কৃষ্ণ গহ্বরে আফগানিস্তান
*সুকুমার মিত্র*

আফগানিস্তানে নূর মহম্মদ তারাকি সরকারকে নিয়ে পশ্চিমা প্রচার মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করা হয়েছিল- এরা নাস্তিক, ধর্মবিরোধী, সোভিয়েত অনুচর।নূর মুহাম্মদ তারাকি ছিলেন একজন আফগান রাজনীতিবিদ। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করার পর তিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে পিপল’স ডেমোক্রেটিক পার্টি অব আফগানিস্তান গঠনের সময় তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। দলের প্রথম কংগ্রেসে তিনি মহাসচিব নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারাকির রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন সময়ে ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি চালু করা ভূমি সংস্কার কার্যক্রমসহ অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রম ব্যাপকভাবে জন অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। জন অসন্তুষ্টির ফলে এক পর্যায়ে আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধ দেখা দেয়। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরও শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নকে হস্তক্ষেপ করতে রাজি করাতে পারেননি।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খানের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করেন বামপন্থি সামরিক কর্মকর্তা নুর মোহাম্মদ তারাকির বাহিনী। এরপর ক্ষমতা ভাগাভাগি হয় দুই বাম দলের মধ্যে। পরে পিপলস পার্টি ও ব্যানার পার্টি একসঙ্গে পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি নামে গঠিত হয়। ওই সরকারের জনপ্রিয়তা না থাকলেও মাথার ওপর ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের আশীর্বাদ। বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতি ও শহুরে গোষ্ঠীগুলো নতুন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে, যাদের বলা হয় মুজাহিদিন। তখন সরকারের মধ্যকার পিপলস ও ব্যানারের দুটি অংশের বিরোধের মধ্যে ১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরে আফগানিস্তানে ৩০ হাজার সেনা নিয়ে প্রবেশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। অল্প সময়ে ক্ষমতাচ্যুত হন পিপলস নেতা হাফিজুল্লাহ আমিন। ক্ষমতায় বসেন ব্যানার পার্টির নেতা বাবরাক কারমাল। কিন্তু তিনিও জনপ্রিয় হতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন নিয়ে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে মুজাহিদিনরা। ওই সময় মুজাহিদিনদের প্রতি পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম দেশগুলো সহানুভূতিশীল ছিল। ১৯৮৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে এবং সে দেশ থেকে সেনা প্রত্যাহারে সম্মত হয়। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। আজ যেমন প্রশ্ন উঠছে কেন মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করল আফগানিস্তান থেকে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বিরোধীরা আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন। ট্র্যাজেডি এটাই বাইরের সেনার উপস্থিতিতে কাবুলের মাটিতে কোনও প্রগতিশীলতার চর্চা হয়নি। শাসন কায়েম রাখাটাই যেন লক্ষ্যউ ছিল। তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের রণকৌশল ছিল সোভিয়েতকে ঠেকিয়ে রাখা, কিন্তু রেগান প্রশাসন এগোতে থাকে সোভিয়েতকে পেছনে ঠেলে দেওয়ার কৌশল নিয়ে। কার্টার চেয়েছিলেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, অন্য দিকে রেগান চাইলেন পালটা আঘাত করতে। কিন্তু ভিয়েতনামে যেভাবে সরাসরি আঘাত যুক্তরাষ্ট্র করছিল, সেভাবে নয়। স্থানীয় বা বিশ্ব সোভিয়েতবিরোধীদের জড়ো করে সোভিয়েতকে আফগানিস্তানে আটকে ফেলে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে মার্কিন সরকার। সেই পরিকল্পনায় সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রভাবশালী সোভিয়েতবিরোধী শক্তি হিসেবে ইসলামপন্থিদেরই বেছে নেন রেগান প্রশাসন। বিডেন প্রশাসনও আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা সরিয়ে নিলেও সেখানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ থাকুক এমনটা চাইনি। তালেবানদের হাতে কার্যত কাবুলের ভার তুলে দিয়ে স্থায়ী অশান্তিতে আফগানবাসীকে ফেলে সরে গেল। আসলে তালেবান আফগানিস্তানে থাকলে পাকিস্তান ও চিন জুজুর ভয়ে আরব দুনিয়া ও আমাদের উপমহাদেশের দেশগুলি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে অস্ত্র কিনতে বাধ্য হবে। অস্ত্র বিক্রি মানে মার্কিন অর্থনীতিত তেজিভাবে আসবে। করোনা তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলার এসব নিয়ে কোনও দায়িত্ব মার্কিন দুনিয়ার নেই। চিনের তো নেয়ই। চিন হল বিশ্বের প্রথম রাষ্ট্র যে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তারপরই পাকিস্তান সরকারের স্বীকৃতি। ঘোলা জলে মাছ ধরার কৌশল নিয়ে কাশ্মীরে লস্কর-ই-তৈবা ও জৈশ-ই-মহম্মদ-এর সঙ্গে তালেবান যোগাযোগের অজুহাতে কাশ্মীরে অশান্তির বার্তা রটিয়ে কাশ্মীরে ভোট পিছিয়ে দেওয়া যেমন যাবে তেমনি ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে দেশপ্রেম, তথাকথিত জাতীয়তাবাদের আওয়াজ তোলা যাবে, দেশ বিপন্ন হতে পারে তালেবানের দ্বারা এই প্রচারকে মুখরোচক প্যাকেজে শাসক দলের আই.টি সেলের মাধ্যমে ভাইরাল করে দেওয়া হবে। তৃতীয়বারের জন্য বিরোধীদের জোট, কৃষক আন্দোলন সব কিছু ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার নীল নকশা চূড়ান্ত করে আপাত ঘাপটি মেরে বসে থাকছে নতুন দিল্লি কর্তারা। বস্তুত আফগানিস্তানের সাম্প্রতিককালের বা অতীতের ইতিহাস বলে দেশটিকে ব্যবহার করে যে যখন পেরেছে শাসন-শোষণ করে গিয়েছে। গণতন্ত্রের স্বপ্ন আফগানবাসীকে দেখার ফুরসুত দেয়নি কেউ কখনও। বিশ্বরাজনীতির দাবার ছকে আফগানিস্তান ব্যবহার হয়েছে ‘বোড়ে’ হিসেবে।
