//*তারকনাথ দত্ত*//

নব্বই দশকের অব্যবহিত পূর্ব থেকে শুরু হয়ে গোটা নব্বই দশক জুড়ে ভারতীয় সংগীত জগতে কুমার শানুর ক্রমবর্ধমান প্রতিষ্ঠা তাঁকে স্বর্ণযুগের গায়ককূলের যোগ্য উত্তরাধিকারীর সম্মানে ভূষিত করেছে। এমনটা বহুবার হয়েছে অতীতের সব নামকরা সংগীত শিল্পীদের সাথে তাঁর নাম উচ্চারিত হতে শোনা গিয়েছে, এবং এখনও সেই ধারা যথারীতি অব্যাহত আছে। বহু মানুষ যখন কোন শিল্পীকে এই পর্যায়ের স্বীকৃতি দেন, তখন বুঝতে হবে তারা যোগ্য ব্যক্তিকেই বেছে নিয়েছেন। কথায় আছে— Voice Of The People Is The Voice Of The God.
একটা সময় পর্যন্ত সাধারণ শ্রোতাদের ধারণা ছিল ‘আশিকী’ ছবিতেই কুমার শানুর প্রথম প্লে-ব্যাক করেন। এতে করে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, কুমার শানুর প্রথম আত্মপ্রকাশ রীতিমত চমকপ্রদ ঘটনা। আসলে বিষয়টাকে এইভাবে ভাবলে গোটা বিষয়টার অতি সরলীকরণ হয়ে যায়। বিপুল আয়তন অট্টালিকা যেমন একের পর এক ইঁট সাজিয়ে গড়ে ওঠে কুমার শানুর বিরাট প্রতিষ্ঠার পিছনেও তেমনি তিল তিল পরিমাণ করে সঞ্চিত নিষ্ঠা আর ধৈর্য্য কাজ করেছে। বস্তুত এই কাজে তাঁর মত পরিশ্রমের দৃষ্টান্ত ভারতীয় সংগীত জগতের ইতিহাসে দূর্লভ।
কুমার শানু তাঁর গোটা কেরিয়ারে অসংখ্য গান গেয়েছেন। তাঁর একাধিক ভাষায় গাওয়া বৈচিত্র্যময় গানের ভাণ্ডারে ফিল্মি গান যেমন আছে, আছে আধুনিক গান, ভক্তিগীতি, লোকসংগীত, গজল আরো অনেক কিছু।
আজ আমরা কুমার শানুর গাওয়া গান নিয়েই যে আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবো সেকথা বলাই বাহুল্য। কেননা কোন শিল্পীর মূল্যায়ণ তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে করাটাই রীতি। শিল্পীর শিল্প না থাকলে সেই শিল্পীর পরিচয় অন্তঃসারশূন্য। গান নিয়েই আলোচনা হবে, তবে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। বস্তুত কুমার শানুকে নিয়ে এই জাতীয় আলোচনা এর আগে কখনও হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। সেদিক থেকে আজকের আলোচনা অভিনব তো বটেই, কিছুটা স্পর্শকাতরও বটে। যদিও কাউকে অযথা আঘাত করা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়।
আজ আমরা কুমার শানুর এমন কিছু গান নিয়ে আলোচনা করব যে গানগুলি তিনি ছাড়াও অন্য কোন শিল্পীও গেয়েছেন। সেটা একক কণ্ঠের গানও হতে পারে, কিংবা দ্বৈত কণ্ঠের গান।
লেখাটি আগাগোড়া পড়ার পর অনেকের মনে হতেই পারে অমুক গানটির এই তালিকায় থাকা উচিত ছিল। আলোচ্য প্রতিবেদনে নিজের পছন্দের গানটিকে দেখত না পেয়ে হতাশ হওয়াটা বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়। সেই কারণেই আরো আগেভাগে জানিয়ে রাখা ভালো যে, এই প্রতিবেদনে কুমার শানুর গাওয়া নির্দিষ্ট কিছু গানকে বেছে নেওয়া হয়েছে। এবং এই বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কোন ধরাবাঁধা নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। সীমিত পরিসরে অনেক কম জনপ্রিয় গান যেমন আলোচনায় জায়গা পেয়েছে, তেমনি বহুল জনপ্রিয় গানও অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ পড়ে গেছে।
লেখালেখির ক্ষেত্রে পাঠকের যেহেতু সরাসরি হস্তক্ষেপ করার কোন সুযোগ নেই, সেক্ষেত্রে লেখকের পছন্দের উপর ভরসা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন পথ খোলা থাকছে না।
১৯৪২ এ লাভ স্টোরি। (১৯৯৪) তে রিলিজ হওয়া ছবিটাকে নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সর্বোপরি সংগীত পরিচালক আর.ডি বর্মনের শেষ কাজ হিসেবে এই ছবির গানগুলো আজও ভীষণ রকমের প্রাসঙ্গিক। যদিও তাঁর সৃষ্টির মৃত্যুঞ্জয়ী উত্তরণ তিনি দেখে যেতে পারেননি। সময়ের সাথে সাথে এই ছবির গানগুলো আজকাল ক্লাসিকের মর্যাদা পাচ্ছে।
বিশ্বস্ত সূত্রের তথ্যানুযায়ী এই ছবির নায়ক অনিল কাপুর নাকি প্রথমে এই ছবিতে অভিনয় করতে রাজি হননি। এক্ষেত্রে তাঁর যুক্তি ছিল, ছবির বিষয়বস্তু অসাধারণ তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই। কিন্তু যে সময়টাতে দাঁড়িয়ে ছবিটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেই সময়ের নিরিখে এই জাতীয় বিষয়সমূহ নিয়ে ছবি করলে তা গ্রহণ করার মত মানসিকতা দর্শকদের তৈরি হয়নি। তারা প্রেম, সংঘাত আর চড়া দাগের অভিনয় দেখে অভ্যস্ত। সুতরাং এক্ষেত্রে মূল সমস্যাটা হলো এই জাতীয় বিষয়সমূহ নিয়ে ছবি করলে ছবি মুখ থুবড়ে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। অনিল কাপুরের এই জাতীয় ভাবনাচিন্তা স্বাভাবিক কারণেই বিধুবিনোদ চোপরার পছন্দ হয়নি। পছন্দ হবার কথাও না। কেননা এটা ছিল তার ড্রিম প্রজেক্ট। ছবিটির সাফল্য নিয়ে তিনি যথেষ্ট আশাবাদী ছিলেন।
এরপর তিনি নতুন মুখের সন্ধান চালাতে থাকেন। বিধুবিনোদ চোপড়া বেশ কিছু সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, এই ১৯৪২ আ লাভস্টোরি তার ড্রিম প্রজেক্ট ছিল। তিনি ছবিটা তৈরির ক্ষেত্রে যে কোনরকমের রিস্ক নিতে প্রস্তুত ছিলেন। ছবিতে অভিনবত্ব আনার ক্ষেত্রে তার পরিকল্পনার অভাব ছিল না। মোদ্দা কথা ছবিটাকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের একটি মাইলস্টোনে পরিণত করাকে তিনি পাখির চোখ করেছিলেন। এর জন্য তিনি চেষ্টার কসুর করেননি। প্রথমে অনাগ্রহ দেখালেও কোন এক অদ্ভুত কারণে পরে ছবিটা করতে অনিল কাপুর রাজি হয়ে যান। রীতিমত ঢাকঢোল পিটিয়ে এই ছবি রিলিজ করলেও দেখা গেল ছবির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিল কাপুরের আশঙ্কা অমূলক ছিল না। এত ভালো একটা ছবি পাবলিক সেভাবে গ্রহণ করেনি। ছবি যথারীতি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। পরে অনিল কাপুরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, তিনি প্রথমে ছবিটি করতে রাজি ছিলেন না, তারপরে কী এমন ঘটল যে তিনি হঠাৎ করে ছবিটা করতে রাজি হয়ে গেলেন?’
