
মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুদিনেও সিপিএম নির্মম নির্লজ্জ্ব আচরণ করেছিল। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তের নির্দেশে রবীন্দ্রসদনে মহানায়কের মরদেহ রাখতে দেওয়া হয়নি। মরদেহ রাখা হয়েছিল পূর্ণ সিনেমায়। আশ্চর্য হলেও সত্যি জ্যোতি বাবু বুদ্ধবাবুরাও উত্তমকুমার সম্পর্কে ছিলেন উন্নাসিক।
24 জুলাই 1980 ভোরবেলা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আধিকারিক রা ফোন করলেন বুদ্ধাদেব ভট্টাচার্য্য কে, স্যার উত্তম কুমার মারা গেছেন, মালা কোন ধরণের কেনা হবে আর কোন rank এর অফিসার মালা দিতে যাবেন। তখন জ্যোতি বাবু বিদেশে, তাই ওঁর সঙ্গেই কথা বলতে হবে। ফোনের উল্টোদিক থেকে উত্তর এলো, ধুর উত্তম কুমার আবার অভিনেতা নাকি? কোনো মালা দিতে হবে না। মালা দেওয়া হয় নি।
অথচ বিশ্ব বিখ্যাত অস্কার জয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায় উত্তম কুমারের স্মরণ সভাতে বলেছিলেন “কেউ উত্তম হন নি, কেউ হবেনও না।
মৃত্যুর 41 বছর পরে শুধু ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীর সিনেমা জগতে আর দ্বিতীয় কোনো নজির নেই যে অভিনেতার মৃত্যুর পরেও তার জনপ্রিয়তা বেড়ে চলেছে। সত্যজিৎ রায় ওই স্মরণ সভাতে বলেছিলেন উত্তম বিদেশে জন্মালে গ্রেগরি পেকে র মতো স্টার হতেন।”
উত্তমের প্রসঙ্গে সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন,|”আমি উন্মুখ হয়ে ছিলাম উত্তমের সাথে কাজ করার জন্যে আর ওর সবকিছু মাথায় রেখে একটা গল্পও লিখে রেখেছিলাম। আমি ভেবেছিলাম এই চরিত্রটাতে উত্তম খুব সহজেই খাপ খেয়ে যাবে, একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের যুবক যিনি ফিল্মে সুযোগ পেয়েই অতি দ্রুত সাফল্যের শিখরে উঠে যান। আসলে, এই অসচ্ছল জীবন থেকে হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠা, এই গল্পটার সাথে উত্তমের নিজ জীবনের কিছুটা মিলও ছিল বটে। উত্তম এই চরিত্রটা পছন্দ করে এবং রাজিও হয়ে যায় এটা করার জন্য যদিও সে বুঝতে পেরেছিলো এই চরিত্র করা অর্থই হচ্ছে তাঁর চিরচেনা জাঁকজমকপূর্ণ ধারার বাইরে গিয়ে কাজ করা অন্তত কিছু সময়ের জন্যে হলেও। কোনো ধরনের মেক-আপ ব্যবহার করা যাবে না, এই প্রস্তাবেও উত্তম রাজি হয়। সম্প্রতি হয়ে যাওয়া গুটি বসন্তের দাগ মুখে কিছুটা রয়ে যায় তা সত্ত্বেও সে রাজি ছিল।
