মাঝে কেটে গিয়েছে ১৪টি বছর। হলদি নদী ও তালপাটি খালে কয়েক সহস্রবার জোয়ার ভাটা খেলেছে। ৩৪ বছরের সিপিএম জমানার অবসান হয়েছে তাও তো দশ পেরিয়ে এগারোয় পা দিল। আন্দোলনের শক্ত মাটি নন্দীগ্রামকে যেভাবে নিছক ভোটের রাজনীতির জন্য সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করে বিষিয়ে তোলা হয়েছে তা কল্পনার অতীত। কোনও মতেই নন্দীগ্রামের ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে কোনও মতেই ম্লান হতে দেওয়া উচিত নয়। সংগ্রামী মানুষদের মধ্যে বিভাজনের জন্য যে রাজনৈতিক প্রচার গত বিধানসভা নির্বাচনে নন্দীগ্রামে করা হয়েছে তা রাজ্যবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। যা কোনও অবস্থাতেই কাঙ্খিত ছিল না। রাজনৈতিক বা সাংগঠনিক কারণে রাজনৈতিক দলের নেতাদের দল বদলের ঘটনা আমাদের দেশে বা রাজ্যে কোনও বিস্ময়কর নয়। তবে তা ঐতিহাসিকভাবে সত্য একটা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ গণ আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াস ইতিহাসের প্রতি নিষ্ঠুর বিশ্বাসঘাতকতার নামান্তর। রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করলে কি অসহযোগ আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন বা স্বাধীন তাম্রলিপ্ত মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের আন্দোলনকে যেমন অস্বীকার করা যায় না তেমনি নন্দীগ্রামে সেজ গড়ে সালিম গোষ্ঠীর কেমিক্যাল হাব গড়ার জন্য জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও সাফল্যকে কোনও মতেই আমরা ভুলতে পারি না। দেড় দশক পেরিয়ে এখন ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে নন্দীগ্রাম আন্দোলনের নানা ঘটনাবলীর সংগ্রহ, সংকলন ও সম্পাদনায় গবেষণা ধর্মী গ্রন্থ প্রকাশ বিশেষ জরুরি। আগামী প্রজন্মের অবগতির জন্য সমৃদ্ধ এই ইতিহাসের নানা উপাদান না রেখে গেলে তা হবে নৈতিক ভাবে একটি অপরাধ। এসব নিয়ে উদ্যোগ কোথায়?
অন্যদিকে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কেমিক্যাল কমপ্লেক্স-এর জন্য নয়াচরে সালিম গোষ্ঠীকে দেওয়া বামফ্রন্ট সরকারের লিজ চুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে সর্বশেষ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তা ফিরেয়ে নেওয়ার জন্য যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা জানতে চায় নন্দীগ্রাম সহ গোটা দেশবাসী। যদি সেই উদ্যোগে বিলম্ব হয় তাও অনভিপ্রেত। নন্দীগ্রামের মানুষের পক্ষ থেকে জোরালো ভাবে এই দাবিও তোলা বিশেষ প্রয়োজন। প্রায় ১২ হাজার ৫০০ একর জমি সালিম গোষ্ঠীকে লিজে দেওয়া হয়েছিল। কেমিক্যাল হাবের প্রযুক্তি, না তার কাঁচামাল বা বিনিয়োগ, কোনটাই আমাদের নয়। সমস্ত কিছুই বিদেশি বহুজাতিক কর্পোরেশনের। আমাদের কেবল যোগান শ্রমিক, বিনে পয়সার জমি, আর ঢিলেঢালা পরিবেশ সংক্রান্ত নিয়ম। এই কেমিক্যাল হাব আমাদের জাতীয় সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। নয়াচরে যেহেতু জনবসতি নেই, প্রতিরোধ হবে না—তাই নন্দীগ্রামে ব্যর্থ হওয়ার পর বামফ্রন্ট সরকার সালিম গোষ্ঠীর পুনর্বাসনের জন্য নয়াচরকে বেছে নিয়েছিল। আশা করব, কোনও আইনি জটিলতা যেন সেই চুক্তি বাতিলের ক্ষেহত্রে অন্তরায় না হয়।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নয়াচরে সালিমকে দেওয়া জমি ফেরতের বিষয়ে ২০১৬ সালেই সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন রাজ্য ওই জমি ফেরত নিতে উদ্যোগ নেবে। নয়াচরে সেই জমি সংক্রান্ত লিজের বিষয়টি রাজ্যবাসী জানতে চায়। এটি নন্দীগ্রাম আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি- কেমিক্যাল হাব ও সেজ দেশের কোথাও নয়, কখনও নয়। আজও নন্দীগ্রামের দুর্বিসহ দুটি গণহত্যায় কোনও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি। নন্দীগ্রাম ও খেজুরিতে বাম আমলে রুজু করা দুই শতাধিক মামলায় হেনস্থা হচ্ছে আন্দোলনকারীরাই। নন্দীগ্রামের তুলনায় খেজুরিতে এইসব মামলায় হেনস্থা হচ্ছেন বহু গুণ বেশি আন্দোলনকারী।