উত্তরে অনিল কাপুর বলেছেন,’ছবিতে আর ডি বর্মণের সুরে কুমার শানুর গাওয়া গানগুলো তাঁর এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে, তিনি চাইছিলেন না এই গানগুলো অন্য কোন অন্য কোন অভিনেতার দখলে চলে যাক। মোদ্দা কথা শুধুমাত্র কুমার গাওয়া গানগুলোর কারণেই তিনি এই ছবিটি করতে রাজি হয়েছিলেন। ছবির গান নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। প্রতিটা গানই এককথায় অসাধারণ। এই ছবির যে গানটি নিয়ে আলোচনা করতে যাচ্ছি, আমি জানি না এই আলোচনা স্বয়ং কুমার শানুর কাছেও ঠিক কতটা গ্রহণযোগ্য হবে। কেননা এই গানটির ক্ষেত্রে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী এমন একজন শিল্পী যাঁকে নিয়ে কিছু বলতে যাওয়াটাই আমার মত নিম্নশ্রেণীর মানুষের জন্য ধৃষ্টতার নামান্তর। ‘কুছ না কহো কুছ ভি না কহো…’ গানের কথা মনে পড়লে কুমার শানুর কথাই আমাদের সর্বাগ্রে মনে পড়ে। বস্তুত এই গানটির একচ্ছত্র মালিকানা তিনি কতকটা নিজের অজান্তেই নিজের নামে পাকাপাকি ভাবে রেজিস্ট্রি করে বসে আছেন। যদিও গানটির একটি ফিমেল ভার্সনও আছে। যেটি গেয়েছেন উপমহাদেশের মুকুটহীন সংগীত সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর মহোদয়া। একবার একটি সাক্ষাৎকারে কুমার শানু নিজমুখে বলেছিলেন যে, তাঁর গাওয়া ‘কুছ না কহো…’ এই গানটি নিয়ে লতাজির সাথে কোন তুলনামূলক আলোচনা তিনি একেবারেই সমর্থন করেন না। বস্তুত লতাজির ভার্সনটিকেই তিনি আগাগোড়া এগিয়ে রেখে এসেছেন। এটা ঘটনা যে লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ভার্সনটিতে যে পরিমাণ প্রখর সংগীত প্রজ্ঞার প্রয়োগ আমরা দেখি, তার ছিটেফোঁটাও কুমার শানুর ভার্সনটিতে দেখতে পাই না। কুমার শানুর নিজের কথায়—”নির্দিষ্ট করে এই গানটির ক্ষেত্রে কোনরকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার রাস্তায় তিনি হাঁটেননি। সোজাসাপ্টা গেয়ে দিয়েছেন। আর এইখানটাতেই তিনি বাজিমাত করে বেরিয়ে গিয়েছেন। তাঁর এই কারুকার্য হীন সোজাসাপ্টা গায়ন শৈলী অবলীলায় শ্রোতাদের মনকে ছুঁয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছে। গান হয়েছে উঠেছে হৃদয়ের বাণী। তুলনায় লতা মঙ্গেশকরের গাওয়া ফিমেল ভার্সনটি অচিরেই শ্রোতাদের মন থেকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যেতে বসেছে।
হাস্কিটোনে গান গাওয়া কুমার শানুর গায়কীর এক অনবদ্য নিদর্শন। তাঁর আগেও অবশ্য অনেক নামকরা শিল্পী নিজেদের গানে কখনও সখনও এটির সফল প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কুমার শানুই প্রথম শিল্পী যিনি ধারাবাহিকভাবে এর সফল প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন। বস্তুত এই বিষয়টাকে তিনি প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। নিন্দুকেরা যদিও তাঁর এই অভূতপূর্ব গুণাবলীকে নিয়ে কটাক্ষ করতে ছাড়েন না। অনেকেরই ধারণা এটা আদতে নাক দিয়ে গাওয়ার একটা দুর্ভাগ্যজনক প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু না। কেউ কেউ বলে থাকেন কুমার শানু গলা দিয়ে নয়, নাক দিয়ে গান করেন। তার সমসাময়িক বেশ কিছু স্বনামধন্য গায়কও এই মতের অনুসারী। এ বিষয়ে কুমার শানুর নিজের যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য যুক্তি আছে। মজার বিষয় হলো এই জাতীয় ধারণা পোষণ করলেও তাদের প্রায় প্রত্যেকেই কোন না কোন সময় কুমার শানুর এই স্টাইলটি নিজেদের গাওয়া গানগুলিতে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন। এবং বলা বাহুল্য সেই প্রচেষ্টা তাদের পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। সব কিছু সবাই করতে পারেন না। কুমার শানুর সমসাময়িক তাঁর এক স্বঘোষিত প্রতিদ্বন্দ্বী বিনোদ রাঠোর এই সম্পর্কে কী বলেছেন একবার দেখে নেওয়া যাক—”হাস্কিটোনে গান গাওয়ার ক্ষেত্রে শানুজির ধারেকাছে কেউ নেই। আমিও বাজিগর ছবির ‘অ্যায় মেরে হামসফর…’ গানটি গাইবার ক্ষেত্রে শানুজিকেই অনুসরণ করেছি। কিন্তু তাঁর মত করে করতে পারিনি।”
