সুকুমার মিত্র, এইকাল নিউজ:

‘আমি গাইঘাটা থানার সুটিয়া গ্রাম পঞ্চায়েতের যাদবপুর গ্রামের বেনজির জুলেখা। আমি ভালোবেসে আমাদেরই গ্রামের একটি ছেলেকে বিবাহ করি। কিন্তু আমাদেরকে আমার বাড়ি থেকে না মেনে নেওয়ায় এবং আমাদের দাম্পত্য জীবন বিনষ্ট করার জন্য আমার বাবার সাথে হাত মিলিয়ে পুলিশের লোকেরা অন্যায় করছে। পুলিশের(গাইঘাটা) কাছ থেকে আমরা কোন সাহায্য না পাওয়ায় আপনার কাছে আমরা এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুরোধ করছি।’ এই আবেদনটি ঘুরেছে সোস্যাল মিডিয়ায়। প্রবাদ রয়েছে, ‘মিঞা-বিবি রাজি তো ক্যায়া করেগা কাজি?’ প্রবাদটি একুশ শতকের দুই দশক পেরিয়ে শুধুই প্রবাদই থেকে গিয়েছে। যুগযুগ ধরে প্রেমের মাঝে আড়কাঠি হয়ে হাজির হয় একদল দুষ্টু প্রকৃতির মানুষ। উপরোক্ত এই করুণ আবেদনটির নেপথ্যেও রয়েছে এক নিষ্ঠুর অমানবিক, অগণতান্ত্রিক, বেআইনি দুষ্টুচক্রের মেলবন্ধন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও প্রেমের টানে প্রতিবন্ধকতাকে কাটিয়ে যাওয়ার শত-সহস্র উদাহরণ টেনে বেনজির জুলেখা তুলে ধরেন বিখ্যাত গানের কলিটি-‘প্রেম চিরদিন কাঁদিয়ে গেছে, কেঁদেছে মানুষ তবু ভাল তো বেসেছে।’
তিন বছর প্রেমের পর যৌথ সিদ্ধান্তে নিবন্ধিত বিয়ে করার পরেও পুলিশ এবং মেয়েটির বাবা স্থানীয় যাদবপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক জুলফিকার আলির ভয়ে গ্রামছাড়া হয়ে অজানা পথে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে দম্পতি। অত্যাচারের ফলে দম্পতির গ্রাম ছাড়াই নয় প্রাপ্তবয়স্ক-প্রাপ্তবয়স্কাদের বিয়ে জানা সত্ত্বেও পুলিশ ছেলেটির বাবা-সহ পরিবারের মোট সাতজন সদস্যের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা (গাইঘাটা থানা কেস নম্বর-৬৫০ তারিখ ২৭ জুলাই, ২০২১)। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থানার পুলিশ ছেলেটির বাবা মধুবক্স মণ্ডলকে গ্রেপ্তার করে তাঁদের হেপাজতে রাখে। পুলিশের অতিসক্রিয়তায় ভয়ে গুটিয়ে রয়েছে গোটা গ্রাম। করুণ এই ঘটনার অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন গাইঘাটা সুটিয়া অঞ্চলের যাদবপুর গ্রামের বাসিন্দা বাসারুল মন্ডল(৩৩) এবং বেনজির জুলেখা(২৮)।
অভিযোগ, বিয়ের পর স্ত্রীর পরিবার এবং গাইঘাটা থানার পুলিশের চাপে স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে থাকতে পারছেন না বাসারুল। ভয়ে নিজেদের গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে থাকতে হচ্ছে বাসারুল এবং বেনজিরকে।। গাইঘাটা থানার পুলিশ অভিযোগ তুলেছেন বেনজির জুলেখার বিরুদ্ধে। পুলিশের অভিযোগ, তদন্তে সাহায্য করছে না বেনজির জুলেখা। এই অভিযোগের উত্তরে বাসারুল মণ্ডল ও বেনজির জুলেখা অবশ্য