
জীবন্ত কিংবদন্তি শিল্পী কুমার শানুর শ্যামা সঙ্গীতেও আলাদা মাত্রা যোগ করেছেন।
বাংলা ও হিন্দি সঙ্গীত জগতে নয়ের দশক আর কুমার শানু যে সমার্থক তা যে কোনও সঙ্গীত সমালোচকই একবাক্যে স্বীকার করে নেন। এই নয়ের দশকের প্রায় মাঝামাঝি কুমার শানুর প্রথম শ্যামা সঙ্গীতের ক্যাসেট ‘সকলই তোমারই ইচ্ছা’ বাজারে বেরোতেই তা গান প্রেমী বাঙালির দরবারে গৃহীত হয়। আর তার পরের ঘটনা ইতিহাস। কুমার শানুর গাওয়া সমস্থ শ্যামা সঙ্গীত নিয়ে আলোকপাত করা হল এই বিশেষ প্রতিবেদনে।
শ্যামাসংগীত বলতে কালী-বিষয়ক বাংলা ভক্তিগীতির একটি জনপ্রিয় ধারাকে বোঝায়। এই শ্রেণীর সঙ্গীত শাক্তপদাবলির একটি বিশিষ্ট পর্যায়। শাক্তকবিরা প্রধানত তন্ত্রাশ্রয়ী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন বলে শ্যামাসংগীতে তন্ত্রদর্শন নানাভাবে দ্যোতিত। শ্যামাসঙ্গীতের পদগুলিতে কালী বা শ্যামা মাতৃরূপে ও ভক্ত সাধক সন্তানরূপে কল্পিত। ভক্তের প্রাণের আবেগ, আকুতি, আবদার, অনুযোগ, অভিযোগ, দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণার নিবেদন ছন্দোবদ্ধ হয়ে গীতধারায় প্রকাশিত হয়েছে এই পর্যায়ে। এই কারণে সাধনতত্ত্বের পাশাপাশি আত্মনিবেদনের ঘনিষ্ঠ আকূতি শ্যামাবিষয়ক পদগুলিতে অপূর্ব কাব্যময় হয়ে উঠেছে। শুধু তাই নয়, সমাজজীবন ও লৌকিক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ এই পদাবলির অধ্যাত্মতত্ত্ব শেষাবধি পর্যবসিত হয়েছে এক জীবনমুখী কাব্যে।
আজ কালী পূজা। আর কালী পূজার কথা বলতে গেলে কালীকীর্তন বা শ্যামা সংগীতের প্রসঙ্গ আসবে না তাও কখনও সম্ভব?
একটা সময় ছিল যখন শ্যামা সংগীতের প্রসঙ্গ এলে অবধারিতভাবে যে দুটো নাম আমাদের সামনে চলে আসত তাঁরা হলেন, পান্নালাল ভট্টাচার্য ও ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। অদ্ভুত বিষয় হলো, এতকাল পরেও তাঁরা ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। এঁনারা ছাড়াও আরো অনেক শিল্পীই এই কাজে হাত পাকানোর চেষ্টা করেছেন। এবং তাঁরা সফলও হয়েছেন। কুমার শানুও তাঁর গোটা কেরিয়ারে বেশ কিছু শ্যামা সংগীত গেয়েছেন। এবং সেই সমস্ত গান শ্রোতাদের দরাজ প্রশংসাও কুড়িয়েছে। বর্তমানে শ্যামা সংগীত হিসেবে কুমার শানুর গাওয়া গানগুলিও সবথেকে বেশি বাজানো হয়ে থাকে। অতএব আজ আমরা আলোচনা করব কুমার শানুর গাওয়া তেমনি কিছু বাংলা ভক্তিগীতি বা শ্যামাসংগীত নিয়ে।
’সকলি তোমারই ইচ্ছা/ ইচ্ছাময়ী তারা তুমি/ তোমার কর্ম তুমি করো মা/ লোকে বলে করি আমি…’
কুমার শানুর গাওয়া শ্যামাসংগীতের প্রসঙ্গ এলে অবধারিতভাবে যে সংকলনটির কথা আমাদের সর্বাগ্রে মনে আসে সেটা হলো, ‘সকলি তোমার ইচ্ছা’।