১৯৯৬ সালে “জীৎ” নামে একটি ছবির গান নিয়ে শ্রোতাদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন লক্ষ্য করা গিয়েছিল। মূলত একে একটি সফল বানিজ্যিক ছবি বলা যেতে পারে। তবে ছবিটির সাফল্যের পিছনে এ ছবির গানের একটি বিরাট ভূমিকা যে ছিল, সে কথা অস্বীকার করার কোন জায়গা নেই। এই ছবিতে কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া ‘তু ধরতি পে চাহে যাহা ভি রহেগি…’ গানটি সেই সময় তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। গানটির জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় আজও এতটুকু ভাঁটা পড়েনি। এই গানটি প্রথমে বিনোদ রাঠোর ও অলকা ইয়াগনিককে দিয়ে রেকর্ড করানো হয়েছিল। আন্তর্জাল মাধ্যমে বিনোদ অলকার গাওয়া সেই অপ্রকাশিত গানটি আমাদের কাছে পৌঁছে গেছে। আন্তর্জালের দৌলতে আজকাল কোনকিছুই আর অপ্রকাশিত থাকছে না। অতীতের কবর খুঁড়ে বহু সম্ভাবনাময় কর্মকাণ্ড আমাদের নাগালের মধ্যে চলে এসেছে। সে অন্য কথা, আমাদের আলোচ্য বিষয় সেটা নয়। আমরা কথা বলছিলাম ‘তু ধরতি পে চাহে…’ গানটি নিয়ে। অনেকেই আজ বলতে শুরু করেছেন যে বিনোদ রাঠোরের ভার্সনটিও নেহাত মন্দ ছিল না। তাই যদি হয় তবে গানটিকে কেন ছবি থেকে বাদ দেওয়া হলো? কেনইবা কুমার শানুকে দিয়ে পুনরায় নতুন করে রেকর্ড করানোর প্রয়োজন হলো? আমার সীমিত জ্ঞানে দু’টি গানের মধ্যে যে পার্থক্য প্রকট হয়ে ধরা দেয় তা হলো দু’টি গানের গায়কদ্বয়ের গায়ন শৈলীই গান দু’টির মধ্যে বিরাট পার্থক্য গড়ে দিয়েছে। প্রথমত এই জাতীয় আবেঘন রোমান্টিক গানের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ আবেগের বহিঃপ্রকাশ থাকাটা ভীষণভাবে জরুরী সেটা বিনোদ রাঠোরের ভার্সনটিতে অদ্ভুতভাবে অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত বিনোদ রাঠোর গানটি গেয়েছেন সম্পূর্ণ উন্মুক্ত কণ্ঠে। দরাজ কণ্ঠ সর্বক্ষেত্রে সমভাবে প্রাসঙ্গিক হবে তার কোন মানে নেই। অপরদিকে কুমার শানুর গাওয়া ভার্সনটি কুমার শানু গেয়েছেন তাঁর চিরাচরিত হাস্কিটোনে। গানের বাণীকে আত্মস্থ করে তাঁর প্রতিটি উচ্চারণ, সর্বোপরি তাঁর স্বভাবসুলভ মসৃণ প্রয়োগ ভঙ্গিমা গানটির মধ্যে প্রাণ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়েছে। বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে দাঁড়িয়ে কুমার শানুর উচ্চারিত প্রতিটি দীর্ঘশ্বাস অবুঝ প্রেমের আবেগকেই আরো বেশি করে উস্কে দিতে পেরেছে বলেই মনে হয়। যে কারণে গান হয়ে উঠেছে একজন সাধারণ প্রেমিকের অসাধারণ হয়ে উঠতে চাওয়ার মরিয়া প্রয়াসের সফল বহিঃপ্রকাশ। একটা ছোট্ট উদাহরণ দেওয়ার লোভ সামলানো গেল না কিছুতেই। গানটিতে একটা লাইন আছে ‘অগর বন্ধ হো যায়েগি মেরি আঁখে/ তুঝে তেরি আহট সে পহেচান লুঙ্গা…’ উদ্ধৃত অংশটি কুমার শানু এমনভাবে উচ্চারণ করছেন যেন ছবির নায়ক সানি দেওল নন, তিনিই তাঁর প্রেমিকাকে কথাগুলো বলছেন। এটাই কুমার শানুর গানের মাহাত্ম্য। প্লে-ব্যাকের মূল শর্তই হলো গানের মধ্যে দিয়ে অভিনয়কে প্রকাশিত করা। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার ক্ষেত্রে কুমার যোগ্যতা প্রশ্নাতীত।
‘কাল চৌধভি কী রাত থি সব ভর রাহা চর্চা তেরা/ কুছ নে কাঁহা ইয়ে চান্দ হ্যায়, কুছনে কাঁহা চেহরা তেরা…’
ছবির নাম ‘জিয়ালা’। গুগল ঘাটলে এর রিলিজের সময়টা ২০০০ দেখালেও খুব সম্ভবত এ-ছবির গান রেকর্ড হয়েছিল ৯৪ কিংবা ৯৫ সালে। কুমার শানুর কণ্ঠ শুনলে অন্তত তেমনটাই মনে হয়।
এটি আদতে একটি পাকিস্তানি গান। মূল গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন গুলাম আলি। যদিও দুটি গানের কথা এক হলেও সুরে সামান্য তারতম্য আছে। দুটি গানের মেজাজ দু-রকম। কুমার শানুর নিজস্ব গায়ন শৈলী গানটিতে একটি আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় খোদ পাকিস্তানি শ্রোতাদের মন্তব্য পড়ে আন্দাজ করে নিতে অসুবিধা হয় না, দুটো গানের প্রতিই তারা সমানভাবে শ্রদ্ধাশীল। কেউ কেউ আবার কুমার শানুর গাওয়া গানটিকে মূল গানটির থেকেও এগিয়ে রাখেন। পাকিস্তানের শ্রোতারা কুমার শানুকে দীর্ঘদিন তাদের বিশেষ শ্রদ্ধার আসনে বসিয়েছেন। ভারতীয় গায়কদের মধ্যে এক মহঃ রফি ছাড়া কুমার শানু হলেন সেই দ্বিতীয় ব্যক্তি যার গানকে পাকিস্তানিরা তাদের অপরিমিত ভালোবাসায় ভরিয়ে দিতে কার্পণ্য করেনি।