জানিয়েছেন, ‘২৮ মে, ২০২১ স্পিড পোস্টে সমস্ত ঘটনা ও বিবাহ রেজেস্ট্রেশন সার্টিফিকেট সহ বনগাঁ জেলা পুলিশ সুপার ও গাইঘাটা থানার ওসিকে পাঠিয়েছি। ব্যাক্তিগতভাবে গাইঘাটা থানার ওসির সঙ্গে বাসারুল দেখা করে সব জানিয়েছেন। তদন্তে অসহযোগিতার প্রশ্ন কেন? কেনইবা তদন্ত? আমরা উভয়েই প্রাপ্তবয়স্ক। স্ব-স্ব সিদ্ধান্তে সরকারি নিয়ম মেনে বিয়ে করেছি। তার মাসুল শুধু আমাদের নয় আমার পরিবারের সকল সদস্য-সদস্যাদের দিতে হচ্ছে।’
দম্পতি জানিয়েছেন, গাইঘাটা থানা পুলিশের কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা না পাওয়ায় ৩০ জুলাই,২০২১ রাজ্য পুলিশের মহানির্দেশকের কাছে লিখিতভাবে জানাতে বাধ্য হয়েছি। আমরা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পিপল ইন ডিস্ট্রেস(পিআইডি)কে লিখিতভাবে জানিয়েছি। তাঁদের অন্যতম দুই প্রধান কর্মকর্তা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের প্রাক্তন চেয়ারম্যান ডাঃ দেবপ্রিয় মল্লিক ও সমাজকর্মী গৌতম দাশকে বিস্তারিত জানাই। তাঁদের পক্ষ থেকেও পুলিশ-প্রশাসনের সর্বত্র জানানো হয়েছে ও তার প্রতিলিপি আমাদেরকেও তাঁরা পাঠিয়েছেন।
জুলেখার অভিযোগ, অপহরণের মামলা সাজানো হয়েছে পরিকল্পিত ও অবৈধভাবে। বেনজির জুলেখার বাবার আপত্তি বাসারুল মাত্র অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনো করেছেন। তাই স্নাতকোত্তর মেয়ের সঙ্গে এই বিয়ে তিনি মানেন না।
বেনজির জুলেখাই জানালেন, তিনি স্নাতক ও প্রাথমিক শিক্ষকতার প্রশিক্ষণ কোর্সও করেছেন।চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বেনজির ও বাসারুলের বাড়ির মাঝে মাত্র চার-পাঁচটা বাড়ি। বছর তিনেক ধরে তাঁদের প্রেম। শেষে এক বছর আগে বাদুড়িয়ায় একজন রেজিস্টারের কাছে গিয়ে বিয়েও করেছেন।
বিয়ে নিবন্ধনের পর বাসারুল কর্মক্ষেসত্রে চলে যান। আর বেনজির থাকতেন বাপের বাড়িতে।চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।কিন্তু মাস দেড়েক আগে বেনজিরের বাবা জুলফিকার আলি আকস্মিক মেয়ের বিয়ের তোড়জোড় শুরু করতেই বিপত্তি শুরু। বেনজির বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বীকার করেন তাঁদের বিয়ের কথা। জামাইয়ের পড়াশুনো অষ্টম শ্রেণী এতেই ঘোরতর আপত্তি জুলফিকারের। তাছাড়া প্রেমের বিয়ে মানেন না। শুধুই আপত্তি নয় বাসারুলের সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করতে চেষ্টার কসুর করেননি শিক্ষক জুলফিকার। মেয়ের মোবাইল কেড়ে নেওয়া থেকে তাঁকে মারধরও করা হয়েছে, না খাইয়ে রাখা হয়েছে। এইসব অভিযোগ খোদ তাঁরই প্রাপ্তবয়স্কা বিবাহিতা কন্যা বেনজির জুলেখার।
