Breaking
11 Apr 2025, Fri

মেলোডি কিং কুমার শানুর জন্মদিন উপলক্ষে তারকনাথ দত্তের বিশেষ প্রতিবেদন

|| কুমার শানু, কিছু কথা কিছু গল্প ||

Advertisement

আশির দশকের একেবারে শেষের দিকে, তখন বোধহয় আমি ক্লাস ফোরে পড়ি। গায়ে‌ হাফ সার্ট পরনে হাফ প্যান্ট। গান যে খুব একটা বুঝি তা না, তবে গান শোনার অভ্যাস আছে। কার গান? কেমন গান? বোঝার মত বোধ তখনও হয়নি। আমার বন্ধু বৃত্তের অনেকেই জানেন, আমার বাবার মাইকের ব্যবসা ছিল। পুজো এলেই গাদাগাদা নতুন গানের ক্যাসেট কিনতেন। প্রয়োজনের তাগিদেই কিনতেন। মাইক-লাইনে তখন যার যত গানের স্টক তার কদর তত বেশি। বাজারে তখন সদ্য সদ্য আসা ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির গান বাজছে— ‘পাপা কেহতে হ্যায় বড়া নাম করেগা—’ কার গান জানি না। তবে গুনগুন আমিও করি। তখন কিশোর কুমার, বাপী লাহিড়ি, লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, সন্ধা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, মান্না দে, আরতি মুখোপাধ্যায় এই নাম গুলোর সাথে মোটামুটি একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে।
হঠাৎ দেখি সেবার সব জায়গায় ‘অমর শিল্পী তুমি কিশোর কুমার…’ গান বাজছে। কে যেন বলল, এটা কিশোর কুমারের গান। আমার কম বয়স, গান সেভাবে না বুঝলেও মনে খটকা জাগল— কিশোর কুমার নিজেই নিজেকে অমর শিল্পী বলছেন? ভারী অদ্ভুত তো? এটা কীভাবে সম্ভব? বাবাকে দেখলাম সবাইকে ক্যাসেটের কভার দেখিয়ে দেখিয়ে বলছেন, “এই ছেলেটা নতুন এসেছে বাজারে, নাম কুমার শানু। হুবহু কিশোর কুমারের মত গলা।” ক্যাসেট কভারে বড় বড় করে কিশোর কুমারের ছবি, ক্যাসেটের একেবারে নীচে ছোট্ট করে মূল গায়কের ছবি। থুতনিতে হাত রাখা মোটের উপর বিশেষত্বহীন ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম, এই নাকি কুমার শানু? পুজোয় ঠাকুর দেখতে বেড়িয়ে প্রতিটা পুজো প্যান্ডেলে শুনছি ‘অমর শিল্পী’ অ্যালবামের গানগুলো বাজছে। শুধু কি ‘অমর শিল্পী? ‘তুমি যদি থাকতে…’ বা ‘কল্কাপাড়ের নীল শাড়িতে প্রথম দেখেছি…’ গানগুলো নাগাড়ে বেজে যাচ্ছে। সকাল থেকে রাত দিন কম করে হলেও পঞ্চাশবার এই একই গান। মনে মনে ভাবলাম মানুষের ধৈর্য আছে বটে। আজ বলতে দ্বিধা নেই কুমার শানু নামের এই নতুন গায়ক আমাকে সেভাবে আকৃষ্ট করতে পারেননি। আমার কাছে তখন ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ ছবির গানের গায়কের গলাটা অনেক বেশি পছন্দের। ক্লাস সিক্সে ওঠার পর এলো ‘আশিকী’। যেদিন থেকে আমি একটু আধটু গান শুনতে শুরু করেছি তার মধ্যে এত বেশিবার কোন গান বাজতে শুনিনি। প্রতিটা পুজো প্যান্ডেল থেকে শুরু করে সমস্ত অনুষ্ঠানে, বাসে, লরিতে, পাড়ার মোড়ের পান-বিড়ির ছোট্ট গুমটিতে, প্রায় প্রত্যেকটা বাড়ির টেপরেকর্ডারে শুধুই ‘আশিকী’ ছবির গান। একটা হিন্দি ছবির গান যে এমন ধুন্ধুমার কাণ্ড বাঁধাতে পারে এমনতর ধারণা আমার একেবারেই ছিল না। শুনলাম সবাই বলাবলি করছে—’কিশোর কুমারের পর এতদিনে একটা সিংগার এলো, যার গান শোনার জন্য লোক একেবারে হামলে পড়ছে।’ আমাদের অডিও ক্যাসেটের ব্যবসা ছিল। আমার মনে আছে, সেবার অন্ততপক্ষে ষাট থেকে সত্তর হাজার ‘আশিকী’ ছবির অডিও ক্যাসেট সরু গলি বেয়ে প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে‌ পাঠানো হয়েছিল। বেস্ট সেলার হওয়ার সুবাদে কম্পানী থেকে বাবাকে বিশেষ পুরস্কারও দেওয়া হয়েছিল। হুবহু একই ঘটনা ঘটেছিল ‘সুরের রজনীগন্ধা’ ও ‘প্রিয়তমা মনে রেখ’এর ক্ষেত্রেও। ভাবা যায়? একজন গায়কের জনপ্রিয়তা কোন পর্যায়ে পৌঁছলে এমনটা হতে পারে!
