
দিদি(মহাশ্বেতা দেবী) নেই, এই অভাব কোনও দিনই পূরণ হবে না। হওয়ার নয়। এই রাজ্যে একজন মানুষ যাঁকে ঘিরে একটা প্রতিবাদী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেই খামতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। অন্তত আমরা যারা দিদিকে ঘিরে এক বৃহত্তর সংসারে বাস করতাম তাদের কাছে। গত পাঁচ বছরে অন্তত পাঁচশোবার তাঁর অনুপস্থিতির অভাব বোধ করেছি। দিদিকে আমার কাছ থেকে দেখা আজ থেকে ৪২ বছর আগে। স্কুলজীবনের শেষলগ্নে। অশোকনগরে শেরপুর মাঠে খোলা আকাশের নীচে এক মাঠ মানুষের সামনে বক্তব্য রাখছেন ‘অরণ্যের অধিকার’ নিয়ে। সবে উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে। দিদি বলতেন, ‘আমি সর্বদাই বিশ্বাস করি যে, সত্যকারের ইতিহাস সাধারণ মানুষের দ্বারা রচিত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাধারণ মানুষ যে লোককথা, লোকগীতি, উপকথা ও কিংবদন্তিগুলি বিভিন্ন আকারে বহন করে চলেছে, তার পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে আমি ক্রমাগত পরিচিত হয়ে এসেছি। … আমার লেখার কারণ ও অনুপ্রেরণা হল সেই মানুষগুলি যাদের পদদলিত করা হয় ও ব্যবহার করা হয়, অথচ যারা হার মানে না। আমার কাছে লেখার উপাদানের অফুরন্ত উৎসটি হল এই আশ্চর্য মহৎ ব্যক্তিরা, এই অত্যাচারিত মানুষগুলি। অন্য কোথাও আমি কাঁচামালের সন্ধান করতে যাব কেন, যখন আমি তাদের জানতে শুরু করেছি? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার লেখাগুলি আসলে তাদেরই হাতে লেখা।’
এরপর ১৯৯৩ সালে দিদির বালিগঞ্জ স্টেশন রোডের বাসায় তহমীনাকে ও আমাকে ডেকে পাঠালেন। তহমীনা খাতুন হাবড়া গান্ধি সেন্টিন্যারি বি.টি. কলেজে ধর্ম ও স্বামীর পদবি না লেখায় মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও ভর্তি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার খবর জেনে। মামলা লড়ছে তহমীনা শুনে তিনি বললেন লড়াই চলবে। আমরা জিতবই। তহমীনার লড়াই নিয়ে আজকালে লিখলেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। তারপর লিখেছেন, বলেছেন তার থেকেও বেশি। নিম্ন আদালতে তহমীনার আইনজীবী অসীম চট্টোপাধ্যায়কে তহমীনার মামলা লড়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। এটাই ছিল ওই বড় মনের মানুষের একটা বৈশিষ্ট্য। আইনজীবী অসীমদাও মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে কথা বলে স্বস্তি পেতেন।
তারপর বেআইনি ইটভাটা, মেছোঘেরির বিরুদ্ধে, নদী দখলের বিরুদ্ধে গোটা উত্তর ২৪ পরগনা জেলা জুড়ে আমাদের উদ্যোগে ‘নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন সমিতি’র আন্দোলন নিয়ে বর্তিকার একটি সংখ্যা প্রকাশ করলেন ‘নদী ও পরিবেশ’। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে আমাদের দাবির সমর্থনে তিনিও লিখলেন। সেই পর্যায়ে অনেকখানি সাফল্য এসেছিল।
