Breaking
11 Apr 2025, Fri

নক্ষত্র পতন: চলেগেলেন ‘জনপ্রিয়’ সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ, লিখছেন শোভনলাল রাহা

সাহিত্য জগতে ফের ইন্দ্রপতন।

প্রাক ইন্টারনেট যুগে যা কিছু নিষিদ্ধ, যা কিছু বাঙালি কুণ্ঠাভরে উচ্চারণ করত- সেই সব কিছুকে সাহিত্যের ভাষায় সাবলকত্বের আবীর মাখিয়ে প্রকাশ করে কোটি কোটি পাঠকের মন চুরি করে নেওয়া সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ চলে গেলেন।
রবিবার রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি৷ মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর ৷

কয়েক মাস আগেই করোনা কেড়েছে কবি শঙ্খ ঘোষকে। দিন কয়েক আগে প্রয়াত হয়েছেন বাচিকশিল্পী গৌরি ঘোষও। এ বার বুদ্ধদেব গুহ। শিল্পীমহলের মন ভাল নেই আজ। কাঁদছেন তাঁর অসংখ্য ভক্তকুল।
হাসপাতাল সূত্রে খবর, হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে বুদ্ধদেব গুহ’র।
কলকাতার এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিত্‍সাধীন ছিলেন তিনি। সেখানেই রবিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ প্রাণহানি হয় তাঁর। সাহিত্যিকের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ সংস্কৃতি জগত্‍।

দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। হাসপাতাল সূত্রে খবর, শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যার পাশাপাশি বুদ্ধদেবের মূত্রনালীতে সংক্রমণ ধরা পড়েছিল। এ ছাড়া তাঁর লিভার এবং কিডনিতেও সামান্য সমস্যা ছিল বলে জানিয়েছিলেন চিকিত্‍সকেরা। ফের কোভিড পরীক্ষাও করা হয়েছিল। তবে তাতে সংক্রমণ ধরা প়ড়েনি। দৃষ্টিশক্তির সমস্যায় ভোগা বুদ্ধদেব বয়সজনিত নানা সমস্যাতেও ভুগছিলেন।

গত এপ্রিল মাসে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। শঙ্কার মেঘ দেখা দিয়েছিল বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য অনুরাগীর মধ্যে। মৃত্যুর গুজবও রটেছিল বেশ কয়েকবার। কিন্তু সে সব গুজব নস্যাত্‍ করে প্রায় ৩৩ দিন হাসপাতালে কাটিয়ে করোনাকে জয় করে বাড়ি ফিরেছিলেন তিনি। সগর্বে ঘোষণা করেছিলেন ‘এখনই ফুরব না’। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিল তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠকরা। কোভিড ও নিউমোনিয়াকে হারিয়ে বালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে সানি টাওয়ারে ফিরলেন তিনি। সেখানেই তাঁর ফ্ল্যাট। বিগত বহু বছর ধরে এখানেই থাকেন লেখক। সহধর্মিণী গায়িকা ঋতু গুহ মারা গিয়েছেন কবেই। তবু প্রতিটা ঘরের অন্দরে ঋতু গুহর উপস্থিতি! শ্বাসকষ্ট বাড়লে তাঁকে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রথম দিয়ে লেখকের শারীরিক পরিস্থিতি খারাপ হলেও পরে ধীরে ধীরে উন্নতি হয়। চিকিত্‍সাধীন থাকার সময় মন খুলে গানও গেয়েছেন বুদ্ধেদেব গুহ। এবার তিনি মনের জোরে বাড়ি ফিরলেন।তাঁর ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়েছে, কোভিড ও নিউমোনিয়াকে হারিয়ে বুদ্ধপূর্ণিমায় বাড়ি ফিরেছেন লেখক বুদ্ধদেব গুহ। এখনও দুর্বল রয়েছেন তিনি। তাই তাঁকে ফোন করতে আপাতত নিষেধ করা হয়েছে। কোভিড জয় করে লেখকের বাড়ি ফেরার খবরে খুশি তাঁর অসংখ্য পাঠক।তবে এই মাসেরই প্রথম দিকে আবারো অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রবীণ এই সাহিত্যিক। ভর্তি করতে হয় হাসপাতালে। হাসপাতালে সূত্রে জানা যায় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হয়েছে তাঁর। মুত্রথলীতেও দেখা গিয়েছে সংক্রমণ। অবস্থার অবনতি ঘটতেই তাঁকে স্থানান্তরিত করা হয় আইসিইউতে। চার চিকিত্‍সকের এক দল দেখছিলেন তাঁকে। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। কিছুদিন আগেই করনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ। অতিমারি পরিস্থিতিতে গত এক বছর বাড়ি থেকে বের হননি। তবু রেহাই মেলেনি করোনার হাত থেকে। লেখকের পাশাপাশি করোনা হয়েছিল তাঁর মেয়ে, ড্রাইভারের। প্রথমে শহরের এক হোটেলে নিভৃতাবাসে ছিলেন তিনি।