এদিকে স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করতে না পেরে কর্মক্ষেতত্র থেকে গ্রামের বাড়িতে চলে আসেন বাসারুল।তাঁর আসার খবর পেয়েই বেনজিরকে জোর করে তাঁর বাবা স্বরুপনগরে নিয়ে যান এক আত্মীয়ের বাড়িতে। শুধু তাই নয় জুলফিকার আলি নিজের প্রভাব খাটিয়ে গাইঘাটা থানা এবং সুটিয়া ফাঁড়ির পুলিশকে কাজে লাগিয়ে বাসারুলকে এলাকা ছাড়া করেন। অভিযোগ, সুটিয়া ফাঁড়ির পুলিশের হুমকির ভয়ে গত ২৩ আগস্ট,২০২০ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন বাসারুল মন্ডল। বাসারুলের গ্রাম ছাড়ার পরেই বেনজিরকে বাড়িতে নিয়ে আসেন জুলফিকার। এরপর সুযোগ বুঝে গোপনে ভালোবাসার মানুষের জন্য বাড়ি ছাড়েন বেনজির জুলেখা। চলে যান বাসারুলের কাছে। এদিকে মেয়ে চলে যাওয়ার পর বেনজিরের বাবা অপহরণের অভিযোগ দায়ের করেন গাইঘাটা থানায়। গাইঘাটা থানার পুলিশের অতিসক্রিয়তায় বাসারুলের বাবা মধুবক্স মন্ডলকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশের এই ভুমিকায় হতবাক গাইঘাটার সুটিয়া যাদবপুর গ্রামের আপামর সাধারণ মানুষ। বিস্মিত মানবাধিকার সংগঠনগুলি।
খোদ সুটিয়া অঞ্চলের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ও সমবায় আন্দোলনের একজন আদর্শ ব্যাক্তিত্ব কালিপদ সরকার বলেন, ‘প্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে এতে আপত্তি জানানোর কোনও কারণ নেই। পুলিশের অতিসক্রিয়তায় তিনিও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, এই অগণতান্ত্রিক, নিষ্ঠুর, অমানবিক কাজের প্রতিবাদে সমাজের সকল স্তরের মানুষের এগিয়ে আসা উচিত।তিনি আশা প্রকাশ করেন শীঘ্রই উর্ধতন পুলিশ প্রশাসনের হস্তক্ষেমপে অনভিপ্রেত সমস্যার সমাধান হবে।’
গোবরডাঙা গবেষণা পরিষৎ-এর কর্ণধার, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও বিশিষ্ট বিজ্ঞান লেখক দীপককুমার দাঁ জানিয়েছেন, একজন শিক্ষক হয়ে তিনি কিভাবে প্রাপ্ত বয়স্কা কন্যার মতকে উপেক্ষাক করছেন তা ভেবে বিস্মিত হচ্ছি। অত্যন্ত নিন্দনীয় ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তিনি ও গাইঘাটা থানার পুলিশ। প্রাপ্ত বয়স্ক-বয়স্কারা নিবন্ধিত বিয়ের নথি দেখানোর পরও কিভাবে অপহরণের মামলা রুজু করল পুলিশ? এই প্রশ্নও তুলেছেন দীপকবাবু।
রবীন্দ্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বিজ্ঞান-যুক্তিবাদী লেখক, মুক্তমন-মুক্তচিন্তা পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ ভবানীপ্রসাদ সাহু বলেন, এই ঘটনা শুনে বিচলিত বোধ করছি। কারণ সুটিয়া অঞ্চলে প্রতিবাদী শিক্ষক বরুণ বিশ্বাস খুন হয়েছিলেন। সেই অঞ্চলে আর একজন শিক্ষক সমাজ বিরোধীদের দিয়ে হত্যার হুমকি দিচ্ছেন তাঁর মেয়ের স্বামী বাসারুলকে। এছাড়া পুলিশকে প্রভাবিত করে প্রাপ্ত বয়স্ক-প্রাপ্ত বয়স্কাদের বিয়েতে অপহরণের মামলা রুজু করে চরম হেনস্থা করছেন। অত্যন্ত অমানবিক ঘটনা যে দম্পতি গ্রামছাড়া। অবিলম্বে পুলিশ-প্রশাসন ব্যবস্থা গ্রহণ করে উদ্ভুত সমস্যার সমাধান করুক। এ বিষয়ে তিনি সমাজের বিভিন্নস্তরের মানুষকে দম্পতির পাশে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
