বাসই বা করবে কেন? মাকে বলব? মা’তো বিপুলদা! বিপুলদা! করেই একেবারে অস্থির। অতএব কাউকেই কিছু বলতাম না। শুধু বিপুল কাকু এলে, টুক করে সরে পড়তাম। লোকটার অভ্যাসটা খুব বাজে। হাতদুটোও খুব নোংরা।
একবার যদিও ভেবেছিলাম মা’কে বলব কথাটা, কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনা দেখার পর আর সাহস হয়নি।
সেদিন বাবা বাড়িতে ছিল না৷ দাদাও কোচিংয়ে গেছল। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে, বাইরে থেকেই মা আর বিপুল কাকুর হাসাহাসির শব্দ আমার কানে আসছিল। ঘরে ঢুকতে গিয়েও, কী ভেবে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারতেই আমার তো চক্ষু চড়কগাছ! আমার মা খাটের সঙ্গে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। লাগোয়া ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় দেখতে পেলাম, মা’র বুকের কাপড় খসে পড়েছে। বিপুল কাকু পিছন দিক থেকে মাকে জড়িয়ে ধরে গালে গাল ঠেকিয়ে আদর করছে। ঠিক যেন স্বামী-স্ত্রী। ওদের সেই মুহূর্তের কথোপকথন আজও আমার কানে বাজে। মা বলছে,”এই ছাড়ো না, কেউ এসে পড়বে!”
“আসুক। আজ আমি কোন বাঁধাই মানবো না। ভেঙেচুরে সব তছনছ করে দেব।” বিপুল কাকুর কণ্ঠে যেন ধ্বংসাত্মক বিপ্লবের কড়া হুমকি।
“তোমার বন্ধু যদি জানতে পারে না—”
“জানলে কচু হবে। বন্দুক কি খালি ওর আছে? আমারও আছে।”
“তাতে কী?”
“সোজা গুলি করে দেব না—” বলেই যেন খুব একটা মজার কথা, মা আর বিপুল কাকু দু’জনেই হোহো করে হেসে উঠল।
আমি আর দাঁড়াইনি ওখানে। একছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। খুব দৌড়েছিলাম সেদিন। কেন? জানি না। তবে কেমন যেন ভয়ভয় করছিল৷ এই বুঝি ওরা এসে পড়ল৷ বাবার মত আমাকেও যদি গুলি করে দেয়।

( ৩ )