তখন পুজোর গান নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল চোখে পড়ার মত। যদিও সারা বছরই বিভিন্ন শিল্পীর গাওয়া নতুন নতুন সব গান আত্মপ্রকাশ করত। এর মধ্যে সিনেমার গান বা আধুনিক গান যেমন থাকত, পাশাপাশি লোকগীতি, ভক্তিগীতি কিংবা কৌতুক নকশা, নাটক এসবের ক্যাসেট কেনা নিয়েও সাধারণ মানুষ ছিল দ্বিধাহীন। তখন প্রায় কমবেশি প্রত্যেকের বাড়িতেই রেডিওর পাশাপাশি নামীদামি না হোক অন্তত চলনসই ক্যাসেট প্লেয়ার বা টেপরেকর্ডার থাকতই। বস্তুত এগুলোই ছিল আমজনতার অবসর সময়ে বিনোদনের একমাত্র অবলম্বন। প্রবল ইচ্ছে থাকলেও যারা নিয়ম করে নিত্যনতুন ক্যাসেট কিনতে পারতেন না তারা ব্ল্যাঙ্ক ক্যাসেটে বা পুরনো ক্যাসেটে মনমতো নতুন গান রেকর্ড করিয়ে নিতেন। সারাবছর টুকটাক এই সমস্ত গান নিয়ে চর্চা চললেও পুজোর সময় চিত্রটা কিছুটা বদলে যেত। পুজোর গান নিয়ে একটা শোরগোল পড়ে যেত। ছোটবেলায় বাবাকে দেখেছি লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, কিশোর কুমার, শ্যামল মিত্র মান্না দে প্রভৃতি দিকপাল শিল্পীদের পুজোর গানের রেকর্ড কিনে আনতেন। রেকর্ডের জমানা পাকাপাকিভাবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেবার পূর্বেই অডিও ক্যাসেটের বাড়বাড়ন্ত শুরু হয়ে গিয়েছিল। তারপর একটু একটু করে একটা সময় রেকর্ডকে পিছনে ফেলে অডিও ক্যাসেট একদিন সমগ্র বাজারটাকে পুরোপুরি দখল করে নিয়েছিল। উপরে যেসমস্ত প্রাতঃস্মরণীয় শিল্পীদের কথা বললাম তারাও ক্যাসেটের জমানায় দস্তুরমত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। এনাদের পরে ক্যাসেটের জমানায় যার পুজোর গান নিয়ে শ্রোতাদের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি ছিল তিনি কুমার শানু। ‘অমর শিল্পী’র কথা আগেই বলেছি। ওটা ছাড়াও কুমার শানুর গাওয়া আমার প্রাণের খাতায়, সুরের রজনীগন্ধা, প্রিয়তমা মনে রেখো, সোনার মেয়ে, ফুলের আসরে, জলসাঘর, ফেলে আসা পথে, আরো পরে একটি চোখে গঙ্গা একটি চোখে পদ্মা, তোমাকে শোনাবো বলে, প্রেরণা এই সংকলনগুলিও বিরাট জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল। লক্ষনীয় বিষয় হলো এর পর থেকেই বাংলাগানের খোলনলচে বদলাতে শুরু করে। শ্রোতাদের মধ্যেও পুজোর গান নিয়ে আগ্রহ কমতে থাকে।
সাধারণ শ্রোতাদের অনেকেই এই আকস্মিক পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে উঠতে পারেননি। সে অন্য কথা।
কথা হচ্ছিলো কুমার শানুর পুজোর গান নিয়ে। কুমার শানুর গাওয়া সেই সমস্ত গানগুলো আজও সমান জনপ্রিয়। সে পুজো প্যান্ডেল হোক কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান তাঁর গানগুলোই সবথেকে বেশি বেজে থাকে। এটা ঘটনা।
এরপর বছর গড়িয়েছে, কুমার শানু’র আরো বহু গান বাজারে এসেছে। এবং সবক’টার প্রায় একই অবস্থা। যৎসামান্য উনিশ-বিশ এই যা। তখন হিন্দি বা বাংলা গানের ক্যাসেট কিনতে এসে সবাই প্রথমেই যেটা জানত চাইতেন, কুমার শানুর গান ক’টা আছে? আছে কি নেই সেটা বড় কথা নয়। তাদের ভাবখানা এমন কুমার শানু’র গান থাকলে ক্যাসেট কেনা আছে, নচেৎ নয়। আমার মনে হয় এটা একধরনের পাগলামি; এবং বাড়াবাড়ি রকমের পাগলামি। কোনভাবে তাদের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে থাকবে যে, কুমার শানুর গান মানেই বেঁচে থাকার চাবিকাঠি। সুখে হোক, দুঃখে হোক, কুমার শানুর গান সর্বক্ষেত্রেই প্রাসঙ্গিক। এটাই হলো স্টারডম, একেই বোধহয় জনপ্রিয়তা বলে। যারা দেখেননি তাদের কাছে গোটা ব্যপারটা অবিশ্বাস্য গল্প মনে হলেও এটাই দিনের আলোর মত সত্যি। আজ যে প্রসেনজিৎ চ্যাটার্জী বাংলার অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠ নায়ক, ৯০তে তাঁর অবস্থা তখন সত্যিই খুব খারাপ যাচ্ছিল। হাতে বলার মত কোন ছবি নেই। পর পর খানকতক ছবি বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে একেবারে যা তা অবস্থা। ফিল্ম প্রোডিউসাররা তাঁর উপর লগ্নি করতেই সাহস পাচ্ছিলেন না। এখানে একটা কথা বলে রাখা ভালো, বুম্বাদার সেই সময়কার বেশ কিছু ছবিতে কেন জানি না কোন এক অদ্ভুত কারণে কুমার শানুর কোন গান ছিল না। অথচ তখন কী হিন্দি কী বাংলা কুমার শানুর গান ছাড়া ভাবাই যায় না। অন্যদিকে তখন সমস্ত বাংলা ছবির বাজার চিরঞ্জিতের একার দখলে চলে গিয়েছিল। চিরঞ্জিতের লিপে কুমার শানুর গাওয়া একের পর এক হিট গান পাবলিকের মুখে মুখে ফিরছে। বুম্বাদার তখন এমন অবস্থা হয়েছিল, খলনায়কের ছোট্ট পার্শ্বচরিত্র (পড়তে হবে ‘সংঘর্ষ’) করতে পর্যন্ত বাধ্য হয়েছিলেন। তারপর ১৯৯৬ সালে এলো ‘বিয়ের ফুল’ নামে একটা বাংলা ছবি। বস্তুত এই ছবির মাধ্যমেই রানী মুখার্জির নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই ছবির গানের কথা লিখেছিলেন শ্রদ্ধেয় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। যতীন-ললিত সুরারোপিত
এই ছবির পুরুষ কণ্ঠের প্রত্যেকটা গান কুমার শানুর গাওয়া। প্রতিটা গান হিট— শুধু হিট নয়, সুপার ডুপার হিট। এবং যথারীতি ছবিও সুপার হিট। সেই থেকে শুরু হলো প্রসেনজিৎ-কুমার শানু জুটির এক নতুন অধ্যায়। আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি বুম্বাদাকে। একের পর এক হিট ছবি তিনি উপহার দিয়ে গেছেন আপামর সিনেমাপ্রেমী মানুষদের। বলাই বাহুল্য সেইসমস্ত ম্যাক্সিমাম হিট ছবির নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী ছিলেন কুমার শানু।

আজকাল বলার চেষ্টা হচ্ছে,
বর্তমান প্রজন্ম নাকি কুমার শানুর গান শোনে না। তাদের জ্ঞাতার্থে বলি, ইহা সত্য নহে। এমন অনেক কমবয়সী শ্রোতাকেও দেখেছি যারা নতুন গানের পাশাপাশি কুমার শানুর গান শোনে। আগ্রহ নিয়ে শিল্পী সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে অবগত হতে চায়। কুমার শানুর সেই স্টারডম তাদের হয়ত দেখার সুযোগ হয়নি , কিন্তু তাঁর গানের মধ্যে নিয়ে সেই সময়টাকে উপলব্ধি করার চেষ্টায় কোন খামতি নেই। এটা গেল একটা দিক। আবার এমন অনেকেই আছেন যারা কুমার শানুর গানকে পছন্দ করে না। আমি মনে করি এই পছন্দ অপছন্দ বিষয়টা একান্তই ব্যক্তিগত। এটা হতেই পারে। সবার সবাইকে পছন্দ হবে তার কোন মানে নেই। সেটা শুধু কুমার শানু কেন, জগতের সকল বিখ্যাত মানুষদের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য।
কিন্তু কখনও কখনও কিছু মানুষ বর্ষীয়ান শিল্পীর প্রতি ন্যূনতম শ্রদ্ধা তো দূরে থাক, চূড়ান্ত অবজ্ঞার পাশাপাশি ব্যক্তি আক্রমণের রাস্তা ধরেন। এই পর্যায়ের মানুষেরা আর যাইহোক প্রকৃত সংগীতপ্রেমী হতে পারেন না। প্রতিক্ষেত্রে তাদের চেষ্টা থাকে কীভাবে কুমার শানুর কৃতিত্বকে খর্ব করা যায়। তারা কথায় কথায় এমন এমন সব দাবি করে বসেন যা আদতে ভিত্তিহীন,
অন্তঃসারশূন্য।
এই যেমন কিছুদিন যাবত সোশ্যাল মিডিয়ায় কান পাতলেই কুমার শানু আর এ.আর রহমানকে নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
কুমার শানু তাঁর গোটা কেরিয়ারের অসংখ্য গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন। এই পর্যায়ে তিনি যেসমস্ত সংগীত পরিচালকের সাথে কাজ করেছেন তারা প্রত্যেকেই এক একজন রথী মহারথী। স্বর্গীয় আর.ডি বর্মন থেকে শুরু বাপী লাহিড়ী, নৌশাদ, অনু মালিক নদীম-শ্রবন যতিন-ললিত কে নেই? তাদের সকলের নাম একত্রিত করে তালিকা দীর্ঘায়িত করতে চাচ্ছি না। অথচ সমসাময়িক আর এক নামজাদা সংগীত পরিচালক এ.