এরপর তহমীনার মামলা নিম্ন আদালত থেকে কলকাতা হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে। সর্বত্র রায় তহমীনার সমর্থনে। এক দশক পর কলেজ ভর্তি নিল কিন্তু বি.এড পড়ার বয়স চলে গিয়েছে। চলে গিয়েছে শিক্ষকতার চাকরির বয়স, যেকারণে বি.এড পড়া। হাইকোর্ট থেকে দিদিকে ফোনে তহমীনার জয়ের খবর প্রথম জানালাম। দিদির নির্দেশ, চলে আয় গল্ফগ্রিনের বাসায়। তহমীনা, আমি ও গোবরডাঙার দীপককুমার দাঁ সোজা চলে গেলাম দিদির বাসায়। দিদি আমাদের মিষ্টি খাওয়ালেন নিজের হাতে। এই জয়ের পর দিদি উপন্যাস লিখলেন ‘এলাটিং, বেলাটিং সইলো’।
এরপর যেখানেই আন্তধর্ম বিয়ে আমরা বলি ‘ধর্মনিরপেক্ষ মানুষদের বিয়ে’ নিয়ে সমস্যা সেই বিষয় দেখার দায়িত্ব তহমীনা-সুকুমার-এর। তবে লড়াইয়ের ছাতা দিদি। বীরভূমের ইলামবাজারের দম্পতি জিন্নাহ-পূর্ণিমা, দক্ষিবণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের শর্মিলা-রফিউদ্দিন বা বংশীহারীর দৌলতপুরের মোজাফ্ফার রহমান- সুজাতা চক্রবর্তীর বিবাহ পরবর্তী সমস্যা নিয়ে দিদি বাম আমলে সাম্প্রদায়িক শক্তির আস্ফালন তুলে ধরেছেন। তবে মোজাফ্ফার দক্ষিিণ দিনাজপুর থেকে জ্বর গায়ে বর্ষার মধ্যে দিদির বাড়ির ঠিকানা জোগাড় করে হাজির হয়। সালটা ২০০৩। দিদি মোজাফ্ফারকে সমস্ত পোষাক পরিবর্তন করে খাবার খাওয়ানোর পর তাঁর মুখে সমস্ত ঘটনা শুনলেন ও রাতে হোটেলে নয় দিদির বাড়িতেই তাঁকে থেকে যেতে হল। যাতে জ্বর না বাড়ে ওষুধও খাইয়েও দিয়েছিলেন দিদি। সকালে মহাকরণে তৎকালীন ডিজি দীনেশ বাজপেয়ীর কাছে দিদির চিঠি নিয়ে মোজাফ্ফার হাজির। সেখান থেকে নির্দেশ গেল সর্বত্র মোজাফ্ফারের অভিযোগ অনুযায়ী পুলিশ যেন ব্যবস্থা নেয়। দিদি কেস দেখভালের দায়িত্ব দিলেন আমার ও তহমীনার উপর। আমরা কাঁথিতে সেদিন এক সেমিনারে বক্তব্য রাখতে গিয়েছিলাম। ওই সভায় অন্যতম বক্তা ছিলেন সদ্য মৃত গণ দর্পনের ব্রজ রায়ও। অনুষ্ঠান চলাকালীন দিদির ফোন তোরা তাড়াতাড়ি কালই ফিরে আয় মোজাফ্ফার ভারি সমস্যায় পড়েছে সুজাতা চক্রবর্তীকে বিয়ে করে। সে এক দীর্ঘ লড়াই। তারপর মোজাফ্ফার-সুজাতার দুই ছেলে মহাশ্বেতা দেবী নাম রাখলেন শমিক ও সাম্য। না কোনও পদবি নেই। এরপর আরও এই ধরনের সমস্যার কথা দিদিকে জানালে দিদি বলতেন, ‘সুকুমার আমাদের অভিভাবক’ ওই এই বিষয় দেখবে। তবে দিদি ডাকতেন আমাকে ‘হারামজাদা’ ও তহমীনাকে ‘হারামজাদি’ বলে। এই সম্বোধন তাঁদেরই করতেন যাঁদের তিনি অত্যন্ত স্নেহ করতেন, ভালবাসতেন। এই তো দেবুদা আমাদের ডাঃ দেবপ্রিয় মল্লিক তাঁকেও হারামজাদা বলে সম্বোধন করতেন। এই ডাকে আমরা যথেষ্ট গর্বিত ও খুশী হতাম। এই সম্বোধন করার সাহস কজনই বা রাখেন? দিদি একবার বহরমপুরে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ভর্তি হলেন বহরমপুর হাসপাতালে। তখনও বহরমপুর মেডিক্যাল কলেজ হয়নি। ওইদিন বাপ্পাদা (নবারুণদা) চিন সফরে যাবেন। আমাদের ফোন করে বললেন বাও(তথাগত ভট্টাচার্য) চলে গিয়েছে তোরা পারলে যা। বারাসত থেকে রাতের শেষ বাস ধরে বহরমপুরে মাঝরাতে পৌঁছাই। ওই দিকে দিনাজপুর থেকে মোজাফ্ফার সেও চলে এল। বাকি রাত বাউ-আর আমরা হাসপাতালের বাইরে কাটিয়ে দিলাম। পরের দিন দিদিকে কলকাতায় ট্রান্সফার করা হবে। আমরা হোটেলে কয়েক ঘন্টা বিশ্রাম করে ফিরলাম। বারাসত-বহরমপুর বা বহরমপুর-দিনাজপুর দিদির জন্য আমাদের কাছে কোনও দূরত্বই নয় যেন। একবার দিদি বললেন তোদের আমার সঙ্গে পুরুলিয়ায় শবর মেলায় যেতে হবে। শুধু যেতে হবে না থাকতে হবে ওনার ঘরেই। শীতকাল আমাদের ঠান্ডা যেন না লাগে তাই কোথা থেকে আর একটা কম্বল এনে গায়ে টেনে দিলেন। বাকি অতিথিরা যে যাঁর মতন নির্দিষ্ট জায়গায় ছিলেন। সেবার প্রাক্তন ডিজি আই.