
প্রদীপ্ত চৌধুরী
শিকাগোর মিশিগান অ্যাভিনিউয়ে মেরিলিন মনরোর উড়ন্ত স্কার্ট আগলানো বিশাল মূর্তিটার পায়ের তলায় প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ চোখ কপালে তুলে দাঁড়িয়ে থাকেন। পাঁচ ফুট সাড়ে পাঁচ ইঞ্চি উচ্চতার 34-24-34 দেহাঙ্কের ‘যৌনতার দেবী’ এখানে দীর্ঘতর। ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে নিজের জীবনকে ছাড়িয়ে, সময়কে পেরিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন একইভাবে। অব্যর্থ প্রতীকী!
মনরোর মৃত্যু হয়েছে 1962-তে। পরবর্তী 60 বছরে পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় তাঁকে নিয়ে লেখা বইয়ের সংখ্যা 700 ছাড়িয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। অথচ মনরো যে খুব বড় মাপের অভিনেত্রী ছিলেন, এমন দাবি আজও ওঠেনি। মনরো নিজেকে ‘তৃতীয় শ্রেণির অভিনেত্রী’ বলতেও দ্বিধা করেননি। অথচ ‘মনরো-মিথ’-এর জনপ্রিয়তায় আজও কিন্তু ভাটার পিছুটান নেই। মেরিলিন আজও অমলিন। অবিস্মরণীয়।
অথচ ক্রোমোজোমেই বিষাদ ছিল তাঁর। মা ছিলেন মনোরোগী এবং নেশাসক্ত । অ্যাসাইলামে পাঠাতে হয়েছিল। তাই মনরোর কৈশোর ছিল বিপন্ন। নিরাপত্তার অভাবে ছন্নছাড়া, বিপর্যস্ত। পালিত হয়েছেন অনাথ আশ্রমে এবং অনাত্মীয় সব পরিবারে। সেখানে বারবার যৌন-নিগৃহীত হতে হয়েছে তাঁকে। বাবা কে, সেটাই তো জানতে পারলেন না কোনওদিন। অভিনেত্রী জীবনেও জট-জটিলতা ছিল যথেষ্ট। প্রেমিক বা স্বামী হিসাবে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদেরও সেভাবে মনে ধরল না। জীবনের অন্তিম প্রেমে এল চূড়ান্ত বিফলতা, আত্মগ্লানি। এসবেরই যোগফল বোধহয় মনরোর ওই অতলান্ত বিষাদ। আর্কল্যাম্পের চড়া আলো, ভঙ্গুর সব সম্পর্ক আর নিরন্তর ঘুমের ওষুধ দিয়ে কতই বা ঢাকা যায় তাকে? মনরোও তাই সাত তাড়াতাড়ি বিদায় নিলেন। মাত্র 36 বছর বয়সে। কিন্তু খ্যাতি-যশ-অর্থের শৃঙ্গ থেকে কেউ তাঁকে ঠেলে ফেলে দিল, নাকি তিনি নিজেই লাফিয়ে পড়লেন মরণখাদে, সে প্রশ্নের উত্তর মেলেনি আজও। 1962 সালের 4 অগাস্ট রাতে জীবনের রঙ্গমঞ্চ থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নিলেন হলিউডের সবচেয়ে বিতর্কিত এবং আলোচিত নায়িকা মেরিলিন মনরো। মনরোর সেই বিবর্ণ বিদায় এ বছর পা রাখবে হীরকজয়ন্তীতে।
নিতান্ত কাঁচা বয়সেই পুরুষের চোখের আয়নায় নিজের রূপকথা পড়ে ফেলেছিলেন মনরো। তাঁর হাস্যে-লাস্যে-স্বরে-বিভঙ্গে ছিল যৌন আঁকশির অব্যর্থ টান। হলিউডে মোট 34টি ছবিতে অভিনয় করেছিলেন। তার মধ্যে 27টি-তে ছিলেন নায়িকা। কিন্তু অধিকাংশ চরিত্রই ছিল অকিঞ্চিৎকর, আবেগসর্বস্ব এবং যৌন আবেদনময়।

মারাত্নক ডিপ্রেশনে ভুগতেন মনরো। শেষ দিকে ডিপ্রেশন কাটাতে ড্রাগও নিতেন নিয়মিত। শুধু বিষাদ নয়, অস্থিরতাও মিশে ছিল তাঁর মজ্জায়। বিয়ে করেছিলেন তিনবার। এর বাইরেও সম্পর্কে জড়িয়েছিলেন আরও একগুচ্ছ পুরুষের সঙ্গে। বাড়ি বদলেছিলেন 43 বার। 25 বছরে পা রাখার আগেই আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন তিনবার। 29 বছরের মধ্যে গর্ভপাত করিয়েছিলেন 12 বার। অতিমাত্রায় সচেতন ছিলেন নিজের রূপ নিয়ে। দিনে অন্তত 15 বার নাকি মুখ ধুতেন। তাঁর একটি ডায়েরিতে মোট 37 জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের নাম পাওয়া গিয়েছিল। বেশ বোঝা যায়, মনরোর উজ্জ্বল উচ্ছলতা আসলে সুদৃশ্য একটা ব্যান্ডেজ। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ চাপা দেওয়ার একটা মরিয়া চেষ্টা ছিল তাতে।
মনরোর মৃত্যু-ধোঁয়াশা তো আজও কাটেনি। বিছানায় তাঁর নিথর নগ্ন দেহটা উপুড় হয়ে পড়েছিল। বাঁ হাতের মুঠোয় ধরা ছিল ফোনের রিসিভার। পাশেই পড়ে ছিল ঘুমের ওষুধের শিশি, যা থেকে 50 টা পিল উধাও। অথচ কোথাও একফোঁটা জলের চিহ্নমাত্র ছিল না। ময়নাতদন্তের রিপোর্টেও সেগুলোর হদিশ মেলেনি। তার বদলে পিঠে মিলল একটা ক্ষতচিহ্ন আর রক্তে মিলল ঘুমের ওষুধ আর অ্যান্টি ডিপ্রেশন ড্রাগের উপাদান। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই ঘটনার কিছুদিন আগে মনরো গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন প্রথমে জন এফ কেনেডি (তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট) আর পরে তাঁর ভাই রবার্ট কেনেডির সঙ্গে। কিন্তু তাঁরা কেউই এই সম্পর্ককে স্বীকৃতি দিতে চাননি। অদ্ভুত ব্যাপার, মনরোর মৃত্যু সংক্রান্ত পুলিশ রিপোর্ট আর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নথি রাতারাতি গায়েব হয়ে গেল। সরকারিভাবে জানিয়ে দেওয়া হল, মেরিলিন মনরো আত্মঘাতী। স্তম্ভিত হয়ে গেল গোটা বিশ্ব।
কিন্তু আমরা যা জানলাম, তা হল, মেরিলিন মনরোর মৃত্যু শুধু রহস্য নয়, নিরাপত্তাহীনতা, অসংযম আর মানসিক একাকীত্বের এক নির্ভুল যোগফল।
তবু, এত কিছুর পরও, মেরিলিন অনপনেয়। তাঁকে আমরা ভালোবাসতে পারি, ঘৃণা করতে পারি। কিন্তু ভুলতে পারি না কিছুতেই।