আর রহমানের সাথে কুমার শানুর উল্লেখযোগ্য কোন কাজ আমরা দেখতে পাই না। সাকুল্যে একটিমাত্র গান, সেই গান যে বিরাট আহামরি কিছু গান ছিল তাও না। অনেক বোদ্ধাই এর জন্য কুমার শানুকে এককভাবে দায়ী করে অদ্ভুত অদ্ভুত সব যুক্তি খাড়া করে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে একধরনের আত্মশ্লাঘা বোধ করেন। কেন না একটা বিষয়ে তারা প্রায় নিশ্চিত যে, কুমার শানুর সমালোচনা করা জগতের সহজ কাজগুলোর একটা। তারা প্রায় ধরেই নেন আর যাই হোক এই মানুষটিকে যদি সমালোচনায় বিদ্ধ করা যায় তার দিক থেকে কোন প্রতিবাদ প্রতিহিংসার ঢেউ তাদের উপড়ে আছড়ে পড়বে না। যে কারণে তাঁর সমসাময়িক বা হালফিলের অনেক কলমচি কুমার শানুর কেরিয়ার বা ব্যক্তিজীবন নিয়ে যেসমস্ত তথ্যাদি আমাদের সামনে তুলে ধরেন তার বেশিরভাটাই অমূলক, ভিত্তিহীন কিংবা অর্ধসত্য।
তা যে কথা হচ্ছিল, কুমার শানু আর
রহমানের কাজের স্বল্পতার জন্য যারা কুমার শানুকে দায়ী করেন তারা আর যাইহোক নিরপেক্ষভাবে কুমার শানুর মূল্যায়ন করবেন এমনটা ভাবার কোন কারণ দেখি না। যে ছবির গান গাওয়া নিয়ে এত বিতর্ক এত কথা চালাচালি
ঠিক কী ঘটনা ঘটেছিল একবার দেখে নেওয়া যাক।
ঠিক যে কারণে কুমার শানু ‘রোজা’ ছবির গান গাইবার ক্ষেত্রে নিজের অপারগতার কথা জানিয়েছিলেন, সেই একই কারণ দেখিয়ে মাননীয়া অলকা ইয়াগনিকও ‘রোজা’ ছবির গান গাওয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। রোজা’র হিন্দি সংস্করণে গান গাইবার ক্ষেত্রে রহমানের প্রাথমিক শর্ত ছিল চেন্নাইতে গিয়ে গান রেকর্ড করতে হবে। সেইসময় কুমার শানু এতটাই ব্যস্ত ছিলেন, প্রডিউসার, মিউজিক ডিরক্টরদের আবদার রাখতে তাকে দিনে দশটা-পাঁচটা গান রেকর্ড করতে হচ্ছে। সুতরাং তাঁর পক্ষে সময় বার করে অন্যত্র গিয়ে গান রেকর্ড করা সম্ভব ছিল না। অলকা ইয়াগনিকের অবস্থাও তথৈবচ। তিনিও সময়াভাবের কারণ দেখিয়ে পিছিয়ে আসেন। সাম্প্রতিক কালে এক একান্ত আলাপচারিতায় তিনি অবশ্য অন্য কথা বলেছেন, রহমানের দক্ষতার প্রতি তার না কি সেই সময় মোটেও আস্থা ছিল না। যে কারণে তিনি ‘রোজা’র গান গাইতে অস্বীকার করেছিলেন। পরে অবশ্য একাধিক ছবিতে তারা একসঙ্গে কাজ করেছেন। রহমান সম্পর্কে তাঁর পূর্বের মূল্যায়ণ থেকে সরে আসতে সময় লাগেনি। বর্তমানে রহমান একজন বিরাট মাপের সংগীত পরিচালক সে বিষয়ে তাঁর মনে কোনপ্রকার সন্দেহ নেই। অবশ্য কবে থেকে রহমান সম্পর্কে তাঁর ধারণা বদলাতে শুরু করেছিল সে বিষয়ে মাননীয়া অবশ্য স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
হতে পারে এই ঘটনায় রহমান মানসিক দিক থেকে আহত হয়েছিলেন। যে কারণে তার অভিমান হওয়াটাই স্বাভাবিক। যে কারণে ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা গায়ক হওয়া সত্ত্বেও কুমার শানুকে তিনি আজীবন ব্রাত্য করে রাখলেন। অথচ মজার বিষয় হলো কুমার শানু’র প্রতি চরমপন্থা অবলম্বন করলেও অলকা ইয়াগনিকের ক্ষেত্রে তিনি নরম পন্থাকেই মান্যতা দিলেন।
অনেক বোদ্ধা মনে করেন কুমার শানু প্রশিক্ষিত গায়ক নন। রহমানের সুর বেশ জটিল ধরনের। সেই জটিলতার সাথে খাপ খাওয়াতে কুমার শানুকে যথেষ্ট বেগ পেতে হতো। আদৌ কি তাই? কুমার শানু সরাসরি না হলেও রহমানের সুরের ছায়ায় তৈরি হওয়া গান বা রহমানীয় ঘরানার গান গেয়ে প্রমাণ করেছেন যে, তাঁর সমালোচকদের মতবাদের মধ্যে কোন সারবত্তা নেই। আদতে প্রতিভাবান শিল্পীর সীমাবদ্ধতা বলে কিছু হয় না।
শুধুমাত্র রহমানের সাথে কাজ করা হয়নি বলে কুমার শানুর সংগীত জীবন অসম্পূর্ণ এমনটা যারা মনে করেন তারা আসলে কুমার শানুর শক্তি বা দুর্বলতা সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। অথবা শুধুমাত্র কুমার শানুকে পছন্দ করেন না বলে তাঁর কৃতিত্বকে খাটো করে দেখানোর চেষ্টা করেন। অথচ ইতিহাস কিন্তু অন্য কথা বলে।
সুর সম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর ও.পি নায়ারের সুরে একটিও গান করেননি। অমিতাভ বচ্চন সুভাষ ঘাইয়ের মত বিখ্যাত পরিচালকের সাথে একটা ছবিও করেননি। এতে করে কী প্রমাণিত হয়, তাদের শিল্পী জীবন অসম্পূর্ণ?