আকেলে হাম হাম আকেলে তুম (১৯৯৫)। ইউনাইটেড সেভেন কম্বাইনসের ব্যানারে মনসুর খান পরিচালিত এই ছবিটি সে বছর বক্স অফিসে তুমুল সাড়া ফেলেছিল। মি. পারফেকশনিস্ট হিসেবে পরিচিত আমির খান এ ছবির নায়ক। একটা সময় পর্যন্ত মনে করা হত আমির খানের লিপে উদিত নারায়ণ সবথেকে বেশি সুইটাবল। এমন মনে করার একটাই কারণ আমির খানের প্রথম দিককার বক্স অফিস সফল দু একটি ছবিতে (পড়তে হবে দিল, কয়ামত সে কয়ামত তক প্রভৃতি) উদিত নারায়ণের হিট গান। এটা যে শুধু উদিত নারায়ণের ক্ষেত্রেই ঘটেছে তা না, অতীতে বা তার পরেও এই জাতীয় ব্যাপার ঘটেছে। সলমন খানের কণ্ঠ হিসেবে এস.পি বালা সুব্রমনিয়ম একটা সময় পর্যন্ত অগুনতি গান গেয়েছেন। মহঃ আজিজ দীর্ঘদিন পর্যন্ত অমিতাভ বচ্চনের নেপথ্য কণ্ঠ ছিলেন। এমন উদাহরণ অনেক আছে।
বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই ধারাটাকে রীতিমত চ্যালেঞ্জ করে বসেছিলেন কুমার শানু। তিনি এসে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ওসব ধারা টারা কিস্যু না। নির্দিষ্ট কোন অভিনেতার কণ্ঠ হয়ে নয়,কালে কালে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সার্বজনীন একজন সম্পূর্ণ গায়ক। বলিউডের ছোট থেকে বড়, বাদশা থেকে ফকির সবার কণ্ঠেই তিনি অবলীলায় ফিট করে যান। তা যা বলছিলাম, আকেলে হাম আকেলে তুম ছবির ‘রাজা কো রানী সে প্যায়ার হো গয়া…’ গানটির দুটি ভার্সন আছে। একটি গেয়েছেন উদিত নারায়ণ অলকা ইয়াগনিক। অন্যটি কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিক। শোনা যায় যে ‘রাজা কো রানী সে…’ গানটা অনু মালিক কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিককে দিয়েই প্রথমে রেকর্ড করিয়েছিলেন। কিন্তু ছবির পরিচালকের সে গান পছন্দ হয়নি। এক্ষেত্রে তার যুক্তি ছিল গানটি যে মন্দ হয়েছে এমনটা তিনি মনে করেন না ঠিকই, কিন্তু গানটিকে তিনি ছবির যে পর্যায়ে ব্যবহার করতে চাইছেন, তার স্পিরিটের সাথে নাকি এই গানটি যায় না। তিনি সাজেস্ট করলেন কুমার শানু নয়, গানটি উদিত নারায়ণকে দিয়ে গাওয়ানো হোক। সুতরাং অনু মালিক একপ্রকার বাধ্য হয়ে উদিত নারায়ণকে দিয়ে পুনরায় গানটি রেকর্ড করালেন। যদিও মহিলা কণ্ঠটি এক্ষেত্রে একই থাকলেন। মজার বিষয় হলো উদিত নারায়ণকে দিয়ে নতুন করে গানটি রেকর্ড করা হলেও যেহেতু ‘আকেলে হাম আকেলে তুম ছবিটি’ ভেনাস ক্যাসেট কোম্পানির নিজস্ব ব্যানার ইউনাইটেড সেভেন কম্বাইনসের ছবি তাই তারা সিনেমায় অব্যবহৃত কুমার শানুর ভার্সনটিকে ক্যাসেটে রেখে দিলেন। খুব সম্ভবত কুমার শানুর জনপ্রিয়তার কথা মাথায় রেখেই এই সিদ্ধান্তটি তারা নিয়েছিলেন। এবং তাদের সিদ্ধান্ত যে ভুল ছিল না, সেটা কুমার শানুর গাওয়া গানটির তুমুল জনপ্রিয়তা দেখলেই বুঝতে পারা যায়। বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া গানটি আজও বহুল জনপ্রিয়। যত বেশি সংখ্যক মানুষ শুনে থাকেন, ততটা উদিত নারায়ণ ও অলকা ইয়াগনিকের সিনেমায় ব্যবহৃত গানটি শোনা যায় না। এই ছবিতেই কতকটা নিঃশব্দেই আরো একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে গিয়েছিল। ছবিটির আরো একটি বিখ্যাত গান ‘দিল মেরা চুরায়া কিউ…’। কুমার শানুর গাওয়া ‘রাজা কো রানী সে প্যায়ার…’ গানটির ক্ষেত্রে যেমনটি ঘটেছিল হুবহু প্রায় একই ঘটনা ‘দিল মেলা চুরায়া’র ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো প্রথম গানটির ক্ষেত্রে গায়কের গায়কী নিয়ে কেউ কোন প্রশ্ন তুলেছিলেন বলে শোনা যায়নি। তবে অন্য শিল্পীকে দিয়ে একই গান দ্বিতীয়বার রেকর্ড করার যৌক্তিকতা কোথায়? এ বিষয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই অবগত আছি যে, ‘দিল মেরা চুরায়া কিউ…’
গানটি প্রথমে উদিত নারায়ণকে দিয়ে রেকর্ড করানো হয়েছিল। গানটি মূলত একটি বিচ্ছেদ সংগীত। অন্তত গানটির বাণী এবং সুরের বৈচিত্র্য তেমনটাই দাবি করে। অনু মালিকের করা এ-গানের সুর এককথায় অনবদ্য। যদিও তাঁর সমালোচকরা অনেক খুঁজে পেতে উদ্ধার করেছেন যে গানটির সুর একটি পাশ্চাত্য ধারার সুরের হুবহু অনুকরণ ছাড়া আর কিছু না। এক্ষেত্রে সুরকার একজ তস্করের ভূমিকা পালন করেছেন মাত্র। সে যাই হোক, তা নিয়ে আলোচনা করে প্রতিবেদন দীর্ঘায়িত করাটা অর্থহীন।