আমরা যদি বেশ পিছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখব আফগান ভূ-খণ্ডে অনেক প্রাচীন সভ্যতা ও জনবসতির বিকাশ ঘটেছিল। আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে প্রায় ৫০ হাজার বছর আগে মনুষ্য বসতি ছিল। এই বক্তব্যের সপক্ষো পুরাতাত্ত্বিক নানা নির্দশনও রয়েছে। ঐতিহাসিকেদর অনেকেই মনে করেন, আফগানিস্তানের কৃষি খামার বিশ্বের প্রাচীন খামারগুলোর একটি। আফগানিস্তানের ইতিহাসে বহু সাম্রাজ্য বারবার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, ভেঙেছে। এদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল- গ্রেকো-বারট্রিয়ান, কুশান, হেফথালিটিস, কাবুল শাহী, সাফারি, সামানি, গজনবী, ঘুরি, খিলজি, কারতি, মুঘল ও সবশেষে হুতাক ও দুররানি সাম্রাজ্য। ইতিহাস থেকে জানা যায়, প্রাক ইসলামী শাসন কালের পূর্বে খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ সালের পর মধ্য এশিয়া থেকে এখানে মানুষ আসতে শুরু করে। যাঁরা অধিকাংশ ছিল আর্য, যাঁরা ইরান ও ভারতেও বসতি স্থাপন করেছিল। তখন এলাকাটির নাম ছিল আরিয়ানা। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে পারস্য সাম্রাজ্য প্রাচীন আরিয়ানা দখল করে। খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ সালে আলেকজান্ডার পারস্যের সম্রাটকে পরাজিত করে অঞ্চলটির পূর্ব সীমান্ত দখল করে নেন। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালের পর অর্থাৎ আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর অনেক রাজ্য তার এশীয় সাম্রাজ্যের দখল নেওয়ার চেষ্টা করে। এদের মধ্যে সেলুজিত সাম্রাজ্য, বাকত্রিয়া সাম্রাজ্য ও ভারতীয় মৌর্য সাম্রাজ্য উল্লেখযোগ্য। খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে মধ্য এশীয় কুশান জাতি আরিয়ানা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়। খ্রিষ্টীয় তৃতীয় থেকে অষ্টম শতাব্দী বৌদ্ধ ছিল এখানকার প্রধান ধর্ম। এরপর হুন নামের মধ্য এশীয় এক তুর্কি জাতি চতুর্থ শতাব্দীতে এসে কুশানদের পতন ঘটায়। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে আরব সৈন্যরা আফগানিস্তানে নতুন ধর্ম ইসলাম নিয়ে আসে। পশ্চিমের হেরাত ও সিস্তান প্রদেশ আরবদের নিয়ন্ত্রণে আসে। আরব সেনাবাহিনা চলে যাওয়া মাত্রই সেখানকার জনগণ তাঁদের পুরনো ধর্মে ফেরত যায়। দশম শতাব্দীতে বর্তমান উজবেকিস্তানের বুখারা থেকে সামানিদ নামের মুসলিম শাসক বংশ আফগান এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করে। তখন থেকে গজনীতে গজনবী রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯৯৮ থেকে ১০৩০ সাল পর্যন্দ গজনীর রাজা মাহমুদ গজনবী আফগান শাসন করেন। রাজা মাহমুদ গজনবীর মৃত্যুর পর গজনীর প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। ১২শ শতাব্দীতে পশ্চিম-মধ্য আফগানিস্তানের ঘুর শহরে ঘুরি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারা আবার ১২১৫ সালে মধ্য এশিয়ার খোয়ারিজমি শাহদের কাছে পরাজিত হন। ১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান খোয়ারিজমি শহর হেতাত ও বালখ এবং বামিয়ানে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেন। ১৪শ শতাব্দীর শেষে মধ্য এশীয় সেনাপতি তৈমুর লং আফগানিস্তান জয় করেন ও ভারতে অগ্রসর হন। যদিও তৈমুরের সন্তান ও পৌত্রেরা তার সাম্রাজ্যর পুরোটা ধরে রাখতে পারেনি। ১৬শ শতাব্দীর শুরুতে ১৫০৪ সালে তৈমুর লং-এর বংশধর জহিরুদ্দীন মুহম্মদ বাবর আরঘুন রাজবংশের নিকট থেকে কাবুল দখল করেন। তারপর ১৫২৬ সালে তিনি ভারতে গিয়ে দিল্লি সালতানাতে আক্রমণ চালিয়ে লোদি রাজবংশকে পরাজিত করে মুঘল সাম্রাজ্য স্থাপন করেন। ১৬শ থেকে ১৮শ শতাব্দীর পুরোটাজুড়ে ভারতে অবস্থিত মুঘল সাম্রাজ্য, উজবেক বুখারা খানাত এবং পারস্যের সাফাভি রাজবংশের রাজারা আফগানিস্তানের দখল নিয়ে যুদ্ধ করেন। ১৭০৯ সালে স্থানীয় ঝিলজাই গোত্রের নেতা মিরওয়াইস হুতাক সাফাভিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং গুরগিন খানকে পরাজিত করে স্বাধীন আফগানিস্তান স্থাপন করেন। মিরওয়াইস ১৭১৫ সালে মারা যান এবং তার স্থলে তার ভাই আবদুল আজিজ সিংহাসনে আরোহণ করেন। মিরওয়াইসের পুত্র মাহমুদ হুতাক তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য হত্যা করে। মাহমুদ ১৭২২ সালে পারস্যের রাজধানী ইস্পাহানে আক্রমণ চালান এবং গুলনাবাদের যুদ্ধের পর নগরীটি দখল করে নিজেকে পারস্যের রাজা হিসেবে ঘোষণা দেন। ১৭৪৭ সালে আহমদ শাহ দুররানি কান্দাহার শহরকে রাজধানী করে এখানে দুররানি সাম্রাজ্যের পত্তন করেন। ১৭৭২ সালে দুররানির মৃত্যু হয়। তার পুত্র তৈমুর শাহ দুররানি তার স্থলাভিষিক্ত হন। এই সময় থেকে আফগানিস্তান প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর কাছে অনেক অঞ্চল হারাতে শুরু করে। ১৭৯৩ সালে তৈমুরের মৃত্যুর পর তার পুত্র জামান শাহ দুররানি ক্ষমতায় আসেন। এরপর ধারাবাহিকভাবে মাহমুদ শাহ দুররানি, সুজা শাহ ও অন্যরা সিংহাসনে আরোহণ করেন।
তালেবানের উত্থান, চালায় ধ্বংসযজ্ঞ