বলতেই হবে, উত্তমের সাথে কাজ করাটা আমার সিনেমা জীবনের আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতাগুলোর মধ্যে একটি। আমি আগে থেকেই বুঝতে পেরেছি যে উত্তমের অভিনয়ের ধাঁচ’টা অনেকটা সহজাত প্রবৃত্তিগত। আমি অন্য ধাঁচের লোকের সাথেও কাজ করেছি যারা কিছুটা আবেগ বর্জিত কিন্তু অনেক বুদ্ধিখাটিয়ে কাজ করে, তাঁরা একটা পটভূমিকে চিরে তা নিয়ে সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ক’রে যাতে চরিত্রটার সাথে একেবারে রক্তে মাংশে মিশে যেতে পারে। কিন্তু আসল বিষয় হচ্ছে এখানে কোনো নিশ্চয়তা নেই যে এই সেরেব্রাল বা ব্রেন খাটানো লোকটা ঐ সহজাত অভিনয়ের লোকটার থেকে অধিকতর বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে পারবে কি পারবে না।
আমার মনেই নেই এমন কোনো ঘটনা যেখানে আমি উত্তমের সাথে বসে গুরুগম্ভীর আলোচনা করেছি ওর সিনেমার চরিত্রটা নিয়ে! ওকে তেমন কিছু বলতেই হতো না। আর তারপরেও উত্তম ওর অপ্রত্যাশিত ছোট ছোট নিখুঁত কাজের মাধ্যমে আমাকে অনবরত চমকে দিতো এবং মুগ্ধ করতো যেগুলো সবসময়ই ঐ চরিত্রের শোভা আর ঐ মুহূর্তটার উৎকর্ষতা বৃদ্ধি করে দিতো বহুগুণে। এই বিষয়গুলো দৃশ্যের মাঝে এতটা স্বাভাবিক দেখাতো যে মনে হতো এই স্বাভাবিকতা সে ভিনগ্রহ থেকে রপ্ত করে এনেছে। এর মধ্যে যদি কোনো গভীর ভাবনার যোগসূত্র থাকতো, তাহলে উত্তম ঐ সম্বন্ধে কোনো প্রকার কথাবার্তাই বলতো না। এই স্বতঃস্ফূর্ততার কথা ওর নিজের মধ্যেই রয়ে যেত।”
বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা শেষ দিন পর্যন্ত উত্তমকুমার কে জাত অভিনেতার স্বীকৃতি দেননি। বামপন্থী মৃনাল সেন এর পরিচালনায় উত্তমকুমার খুব কম পারিশ্রমিক নিয়ে একটি সিনেমা করেছিলেন। ছবির নাম রাতভোর।
মৃণাল সেন, যিনি প্রথম সিনেমাটা উত্তমকুমারের সাথে করেছিলেন বলে তাকে পরবর্তীকালে নিজের ছবি বলতে বা ভাবতে অস্বীকার করেছিলেন। ভাবা যায়! এত তীব্র উত্তম বিদ্বেষ!
অথচ রাতভোর এর সময় মৃণাল সেন আনকোরা। তাঁর মত একজন আনকোরা লোকের সাথে সিনেজগতে প্রতিষ্ঠিত উত্তম বিনা বাক্যব্যয়ে ন্যুনতম পারিশ্রমিকে কাজ করেছিলেন। ছবি হিসাবেও রাতভোর ভাল ছিল। কিন্তু তার প্রিন্টকে সংরক্ষিত করতে দেন নি কে জানেন ? স্বয়ং ছবির পরিচালক। বাম আমলে গোডাউনে আগুনে পুড়ে স্বর্ণযুগের বহু ছবির নেগেটিভ চিরতরে শেষ হয়ে যায়। তার পেছনেও অনেকেই পলিটিকাল কন্সপিরেসির অভিযোগ আনেন। অ্যাঞ্জেল ভিডিও না থাকলে উত্তমকুমারেত অস্তিত্ব শুধু স্টিল ফটোতেই সীমাবদ্ধ থাকত।
অথচ এতকিছুর পরেও উত্তমকুমারের শেষ যাত্রায় 1980 সালের 25 জুলাই জনসমুদ্র সমালদিতে হিমশিম খেতে হয়েছিল পুলিশকে। বাংলার ইতিহাসে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রেকর্ড জনজোয়ারের পরেই দ্বিতীয় বৃহত্তম অন্তিম যাত্রা হিসাবে ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে মহানায়ক উত্তমকুমারের শেষ যাত্রা।