সলিল চৌধুরী কিশোর কুমারের গায়কী নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। প্রকাশ্যেই বহুবার বিরোধিতা করেছেন।
নৌশাদের মত দিকপাল সংগীত পরিচালক কিশোর কুমারকে কোন গায়ক বলেই মনে করতেন না। তাঁর সুরে কিশোর কুমারের সাকুল্যে একটি মাত্র গান। প্রডিউসারদের চাপে পড়ে যে গান তিনি কিশোর কুমারকে দিয়ে গাওয়াতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিলেন। তাও রেকর্ডিংয়ের দিন নৌশাদ সাহেব অনুপস্থিত ছিলেন। অথচ এই নৌশাদ সাহেবই কুমার শানুকে দিয়ে একাধিক গান গাইয়েছেন। কুমার শানুকে তিনি যথেষ্ট স্নেহও করতেন।
এতে করে আদৌ কিছু প্রমাণিত হয় কি? উপরে এতক্ষণ ধরে যাদের নিয়ে আলোচনা করলাম তাঁরা প্রত্যেকেই এক একজন জিনিয়াস।
এখন যদি কুমার শানু রহমান প্রসঙ্গে বলি যে, রহমানের দুর্ভাগ্য যে তিনি কুমার শানুকে দিয়ে গাওয়াতে পারেননি। এটা তার একধরনের ব্যর্থতা, তাহলে কি খুব একটা ভুল বলা হবে?
অন্যদিকে কুমার শানু তাঁর শিল্পী জীবনে এমন কিছু গান গেয়েছেন সেই গানগুলো হয়ত সেই অর্থে প্রচারসফল নয়, কিন্তু সেই সমস্ত গানগুলোতে তিনি যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। বস্তুত সেই সমস্ত গান শুনলে কুমার শানুর এক অজানা দিক আমাদের কাছে প্রকট হয়ে ওঠে।
সেই কবে কেদারনাথ ভট্টাচার্য থেকে কুমার শানু, আত্মপ্রকাশের ঊষালগ্নে রব উঠেছিল, ‘গেল গেল সব শেষ হয়ে গেল’! সেই ট্রাডিশন সমানে চলে আসছে।
শুরুর দিকে বাংলার এক বিখ্যাত সংগীত পরিচালকের কাজ চাইতে গেলে কুমার শানুর গলা শুনে বলেছিলেন, “দুধ থাকতে ঘোল কেন খাবো কেন?” ইঙ্গিতটা স্পষ্ট। পরবর্তীকালে অবশ্য সেই সুরকার ভদ্রলোক বহু ছবিতে কুমার শানুকে দিয়ে গান গাইয়েছেন। বিখ্যাত বিখ্যাত সব গান।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে কুমার শানুকে নিয়ে এই ‘গেল গেল’ রব ওঠাটা নতুন কিছু নয়।
এমনও হয়েছে কালি পুজোর সময় চারিপাশে কুমার শানুর কণ্ঠে শ্যামাসংগীত বাজতে শুনে ‘বাঙালি তার ঐতিহ্য ভুলেছে’ বলে কেউ কেউ রীতিমতো আশংকা প্রকাশ করেছেন।
তাদের মধ্যে থেকে অনেকেই আবার বলেছেন, পান্নালাল ভট্টাচার্য্য একজন সাধক ছিলেন, তাঁর গাওয়া গান শুনলে ভাবে-ভক্তিতে হৃদয় বিগলিত হয়ে ওঠে। সেখানে কুমার শানুর কণ্ঠে শ্যামাসংগীত জাস্ট নেওয়া যায় না। শুনতেই যদি হয় প্রয়োজনে অমুক শিল্পীর গান শুনব তাই বলে কুমার শানু কখনই নয়। এটা কারো নিজস্ব মতবাদ হতেই পারে, কিন্তু সেটা সকলের ক্ষেত্রে শিরোধার্য হবে এমনটা ভাবার কোন কারণ নেই। সবক্ষেত্রে আমি কী চাইছি সেটা গুরুত্বপূর্ণ নাও হতে পারে। জনগণ কী চাইছে সেটাই হলো বড় কথা। ১৯৯8 সালে কুমার শানু যখন খ্যাতির মধ্যগগনে ‘সকলি তোমারই ইচ্ছা’ সংকলনটি বাজারে আসে। আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে ক্যাসেট কেনা নিয়ে মানুষ কী পরিমাণ হুড়োহুড়ি লাগিয়ে দিয়েছিল। বুদ্ধিজীবীরা বলবেন, পাবলিক হুজুকে মাতাল। তাৎপর্যপূর্ণভাবে মানুষের এই প্রকৃতিগত আচরণ যখন দীর্ঘস্থায়ী অভ্যাসে পরিরণত হয়, তখন তাকে কি আদৌও হুজুক বলা যায়? কেন না প্রমাণিত সত্য এই যে, হুজুক ক্ষণস্থায়ী। কুমার শানুর গান দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে শ্রোতারা একটানা শুনে আসছেন। তাদের তো একঘেয়েমিতে পেয়ে বসার কথা। সেটা হচ্ছে না, তার বদলে যতদিন যাচ্ছে তাঁর গানের গ্রহণযোগ্যতা ক্রমশই বাড়ছে। কুমার শানু আজকাল আগের মত দিনে দশটা পাঁচটা গান করছেন না এটা যেমন ঠিক, আবার এটাও ঠিক যে ইন্টারনেটে তাঁর গানগুলিই এখনও পর্যন্ত মানুষ সবথেকে বেশি খোঁজ করে চলেছে। যে কারণে গুগল পর্যন্ত তাঁকে পুরস্কার প্রদান করেছে। অন্যেরা মান্যতা দিচ্ছে, আমরা দিচ্ছি না।