পশ্চিমবঙ্গ না-ধার্মিক মানবতাবাদী মঞ্চের পক্ষেত মোজাফ্ফার রহমান বলেন, ‘এই রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুলিশ-প্রশাসনের কাজে স্বচ্ছতা আনার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন অথচ একদল তা অমান্য করে তাঁর ভাবমূর্তিকে কালিমালিপ্ত করছেন। আমরা আমাদের মঞ্চের পক্ষ থেকে এই ঘটনার তীব্র ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছি। অমানবিক, অগণতান্ত্রিক শুধু নয় অবৈধভাবে দম্পতিকে হেনস্থা করা হচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায় না। রাজ্যের সংস্কৃতিবান মানুষ নিশ্চয় এর প্রতিবাদে প্রয়োজনে পথে নামবেন।’
বেনজিরের বাবা জুলফিকার আলি বলেছেন, ‘ওদের রেজিষ্ট্রেশনের কাগজ জাল। আমি এই বিয়ে মানি না। অবিভাবক হিসেবে মেয়ের ভালোর জন্য আমি অনেক কিছুই করতে পারি। তাই অপহরনের অভিযোগ করেছি।’
বনগাঁ পুরসভার পৌর প্রশাসক ও উত্তর ২৪ পরগণা জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম নেতা গোপাল শেঠ ঘটনাটি জেনে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি পুলিশ-প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। বনগাঁ শহর তৃণমূল কংগ্রেসের সহ সভাপতি পংকজ রায় বলেন, বনগাঁ মহকুমা পুলিশ আধিকারিক অশেষ বিক্রম দস্তিদার তাঁকে জানিয়েছেন, গাইঘাটা থানায় যেতে হবে না। ওরা যে বিয়ে করেছে সেটা আমার কাছে এসে বলুক। তাহলেই অপহরণের মামলা আর থাকবে না।
এরপরেই শনিবার বনগাঁ মহকুমা আদালত থেকে বাসারুলের বাবা মধুবক্স মণ্ডল জামিন পেয়ে যান। বনগাঁ মহকুমা পুলিশ আধিকারিকের আশ্বাসে দম্পতি শীঘ্রই তাঁর সঙ্গে দেখা করে সমস্ত নথি দেখাবেন। জানাবেন গাইঘাটা থানা ও সুটিয়া ফাঁড়ির পুলিশের অতিসক্রিয়তার কথাও। বেনজির জুলেখা বলেন, আমার ওপর শারিরীক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনাও তাঁকে জানাব। গ্রামে যাতে তাঁর শ্বশুরবাড়ির সামনে নিরাপত্তার জন্য পুলিশ পিকেট অতি সত্ত্বর দেওয়া হয় সেই আবেদনও রাখব মহকুমা পুলিশ আধিকারিকের কাছে। পাশাপাশি তাঁদের জীবনে কোনও ক্ষতি হলে তার দায় নিতে হবে শিক্ষক জুলফিকার আলিকেই। এমনটাই দাবি মেয়ে বেনজির জুলেখার।
কি ভাবছেন বাসারুল? বলিউডে থাকার সুবাদে শোনালেন হিন্দি সিনেমার সংলাপ, “হাম জিতে এক বার হ্যায়, মরতে এক বার হ্যায়, প্যার ভি এক বার করতে হ্যায় অউর শাদি ভি একবার উসিসে করতে হ্যায় জিসসে প্যার করতে হ্যায়।”