১৯৭৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিক। আফগানিস্তানের কমিউনিস্ট সরকারকে রক্ষা করতে সে দেশে ঢুকে পড়ল সোভিয়েত সেনাবাহিনী। মস্কো তখন বলেছিল, সোভিয়েত সৈন্যরা ছয় মাস থাকবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে দেশে সোভিয়েত সৈন্যরা ছিল দীর্ঘ ১০ বছর এবং আফগানিস্তান পরিণত হয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের ভিয়েতনামে। সে যুদ্ধের মাঝে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল তার বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠল আফগানিস্তান। আফগানিস্তানের সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ভিতর দিয়েই জন্ম হয়েছিল তালেবান এবং আল-কায়েদার মতো জিহাদি বাহিনীগুলোর। তখন থেকে আফগানিস্তানে সশস্ত্র সংগঠনগুলো ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমে উঠেপড়ে লাগে। সে সময় তারা নৃশংস ধর্মান্ধতা চাপিয়ে আফগানিস্তানকে পেছনের যুগে ঠেলে দেয়। তখন ওই মুজাহিদিন তথা তালেবান যোদ্ধারা ইসলামী শাসনের নামে মহিলাদের বাড়িতে আটকে রাখে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। আপদমস্তক বোরকা পরতে বাধ্য করে এমনকি বিনোদনমূলক কর্মকান্ডও বন্ধ করে দেয়। কেউ এসব কাজে জড়ালে তাকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হয়। তখন তারা আফগানিস্তানজুড়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ধ্বংসযজ্ঞ চালায় দেশটির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। ধুলিসাৎ হয় মানবতা। লিঙ্গ বৈষম্যের সূচকে আফগানিস্তানে এক নম্বরে চলে যায়।
আফগানিস্তানে বারবার দখলদারদের পতন
আফগানিস্তানের ইতিহাস থেকে জানা যায় দেশটির ইতিহাস, সাধারণ মানুষ আর ঐতিহ্যের কথা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিকে বারবারই হতে হয়েছে বিদেশি পরাশক্তিগুলোর হামলার শিকার। খ্রিস্টপূর্ব থেকে আজকের আফগানিস্তান, কালে কালে অন্য দেশের সম্রাট ও রাজাদের আক্রমণে জর্জরিত। বহু সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন দেখেছে আফগান। প্রাচীনকাল থেকে এসব হামলার বর্ণনা পাওয়া যায় ইতিহাসবিদদের লেখনী এবং পুরাতত্ত্ববিদদের নানা পরীক্ষায়। প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধকে (১৮৩৮-১৮৪২) আফগানিস্তানের দীর্ঘ ইতিহাসের একটি অশ্রুসিক্ত অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৮৩৮ সালে ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল জর্জ ইডেন (লর্ড অকল্যান্ড) সিমলা মেনিফেস্টো ঘোষণার মাধ্যমে আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আক্রমণের কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল ভারতীয় ভূখন্ডকে আফগানিস্তান ও তার মিত্রদের থেকে রক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু ব্রিটিশরা কাবুলের শাসক দোস্ত মোহাম্মদ খান ও তার সহযোগীদের সরাতে চেয়েছিল। আরও পরিষ্কার করে বললে প্রাক্তন আফগান বাদশাহ শাহ শুজা দুররানি এবং দেশটির প্রতিষ্ঠাতা আহমদ শাহ দুররানির নাতিকে কাবুলের শাসনভার দিতে চেয়েছিল ব্রিটিশরা। তবে পরবর্তীকালে সার্বভৌমত্ব রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে আফগানরা ব্রিটিশ ও রাশিয়ানদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে। এরপর ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান আক্রমণ করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। বলা হয়, আফগানিস্তানের সেই যুদ্ধই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার জন্য অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। এরপর ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার পর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তালেবান সরকারকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলেছিল। কিন্তু সেবারও তালেবান ওই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। এর উপযুক্ত জবাব দিতে আফগানিস্তানে অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বাহিনী। পরের কয়েক মাসে আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী বাহিনী ‘দ্য নর্দান অ্যালায়েন্স’ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাহিনীর সহায়তায় কাবুলে হামলা চালিয়ে তালেবান সরকারকে উৎখাত করে। যদিও সে যুদ্ধ থেমে থাকেনি, চলেছে দীর্ঘ ২০ বছর। যুদ্ধে মূল টার্গেট তালেবান এবং আলকায়েদা হলেও দীর্ঘ সময়ের যুদ্ধে প্রাণ হারায় লাখ লাখ সাধারণ আফগান নাগরিক। ব্রিটিশদের পুতুল সরকার প্রধান ‘শাহ শুজা’ পরবর্তী সব বিদেশি সরকারের মনোনীত শাসকের পরিচয় হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ১৯৮০ দশকে সোভিয়েত মনোনীত বাবরাক কারমাল আফগানদের কাছে ‘শাহ শুজা দ্য সেকেন্ড’ নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তী সময় শতাব্দীর শুরু অর্থাৎ ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান আক্রমণ করে তাদের মনোনীত হামিদ কারজাইকে ক্ষমতা প্রদান করে। হামিদ কারজাই পরিচিত ছিল ‘শাহ শুজা দ্য থার্ড’ নামে।
আফগানিস্তানের মাটিতে মার্কিন সেনাদের দুই দশক