১৯৩৬ সালে ২৯ জুন কলকাতায় জন্ম নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব গুহ ৷
বুদ্ধদেব গুহ সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুল ও স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়াশুনা করেন। তার স্ত্রী প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ঋতু গুহ। বুদ্ধদেব নিজেও ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন এবং তিনি পুরাতনী টপ্পা গান গাওয়াতে বেশ পারদর্শী।

পেশাগত জীবনে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট হলেও তাঁর ছোটগল্প ও উপন্যাসে পাঠক পান এক স্বপ্নালু বিমূর্ততা ও রোম্যান্টিক আবেদন।
পশ্চিমবঙ্গের আয়কর বিভাগের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য হিসেবেও কাজ করেছেন। আকাশবাণী কলকাতার অডিশন বোর্ডের সদস্যও ছিলেন তিনি।

সমকালীন বাংলা সাহিত্যে নিজের জায়গা গড়ে নিয়েছিলেন বুদ্ধদেব।

বুদ্ধদেব গুহ-র প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘জঙ্গলমহল’। এর পর তাঁর কলম থেকে একে একে বেরিয়ে এসেছে ‘মাধুকরী’, ‘কোজাগর’, ‘চান ঘরে গান’, ‘বাংরিপোষির দু’রাত্রির’, ‘মাধুকরী’, ‘একটু উষ্ণতার জন্য’, ‘হলুদ বসন্ত’, ‘কোয়েলের কাছে’র মতো বিচিত্র আরণ্য-কথামালা। 

অন্নদাশঙ্কর রায় তাঁকে ‘সব্যসাচী’ বলেছিলেন। কেননা বুদ্ধদেব একাধারে লেখক, গায়ক, বন্দুকবাজ, আঁকিয়ে আবার সফল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টও–এক জীবনে কত কিছু! শোনা যায়, তাঁর গান শুনে মান্না দে একবার বুদ্ধদেবকে নাকি বলেছিলেন, আপনি তো প্রফেশনাল সিঙ্গারও হতে পারতেন। শোনা যায়, উত্তমকুমারের সঙ্গে অভিনয়ের সুযোগও এসেছিল বুদ্ধদেব গুহর; ঘটনাচক্রে ঘটে ওঠেনি। এক বনপালক বলেছিলেন, বুদ্ধদেবই একমাত্র সাহিত্যিক যাঁর উপন্যাস নতুন ‘টুরিস্ট স্পটে’র জন্ম দিয়েছে– বাংরিপোষি, মাড়ুমার, ম্যাকলাস্কিগঞ্জ।

হলুদ বসন্ত’ উপন্যাসের জন্য আনন্দ পুরস্কার পেয়েছেন। শরৎ পুরস্কারেও সম্মানিত হয়েছেন। তাঁর ‘বাবা হওয়া’ এবং ‘স্বামী হওয়া’-র উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে বাংলাছবি ‘ডিকশনারি’। এগুলি অবশ্য তাঁর শিল্পীসত্তার কাছে সামান্যই। তিনি যা পেয়েছেন, তা সব চেয়ে দুর্মূল্য। পাঠকের অপার আনুকূল্য। 

বর্ষীয়ান সাহিত্যিকের প্রয়াণে শোকজ্ঞাপন করেছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘বিশিষ্ট সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহর প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। বাংলা সাহিত্যের অগ্রগণ্য লেখক বুদ্ধদেব গুহর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ কোয়েলের কাছে, কোজাগর, একটু উষ্ণতার জন্য, মাধুকরী, জঙ্গলমহল, চরৈবেতি ইত্যাদি। এছাড়া তিনি বাংলা সাহিত্যের দুটি জনপ্রিয় কাল্পনিক চরিত্র- ঋভু এবং ঋজুদার স্রষ্টা। পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট বুদ্ধদেববাবু পুরাতনী টপ্পা সহ বিভিন্ন সংগীতে পারঙ্গম ছিলেন। তাঁর বহু গল্প-উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। বিদ্যাসাগর স্মৃতি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার সহ বহু সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছেন। তাঁর প্রয়াণে সাহিত্য জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল। আমি বুদ্ধদেব গুহর আত্মীয় পরিজন ও অনুরাগীদের আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’

Developed by