একটি মিথ্যে মামলাও যেন কেউ হেনস্থা না হয়—এই দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে খেজুরি ও নন্দীগ্রামের সেদিনের আন্দোলনকারীদেরই। আইনি জটিলতার পথে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকারীরা দেড় দশক পরেও কেন নিশ্চিত জীবন যাপন করতে পারবেন না? নন্দীগ্রামের ঘটনার বিস্তারিত ও পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্ট মুখ্যমন্ত্রীর গোচরে যথাযথ এনে তা সমাধানের উদ্যোগের দায় কিন্তু এড়াতে পারে না ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। খেজুরি ও নন্দীগ্রামের শাসক দলের নেতৃত্বকে এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে দেড় দশক পরে এখনও কেন সেদিনের আন্দোলনকারীরা ঘুরে বেড়াবে আশংকায় অনিশ্চিত জীবন নিয়ে? অপরদিকে সেদিনের দুস্কৃতীদের বড় অংশ বহলা তবিয়তে ঘুরে বেড়াচ্ছে—এটাও এক বড় ট্র্যাজেডি।
আজ ১০ নভেম্বর,২০২১ পনের বছরে পা দিল নন্দীগ্রামে সিপিএমের ‘সূর্যোদয়’-এর। আর মাঝে মাত্র কয়েকটা মাস পার হলেই ১৪ মার্চ, ২০২২ পনের বছর পূরণ হবে নন্দীগ্রামে পুলিশ ও সিপিএম হার্মাদদের যৌথ গণহত্যা অভিযানের। নভেম্বরের শীতে হাড় হিমকরা পরিস্থিতি তৈরি করে চারদিক থেকে ঘিরে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে হার্মাদবাহিনীর নন্দীগ্রাম দখলের তৎকালীন সিপিএম সাংসদ লক্ষণ শেঠের কর্মসূচিতে সিলমোহর দিয়েছিল আলিমুদ্দিনওয়ালারা। রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধি বলেছিলেন, দীপাবলীর আলোকে ম্লান করে দিয়েছে নন্দীগ্রামের ঘটনা। ‘অপারেশন সূর্যোদয়ে’ শহিদ হয়েছিলেন শেখ রেজাউল ও মালতী জানা। আর ওই দিনের ঘটনায় নিখোঁজ সাত জনের সন্ধান আজও মেলেনি। এর আগে ১৪ মার্চ,২০০৭ নিখোঁজ হয়েছিলেন আরও তিন জন। ২০০৭ সালে টানা ১১ মাস লড়াই-এর পর সিপিএমের এলাকা দখলের জন্য ফের নন্দীগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে পুলিশ ক্যাম্পগুলি তুলে নিয়ে নন্দীগ্রাম থানার পুলিশকে নিষ্ক্রিয় রেখে ১০ নভেম্বর শান্তিপূর্ণ মিছিলের ওপর হামলা, হত্যালীলা, লাশ পাচার, গুম, অপহরণের ঘটনা সবই ঘটেছে অপারেশন সূর্যোদয়ে। সেদিনের কথা আলোচনা করতে গেলে রাজনৈতিক নেতাদের নাম তো আলোচনায় অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে এসে থাকে। কিন্তু তৎকালীন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী, ডিআইডি সিআরপিএফ অলোক রাজ, মেধা পাটকর, মহাশ্বেতা দেবী, কবীর সুমন এঁদের কথা ভুলি কি করে? রক্তস্নাত নন্দীগ্রামে বারবার ছুটে গিয়েছেন রাজ্য তথা দেশের এমনকী আন্তর্জাতিকস্তরের মানবাধিকার কর্মীরা। রাজ্য রাজনীতির পট পরিবর্তনে সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ও জঙ্গলমহলের শহিদদের অবদানকে নত মস্তকে স্বীকার করতেই হবে। আর সেই সাথে সেই গৌরবোজ্জ্বল গণ আন্দোলনের ইতিহাসকে তুলে ধরার জন্য কার্যকরী উদ্যোগ নিতেই হবে। নতুবা নন্দীগ্রামে ৩ জানুয়ারি, ৭ জানুয়ারি, ১৪ মার্চ, ১০ নভেম্বর এই দিনগুলি উদযাপন নিছক একটি প্রথায় পরিণত হবে। আজ নন্দীগ্রামের গোকুলনগর অঞ্চলের তেখালিতে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির উদ্যোগে শহিদ স্মরণ অনুষ্ঠানে মানুষের ঢল নামাই প্রমাণ করে নন্দীগ্রাম আন্দোলন নিয়ে মানুষের আবেগে কোনও চির ধরেনি। কলকাতা সহ রাজ্যের অন্যান্য জেলা থেকেও বহু মানুষ ছুটে গিয়েছিলেন এদিনের তেখালির সভায়। মহাশ্বেতা দেবী প্রতিষ্ঠিত নন্দীগ্রাম মঞ্চের প্রতিনিধিরাও ডাঃ দেবপ্রিয় মল্লিকের নেতৃত্বে গিয়েছিলেন তেখালির সভায়। শহিদবেদীতে মাল্যদান থেকে বক্তব্যে তাঁরাও অন্যান্য বারের মতই শরিক হয়েছিলেন জেনে ভাল লাগছে। খুব ইচ্ছা থাকলেও শারিরীক কারণে এদিন যাওয়া হল না তবে ১৪ মার্চ, ২০২২ ভাঙাবেড়ায় গণহত্যার ১৫ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে যাওয়ার ইচ্ছা রইল। ৭ জানুয়ারি ভোরবেলার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বহুবার আগের দিন নন্দীগ্রামে পৌঁছে গিয়েছি। সংবাদ সংগ্রহের জন্য তো বহু এলাকায় যেতে হয় সাংবাদিকদের কিন্তু সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম ও জঙ্গলমহলের মাটির টানে ভিতর থেকে যেন নাড়া দেয়—শহিদের রক্তভেজা মাটির স্বতন্ত্রতা রয়েছে যার ডাকে তাই সাড়া দিতেই হয়।