টুইন টাওয়ার ধ্বংসের জেরে ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রবাহিনী আফগানিস্তানে হামলা চালায়। প্রথমে তালেবানরা মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হতে চললেও ২০০৪-২০০৫ সাল থেকেই তালেবান নামক সংগঠনটি পুনরায় সংগঠিত হয়। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি মার্কিন সেনা ও আফগান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আসছে। এই যুদ্ধের বলি হতে হয়েছে অগণিত সাধারণ মানুষকে। দুই দশক ধরে চলা দীর্ঘ যুদ্ধের পুরোটা সময় মার্কিন সৈন্যদের তালেবান ও আলকায়েদাকে মোকাবিলা করেই থাকতে হয়েছে। গত এপ্রিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ঘোষণা দিয়েছিলেন ৩১ আগস্টের মধ্যে তথা নাইন-ইলেভেন দিবসের আগেই সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবেন। ঘোষণা অনুযায়ী, ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। আফগান যুদ্ধে দেশটি তাদের হাজার হাজার সৈন্য হারিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশটি আফগানিস্তান থেকে তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নেয়। যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের এই দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষকদের সন্তুষ্ট করতে পারেনি। আলকায়েদা এবং ওসামা বিন লাদেন যদি মার্কিনিদের উদ্দেশ্য হয়, তবে দুটো লক্ষ্য ১০ বছর আগে অর্জিত হয়েছে। তাহলে এতদিন পর কেন সেনা প্রত্যাহার করল? বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আক্ষরিক অর্থেই আফগানিস্তানে পশ্চিমা পরাশক্তি ঘেঁষা একটি শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে চেয়েছিলেন। যা অনেকটা ঔপনিবেসিক আমলের মতো। কিন্তু সে উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যর্থ হওয়ায় এবং আপাতত সে লক্ষ্য পূরণের ন্যূনতম সম্ভাবনা না থাকায় এক রকম হতাশা থেকেই যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান তাদের সৈন্য প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যদিও মার্কিন দেশে সেনা প্রত্যাহারের দাবিতে মহিলাদের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দীর্ঘদিন ধরেই দানা বাঁধছিল। এমনকী প্রকাশ্যে বিক্ষোাভও প্রদর্শন করেছে মার্কিন নাগরিকরা। দেশের ৫০টি প্রদেশেই এই মর্মে বিক্ষোকভ হয়েছে। ভিতরের চাপ ও আফগানিস্তানে পিছু হঠা দুই-এর ফলেই এই প্রত্যাবর্তনকে ত্বরান্বিত করেছে।
তালেবান কারা?
১৯৮৯ সাল, আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া) সৈন্য প্রত্যাহারের পর যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়, সেই যুদ্ধেই তালেবান গোষ্ঠীর উত্থান। দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল ও পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় ছিল তাদের দাপট। সংগঠনটি (তালেবান) আফগানিস্তানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তবে সংগঠনটি একই সঙ্গে আফগানিস্তানে ইসলামী অনুশাসনও চালু করে। ১৯৯৮ সাল নাগাদ তারা আফগানিস্তানের প্রায় পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ নেয়। তারা ইসলামী শরিয়া শাসনের পাশাপাশি চালু করে নিষ্ঠুর শাস্তির প্রচলন। পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং মেয়েদের বোরকা পরতে বাধ্য করা হয়। সে সময় থেকে নিষিদ্ধ করা হয় টিভি, সংগীত এবং সিনেমা। আফগানিস্তানের ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর তারা পাকিস্তানের সীমান্ত এলাকায় নতুন করে সংগঠিত হয়। তাদের প্রায় ৮৫ হাজার সশস্ত্র যোদ্ধা আছে বলে মনে করা হয়। ২০০১ সালের পর তারা এখন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থায় আছে।
ইসলামী রাষ্ট্রের নামে ধ্বংসযজ্ঞ
যুক্তরাষ্ট্র তাদের দীর্ঘতম যুদ্ধের সমাপ্তি টেনে আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিয়েছে। দেশটি তাদের হাজার হাজার সেনা হারিয়েছে। এ ছাড়াও লাখ লাখ আফগান সেনা এবং বেসামরিক নাগরিকের মৃত্যু পর্যবেক্ষণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান যুদ্ধে ২ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি ব্যয় করেছে। তবে এতে আফগানিস্তানের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেনি। বরং পরিস্থিতি ক্রমেই আরও খারাপ হতে চলেছে। দেশটিতে মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে উঠেছে তালেবান সশস্ত্র গোষ্ঠী। ধর্মের নামে তারা প্রাচীন স্থাপনা ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারী এবং তাদের উপাসনালয় ধ্বংস করে চলেছে। আজকের সাধারণ আফগানদের জীবন ২০০১ সালের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপত্তাহীন। ২০০১ সালে যখন দেশটিতে মার্কিন সেনা মোতায়েন শুরু হয়, তখনকার তুলনায় গত বছর নাগরিক হতাহত প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি দেখা গেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সহিংসতা অনেক বেড়েছে। আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর মনোবল ভেঙে দিতে সামরিক হামলা নিয়ে ব্যাপক প্রোপাগান্ডা চালাচ্ছে তালেবান। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও আফগান কর্মকর্তাদের মতে, তালেবানের ইতিহাসে শুধুই বর্বরতা। ইসলামী শাসন কায়েমের নামে মানুষ হত্যা, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে হামলা, প্রাচীন স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়াসহ নানা অপরাধমূলক কাজ করে চলেছে দেশটির সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী। আফগানিস্তানের কর্মকর্তারা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলোকে জানিয়েছে, তালেবানরা ক্ষমতায় এলে তাদের পূর্ববর্তী শাসনামলের মতোই তারা নৃশংস ধর্মান্ধতা চাপিয়ে আফগানিস্তানকে আবার কয়েক যুগ পেছনে ঠেলে দেবে। তালেবানরা ইসলামী শাসনের নামে মহিলাদের বাড়িতে আটকে রাখবে, স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেবে এবং ভুল পোশাক পরিধান বা ভুল সংগীত শোনার মতো পাপের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করবে। অসুস্থ এমনকী মৃত্যুপথযাত্রীরা চিকিৎসার জন্যও প্রতিবেশী, জানা শোনা পরপুরুষের সঙ্গে যেতে পারবে না। তাতে বিনা চিকিৎসায় ধুকে ধুকে ঘরের মধ্যে অকালে মৃত্যবরণ করতে হবে।
তালেবান এখনো কীভাবে শক্তিশালী?