তা যে কথা হচ্ছিল, উদিত নারায়ণের গাওয়া ‘দিল মেরা চুরায়া কিউ…’ গানটি নিয়ে। গানটিকে কেন বাদ দেওয়া হয়েছিল? আর কেনই বা কুমার শানুকে দিয়ে দ্বিতীয়বার রেকর্ড করানোর প্রয়োজন পড়ল? এসব প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। এর উত্তর উদিত নারায়ণ বা কুমার শানুর গাওয়া ভার্সন দু’টির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। উদিত নারায়ণ একজন বড় মাপের সংগীত শিল্পী এটা নিয়ে খুব বেশি বিতর্কের অবকাশ আছে বলে হয় না। বস্তুত তিনি তাঁর অভিনব কণ্ঠ মাধুর্যের কারণে একটা বিরাট সংখ্যক শ্রোতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর প্রতি সমস্ত শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ‘দিল মেরা চুরায়া কিউ…’ গানটির ক্ষেত্রে তিনি অন্তত নিজের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। বস্তুত এই জাতীয় বিষাদের গানে তাঁর সীমাবদ্ধতা ভীষণভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত গানে বিষাদের প্রবল বহিঃপ্রকাশ ঘটে থাকে, এই জাতীয় গান গাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর খুব একটা সুখ্যাতি নেই। এক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটি বিষাদের গান গাইছেন অথচ তাঁর গায়কীর মধ্যে কোনরকমের ভাবের বহিঃপ্রকাশ নেই। নিতান্তই যান্ত্রিক ভঙ্গিমায় একটানা গেয়ে দিয়েছেন। এই পর্যায়ে উদিত নারায়ণের গায়কীর এক বড় সমস্যা ছিল তাঁর সব গানের মধ্যেই অবধারিতভাবে একটা ফিল গুড ব্যাপার প্রকাশিত হত। সে আনন্দের গান হোক কিংবা দুঃখের গান। সব ক্ষেত্রেই তার প্রয়োগ ভঙ্গিমা প্রায় একই ছিল। বৈচিত্র্যহীন একপেশে গায়কী।
১৯৯৬ এর ছবি মিঃ বেচারা। গীতিকার সমীরের কথায় এবং আনন্দ-মিলিন্দের সুরে এ ছবির গানগুলি গেয়েছেন, কুমার শানু, অলকা ইয়াগনিক, উদিত নারায়ণ, বিনোদ রাঠোর ও আলিশা চিনয়। এই ছবির একটি জনপ্রিয় গান “জানম মেরে জানম…” গানটি নিয়ে আলোচনা করব। এই গানটির দু’টি ভার্সন আছে। একটি ডুয়েট ও অন্যটি সোলো। ডুয়েট গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন উদিত নারায়ণ ও অলকা ইয়াগনিক। অপরটি অর্থাৎ সোলো গানটি গেয়েছেন কুমার শানু। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো দুটি গানের সুর এক হলেও মুড বা ভাব যাই বলি না কেন সম্পূর্ণ আলাদা। ছবির কাহিনীর সাথে সামঞ্জস্য রেখেই সচেতন ভাবেই এটা করা হয়েছে। গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত ছবিটি যারা দেখেছেন বিষয়টা তারা খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করে থাকবেন। উদিত নারায়ণ এবং অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া ‘খোয়ি খোয়ি আঁখো মে সজনে লগে হ্যায়, সপনে তুমহারে সনম…’ এই ভার্সনটি সেই সময় বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। তুলনায় কুমার শানুর সোলো ভার্সন ‘জানম মেরি জানম…’ খুব বেশি আলোচিত হয়নি। সোলো গানে কুমার শানু বরাবরই অন্য শিল্পীদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে। বিশেষ করে দুঃখের গানগুলিতে তাঁর প্রশ্নাতীত দক্ষতা নিয়ে তর্কের অবকাশ সেদিনও ছিল না, আজও নেই। এই গানটির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ‘জানম মেরি জানম জানম মেরি জানম…’ নিরীহ একটা কথা, যে কথার সাথে প্রতিভান শিল্পীর আবেগ যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। যে কারণে কুমার শানুর ভার্সনটির পাশে উদিত নারায়ণের ভার্সন নিতান্তই সাদামাটা মনে হয়েছে।
কুমার শানুর সমসাময়িক বাকি শিল্পীরা যে এই জাতীয় গান গাইতে অক্ষম ছিলেন তা না, তারাও আমাদের বহু ভালো গান উপহার দিয়েছেন। কিন্তু কুমার শানু যেভাবে গানের সাথে একাত্ম হয়ে যান তা অন্যদের ক্ষেত্রে খুব একটা দেখা যায় না। অসংখ্য দুঃখের গান তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। যে গানটি নিয়ে কথা হচ্ছিল, এই গানটি সেইসময় তেমন একটা প্রচারের আলোয় আসতে পারেনি। পাবলিসিটির টালবাহানা তো ছিলই, কোন এক অজ্ঞাত কারণে ক্যাসেটের বি সাইডের একেবারে শেষে গানটিকে রাখা হয়েছিল। যে কারণে গানটির তথ্য অধিকাংশ সাধারণ শ্রোতার কাছেই অজ্ঞাত ছিল। অনেকেই গানটি প্রথম শুনেছেন একেবারে সরাসরি সিনেমা হলে গিয়ে। তারপরেও কিন্তু সময়ের সাথে সাথে এই গানটির আগের অবস্থানের আমূল পরিবর্তন ঘটে গেছে। উদিত নারায়ণ, অলকা ইয়াগনিক জুটির গানটি আজকাল আর খুব একটা শোনা যায় না। অথচ কুমার শানুর ভার্সনটি এখনও যথেষ্ট পরিমাণে পপুলার। এটা শুধুমাত্র এই গানটির ঘটেছে তা না, কুমার শানুর এমন বহু গান আছে যা সেই সময়টাতে হয়ত সেভাবে জনপ্রিয়তা পায়নি, কিন্তু দীর্ঘদিন বাদে এসে সেইসব গানগুলি শ্রোতাদের কাছে বাড়তি সমাদর পেয়েছে।