কুমার শানুর গান সবার ভালো লাগতেই হবে এমন দিব্বি কেউ দেয়নি। ভালোলাগা বা মন্দ লাগা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি এমন মানুষকেও দেখেছি যারা প্রকাশ্যে কুমার শানুর গান নিয়ে সমালোচনা করেন। কুমার শানু একজন গায়ক হলো? ও তো নাক দিয়ে গায়? ক্লাসিক্যালটা একেবারেই জানে না। ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ তারা কেউই কুমার শানুর গানটা ভালো করে কখনও শুনেছেন কিনা সন্দেহ আছে। শ্রদ্ধা না থাকলে ভক্তি আসে না। কুমার শানুর দুর্ভাগ্য তিনি বাংলায় জন্মেছেন। বিগত কয়েক বছরে কুমার শানু দেশ-বিদেশে প্রচুর সম্মান পেয়েছেন। যা কিনা ভারতীয় সংগীতের ইতিহাসে কুমার শানুর পূর্বসূরী বা উত্তরসূরী কেউ পেয়েছেন বলে মনে হয় না। অথচ
এটা নিয়ে কারো কোন মাথাব্যথা আছে? কোন পত্রিকায় এসব নিয়ে কোন নিউজ হয়েছে? হয়নি। অথচ জনৈকা নায়িকার গর্ভজাত সন্তানের পিতা কে? তা নিয়ে মিডিয়ার হ্যাংলামো বা শোভন-বৈশাখীর ধারাবাহিক ন্যাকামোও গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়েছে। এগুলো বাংলা ও বাঙালির ঐতিহ্যকে মহিমান্বিত করেছে তাই তো? শুধু কুমার শানু শ্যামাসংগীত গেয়ে বাঙালির এতদিনকার এতিহ্যবাহী পরম্পরায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ফেলেছেন। তিনি কি বাঙালি নন? কেউ কেউ দেখছি বলছেন, হিন্দি গানই তো ঠিক ছিল, আবার শ্যামাসংগীত কেন? যারা বলছেন, প্রয়োজনে অমুক শিল্পীর শ্যামাসংগীত শুনব, তাদের কাছে আমার একটাই প্রশ্ন, কেন? আপনারা যে শিল্পীর কথা বলছেন তিনি কি পান্নালাল ভট্টাচার্যের মত সাধক না কি? আর কোথায় লেখা আছে একমাত্র সাধক ব্যক্তিরই শ্যামাসংগীত গাইবার অধিকার একচেটিয়া?
যারা কুমার শানু’র সমালোচনা করেছেন, আমার মনে হয় না তারা কুমার শানুর গানগুলি খুব একটা গুরুত্ব দিয়ে শুনেছেন। শুনলে কুমার শানু’র প্রতি এতটা নির্দয় হতে পারতেন না। কুমার শানুর যে পর্যায়ের গান নিয়ে আজ সমালোচনা হচ্ছে এই গান তো তিনি আজ রেকর্ড করেননি। কখনও কি কেউ ভেবে দেখেছেন সাতাশ বছর আগে রেকর্ড করা গান আজও কেন এতটা প্রাসঙ্গিক? তার আগে পরে অনেকেই তো শ্যামাসংগীত গেয়েছেন, সেইসব শিল্পী বা তাদের গানগুলিই বা আজ কোথায়? তাহলে গোটা বিষয়টা কী দাঁড়ালো? কুমার শানুর গান প্রায় তিনটে দশক তার গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। শ্রোতারা এখনও পর্যন্ত তাঁর গানগুলিকেই পছন্দ করছেন। এটাই কুমার শানু, আর এটাই তাঁর গানের সার্থকতা। এখন কেউ যদি মনে করেন কুমার শানুর গান যারা শোনে তারা কোন শ্রোতাই নয়, তাহলে অবশ্য আলাদা কথা।
আসলে সমস্যাটা কুমার শানুর গান নিয়ে নয়, সমস্যাটা কুমার শানুকে নিয়ে। কোন অজ্ঞাত কারণে কিছু মানুষের কুমার শানু নামটার প্রতি অ্যালার্জি আছে। এখন আমি মেনে নিতে পারছি না বলে, বাঙালি তার ঐতিহ্য ভুলেছে এমনটা মনে করার কোন কারণ নেই। হতে পারে কুমার শানুর পোশাক-আশাক চালচলন কথাবার্তা কোনটাই ঠিক আঁতেলদের মত নয়। তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে যে, নিজেকে একজন আগমার্কা বাঙালি প্রতিপন্ন করার প্রাথমিক শর্ত হলো নিজেকে একজন আতেঁল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা? পুরনোকে চিরকালীন করতে তার মাহাত্ম্যকে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে জীবিত রাখতে হলে, নতুনকে অবজ্ঞা করাটা কোন কাজের কথা নয়। ভুললে চলবে না নতুনরাই কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্মে পুরনো ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক। নতুনরাই পারে তাদের ঐতিহ্যবাহী পরম্পরাকে শ্রদ্ধাভরে এগিয়ে নিয়ে যেতে।