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও আফগানিস্তানের কর্মকর্তাদের মতে, তালেবান যেভাবে আফগান শহর দখল করছে, তাতে ভবিষ্যৎ বিশ্ব বেশ হুমকির মুখে রয়েছে। আর তালেবান গোষ্ঠীর শক্তির উৎস সম্পর্কে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে অজানা। রাষ্ট্রসংঘের পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তালেবানের অর্থের উৎস অস্পষ্ট। রাষ্ট্রসংঘ পর্যবেক্ষকদের ধারণা, তালেবানের বার্ষিক আয় ৩০ কোটি থেকে ১৫০ কোটি ডলার হতে পারে। তাদের আয়ের বড় অংশ আসে মাদক ব্যবসা থেকে। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড এবং দখল করা এলাকা থেকে কর আদায়ের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে তারা। আবার তালেবানের শক্তিমত্তা সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি। তবে গত বছর রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের পর্যবেক্ষকরা বলেন, সশস্ত্র সংগঠনটির ৫৫ থেকে ৮৫ হাজার যোদ্ধা রয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলের পর্যবেক্ষকদের মতে, এখন পর্যন্ত যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে তাতে স্পষ্ট যে, জনবল, অর্থ, অস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহের জন্য তালেবানকে বেগ পেতে হয় না। অভিযোগ রয়েছে, পাকিস্তান, ইরান, তুর্কি, চিন ও রাশিয়া তালেবানকে রসদ ও পরামর্শ দিচ্ছে। তবে এই দেশগুলি এইসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
আফিগানিস্তান মানেই যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অভিশপ্ত পশ্চাদপদ এক জনপদ
‘আফগানিস্তান’ মানেই কয়েক গত প্রজন্মের কাছে এক যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অভিশপ্ত জনপদ। অগুণতি পাহাড়ে ভরা প্রাচীন এ জনপদের নাম নিতেই দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে- জনপ্রতি গড়ে বিশ কেজি করে বোমা ঢালছে মার্কিন বাহিনী। আয়তনে বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ছয় গুণ বড় আফগানিস্তানকে ঘিরে রয়েছে পাকিস্তান, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান।ইরান এবং তুর্কমেনিস্তান বিশ্বের অন্যতম তেল সমৃদ্ধ দেশ।
‘ডুরান্ড লাইন’ এর কথা সকলেরই জানা। এ কৃত্রিম রেখার মাধ্যমে ব্রিটিশ ভারতকে আফগানিস্তান থেকে আলাদা করা হয়েছিল। আফগানিস্তানের বেশ কিছু অংশ ব্রিটিশ ভারতের ভাগে নেওয়া হয়েছিল (এখন যেটি পাকিস্তানের ভাগে)। এ লাইনের বিশেষত্ব হচ্ছে, আরব সাগরে যেতে হলে আফগানিস্তানকে এ লাইন পেরিয়ে ব্রিটিশ ভারতের উপর দিয়ে যেতে হত (দেশ ভাগের পর পাকিস্তানের উপর দিয়ে)। ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অংশ নিতে আফগানদের আবশ্যিকভাবেই এ দেশের মুখাপেক্ষী (তখনকার ব্রিটিশ ভারত আর এখনকার পাকিস্তান) হতে হতো। কঠিনতম বিকল্প ছিল ইরানের বন্দর ব্যবহার করা। যেটির জন্য পাড়ি দিতে হতো বহুদূরের পথ। এদিকে ১৯৫১ সালে মোসাদ্দেক ইরানের প্রথম নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে ক্ষমতায় এসেই দেশটির তেলক্ষেত্রগুলোর জাতীয়করণ করেন। ওদিকে ব্রিটিশরা ভারত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিলেও, বিশ্ব বাণিজ্যে তখনও দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল। মোসাদ্দেকের এ জাতীয়করণে বিপাকে পড়ে বৃহৎ তেল কোম্পানি ব্রিটিশ কর্পোরেশন। ইরানের প্রায় আড়াই লাখ বর্গমাইল এলাকা ছিল এ তেল কোম্পানির অধীনে। ১৯৪১ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ইরান থেকে এই কোম্পানি অপরিশোধিত তেল রপ্তানি করেছে ৬২ দশমিক ৪০ কোটি টন। বিনিময়ে ইরান পেয়েছে ৪২ কোটি ডলার এবং ব্রিটিশ কোম্পানি সব বাদ দিয়ে মুনাফা করেছে ৫০০ কোটি ডলার! মোসাদ্দেক সমস্ত তেলক্ষেত্র রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে নিলে, থলের বেড়ালের সন্ধান পায় আশেপাশের দেশগুলোও। বাহারিনের দাবি উঠে ব্রিটিশ-আমেরিকান কোম্পানিকে হটিয়ে তেলক্ষেত্র জাতীয়করণের, দাবি উঠে মিশরেও। এর মধ্যে মিশরে ক্ষমতায় আসেন আবদুল নাসের এবং সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করে ফেলেন। স্বাভাবিকভাবেই ব্রিটিশদের বিশ্ব বাণিজ্য নকশা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে মরীয়া ব্রিটিশরা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মিলে মাত্র দুই বছরের মাথায় সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেককে সরিয়ে ইরানের ক্ষমতায় নিয়ে আসে জেনারেল ফয়জ উল্লাহ জাহেদিকে। আফগানিস্তানের একদিকে ইরানের সাথে এক হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত। অন্য দিকে পাকিস্তানের সাথে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত। উল্লেখিত সামরিক অভ্যুত্থান পরবর্তী ইরানের জাহেদি সরকার এবং পাকিস্তানের জিয়া-উল হক সরকার দুটোই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সহায়ক এবং সহযোগী শক্তি হিসেবে ধরা দেয়। স্বাভাবিকভাবে রাজনীতিতে চাপে পড়ে যায় আফগানিস্তান। উল্লেখ্য, আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম সীমান্ত যোগাযোগ তাজিকিস্তানের সাথে, যেটি তখন সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত। সোভিয়েতের প্রভাব ছিল ইরাকে এবং আফগানিস্তানে। তখন শোলা, পরচাম এবং খালক- এ তিন নামে তিনটি বামপন্থি গ্রুপ আফগান রাজনীতিতে সক্রিয় ছিল। যার মধ্যে শক্তিশালী পরচাম গ্রুপের হাত ধরে প্রিন্স দাউদ আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন ১৯৭৩ সালে। দাউদ ক্ষমতায় এসে ভূমি সংস্কার সহ বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ নেন। তবে নানামুখী আন্তর্জাতিক রাজনীতির খেলায় পরচাম গ্রুপের অনেককেই সরকার থেকে সরিয়ে দেয়। এর পাশাপাশি ইরানের রাজা মোহাম্মদ রেজা শাহ্-র গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক (SAVAK) এর মাধ্যমে দাউদ এর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ গড়ে উঠে শাহ্ এর সাথে। যে সম্পর্ক পরে সিআইএ-র দুয়ার পর্যন্ত গড়ায়।