আলোচনা করতে বসে ‘সাজন’ ছবির সেই বিখ্যাত গানটির কথা আসবে না তাই কখনও হয়? —’জিয়ে তো জিয়ে ক্যায়সে বিন আপকে…’ একই গান পঙ্কজ উদাস গেয়েছেন। আবার কুমার শানুও গেয়েছেন। দুটি গানই শ্রোতাদের কাছে বিশেষ ভাবে সমাদৃত। পঙ্কজ উদাস মন্দ গেয়েছেন এটা কখনই বলা যাবে না। গজলধর্মী গান গাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রোতাদের কাছে তাঁর আলাদা গ্রহণযোগ্যতা আছে। কিন্তু এই গানটিকে খুব মনোযোগ সহকারে শোনা যায় তাহলে বোঝা যাবে দুটি গান হুবহু এক হলেও গান দুটির মধ্যে চরিত্রগত কিছু পার্থক্য আছে। পঙ্কজ উদাস গানটি গেয়েছেন তাঁর পরিচিত আপাত নিরীহ নির্বিষ কণ্ঠে। যে কারণে গানটি দু-একবার শোনার পর পুনরায় নতুন করে শোনার আগ্রহ তৈরী হয় না। অথচ কুমার শানুর গানটির ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটে ঠিক তার উল্টো। কুমার শানুর গাওয়া গানটির মধ্যে একধরনের অদ্ভুত মাদকতা আছে। পুরুষালী কণ্ঠ বলতে আমরা যেটা বুঝি, কুমার শানুর কণ্ঠ ঠিক সেটাকেই আরো জোরালো ভাবে মান্যতা দেয়। ওনার গায়কীর মধ্যে যে স্বতঃস্ফূর্ত ভাব আমরা লক্ষ্য করি, এই গানটিতেও তা ভীষণভাবে উপস্থিত। তারপরে আছে শব্দের মানে বুঝে নিখুঁত উচ্চারণ। এর সাথে চূড়ান্ত পর্যায়ের মেলোডি মিশে গিয়ে এক অপার্থিব সুর মূর্ছনার সৃষ্টি করেছে যা কিনা সোজা বুকের মাঝখানে এসে আঘাত করে। আমার বিদ্যাবুদ্ধি অতি সামান্য। আমার মনে হয় এই গানটার মধ্যেই শ্রোতারা এর উত্তর পেয়ে যাবেন।
ধরকন (২০০০) ছবির ‘তুম দিলকি ধরকন মে রেহতি হো..’ গানটির দুটি ভার্সন আছে এটা আমরা সবাই জানি। যদিও দুটি গানের মুড আলাদা। অভিজিৎ আর অলকা ইয়াগনিকের গাওয়া গানটি একটি দ্বৈত সংগীত। গানের মধ্যে চটুল একটা ব্যাপার আছে। গানটির পিকচারাইজেশনের কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত গানটির মধ্যে একটা সুখী সুখী ভাব রাখা হয়েছে। উল্টো দিকে একই গান যেটা কুমার শানু গেয়েছেন তাঁর মধ্যে একজন ব্যর্থ প্রেমিকের রোদনভরা আবেদন আছে। দস্তুর মত করুণ রস অবলম্বন করে গাওয়া একখানি গান।
এই জাতীয় গানে কুমার শানুর দক্ষতা প্রশ্নাতীত। ‘হে হে হে হো হো হো’ দিয়ে গান শুরু হচ্ছে। শিল্পী যখন শুরু করছেন তখনই গানটির চরিত্র স্পষ্ট হয়ে যায়। গানটি যত এগোতে থাকে ততই গোটা বিষয়টি আরো স্পষ্ট হতে থাকে। ‘ধরকন’ ছবির আরেকটি বিখ্যাত গান, ‘দিলনে ইয়ে কাহা হ্যায় দিলসে/ মোহব্বত হো গয়ি হ্যায় তুমসে…’ গানটি মূলত নব্বই ভাগ গেয়েছেন উদিত নারায়ণ এবং অলকা ইয়াগনিক। উদিত নারায়ণ একজন বড় মাপের শিল্পী। বস্তুত তিনি কুমার শানুর অনেক আগেই ইন্ড্রাস্টিতে এসেছেন। ক্যায়ামত সে ক্যায়ামত তক ছবির গানের সুবাদে তিনি মোটামুটি ভাবে ইন্ড্রাসিতে জাঁকিয়ে বসার ইঙ্গিত দিচ্ছেন এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে কুমার শানুর রাজকীয় উত্থান তার মনবোলকে এক ধাক্কায় তলানিতে পৌঁছে দিয়েছিল। অবশ্য সেইসময়টাতে শুধু উদিত নারায়ণ নন ইন্ড্রাস্টির অনেক বড় বড় রথী মহারথীকে বিরাট অস্বস্তির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। দিনের পর দিন তাদের সেই অস্বস্তি বেড়েছে বই কমেনি।
‘দিলনে ইয়ে কাঁহা হ্যায় দিল সে…’ গানটির একেবারে অন্তিম পর্যায়ে ‘হে হে হে হে হে আ হা হা…’ আলাপ দিয়ে কুমার শানুর প্রবেশ করছেন। তাঁর গায়কীর মধ্যে যে পরিমাণ তেজ আর বিদ্রোহের ধ্বংসাত্মক রূপ আমরা ধ্বনিত হতে দেখি তা যেমন জ্বালাময়ী, তেমনি মারাত্মকভাবে গানকে প্রভাবিত করে ফেলে। বস্তুত কুমার শানু গানের মধ্যে প্রবেশ করার সাথে সাথে ধীর লয়ে ইনিয়ে বিনিয়ে চলতে থাকা গানটির মধ্যে একটা ঝাঁঝালো ভাব চলে আসে। যা কিনা দীর্ঘসময় পর্যন্ত শ্রোতাকে অবশ করে রাখে।