ইদানীং এ-বাড়িতে প্রতুলের আসা-যাওয়াটা যেন আগের তুলনায় বেড়েছে। নির্দিষ্ট কোন সময়সূচী নেই। মনে হলেই চলে আসে। এসেই আগে আমার শাশুড়ির পায়ে ঢিপ করে একটা প্রণাম ঠুকে দেয়। শাশুড়ি-মা আবার কেউ প্রণাম ট্রনাম করলে, খুব খুশি হন। আমার আবার ওই অভ্যাসটা নেই বললেই চলে। প্রথম প্রথম এ-বাড়িতে এসে ঠেলায় পড়ে দু-চারবার হয়ত করেছি, কিন্তু এখন ওসব টোট্যালি বন্ধ করে দিয়েছি। কী হয় ওসব করে? মনে ভক্তিশ্রদ্ধা থাকলেই হলো, তারজন্য পায়ে হাত দিয়ে হাত নোংরা করার কোন যুক্তি নেই।
তা নিয়ে অবশ্য আমার শাশুড়ি সময় সুযোগ মত কথা শোনাতে ছাড়েন না। প্রতুল যখন প্রণাম করে, বড় তৃপ্তি পান ভদ্রমহিলা। বলেন, “বেঁচে থাকো বাবা, দীর্ঘজীবী হও! এসব কী আর বলে দিতে হয়? এ হলো বাপ-মায়ের দেওয়া সংস্কার। সবাই বহন করতে পারে না।”
এদিনও এসেছিল প্রতুল। দুপুরবেলা। ম্যাক্সিমাম এই টাইমটাতেই আসে ও। বারটা বোধহয় মঙ্গলবার ছিল। বোধহয় কি, মঙ্গলবারই। এইসময় আশুতোষ স্কুলে। শাশুড়ি মা নীচের ঘরে ভোস ভোস করে ঘুমুচ্ছেন। হাঁটুর ব্যথায় উনি আবার সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না। আমাদের ঘরটা দোতলায়।
আমি দরজার দিকে পিছন ফিরে খাটে বসেছিলাম। দরজা খোলাই ছিল, পরদাটা শুধু নামানো। প্রতুল কখন ঘরে এসে ঢুকেছে, বুঝতে পারিনি ঠিক। এদিন ওর কী হয়েছিল কে জানে! ঘরে ঢুকে আচমকাই পিছন থেকে আমায় জাপটে ধরল। আমি যথারীতি হকচকিয়ে পিছন ফিরতেই দেখি প্রতুল। ও তখন আমার ঘাড়ে-পিঠে মুখ ঘষছে। প্রতুলের সঙ্গে এ-ক’দিনে আমার বেশ জমে গিয়েছিল। ওর মত ছেলেরা হয়ত এমনই হয়। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই লোককে আপন করে নিতে পারে। তাই বলে ফাঁকা ঘরে আমাকে ওর এইভাবে জাপটে ধরাটাকে আমি ওর দুঃসাহসই বলব। আমি ওর হাতের বেষ্টনী ছাড়াতে ছাড়াতে বেশ একটু গম্ভীর কণ্ঠেই বললাম,”এটা কী হচ্ছে, ঠাকুরপো?”
‎প্রতুল সেকথার উত্তর না দিয়ে আমার মুখটাকে ডাবের মত তুলে ধরে চুমু খেতে লাগল। আমার বাঁধা দেবার প্রচেষ্টা কোন কাজেই এলো না। হয়ত আমার বাঁধা দেবার চেষ্টার মধ্যে খামতি ছিল। সেটা প্রতুলের অভিজ্ঞ চোখ চট করে বুঝে নিয়েছিল। আচ্ছা, সব পুরুষরাই কি এ-ব্যপারে এমন দক্ষ হয়? এ-জাতীয় দক্ষতা কি ওরা নিয়েই জন্মায়? প্রতুলের কলাকুশলী দেখে আমার সেটাই মনে হচ্ছিল তখন। প্রতুল যেন বাহ্যিক সমস্তকিছু ছাপিয়ে আমার মনের ভেতরটাকে পরিষ্কার‌ দেখতে পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ও যেন আজ তৈরি হয়েই এসেছে।
খুব বেশিক্ষণ আমি নিজেকে আর আটকে রাখতে পারিনি। মনের নিভৃত কোণে জমে থাকা অতৃপ্ত বাসনা বাঁধভাঙা উচ্ছাসে সশব্দে বাইরে আছড়ে পড়েছিল।
‎প্রতুলের সাথে আমার আলাপ-পরিচয় এ-বাড়িতে এসে। সম্পর্কে ও আমার দেওর। এসব ক্ষেত্রে কথার ছলে হাসি-মস্করা সবই যেমনটা হয়ে থাকে, তেমনি হয়েছে। হয়ত এর বাইরে আমার আচার-ব্যবহারে কখনও কোন অসংলগ্ন মুহূর্তে আমার দূর্বলতাটা ওর প্রশ্রয়টাকে বাড়িয়ে তুলেছিল। প্রতুলের মত ছেলেরা হয়ত দক্ষ খেলোয়ার। কখন,কীভাবে, কোথায় হাতের লুকনো তাস বাইরে বার করতে হয়, সেটা ওরা খুব ভালকরেই জানা আছে। আমার এতদিনের সমস্ত রক্ষণশীলতা, সমস্ত সংযম, প্রতুলের বেপরোয়া আক্রমণের মুখে খড়কুটোর মত ভেসে যাচ্ছিল। কী এক অবাঞ্ছিত তাড়নায় নিজেকে ওর হাতে সঁপে দিলাম। একটা অবৈধ মেলামেশার নির্লজ্জ পরিসমাপ্তি!