১৯৭৮ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের (সউর বিপ্লব/Saur Revolution) মাধ্যমে দাউদকে হটিয়ে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় বসেন অন্য বামপন্থি গ্রুপ খালকের সভাপতি তারাকি। যিনি ক্ষমতায় এসে নিজেকে জাতীয়তাবাদী এবং বিপ্লবী হিসেবে দাবি করেন। ইরান কিংবা পাকিস্তান থেকে দূরত্ব বজায় রাখার কঠিন নীতিতে অগ্রসর হতে থাকেন তারাকি। যুক্তরাষ্ট্রের তখন মাথায় হাত। ইরানের মাধ্যমে সদ্য দাউদকে বশে এনেছিল মার্কিনিরা, সেটি ভেস্তে যাবার উপক্রম হয়। দ্রুত পরিবর্তিত আফগানিস্তানে নিজেদের ছক বাস্তবায়নে তারাকি সরকারকে নিয়ে পশ্চিমা মাধ্যমে প্রচারণা শুরু করা হয়- এরা নাস্তিক, ধর্মবিরোধী, সোভিয়েত অনুচর। প্রসঙ্গত, আফগানিস্তানের শিক্ষার হার তখন ১০ শতাংশের মতো এবং মানুষের গড় আয়ু ৪০ বছরের নিচে, স্থাবর জমির অধিকাংশই ছিল মুষ্টিমেয় মানুষের মালিকানাধীন, যারা মূলত রাজনীতি এবং ধর্মীয় দল ও উপদলগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো।কঠোর ভূমি সংস্কার আইন বাস্তবায়নের ফলে সেসব ভূ-স্বামীর স্বার্থে আঘাত আসে এবং উপরোক্ত পশ্চিমা প্রচারণায় দেশিয় এজেন্টের ভূমিকা পালনে নামে এরা, সাথে জোটে ধর্মীয় গ্রুপগুলো।
ঘটনা থেমে থাকেনি। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইরানে ঘটে যায় খোমেনির ইসলামী বিপ্লব এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন আগ বাড়িয়ে আফগানিস্তানে ঢুকে পড়ে একই বছরের ডিসেম্বরে। সামনে আসে বিপ্লবের আফগান মডেল! এদিকে ভূরাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ আফগান ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিতে এবং সোভিয়েতকে তার ‘ভিয়েতনাম’ ফেরত দিয়ে উচিত শিক্ষা দিতে মার্কিনীরা রাজনীতির ছকে পরিবর্তন আনে। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ায় প্রভাব বজায় রাখতে এবং সোভিয়েতকে পেছনে ঠেলে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের দরকার ছিল, হয় ইরানের নিয়ন্ত্রণ অথবা আফগানিস্তানের। ইরানের ইসলামী বিপ্লব সেই ছক বাস্তবায়নে প্রাচীর হয়ে দাঁড়ালেও, আফগানিস্তানে সোভিয়েতের প্রবেশ ‘শাপে বর’ হয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য।
এদিকে ‘সউর’ বিপ্লবের পর আফগানিস্তানে জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থানে সব ইসলামপন্থিরা ‘ডুরান্ড লাইনে’র ওপারে পাকিস্তানে আশ্রয় নিতে চাইলে জিয়া-উল হক সরকার তাতে সাহায্যের হাত বাড়ায় নানান সমীকরণে। প্রথমত, আফগানিস্তানে জাতীয়তাবাদী শক্তির উত্থান পাকিস্তানকে শঙ্কিত করে ১৯৭১ এর বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে। দ্বিতীয়ত, ভূট্টোকে ফাঁসি দেওয়া এবং ৫৪ জন ভারতীয় যুদ্ধবন্দিকে জেনিভা কনভেনশন অনুসারে ফেরত না দিয়ে রেড ক্রস থেকে লুকিয়ে কারাগার থেকে সরিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়াসহ নানা মানবাধিকার ইস্যুতে পাকিস্তান তখন মারাত্মক চাপের মুখে ছিল। মার্কিনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাহায্য কমে গিয়েছিল উল্লেখযোগ্যভাবে। কিন্তু আফগান ইস্যুতে মার্কিন প্রশাসন বহুগুণ উৎসাহ নিয়ে পাকিস্তানে সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য বাড়িয়ে দেয় এই শর্তে যে, আফগান ‘মুজাহিদিন’ দলকে সব ধরনের সাহায্য করতে হবে। মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণের ঘাঁটি গড়ে উঠে পাকিস্তানে। সারা বিশ্ব থেকে উগ্র ইসলামপন্থিদের জড়ো করা শুরু হয় সেসব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। সৌদি আরব, আলজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মিশর থেকে শুধু নয়, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনের মতো উন্নত বিশ্ব থেকেও মুজাহিদিনদের সাথে যোগ দিয়েছিল, সেসব দেশের সংখ্যালঘু মুসলিমরা। পাঠকের মনে থাকবে বাংলাদেশ থেকেও অনেকে সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। ভারতের কেউ কেউ সেই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিল জিহাদি হিসাবে।