কুমার শানুর গান গুরুত্ব দিয়ে না শুনে শুধুমাত্র একটা বস্তাপচা ধ্যানধারণা মনের মধ্যে পুষে রেখে তার প্রতিভাকে দায়সারাভাবে মূল্যায়ণ করা প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সেই ঘটনা সকলের সাথে ভাগ করে নেবার লোভটা সম্বরণ করতে পারা গেল না। আজ থেকে বছর কুড়ি আগের কথা। আমাদের এখানে বাজারের মুখে একটা চায়ের দোকানে সন্ধ্যা হলেই আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে নিয়মিত আড্ডা দিতাম। সেই দোকানে একটা দু-দিকে দরজা লাগানো ঢাউস সাদাকালো টিভি ছিল। খদ্দেরের বিনোদনের কথা মাথায় রেখে টিভিটা দোকান খোলা থাকা অবধি চালু থাকত। অনেকেই এই টিভি দেখার নেশায় এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে টিভির সামনে বসে যেতেন। চা খাওয়া টিভি দেখা ‘রথ দেখা কলা বেচা’র মত এই লোভনীয় সুযোগ তারা কেউ হাতছাড়া করতে চাইতেন না। সেদিন টিভিতে একটা গানের প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। একজন প্রতিযোগী কুমার শানুর গাওয়া ‘তু মিলে দিল খিলে…’ গানটি গাইলে বিচারকগণ তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনিতে তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। আমার পাশে বসে থাকা একজন ভদ্রলোক হঠাৎ বলে বসলেন, “আহা কি অপূর্ব গায়কী! এস পি বালসুব্রহ্মণ্যমের এমন একখানা কঠিন গান ছেলেটি কিন্তু ভারি চমৎকার আয়ত্ত করেছে!”
এই ভদ্রলোক আমার পূর্বপরিচিত। এক পাড়াতেই বসবাস। বস্তুত আমার যাতায়াতের পথটাও ওনার বাড়ির সামনে দিয়েই। কথাবার্তা না থাকলেও উনি যে গানবাজনা’র সাথে যুক্ত সেটা জানতাম। ভদ্রলোক একজন প্রশিক্ষিত সংগীত শিল্পী। অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের দেখতাম ওনার কাছে গান শিখতে আসত। বাড়ির সামনে দিয়ে যাতায়াতের পথে মাঝে মাঝে গুরুগম্ভীর সংগীত চর্চার আলাপ শুনতে পাওয়া যেত।
ওনার কথাটা কানে যাওয়া মাত্র আমি প্রতিবাদ না করে পারলাম না। আমি বললাম, “মাফ করবেন। এটা মোটেও এস পি বালসুব্রহ্মণ্যমের গান নয়।”
তিনি আমার দিকে কিয়ৎক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,”তাই নাকি? তবে কার গান শুনি?”
আমি বেশ গর্বের সঙ্গে বললাম, “কুমার শানু।”
খুব সম্ভবত আমার কথা ভদ্রলোকের খুব একটা পছন্দ হলো না। তিনি তাচ্ছিল্যভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন,”কী বললে? কুমার শানু? ওটা আবার একটা গায়ক হলো? এই পর্যায়ের গান গাওয়া প্রশিক্ষিত গায়ক ছাড়া অসম্ভব। এস পি ছাড়া এই গান গাইবার ক্ষমতা কারোর নেই।”
আমি পুনরায় দৃঢ় কণ্ঠে বললাম,”আপনি ভুল করছেন, এটা কুমার শানুর গান।”
ভদ্রলোক হঠাৎ একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলেন। কাঁধের ঝোলা ব্যাগ থেকে একটা মাঝারি মাপের ডায়েরি বার আমার সামনে মেলে ধরলেন, বললেন, “গানটি লেখো।”
আমি খানিকটা অবাক হলেও গানের মুখরাটা ওনার ডায়েরিতে লিখে দিলাম।
উনি বললেন, “নীচে তোমার শিল্পীর নাম লেখো।”
আমি গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিলাম—কুমার শানু। আমার হাত থেকে ডায়েরিটা একপ্রকার ছিনিয়ে নিয়ে তিনি লিখলেন— এস পি বালসুব্রহ্মণ্যম।
তারপর কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে বললেন,”তুমি তো আমাদের পাড়াতেই থাকো। তোমাকে আমি চিনি। পরে নিশ্চয়ই এটা নিয়ে কথা হবে।” বলেই আর দাঁড়ালেন না। গট গট করে হেঁটে বেড়িয়ে গেলেন।
আমার পাশে বসে থাকা একজন গদগদ কণ্ঠে বলে উঠলেন, “শিক্ষিত মানুষ। এদের সাথে লাগতে গেলে সমস্যা আছে।”
তিনি হয়ত ভদ্রলোক সম্পর্কে আরো কিছু বলতেন। কেন না তার হাবভাব দেখে আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম ওনার সেই ‘শিক্ষিত মানুষ’ এরইমধ্যে ওনাকে রীতিমতো প্রভাবিত করে ফেলেছে। আমি অবশ্য সেই সুযোগ ওনাকে দিলাম না। বিষণ্ণ চিত্তে বাড়ি ফিরে এলাম। পরেরদিন সকাল হতেই ‘ক্রিমিনাল’ ছবির গানের ক্যাসেট নিয়ে সোজা গানের শিক্ষক ভদ্রলোকের দরজায় কড়া নাড়লাম।
অত সকালে আমাকে দেখে উনি কিন্তু বেশ অবাকই হলেন। বললেন, “তুমি?”