পি.এস অরুণপ্রসাদ মুখার্জি, ড. কৃপাশংকর চৌবে আমাদের একটি দল। আমরা মেলার ফাঁকে ফাঁকে পুরুলিয়ার খেড়িয়া শবর গ্রামগুলি ঘুরে ঘুরে দেখলাম। যা দেখছেন অরুণবাবু তাই খাওয়াচ্ছেন। একেবারে ছেলেবেলায় মেলায় ঘোরার আমেজ ছিল। পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতির শবর মেলা তো না যেন জনজাতিদের এক ব্রিগেড। মহাশ্বেতা দেবীর ডাকে জেলা প্রশাসনের শীর্ষকর্তারা মেলা প্রাঙ্গনে হাজির। তবে মেলায় ভিআইপি কিন্তু খেড়িয়া শবররাই। তহমীনাকে নিয়ে দিদি গেলেন জামশেদপুরে এক অনুষ্ঠানে। দিদির বাড়িতে কতদিন এক টেবিলে বসে খেয়েছি, নানা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা সেরেছি সে সবই তো আজ অতীত!
এরপর ২০০০ সালের বন্যায় ত্রাণকাজে আমরা ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছি আর দিদি ত্রাণ সংগ্রহ করে চলেছেন। টানা ৬৭ দিন এই কাজ চলেছিল। আমাদের ত্রাণের গাড়িতে স্টিকার থাকত “MAHASWETA DEVI ON RELIEF WORK”। ২০০২ সালে তহমীনার মামলার রায়। তারপর শান্তিনিকেতনে রাজ্য সরকারের আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে লড়াই, হরিপুরে পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিরুদ্ধে লড়াই, সিঙ্গুরে টাটার ন্যানো গাড়ি কারখানা কৃষকের উর্বরী জমির উপর দখলের বিরুদ্ধে লড়াই, নন্দীগ্রামে সালিম গোষ্ঠীর কেমিক্যাল হাব-এর সেজ গড়ার বিরুদ্ধে লড়াই, লালগড়ে আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষের আন্দোলনের পাশে তিনি বারবার গিয়েছেন। ফিরে এসেই লিখেছেন সেই সব অত্যাচারের কথা। আর তখন উনি বলতেন আমার সংবাদদাতা হল – সুকুমার মিত্র। প্রতিদিনই খুচিয়ে খুচিয়ে আমার কাছ থেকে বিস্তারিত জেনে এই আন্দোলনের সময়কালে বাপ্পাদা(নবারুণদা), প্রণতি বৌদি, বাও(তথাগত), বুড়িদি(দিদির মেজ বোন), দিদির আপ্ত সহায়ক বাজুদা, ডাঃ দেবপ্রিয় মল্লিক, ড. কৃপাশঙ্কর চৌবে, সকলের সঙ্গে আমাদের সকলকে নিয়েই পরিবার। দিদির কথায় সেই পরিবারে আমি নাকি- আইনি পরামর্শদাতা।
দিদির জীবন নিয়ে লিখতে গেলে অনেক কথাই চলে আসে। সমস্যা সেখানেই। অনেক মূল্যবান কথা বাদ রয়েই যায়। যেমন খেড়িয়া শবরদের নতুন বস্ত্র ও মুখে হাসি ফোটাতে শুধু অর্থ সংগ্রহের জন্য কলকাতায় তাঁদের এনে রেখে পুজো মণ্ডপ বানানো, তাঁদের পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা তো বটেই নিজে টাকার বিনিময়ে পুজো উদ্বোধন করে সেই টাকা তুলে দিতেন খেড়িয়া শবরদের কল্যাণের জন্য। নেপথ্যের এই রহস্য কত মানুষ আর জানেন! দিদির উদ্যোগেই নন্দীগ্রামে ডাঃ দেবপ্রিয় মল্লিক একদল চিকিৎসককে নিয়েই সোনাচূড়ায় গড়ে তুললেন ‘শহিদ স্মৃতি স্বাস্থ্য কেন্দ্র’। ব্যাক্তিগতভাবে দিদির অভাব আমরা একদল ‘বেয়াড়া হারামজাদারা’ কোনও দিনই ভুলতে পারব না। ভুলতে পারব না দিদির সেই কথা, ‘সংগ্রাম কখনও ফুরোয় না’। এই কথাই বাকি জীবনের চলার পথের শেষকথা হয়তো।