জিহাদের জন্য বিশ্ব মুসলিম জনগোষ্ঠীকে প্রলুব্ধ করার মিশনে সবচেয়ে আলোচিত প্যালেস্টাইনি নাগরিক শেখ আজ্জাম, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামী আইনে ডক্টরেট করে কিং আবদুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় যুক্ত ছিলেন তখন। সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আজ্জামের একজন ছাত্র হচ্ছেন ওসামা বিন লাদেন। লাদেন ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক করেছেন। উদ্দেশ্য ছিল- ধনকুবের বাবার নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের দেখভাল করবেন। পাঠক নিশ্চয়ই জানেন যে, লাদেন পরিবার হার্ভার্ড ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর অর্থ অনুদান দিয়েছে শিক্ষা ও গবেষণা খাতে। কিন্তু আজ্জামের দীক্ষা লাদেনকে শিক্ষা গবেষণায় অর্থ দেওয়ার চেয়েও জিহাদে মনোযোগী হতে প্রলুব্ধ করতে থাকে। পাকিস্তানি সাংবাদিক রশিদ আহমেদের বক্তব্য অনুসারে, লাদেন প্রথম পেশওয়ারে আসেন ১৯৮০ সালে এবং এরপর থেকে নিয়মিত অর্থ সাহায্য নিয়ে হার্ভার্ড নয়, যাওয়া শুরু করেন আফগানিস্তানে।
এরমধ্যে, লাদেনের ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে সিআইএ-র মনোযোগ যায় তার দিকে। ১৯৮৬ সালে সিআইএ-র অর্থায়নে একটি বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়নে পরিকল্পিতভাবেই ঠিকাদার হিসেবে নিযুক্ত হন ওসামা বিন লাদেন। প্রকল্প ছিল পাকিস্তানের সীমান্তঘেরা খোস্ত এলাকায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা। ওই পাহাড়ি সুড়ঙ্গই মুজাহিদিনদের অস্ত্র রাখার প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে, ব্যবহৃত হয়েছে যুদ্ধে আহতদের চিকিৎসার কাজে এবং সামরিক প্রশিক্ষণের কাজেও। এ প্রকল্পের সমস্ত অর্থ ঢেলেছে সিআইএ এবং একইসাথে প্রকাশ্যে মুজাহিদিনদের সামরিক কিংবা অর্থনৈতিক সাহায্য জুগিয়ে গিয়েছে। সোভিযেত বাহিনীর আকাশ পথে হামলা প্রতিহত করার জন্য পিঠে বহনকারী অ্যান্টি এয়ারক্রাফ্ট মিসাইল ‘স্টিংগার’ ক্ষে পনাস্ত্র সরবরাহ বাড়িয়ে দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৫ সালে প্রেসিডেন্ট রেগান হোয়াইট হাউজে একদল আফগান যোদ্ধাকে টেলিভিশনে পরিচয় করিয়ে দেন এই বলে যে, নৈতিক মানদণ্ডে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জনকদের সঙ্গে এই ভদ্রলোকদের কোনও তফাত নেই!
কিন্তু, শেখ আজ্জামের শিষ্য হিসেবে সিআইএ-র ছকে আফগানে লাদেনের প্রবেশ ঘটলেও, আফগান যুদ্ধের শেষ দিকে এসে দুজনের চিন্তায় ফারাক ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠে। লাদেন চেয়েছিলেন এ জিহাদের দাবানল বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। এমন কি সৌদি আরব বা মিশরেও জিহাদের কথা ভেবেছিলেন লাদেন। কিন্তু আফগান জিহাদের মূল সেনানায়ক আজ্জাম চাননি কোনও মুসলিম দেশে জিহাদ করতে।
১৯৮৯ সালের শেষ দিকে খোস্ত শহরে জিহাদের ভবিষ্যৎ ঠিক করতে একটা বৈঠক হয়। সে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জামাল আল ফদল নামের সুদানের এক ব্যক্তি। যিনি পরে পূর্ব আফ্রিকার একাধিক মার্কিন দূতাবাসে বোমা বিস্ফোরণের মামলায় আটক হন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আল ফদল জানান, সে বৈঠকেই আফগান সীমান্তের বাইরে জিহাদ চালিয়ে যাওয়ার জন্য একটি নতুন সংগঠন তৈরি করা হয়েছিল- যার নাম ‘আল-কায়দা’। উল্লেখ্য লাদেনের সাথে আজ্জামের দ্বন্দ্বের মাঝেই পেশোয়ারে একটি মসজিদে যাওয়ার পথে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন আজ্জাম।
কোটি কোটি ডলারের সে খেলায় লাখ লাখ জিহাদিতে গড়ে উঠলো মুজাহিদিন বাহিনী, লড়ে গেল অনুপ্রবেশকারী সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে। ভিয়েতনামে মার্কিনিরা নিজের সেনা পাঠিয়ে যে ভুল করেছিল, সেই একই ধরনের ভুল এবার করে বসলো সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেনা পাঠিয়ে আটকে গেল আফগানিস্তানে। যুক্তরাষ্ট্র সে ভুলের সুযোগ নিয়েছে পুরোপুরি, কিন্তু নিজে যুক্ত হয়নি সরাসরি।
এর মধ্যে বিশ্ব রাজনীতিতে ‘শীতল যুদ্ধ’ যবনিকার দিকে এগোতে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নে পেরিস্ত্রৈকা ও গ্লাসনস্ত কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরু হয় এবং ইউনিয়ন ভাঙনের দিকে এগোতে থাকে। সে বাস্তবতায় ১৯৮৮ সালে এক চুক্তির আলোকে আফগানিস্তান থেকে ১৯৮৯ সাল নাগাদ সেনা প্রত্যাহার করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। পরে সোভিয়েতও ভেঙে যায় ১৯৯০ সালের দিকে। আফগানিস্তান চলে যায় মুজাহিদিনদের দখলে। আফগান সভ্যতাকে আরো খানিক পেছনে ঠেসে দিয়ে সারা বিশ্ব থেকে জড়ো হওয়া কথিত জিহাদিরা এরপর ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। বিচ্ছিন্নভাবে বিশ্বের নানান প্রান্তে কথিত জিহাদেরও চেষ্টা করে। এরই মধ্যে মুজাহিদিনের জঠরে সৃষ্ট লাদেনের আল-কায়দা ২০০১ সালে হামলা চালায় টুইন টাওয়ারে। রেগানের আফগানিস্তান রণনীতি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বুমেরাং হয়ে পড়লে, বুশ প্রশাসনও রেগানের কৌশল থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যায়। সরাসরি যুদ্ধে না জড়ানোর কৌশল থেকে সরে এককেন্দ্রিক বিশ্বে আফগানিস্তানে হামলা করতে দুইবার ভাবতে হয়নি যুক্তরাষ্ট্রকে। ‘জিহাদি’দের জড়ো করে সোভিয়েতকে শিক্ষা দেয়ার পালা শেষে, ‘বড্ড বাড় বেড়ে যাওয়া’ আফগানিস্তানকেও ‘উচিত শিক্ষা’ দিয়ে ছেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ইত্যবসরে লিবিয়াকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতেও ভাবতে হয়নি যুক্তরাষ্ট্রকে। ভাবতে হয়নি সাদ্দামের ইরাককে ধ্বসিয়ে দিতেও। এতো শত জমজমাট খেলা শেষে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারে চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রত্যাহার পর্ব শেষ। কায়েম হয়েছে তালেবান রাজ।