১৯৯৪ সালে (তৎকালীন এইচ.এম.ভি অধুনা সারেগামা’র অনুসারী) ওডিন ইন্ডিয়া ক্যাসেট কোম্পানি থেকে কুমার শানুর গাওয়া এই শ্যামা সংগীতের সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল।সংকলনটিতে সর্বমোট গান ছিল আটখানি। যার প্রতিটি গানই ছিল শ্যামা সংগীতের পুরনো গানের রিমেক ভার্সন। তা সত্ত্বেও কুমার শানুর মায়াবী কণ্ঠে বহু শ্রুত গানগুলিও ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। নব্বই দশকের সংগীত পিপাসু শ্রোতাদের মনে থাকবে, সেই সময় রেডিওতে খুব সকালের দিকে চমৎকার একটি অনুষ্ঠান হতো যেখানে মূলত ভক্তিমূলক গান বাজানো হতো। সেখানে বিখ্যাত সব শিল্পীদের গানের পাশাপাশি কুমার শানুর গাওয়া কিছু ভক্তি পর্যায়ের গানও নিয়মিত বাজানো হতো। যার মধ্যে ‘শ্যামা মা কি আমার কালো…’ কিংবা ‘মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন…’ অথবা ‘বসন পরো মা…’ সূর্যের আলো ভালো করে ফুটে ওঠার পূর্বে আধো ঘুম আধো জাগরণ অবস্থায় গানগুলি শুনতে শুনতে এক অপার্থিব ভালো লাগায় মনটা পবিত্র হয়ে উঠত।
চোখের জ্বলে ধোঁয়াবো আজ তারা মায়ের চরণ দু’টি/রাঙা ফুলে সাজাবো মা যতন করে পরিপাটি…
১৯৯৬ এর ছবি ‘তারিণী তারা মা’। ছবির নাম শুনেই বুঝতে অসুবিধা হয় না এটি একটি ভক্তিমূলক ছবি। বাংলা ছবির ইতিহাসে এই ধরনের ছবির সংখ্যা নেহাত কম না। ছবির বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলে অকারণে লেখাটিকে দীর্ঘায়িত করতে চাইছি না। কাজেই সময় নষ্ট না করে সরাসরি ছবির গানের কথায় চলে আসি। ভূপেন রায়ের কথায়, শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের সুরে কুমার শানুর চমৎকার গানটির কথা আগেই উল্লেখ করেছি। যারা মনে করেন কুমার শানু ক্লাসিক্যালটা একেবারেই গাইতে পারেন না, বা ওনার ক্লাসিক্যাল বেস বড্ড নড়বড়ে, আমি তাদেরকে বলব তারা সম্ভব হলে সময় করে একটিবার গানটা শুনে দেখতে পারেন। হতে পারে তাদের এতদিনকার বস্তাপচা ধারণা বদলালেও বদলাতে পারেন।
‘তুই মা তারা শ্মশান বাসী/ ঘর ছেড়ে মা পরবাসী/ আমি কেন বদ্ধ ঘরে মা, জীবনটাকে করি মাটি/আমার সকল জ্বালা মিটিয়ে দিয়ে মা…মা…মা গো…’
ভক্তের হৃদয়ের অন্তস্থল থেকে উঠে আসা ‘মা’ ডাক কুমার শানুর দরদী কণ্ঠে যেন আরো বেশি প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
‘আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা…
বহুল প্রচলিত একটি ভক্তিমূলক গান। মূল গায়ক স্বর্গীয় পান্নালাল ভট্টাচার্য। তাঁর মরমী কণ্ঠের এই কালজয়ী গানখানি একবারের জন্যও শোনেননি এমন একজন বাঙালি এই বাংলায় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। তাঁর পরে এই গান অনেক শিল্পীই কণ্ঠে ধারণ করছেন। তাদের সকলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েই বলছি, ব্যতিক্রমী শিল্পী হিসেবে কুমার শানু তাঁর সুললিত কণ্ঠ মাধুর্যে এই গানকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন। টি-সিরিজ থেকে প্রকাশিত ‘আমায় দে মা পাগল করে’ সংকলনে উপরিউক্ত গানটি ছাড়াও আরো সাতটি গানকে রাখা হয়ছিল। এবং যথারীতি এই সংকলনের গানগুলিও পুরনো কিছু জনপ্রিয় শ্যামাসংগীতের রিমেক ভার্সন ছিল। তথাপি এই সংকলনটি নিয়ে শ্রোতাদের বাড়তি আগ্রহ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি কারণে। এই সংকলনে আটটি গান ছাড়াও বাড়তি পাওনা হিসেবে কুমার শানুর উদাত্ত কণ্ঠের স্তোত্র পাঠ এই সংকলনের জৌলুস এক ধাক্কায় অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। তা কী ছিল সেই স্তোত্র পাঠ একবার দেখে নেওয়া যাক—
‘ওঁ জয়ন্তী মঙ্গলা কালী ভদ্রকালী কপালিনী।
দুর্গা শিবা ক্ষমা ধাত্রী স্বাহা স্বধা নমোঽস্তু তে।।’
অর্থাৎ, হে দেবী, তুমি সর্বোৎকৃষ্টা জয়যুক্তা দেবী জয়ন্তী; তুমি জন্মমৃত্যুবিনাশিনী মোক্ষপ্রদায়িনী দেবী মঙ্গলা; তুমি সর্বসংহারকারিণী কালী; তুমি সুখদায়িনী ভদ্রকালী; আবার তুমিই প্রলয়কালে ব্রহ্মা প্রমুখের মাথার খুলি হস্তে নৃত্যরতা কপালিনী। তুমি দুর্গা, কারণ বহু কষ্ট স্বীকার করে তবে তোমায় লাভ করা যায়; তুমি চৈতন্যময়ী শিবা; তুমি করুণাময়ী ক্ষমা; তুমি বিশ্বধারিণী ধাত্রী; তুমি দেবগণের পোষণকর্ত্রী স্বাহা ও পিতৃগণের পোষণকর্ত্রী স্বধা। তোমায় নমস্কার করি।
সত্যি বলতে কী কুমার শানুর উদাত্ত কণ্ঠের এই স্তোত্র পাঠ শোনাটাও শ্রোতাদের কাছে এক চমৎকার অভিজ্ঞতা। আজকাল নাটক-টিভি-সিরিয়াল বা বিভিন্ন ভক্তিমূলক অনুষ্ঠানেও কুমার শানুর কণ্ঠের এই স্তোত্র পাঠ আবহসংগীত বা নেপথ্য সংগীত হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
’আমার কাছে থাক মা কিছুক্ষণ/ তোকে শুধু চাই মা তারা, চাই না মাণিক ধন।’
‘সিদ্ধিদায়িনী মা তারা’ এই সংকলনের প্রতিটি গানই এককথায় অসাধারণ। সবগুলো গানই নতুন করে লেখা এবং সুর করা। আধুনিক যন্ত্রাণুসঙ্গ সহযোগে গানগুলি শুনতে মন্দ লাগে না। বিশেষ করে ‘এলি যখন আমার ঘরে, আমায় ছেড়ে যাস না তারা মা…’
কিংবা ‘আমার কাছে থাক মা কিছুক্ষণ…’
কুমার শানুর পরিণত কণ্ঠের অব্যর্থ পরিবেশনা গানগুলিকে শ্রোতাদের কাছে আরো বেশি করে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা জানিয়ে রাখি এই সংকলনটি যখন প্রথম বাজারে আসে তখন এর নাম রাখা হয়েছিল ‘এলি যখন আমার ঘরে’। অর্থাৎ নাম ভিন্ন হলেও দু’টি সংকলন এক ও অভিন্ন।
‘ভক্তি স্রোতে ভাস রে মন মায়ের দেখা পাবি,
না হয় বৃথা মন্দিরে তুই মাকে খুঁজে যাবি।’
কুমার শানুর গাওয়া আরো একটি অনবদ্য শ্যামাসংগীত। শুনতে শুনতে মনে হয় গান যেন পারস্পরিক সীমারেখা হারিয়ে এক অখণ্ড পরিমন্ডলে একাকার হয়ে এক বৃহত্তর জীবনাবর্তে আবর্তিত হয়েছে।