ঠিক কতক্ষণ মনে নেই৷ একটা আবছা, ঘোর লাগা অনুভূতি আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। বেশ কিছু সময় আমি যেন অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন বিছানায় আমি একা। একটু ধাতস্থ হতেই টের পেলাম আমার শরীরে একবিন্দুও সুতো নেই। চোখ মেলে সারাঘরের কোথাও প্রতুলের ছবিটাও নজরে পড়ল না। আচমকা ঝোড়ো হাওয়ার মত এসে, আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আর দেরি করেনি। যেমন হঠাৎ এসেছিল, কাজ শেষে তেমনি হঠাৎ ফিরে চলে গেছে। বহুদিন হয়ে গেল সে এবাড়িতে আর আসে না। রাস্তা ঘাটে দেখা হলে মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। প্রতুলরা বোধহয় এমনই হয়। নিজের মর্জির মালিক। যেখানে যায়, নিজের ইচ্ছেতেই যায়। যতটুকু সময় প্রয়োজন ততক্ষণই তার দেখা পাওয়া যায়। কাজ ফুরোলে শতচেষ্টাতেও তাকে কেউ ধরে রাখতে পারে না। ও যে সমাজ সেবক! সমাজের সেবা করাই যার ধর্ম! একজায়গায় অকারণ বেশীসময় থমকে থাকার সময় কোথায়? আবার কোথায় ছুটতে হবে তার ঠিক আছে? সমাজের এ-মাথা থেকে ও-মাথা,সোশ্যাল কমিটমেন্টের ভূত এদের সর্বক্ষণ তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়।

( ৪ )

আমার শ্বশুরবাড়ির পিছনদিকটায় টিলা মতন জায়গা আছে। টিলা বলতে, একটা উঁচু মাটির ঢিপি। এটার ওপর মাঝেমধ্যে এসে দাঁড়াই আমি। এই দাঁড়ানোর পিছনে সুনির্দিষ্ট কোন কারণ নেই। এমনিই দাঁড়াই। আজও এসে দাঁড়িয়েছি। কয়েকহাত দূরেই বাঁধানো পুকুরখানা আমার শ্বশুরবাড়ির এরিয়ার মধ্যেই পড়ে। ক’দিন আগে বর্ষা বিদায় নিলেও এখনও জলে টইটম্বুর। আশুতোষ আবার ওতে মাছ ছেড়েছে। ব্যবসার জন্য না, এমনি সখ করেই। দু-চারটে মাছও যদি রান্নার কড়াই পর্যন্ত পৌঁছয়, তাই বা কম কী! নিজেদের পুকুরের তাজা মাছ খাওয়ার মজাই আলাদা।
এখন দুপুরবেলা। আশুতোষ এখনও ফেরেনি। এখন অবশ্য ওর ফেরার কথাও না। ফিরতে ফিরতে সেই বিকেল। আমার শাশুড়ি মা আজ আবার একটু ঐ ওনাদের কুলগুরুর আশ্রমে গেছেন। সুখরটা ওনাকে জানানো দরকার। ওনার মন্ত্রপূত তাবিজখানা এদ্দিনে খেল দেখিয়েছে যে! সামনের বুধবার আমার সাধভক্ষণ। নিন্দুকের মুখে ঝামা ঘষে আমি মা হতে চলেছি। আমার জঠরে এক নবীন প্রাণ আগামীর আলো দেখার উৎসাহে রাতকে রাত শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েই চলেছে। ||সমাপ্ত||

Developed by