ভূ-রাজনীতির কারণে যে আফগানিস্তানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিক থেকে লড়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র, সেই ভু-রাজনীতির অপরাজিত অধিপতি এখন যুক্তরাষ্ট্রই। অর্থনীতিতেও। সেই সূত্রে আফগানের মূল প্রাকৃতিক সম্পদ তেল এবং গ্যাস নিয়ন্ত্রণ করছে ইনোকল কর্পোরেশন, পাশের দেশ সাবেক সোভিয়েত-ভুক্ত তাজিকিস্তানের তেল গ্যাসের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশ কোম্পানি টেথিস পেট্রোলিয়াম লিমিটেডের হাতে, মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে আছে ব্রিটিশ পেট্রোলিয়াম। ফলে অর্থনৈতিক যে হিসাব থেকে আফগানিস্তানে আধিপত্য জরুরী ছিল সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘বিজয়ীর’ অনুকূলে। তাই আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী হচ্ছে সেটি নিয়ে মিছে চিন্তিত হবার বিলাসিতা ততক্ষণ অন্তত যুক্তরাষ্ট্রের নেই, যতক্ষণ না সেটি তার নিজের জন্য হুমকির কারণ হচ্ছে। কিন্তু আফগানি সাধারণ নাগরিকের দেখার পালা, কী তাদের জন্য অপেক্ষা করছে বিশ্ব রাজনীতির পরিত্যক্ত এ খেলার মাঠে! তাহলে এবার কি চিনের পালা…

যুদ্ধে ধ্বংস ঐতিহাসিক স্থাপনা
মাত্র কয়েক দিন আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে নিজের ও ন্যাটো বাহিনী সরিয়ে নিয়েছে। এরই মধ্যে আফগানিস্তানের ২৯টি প্রদেশের ১১৬টি জেলা নিজেদের দখলে নিয়েছে তালেবান। দেশটির এক সরকারি কর্মকর্তা দাবি করেছে, ১১৬টি জেলা দখল করার সময় তালেবান ধ্বংস করেছে নানা সরকারি স্থাপনা। বাজার মূল্য হিসেবে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ কোটি ডলার। তালেবানের নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর ২৬০টি সরকারি ভবন সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে সশস্ত্র গোষ্ঠীটি। ২০০১ সালে মার্কিন-নেতৃত্বাধীন বাহিনীর আক্রমণের পরও বেপেরোয়া হয়ে উঠেছিল তালেবান বাহিনী। সে সময়ও তারা একের পর এক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল দেশটির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। আফগানিস্তানের গৌরবোজ্জ্বল অতীত এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের নীরব সাক্ষী যেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বুদ্ধের মূর্তি দুটি। ষষ্ঠ শতাব্দীতে বৌদ্ধদের অন্যতম কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয় এই বামিয়ান। কয়েক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর বসবাস ছিল তখন এই উপত্যকায়। আফগানিস্তানের এই বৌদ্ধ মন্দিরটিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের স্বীকৃতি দিয়েছিল ইউনেস্কো। ২০০১ সালে হামলা চালিয়ে এটি প্রায় ধ্বংস করে দেয় তালেবান বাহিনী। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত আফগানিস্তানের ইসলামিক এবং প্রাক-ইসলামিক বহু স্থাপনা ধ্বংসের খেলায় মেতেছে তালেবান বাহিনী। প্রথম অ্যাংলো-আফগান, দ্বিতীয় সোভিয়েত-আফগান এবং তৃতীয় যুক্তরাষ্ট্র-আফগান যুদ্ধে দেশটির বহু প্রাচীন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর থেকে আফগান সরকার ও তালেবানের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র আকার ধারণ করেছিল। আফগানিস্তানের প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা বলছে, ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে আফগানিস্তানের প্রাচীন ঐহিত্য। তালেবান পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে এখন সব প্রাচীন ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে ধ্বংস করে দেওয়ার খেলায় মেতে উঠেছে।
বিশ্বজুড়ে আফগান শরণার্থীদের ঢল
রাষ্ট্রসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৮ সালে বিশ্বে গড়ে প্রতিদিন ৩৫ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এতে প্রতি দুই সেকেন্ডে বাস্তুচ্যুত হয়েছে একজন। সব মিলিয়ে বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ১০ লাখ, যা এ যাবৎকালের রেকর্ড। রাষ্ট্রসংঘ বলছে, এসব শরণার্থীদের মধ্যে আফগান নাগরিকই বেশি। ১৯৭৯ সালের সোভিয়েত ও আফগান বড় ধরনের সেই লড়াইয়ে ২৮ লাখ আফগান পাকিস্তানে এবং ১৫ লাখ আফগান ইরানে পালিয়ে আশ্রয় নেয়। ১০ বছর ধরে চলা সেই যুদ্ধ শেষে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বিদায় নেয়। এরপর কেটে যায় আরও ১০ বছর। টুইন টাওয়ারে হামলার জের ধরে যুক্তরাষ্ট্র ২০০১ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের উৎখাতের পর ২৫ লাখেরও বেশি মানুষ দেশে ফিরে গেছে। তবে পরিসংখ্যান বলছে, এখনো প্রায় ২০ লাখের বেশি আফগান নাগরিক পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের শরণার্থী শিবিরে জীবনযাপন করছে। বর্তমান সহিংসতার কারণে যাদের অনেকেই দেশে ফেরার ক্ষেত্রে খুব একটা আগ্রহী নয়। আর কবে বা ফিরবে। নতুন করে দেশছাড়ার হিড়িক শুরু হয়েছে। বিশ্বে উদ্বাস্তু মিছিলে আফগানিস্তান রোহিঙ্গাদের পিছনে ফেলে ক্রমশ এগোচ্ছে।