১৯৯৪ এর ছবি ইমতিহান। ‘ইস তারহা আশিকী কা অসর ছোড় যাউঙ্গা…’ এটা কুমার শানুর একটি বিখ্যাত গান এটা আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জানি। কিন্তু এমন অনেকেই আছেন যারা জানেন না যে এই গানটির আরো একটি ভার্সন আছে। এবং এই গানটি গেয়েছেন কুমার শানুর ভাবগুরু কিশোর পুত্র অমিত কুমার। এমন অনেক উজবুক পাবলিক আছেন যারা আবার অমিত কুমারের ভার্সনটিকে কুমার শানুর ভার্সনটির থেকে অনেকটাই এগিয়ে রাখতে পছন্দ করেন। হয় তারা একেবারেই গান বোঝেন না। নতুবা কুমার শানুকে নিয়ে তাদের মনে একধরনের অবজ্ঞা কাজ করে। ভাবখানা এমন কুমার শানু আবার একজন গায়ক হলো? অমিত কুমার একজন নামকরা বাবার ছেলে হওয়ার গর্বে গর্বিত হতে পারেন। এর জন্য তিনি অনেকের অযাচিত সহানুভূতিও পেয়ে থাকেন। কিন্তু বাস্তব সত্যটা হলো গায়ক হিসেবে তিনি কুমার শানুর থেকে অনেকটাই পিছিয়ে থাকবেন। বেসুরো গায়ক হিসেবে তার যথেষ্ট বদনাম আছে। এই গানটিও সেই একই দোষে দুষ্ট। সেখানে কুমার শানু বেসুরো গান এমনটা তাঁর অতিবড় নিন্দুকেও বুক বাজিয়ে এমনটা দাবি করতে পারবে না। স্বয়ং আশা ভোঁসলে দ্বর্থহীন ভাষায় বিষয়টাকে স্পষ্ট করেছেন। আশা ভোঁসলে ঠিক কী বলেছেন সেটা না হয় আর একবার শুনে নেওয়া যাক—”ইন্ডিয়া মে এক হি এয়সা আর্টিস্ট (কুমার শানু) হ্যায়, যো কভী বেসুরা নেহি গাতা।”
উক্ত গানটিতে কী ফিলিংস, কী এক্সপ্রেশন! কুমার শানুর প্রত্যয়ী কণ্ঠে গানটা শুনতে শুনতে মনে হয় যেন গায়ক নিজেই এখানে গভীর প্রেম পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। গানের শুরুতে যে আলাপটি আছে ‘হে হে হে…’ যেটা আদতে কুমার শানুর সিগনেচার টিউন, যে টিউন তাঁকে শিল্পী হিসেবে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। অপরদিকে এই একই আলাপ অমিত কুমারের কুমারের কণ্ঠে শোনাটা রীতিমত পীড়াদায়ক এক অভিজ্ঞতা।
এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে, কিছুদিন পূর্বে অমিত কুমার অভিযোগের সুরে বলে বসলেন, ‘চুরাকে দিল মেরা গরিয়া চলি…’ এই গানটি তার নাকি গাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অনিবার্য কারণবশত কার্যক্ষেত্রে সেটা হয়ে ওঠেনি। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। ইন্ড্রাস্টিতে এই জাতীয় ঘটনা নতুন কিছু নয়। একজনের গাওয়ার কথা ছিল পরে হয়ত গান অন্য কেউ গেয়েছে, এমনটা প্রায়ই শোনা যায়। তা নিয়ে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগ বড় একটা শোনা যায় না।
আক্ষেপ হওয়াটা দোষের কিছু না। কিন্তু ঘটনা হলো আক্ষেপটাকে ততক্ষণ আক্ষেপ বলা যায়, যতক্ষণ না তার মধ্যে নির্দিষ্ট করে কাউকে আক্রমণের সুর ধ্বনিত হচ্ছে। তিনি যেটা বলেছেন, সেটা শুধু আক্রমণ নয়, ব্যক্তি আক্রমণ। তিনি কী বললেন? তিনি অকালপক্কের মত সরাসরি অভিযোগ করে বসলেন যে, এই গানটি তাঁর হাতছড়া হবার পিছনে অন্য কোন শিল্পীর অঙ্গুলিহেলন অনুঘটকের কাজ করেছে। সেই শিল্পী নাকি মিউজিক ডিরেক্টরকে উপঢৌকন (পড়তে হবে মদের বোতল) দিয়ে গানটি বাগিয়ে নিয়েছেন। তাঁর করা অভিযোগের সারবত্তা নিয়ে যথেষ্ট পরিমাণে সন্দেহ আছে। ইচ্ছে করলেই তাঁর এই গুরুতর অভিযোগ খণ্ডন করা যায়। কিন্তু সে আলাদা কথা। এসব নিয়ে পরে আলোচনা করার অবকাশ থাকছে। যে গান নিয়ে এত বিতর্ক সেই গানটিকে একবার দেখে নেওয়া যাক। গানটি ছিল— চুরাকে দিল মেরা গরিয়া চলি…’ ছবির নাম ‘ম্যায় খিলাড়ি তু আনাড়ি ১৯৯৪’ যে সময়টার কথা বলা হচ্ছে সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই শূন্য। তারপরেও তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে এইরকমই কিছু ঘটেছিল। তাহলে বলব, ভাগ্যিস ঘটেছিল! তা না হলে গানটির অবস্থা হতো অনেকটা লবন ছাড়া তরকারির মত। কারণ কুমার শানুর গাওয়া এমন কিছু গান আছে যা কেবল তাঁর পক্ষেই গাওয়া সম্ভব। আক্ষরিক অর্থেই ‘চুরাকে দিল মেরা’ তেমনি একটি ব্যতিক্রমী গান। পূর্ণাঙ্গ গানটির কথা না হয় ছেড়েই দিলাম, শুধুমাত্র এই ‘চুরাকে দিল মেরা গরিয়া চলি…’ এই শব্দ কয়য়টি তাঁর মত করে উচ্চারণ করতেই হিমসিম খেয়ে যেতে হবে।
রাজা হিন্দুস্তানি ‘পরদেশী পরদেশী জানা নেহি…’