আমি কোনরকমের ভণিতা না করে মূল প্রসঙ্গে চলে গেলাম। আমার কথা শুনে উনি হেসে ফেললেন। বললেন,”কী ভুল ভাঙলো তাহলে?”
আমি দৃঢ়তার সঙ্গে বললাম, “ভুল হলে তো ভুল ভাঙার প্রশ্ন!”
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভুলটা অবশ্য ভাঙল, তবে সেটা আমার নয়, শিক্ষক ভদ্রলোকের। অকস্মাৎ ছোট্ট একটা আলপিনের খোঁচায় চুপসে যাওয়া বেলুনের মত মুখভঙ্গি করে তিনি দাঁড়িয়ে থাকলেন। আমি ওনাকে অপ্রস্তুত অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়ে যুদ্ধ জয়ের উল্লাস নিয়ে ওনার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম।
এই ঘটনার বছরখানেক বাদে আমি আমাদের দোকানে বসে আছি। স্টিরিওতে গান বাজছে—”প্রদীপটা কাঁপছে নিভে যাবে হয়ত/ এ তোমার ভালোবাসা নয় তো…”
হঠাৎ দেখি সেই ভদ্রলোক আমাদের দোকানেরই উল্টোদিকের দোকানে দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু দাঁড়িয়ে আছেন বলাটা বোধহয় ঠিক হলো না, গানের তালে তালে মাথা নাড়ছেন। মনে হয় গানটি তার বেশ মনে ধরেছে। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই হেসে ফেললেন। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,”এটা নিশ্চয়ই কুমার শানুর গান?”
আমি বললাম, “না। এটা কুমার শানু’র গান আপনাকে কে বলল? কুমার শানু একটা গায়ক হলো?”
ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন,”এখনও আমার পরে রেগে আছো দেখছি। তুমি যখন শুনছো তখন কুমার শানু না হয়ে পারেই না। অসাধারণ গেয়েছে কিন্তু গানটা। দরদী কণ্ঠ। মুড়কিগুলো নিয়ে রীতিমতো ছেলেখেলা করছে।”
সবথেকে মজার বিষয় হলো এখন প্রায়শই ওনার বাড়ি থেকে কুমার শানুর গান ভেসে আসে।
আমার আজও মনে আছে, এক বাংলা রেডিও চ্যানেলে স্বর্গীয় পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় অতিথি হয়ে এসেছিলেন। কথায় কথায় তিনি ঘুরেফিরে কুমার শানুর প্রসঙ্গে বলতে গেলেই চ্যানেলের মহিলা সঞ্চালিকা বিভিন্ন অছিলায় প্রসঙ্গ পাল্টে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাচ্ছিলেন। তার ভাবখানা এমন কুমার শানুর প্রসঙ্গে আলোচনায় গেলে তার অনুষ্ঠানের সুন্দর পরিবেশ বিঘ্নিত হবে। তিনি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। কুমার শানুর প্রতি তার অপত্য স্নেহের কথা আজ আর কারো কাছে অজানা নয়। তিনি সেদিন সঞ্চালিকার এই অদ্ভুত প্রবণতাকে ভর্ৎসনা করে তাকে রীতিমতো লজ্জায় ফেলে দিয়েছিলেন।
আমার ভালোলাগা ছোট্ট একটা ঘটনার কথা বলে শেষ করব। ট্রেনে করে বাড়ি ফিরছি। মোবাইলটাকে স্পিকার মোডে দিয়ে কুমার শানুর গাওয়া আমার প্রিয় গানের দ্বিতীয় খণ্ড থেকে গান শুনছি—”দুটি পাখি দুটি তীরে / মাঝে নদী বহে ধীরে…”
আমার পাশে বসে থাকা একজন অশিতীপর বৃদ্ধ ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপচাপ বসে একমনে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি যে বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে দেখতে একমনে আমার বাজানো গান শুনছিলেন বুঝতে পারিনি। গান থামতেই বললেন,”যাই বলো স্বর্ণযুগের গানগুলি কিন্তু শানু চমৎকার গেয়েছে। এই সমস্ত গান অনেকেই গেয়েছে বটে, কিন্তু তার কোনটাই শানুর গাওয়া গানগুলির মত এতটা প্রাণবন্ত নয়।”
এমন টুকটাক অনেক ঘটনাই আছে যা নিয়ে লিখতে বসলে ঢাউস একখানা উপন্যাস হয়ে যাবে।
ভাবতে অবাক লাগে যেখানে আমেরিকার মত উন্নত বিশ্বের দেশের কোন এক প্রদেশে কুমার শানু’র প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে আস্ত একটা দিন তাঁর নামে উৎসর্গ করে বসে আছে, সেখানে তাঁর নিজের দেশ বা তাঁর জন্মভূমি এই বাংলায় সেই উচ্ছ্বাস কোথায়?
তথাকথিত এলিট সম্প্রদায় আজও কুমার শানুর নাম শুনলে নাক সিঁটকানোর বদভ্যাস এখনও সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছে। আজও যখন শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের নিয়ে আলোচনা হয় ভারি অদ্ভুতভাবে কুমার শানু ব্রাত্য থেকে যান।

Developed by