২০১৬ সালের একেবারে গোড়ার দিকে রেকর্ড হওয়া আমার নিজের পছন্দের এই গানটি দিয়ে প্রতিবেদনটি শেষ করব। সাধক কল্যাণ বাবার কথায় ও শঙ্কর গোস্বামীর সুরে এই গানটিতে শানুদাকে আমরা পূর্বের সেই চেনা মেজাজে ফিরে পাই। একটা নিরীহ ডিভোশনাল গানকেও যে এই পর্যায়ে তুলে আনা যায় গানটি না শুনলে ঠিক লিখে বোঝানো যাবে না। সঙ্গত কারণেই গানের মধ্যে ‘পাগল করে দে মা তারা’ এই লাইনটা ঘুরেফিরে এসেছে। তাৎপর্যপূর্ণ ব্যাপার হলো এই লাইনটাই শানুদা ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ভাবে গেয়েছেন। যে কারণে গানটির উৎকর্ষতা একধাক্কায় অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। একটা পর্যায়ে পাগল করে দে মা তারা…এই ‘পাগল’ শব্দটা তিনি উচ্চারণ করছেন ভেঙে ভেঙে। ‘পা-গ-ল করে দে মা তারা…’ মনে হচ্ছে তিনিও খানিকটা ভাবাবেগের মধ্যে আছেন।
বিভিন্ন স্বরস্থানে ধ্বনির রং কীভাবে পাল্টে পাল্টে যায় কুমার শানুর এই গানটি শুনলে তার কিছুটা অনুধাবন করতে পারা যায়। সূক্ষাতিসূক্ষ কারুকার্য অথচ কী গভীর আর অর্থবহ।
পরিশেষে বলি সীমিত পরিসরে কুমার শানুর গাওয়া সব ক’টি শ্যামাসংগীত নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভব হলো না। নীচে সংকলনের নাম ও গানের তালিকা দিয়ে দেওয়া হলো। পাঠক গানগুলি সংগ্রহ করে শুনে দেখতে পারেন। এটুকু বলতে পারি একেবারে নিরাশ হবেন না।
|| সকলি তোমারই ইচ্ছা ||
১.সকলি তোমারই ইচ্ছা…
২.মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন…
৩.তুই নাকি মা দয়াময়ী…
৪.শ্যামা মা কি আমার কালো…
৫.বসন পড়ো মা…
৬.মা তোর কত রঙ্গ দেখবো বল…
৭. আমার সাধ না মিটিলো…
৮.সদানন্দময়ী কালী…
|| তারানাম মহানাম ||
১. তারিণী তোমায় ভালোবাসি তাই…
২. ভয়টা কীসের ভয় কেন তোর…
৩. মন্ত্র পড়ে তোর পূজা হয়…
৪. জ্বলছে চিতা উঠছে ধোঁয়া…
|| তারা মায়ের মিষ্টি হাসি ||
১. ভক্তি স্রোতে ভাসরে মন মায়ের দেখা পাবি/ না হয় বৃথাই মন্দিরে তুই মাকে খুঁজে যাবি…
|| দে মা পাগল করে ||
১. স্তোত্র পাঠ
২.দোষ কারো নয় গো মা…
৩.চাই না মা গো রাজা হতে…
৪.আমায় মায়ের পায়ের জবা হয়ে ওঠ না ফুটে মন…
৫. আমার চেতনা চৈতন্য করে দে মা চৈতন্যময়ী…
৬.জেনেছি জেনেছি তারা…
৭. আমায় দে মা পাগল করে…
৯. আমায় একটু জায়গা দাও…
|| রাঙা চরণ ||
১.মা তোর রাঙা চরণ বুকে করে থাকবো আজীবন…
|| দয়াময়ী তারা মা ||
১.তুমি ঈশ্বরী পরমেশ্বরী…
২.তুই যে মা আমার দয়াময়ী তারা মা…
|| সিদ্ধিদায়িণী মা তারা/ এলি যখন আমার ঘরে ||
১.ও মা তারা তোকে ছাড়া মন বসে না আমার…
২.এলি যখন আমার ঘরে, আমায় ছেড়ে যাস না তারা মা..
৩. আমার কাছে থাক মা কিছুক্ষণ..
৪.তারা তারা ডেকে…
৫. জয় মা তারা জয় জয় তারা…
৬.বল জয় তারা জয় তারা বল জয় মা জয় তারা…
৭.জয় জয় তারা নাম তারা নাম…
৮.মহামায়ার খেলা চলছে।