চলে আসি ১৯৯৬ সালের বক্স অফিস সফল বিখ্যাত ‘রাজা হিন্দুস্থানির গানের কথায়। বলাই বাহুল্য রাজা হিন্দুস্থানি ছবির সবকটা গানই হিট করেছিল। শুধু হিট না সুপার ডুপার হিট। সমীর আনজানের লেখা নদীম-শ্রবণের সুরকরা বিখ্যাত গানগুলি মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। এই গানগুলির মধ্যে সব থেকে হিট গান অবশ্য করেই ‘পরদেশী পরদেশী জানা নেহি/ মুঝে ছোড়কে মুঝে ছোড়কে…’ আমরা ঠিক এই গানটাকে নিয়েই আপাতত আমাদের আলোচনা এগিয়ে নিয়ে যাবো। ‘পরদেশী…’ গানটির দুটি ভার্সন। একটি গেয়েছেন উদিত নারায়ণ এবং অলকা ইয়াগনিক। অন্যটি কুমার শানু ও অলকা ইয়াগনিক। দুটো গানকেই ছবিতে খুব সুন্দর ভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। উদিত নারায়ণ এই গানটি গেয়েছেন তাঁর চিরাচরিত নির্বিষ ভঙ্গিতে। গায়ন শৈলীর কথা যদি বলতে হয়, তাঁর গাওয়া এই জাতীয় অন্য গানগুলোর থেকে কী ভাবে, কী উচ্চারণে এই গানটির ক্ষেত্রেও খুব বেশি এদিক সেদিক হয়নি।
উল্টোদিকে এই একই গান কুমার শানু যখন গাইছেন, গানটি শুধুমাত্র গায়ন শৈলীর কারণেই ভিন্নমাত্রা পেয়ে যায়। কুমার শানুর কণ্ঠে শুরুর দিককার বাণী—’ম্যায় ইয়ে নেহি কহতা কে প্যায়ার মত কর না/ কিসি মুসাফির কা মগর এতবার মত কর না…
অথবা গানটির একেবারে শেষ পর্যায়ে ‘ও মেরে পরদেশী তু জানা নেহি/মুঝে ছোড়কে, হাঁ মুঝে ছোড়কে…’
দু’টি গানের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বিচ্ছেদের যন্ত্রণাময় অভিব্যক্তি কুমার শানুর কণ্ঠে যেন ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। একটা বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস প্রেমিকের দুঃখ জর্জরিত হতাশাকেই আরো প্রবলভাবে ব্যক্ত করতে সক্ষম হয়েছে।
‘জিস ঘরি তুঝকো মেরে রবনে বনায়া হোগা’ পৃথ্বি (১৯৯৭)।
মিউজিক ডিরেক্টর বিজু শাহ বলিউডের একজন নামকরা মিউজিক ডিরেক্টর। খুব বেশি কাজ হয়ত তিনি করেননি। কিন্ত যা করেছেন তার অধিকাংশই চূড়ান্ত সফল। ব্যতিক্রমী সুরকার হিসেবে নব্বইয়ের দশকে নামকরা মিউজিক ডিরেক্টরের ভিড়ে তার কাজগুলো খুব সহজেই আলাদা করে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হলো তার সুরে কুমার শানুর বেশ কিছু হিট গান যদিও আছে, তারপরেও এই দু’জনার একসাথে কাজের স্বল্পতা আমাদের ভীষণভাবে অবাক করে। কুমার শানুর চির প্রতিদ্বন্দ্বী বলে পরিচিত আরেক গায়কের প্রতি তার দূর্বলতা দৃষ্টিকটু ভাবে প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। তারপরেও হাতে গোনা যে কয়েকটি কাজ তিনি কুমার শানুর সাথে করেছেন তার প্রায় প্রত্যেকটাই শ্রোতাদের অকুণ্ঠ প্রশংসা কুড়িয়েছে। আমার কেন জানি মনে হয় কুমার শানুর প্রতি বরাবরই একধরনের বৈরিতা তার মধ্যে লক্ষ্য করা গেছে। সেই বৈরি মনোভাব আরো বেশি প্রকট হয়ে ওঠে তার কিছু কাজ করার ধরন দেখলে। ১৯৯৭ সালে টি-সিরিজ থেকে ‘পৃথ্বি’ বলে একটা ছবির গানের ক্যাসেট বাজারে আসে। সুনীল শেঠি ও শিল্পা শেঠি অভিনীত এই ছবির সুরকার বিজু শাহ। ছবির গান যে খুব আহামরি কিছু ছিল এমনটা বলা যাচ্ছে না। বিজু শাহের শ্রেষ্ঠ কাজগুলোর মধ্যে এটাকে কোনভাবেই রাখা যাবে না। গানগুলো শুনতে শুনতে একটা কথাই মনে হয় বিজু শাহ তার প্রতিভার প্রতি সুবিচার তিনি এই ছবিটিতে অন্তত করে দেখাতে পারেননি। নিতান্তই দায়সারা গোছের কাজ। লক্ষণীয় বিষয় হলো এখানেও তিনি তার পছন্দের শিল্পীর প্রতিই আস্থা রেখেছেন। এই ছবিটিতে তিন-চারটে গান তিনি তার পছন্দের শিল্পী উদিত নারায়ণকে দিয়েই গাইয়েছেন। এই ছবিটিতে একটি গান আছে, ‘জিস ঘড়ি তুঝকো মেরে রবনে বনায়া হোগা/ তেরা শৃঙ্গার ফরিস্তো সে করায়া হোগা…’ এই গানটির দুটি ভার্সন আছে। একটা গান ডুয়েট। যাতে কণ্ঠ দিয়েছেন উদিত নারায়ণ ও অনুরাধা পড়োয়াল। দ্বিতীয় ভার্সনটি রিমিক্স। এই গানটি গেয়েছেন কুমার শানু & সুজাতা। বলিউড মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে কী পরিমাণ পক্ষপাতিত্ব করা হয় এই গানটি তার একটি ছোট্ট উদাহরণ। প্রথমত কুমার শানুর ভার্সনটিকে রিমিক্স করে গানটার গুরুত্ব কমিয়ে ফেলা হয়েছে। দ্বীতিয়ত গানটিকে রাখা হয়েছিল ক্যাসেটের বি সাইডের একেবারে শেষে। এত কিছুর পরেও কুমার শানুর গানটি যদি ভালো করে পর্যবেক্ষণ করা যায় তো দেখা যাবে অন্যটির তুলনায় কুমার শানু শুধু বেটার গাননি। বস্তুত এখানেও তার মুন্সিয়ানার ছাপ স্পষ্ট। একটা সাদামাটা গানকেও কেবলমাত্র নিজস্ব দক্ষতায় এই পর্যায়ে এনে ফেলা যায় সেটা কুমার শানুর গানটি না শুনলে বিশ্বাস করা শক্ত।
ক্রমশ